মোহিনী পাঠ-৩

Story – মোহিনী
Writer – Nirjara Neera
পার্ট – ৩
.
নতুন একটা দিন। সাগর ভাইয়ের গায়ে হলুদ আজ। পুরো বাড়ি টাই নতুন রুপে সেজেছে। আগা গোড়া পুরাটাই ফুল দিয়ে মোড়া। জায়গায় জায়গায় অর্কিড লাগানো হয়েছে। আমি, মারোয়া, আর মুক্তা মিলে নাস্তা খেয়ে বাড়ি টাকে দেখতে লাগলাম। বাড়ির ছাদ আরও সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মারোয়া হঠাৎ সাগর ভাইয়া বলে ডাক দিল। আমরা ডাক শুনে সামনে তাকালাম। মারোয়া ততক্ষণ এ তার মামাতো ভাই কে জড়িয়ে ধরেছে। দুই তিন দিন হল আসছি। অথচ জামাই রাজাকে এখন দেখলাম। সাগর ভাই আসলেই খুব চমৎকার ছেলে। হাসি খুশি আর বন্ধু বৎসল। এই কয়দিন অফিসের কাজে বাইরে থাকায় আমাদের সাথে দেখা হয় নি।
ইতিমধ্যে মেহমান দের আনাগোনায় ঘর ভরে যেতে লাগল। এত মানুষ দেখে আমার মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা। অবশ্য ঘর বড় ছিল তাই সামাল দেয়া যাচ্ছিল। না হলে দম বন্ধ হয়ে মারা যেত সবাই। মারোয়ার আম্মু কে এ ভীড়ের মধ্যে খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অবশ্য উনিও খুব ব্যস্ত ছিলেন। এত ঘোরা ফেরার মধ্যে আমার ফারানের কথা একদম মনে ছিল না। ফারানের কথা মনে পড়তেই চারদিকে ভাল করে তাকালাম। না নেই। আসলে কালকের ঘটনার পর থেকে আমি তাকে আর দেখি নি। যাক শান্তি তে বিয়ে টা খেতে পারব।
দুপুরের খাবারের পর সবাই পার্লারে চলে গেল বর কে নিয়ে। মুক্তা ও গিয়েছিল। কারন এখানে তার সমবয়সী কাজিনরা রয়েছে। আমি যাই নি বলে মারোয়া ও যায় নি। অবশ্য আন্টি বলেছিল যেতে। আমি ইচ্ছা করে যাই নি। বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। মারোয়ার আম্মু আর কিছু মহিলারা আছেন। আমি আর মারোয়া ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তখন নিচে একটা কার এসে থামল। ওই খান থেকে ব্যাগ নিয়ে একটা লোক নামল। সাথে সাথে নামল ফারানের আব্বুও। কি হচ্ছে এখানে? মারোয়া কে বলতেই মারোয়া লাফিয়ে উঠল।
-“চলেন ম্যাম নিচে গিয়ে দেখে আসি কি হচ্ছে!”
-“না মারোয়া। তোমার আম্মু মানা করছে না ওদের আশে পাশে না থাকতে?”
-“একটু করে ম্যাম। চলেন না। গিয়েই দেখে আসব।”
-“নো”
-“প্লীজ ম্যাম”
এটা বলে মারোয়া আমার দিকে তাকাল বড় বড় চোখে। দুইটা মুক্তোর মত চোখে পানি টলমল করছে। আসলে আমিও ওকে কোন কিছুর জন্য মানা করি নি। তো এখন কি করে করি?
-“ওকে কিন্তু শুধু মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আর তোমার আম্মু যেন জানতে না পারে। ঠিক আছে?”
-“ওকে ম্যাম!”
আমরা নিচে নেমে একপাশে দাড়িয়ে রইলাম। এমন ভাবে দাড়িয়ে রইলাম যেন খুব মনোযোগ দিয়ে বেগুনি অর্কিড গুলো দেখছি।
লোকটা আর ফারানের আব্বু নিজেদের মধ্যে কথা নিচু স্বরে কথা বলছে। কিছু শুনতে পারছিনা। ওরা আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। তারপর ওদের পিছু পিছু হাটতে লাগলাম। তবে এমন ভাবে যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। কিন্তু সিড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই বিপত্তি বাধল। বিপত্তি টির নাম হল মামুন। আমাকে তো কোন দিন মামুন কিছু বলবেনা। তবে মারোয়া কে জিজ্ঞেস করল
-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“এইতো ভাইয়া ছাদে।”
মারোয়ার কথার সমর্থনে আমি জোর করে হাসি দিয়ে মাথা নাড়লাম। কারন আমি মামুন নামক বস্তুটার রাগের সাথে কিছুটা হইলেও পরিচিত। একগুয়ে স্বভাবের এক কথার মানুষ। তাই উল্টা পাল্টা কিছু করলে মারোয়ার আম্মুর চাইতে মারাত্মক হবে মামুন।
-“ছাদে কি কাজ আছে?”
-“না ভাইয়া এমনি যাচ্ছি!”
-“ছাদে যাওয়া লাগবেনা। আমার সাথে চল কাজ আছে।”
-“না ভাইয়া পরে যাই। এখনি চলে আসব।”
-“মনে হচ্ছে চুরি করতে যাচ্ছিস। এখন গেলে কি হবে?”
মারোয়া এবার করুন চোখে আমার দিকে তাকাল। আমার দিকে তাকালে কোন লাভ হবে নাকি। তোমার ভাই আমার কথা শুনবে নাকি। আমাদের এত সাধের গোয়েন্দাগিরি তে পানি ঢেলে দিল। মনে মনে বললাম।
কিন্তু মুখে বললাম (কি বলব খুজেই পাচ্ছিনা ভাষা)
-“মারোয়া কে আমি নিয়ে যাই। পাঁচ মিনিটে আপনার রুমে এনে দিব প্লীজ। একটু কাজ আছে তাই।”
মামুন ভ্রু কুচকে বলল
-“কাজটা আমাকে বলা যায় না?”
মারোয়া আর আমি একসাথে নাড়লাম। বলা যায় না।
-“ঠিক আছে। বাট অনলি ফর ফাইব মিনিটস। ওকে?”
-“ডান ভাইয়া।”
মামুন চলে যেতেই আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম। মারোয়া বলে উঠল
-“চলেন না ম্যাম!”
-“যাচ্ছি যাচ্ছি”
আমরা দুজন চলে গেলাম একদম ফারানের রুমের সামনে। কিন্তু ওইখানে দরজা বন্ধ। কি করি। এসময় মারোয়া বলল
-“ম্যাম জানালা!”
বাহ! আইডিয়া মন্দ না। গেলাম জানালার পাশে। জানালা বন্ধ তবে ভেতরে পর্দা একটু সরে যাওয়ায় কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ওইখানে দেখলাম মারোয়ার মেজ মামা চিন্তিত মুখে একপাশে দাড়িয়ে আছে। আর যে লোকটা ব্যাগ হাতে এসেছিল সে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করছে। তার মানে লোকটা ডাক্তার। তার মানে এও দাড়ায় যে ফারান অসুস্থ। অবশ্য ফারান অসুস্থ তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কারন সে শুয়ে আছে। কোনো নড়চড় নেই। মনে হল জ্ঞান নেই। এবার ডাক্তার তার চেক আপ শেষ করে ফারানের আব্বুর মুখোমুখি দাড়িয়ে কথা বলতে লাগল। কি বলছিল বোঝা যাচ্ছিল না। তবে মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল যে সিরিয়াস কোনো কিছু।
তখন কার যেন পায়ের আওয়াজ পেলাম। এখানে দাড়িয়ে থাকা আর মোটেও ঠিক হবে না। আমি মারোয়া কে নিয়ে সাবধানে চলে আসলাম যাতে কারো চোখে না পরি।
মারোয়া কে নিয়ে আসছিলাম তখন দেখি মামুন ছাদ থেকে নামছে। ও আমাদের দেখে এগিয়ে আসল। আমি আর মারোয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললাম।
-“অলরেডি ১০ মিনিট হয়ে গেছে মারোয়া।”
আমার দিকে তাকিয়ে মারোয়া কে বলছিল মামুন।
-“মারোয়া তুমি আমার রুমে যাও।”
মারোয়া চুপচাপ তার ভাইয়ের রুমে চলে গেল।
আমি দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম
-“স্যরি!”
মামুন কিছু বলল না। চলে গেল ওখান থেকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে আমি আর মারোয়া মেহেদি অনুষ্ঠান এর জন্য সাজতে যাব কিন্তু শপিং ব্যাগ গুলো মারোয়ার আম্মুর রুমে রয়ে গেছে। মারোয়া কে বসতে বলে আমি গেলাম ব্যাগ আনতে। কিন্তু নক করার আগে ভিতরে আন্টির কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। কার সাথে জানি কথা বলছিল। আমি আবার চলে যেতে চাইলাম। কারন এখন আন্টি কে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। কিন্তু যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে মোহিনী নাম শুনলাম। আমার খটকা লাগল। আমি দাড়িয়ে পড়লাম কান লাগিয়ে। কি কথা হচ্ছে শুনতে চাচ্ছিলাম। মারোয়ার আম্মু কোনো মহিলার সাথে কথা বলছিল। মহিলাটা অঝোরে কাঁদছিল। মহিলাটা আর কেউ না স্বয়ং ফারানের আম্মু। কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম।
-“চোখ মুছো ভাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-“কি করে ঠিক হবে বোন। আমার একটা মাত্র ছেলে। সমস্যা থাকলেও আগে কখনো এরকম করেনি। শান্ত শিষ্ট হয়ে থাকত। এখন ওই মেয়েকে দেখার পর থেকে সব উল্টা পাল্টা কাজ করছে। যে ছেলে কখনো উচু আওয়াজে কথা বলে নি সে তার বাবা মার সামনে ভাঙচুর করছে। কিভাবে সহ্য করি এসব? তার উপর বিয়ে বাড়ি।”
-“কোন মেয়েটার কথা বলতেছো! মোহিনী?”
-“হ্যা! বিয়ে বাড়ি। কখন কি করে বসে ঠিক নাই। শেষে সবার নাক কাটা যাবে। তাই আমার ছেলেকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। যেন পাগলা গারদে রেখেছি।”
বলেই হু হু করে আবার কেঁদে উঠল ফারানের আম্মু। মারোয়ার আম্মু স্বান্তনা দিতে দিতে বলল
-“কানাডা পাঠিয়ে দেন না কেন?”
-“আমিতো ভাবছি সেটা। কিন্তু ছেলে আমার নাকি মোহিনী কে ছাড়া কোথাও যাবে না। হুশ ফিরলেই শুধু মোহিনী মোহিনী করে। কোথা কার কোন মেয়ে? কি করব বুঝতে পারতেছিনা।
-“মোহিনী টা কে?”
-“সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। মোহিনী নামে এখানে কোন মেয়ে নাই।”
-“খোঁজ নেন ভালো করে। আমিও দেখি। মেয়ে ভালো হলে বিয়ে দিয়ে দেন।”
.
আমি আর শুনলাম না কথা। আমার চারপাশের সবকিছু ঘুরছে বলে মনে হচ্ছিল। কেননা মোহিনী ফারান আমাকে বলছিল। আর আমি কখনোই ফারানের মুখোমুখি হতে চাই না। জান গেলেও না!
.
আন্টি আর ফারানের আম্মুর মুখে এসব শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমার বড় লোক দেখার সব সাধ মিঠে গেল। আমি শুধু আমার আম্মুর কাছে যেতে চাচ্ছিলাম। আমার আম্মুর কোলে মাথা রেখে বলতে চাই সব ঠিক হয়ে গেছে। সব ঠিক হয়ে গেছে।
কোনো রকম রুমে এসে ঘমার্ক্ত শুয়ে পড়লাম। কথা শুনে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছে। আমাকে শুতে দেখে মারোয়া বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল কি হয়ছে। আমি কিছু বললাম না। ওদিকে সবাই পার্লার থেকে এসে গেছে নিশ্চয়। শোরগোল শোনা যাচ্ছে। আর নিচে যাওয়ার জন্য মারোয়া আমাকে টিকতে দিচ্ছে না। অগত্য আমাকে উঠতে হল। আমি নিজের জন্য আরেকজনের আনন্দ নষ্ট করতে পারিনা। মারোয়া কে বললাম
-“যাও আম্মুর রুম থেকে তোমার শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে আস।”
মারোয়া খুশিতে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। ঠিক একই ভাবে লাফাতে চলে এলো। এই মেয়েটা আমার মধ্যে কি দেখে তা আল্লাই ভালো জানে। আমি মারোয়া কে রেডি করে দিলাম। তারপর ওকে বললাম
-“এবার যাও। তুমি রেডি।”
-“আমি যাবো মানে? ম্যাম আপনি যাবেন না?”
-“মারোয়া আমার একটু খারাপ লাগছে। আমি পরে আসব। তুমি যাও।”
-“ঠিক আছে ম্যাম।”
মারোয়া গোমড়া মুখে চলে গেল। আমি শুয়ে পড়লাম দরজা বন্ধ করে। কোনো বিষন্নতা আমাকে ধরলে আমার ঘুম আসে। তাই আমি বিছানাই শরীর রাখতেই চোখে ঘুম নেমে এলো।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। দরজায় করাঘাত এর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওড়না নিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। মারোয়ার আম্মু আসছে।
-“তুমি রেডি হওনি কেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। জলদি চলো।”
-“আন্টি আমার ভালো লাগছে না। আমি না যাই?
এই কথায় আন্টি আমার কপাল ধরে দেখলেন।
-“কই তুমি তো ঠিক আছ। মারোয়া তোমার জন্য বসে আছে। জলদি চলো।”
আন্টি আমাকে থাকতে দিলেন না। নিজের হাতে তৈরি করে দিলেন। তৈরি করে আমাকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন। আমি নিচে নেমে দেখলাম পুরা ঘর ভর্তি মানুষ। দামী পারফিউম আর সেন্টের গন্ধে চারদিক ভুর ভুর করছে মেয়ে সব গুলো যেন একেকটা পরী। ওরা সব স্টাইলিশ হিজাব বেধে ছিল, কেউ খোলা চুলে স্টাইলিশ ছিল। ভাবছিলাম বড়লোকের মেয়েরা কিভাবে এত সুন্দর হয়। তারপর আমি নিজের দিকে তাকালাম। সিলভার কালার গাউন টা পড়েছি। গাউনটা খারাপ না। চুল খোলা তবে দুপাশের একটু একটু চুল নিয়ে পিছনে কাটা দিয়ে বাঁধা। কানে আর গলায় সাদা পাথরের সেট। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা মেরুন কালার লিপস্টিক। কাঁধের ওড়না টা পিন দিয়ে আটকানো। সব মারোয়ার আম্মুর কাজ।
একটা নিশ্বাস ফেলে মারোয়া কে খুজতে লাগলাম। ওইতো সে এক কোনায় বসে আছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল
-“ম্যাম এত দেরি করছেন কেন?”
-“স্যরি! এইত এখন চলে আসছি। চলো অনুষ্ঠান দেখি।”
মারোয়া আর আমি মিলে অনুষ্ঠান দেখতে বসলাম। এর মধ্যে দেখলাম কনের বাড়িতে মেহেদির তত্ত্ব পাটানো হচ্ছে। মুক্তা সহ আরো এক ঝাক ছেলে মেয়ে গেল।
আমরাও মেহেদি লাগাতে বসে গেলাম। হাসি তামাসায় ফারানের কথা মনেই থাকল না। অনেকক্ষণ পর মেহেদী শুকিয়ে গেলে হাত ধুতে উঠে রুমে চলে গেলাম। মারোয়াও আমার পিছন পিছন চলে আসল। এই মেয়ে কখনোই আমার পিছু ছাড়বেনা। মনে হচ্ছে আমার যদি বিয়ে হয় তাহলে মারোয়া বলবে ম্যাম আমিও আপনার বর কে বিয়ে করব। ভাবতেই আমার হাসি পেয়ে গেল। মারোয়া ভ্রু কুচকে বললো
-“ম্যাম আপনি হাসছেন কেন?
-“কিছু না এমনি।”
-“বলেন না ম্যাম।”
-“সত্যি কিছু না।
রুমের মধ্যে হাত ধুয়ে বের হতেই মারোয়ার বড় মামী সামনে পড়ল। তিনি আমাকে বললেন যে মারোয়ার আম্মু নাকি আমাকে খুজছে। মারোয়ার মামার সাথেই নাকি আছেন তিনি। আমি সায় জানিয়ে মারোয়া কে নিচে পাঠিয়ে গেলাম মারোয়ার মামার রুমে। সেখানে আন্টি রয়েছেন।
-“আন্টি ভিতরে আসব?”
-“আস আস। তোমার মা ফোন করেছে আর তোমার আব্বু নাকি কথা বলতে চাচ্ছেন। ধর কথা বল লাইনে আছে।”
আমি ফোন নিয়ে সালাম দিলাম।
-“হ্যালো আম্মু কি হয়ছে? তোমরা ভালো আছো তো? আব্বু কোথায়?”
-“সবাই ভালো আছে। তোর কথা মনে পড়ছিল তাই ফোন করছি। নে তোর আব্বুর সাথে কথা বল।”
-“আব্বু ভালো আছো?”
-“রেনুমা তুমি না থাকলে ভালো কি করে থাকি? তুমি জলদি চলে আস।”
-“আসব আব্বু। তুমি চিন্তা করিও না। অনুষ্টান চলছে। আমি যাই?”
-“যাও রেনুমা। তবে বাড়ির বাইরে টাইরে যাবে না।”
-“আব্বু তুমিও নিজের খেয়াল রাখিও।
-“রাখব রাখব।”
আব্বুর সাথে কথা বলতেই মন খারাপ হয়ে গেল। অনুষ্টানের জন্যে চলে আসার সময় মনে হল পাশের রুম থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওপরে চোখ তুলে তাকাতেই বুঝলাম এটা ফারানের রুম। আমি চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু আমার বিবেক বাঁধা দিল। নিশ্চই ফারান কোন কষ্টে আছে। ও এমনিতেই অসুস্থ। অসুস্থ শরীরে আমার কিছুই করতে পারবেনা। মানবতার খাতিরে হলেও আমার যাওয়া উচিত। এই ভেবে রুমের ভিতর ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার পা পিছু হটতে চাচ্ছে। তারপরও জোর করে ঢুকলাম। রুমটা আবছা অন্ধকার। এখনো অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ আসছে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম ফারান বিছানায় শুয়ে। তবে চেহারা খুবই মলিন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। মনে হল হুশ নেই। তবে মুখে কি যেন আওড়াচ্ছিল। আমি শুনতে চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট স্বরে যা বলল তাতে মনে হল পানি খুজছে। নিশ্চয় পিপাসা পেয়েছে। আমি টেবিল থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে মুখে ধরলাম। কিন্তু ফারান পানি পান করলনা। কারন ও শোয়া অবস্থায়। এখন কি করব? বালিশ টা আরেকটু উচু করে দিলে হয়তো খেতে পারবে। আমি গ্লাস টা রেখে আস্তে করে ওর বালিশটা একটু উচু করে মাথাটা ওপরে করে দিলাম যাতে পানি খেতে পারে। আমার অস্বস্থি লাগছিল। কিন্তু আমি পরোয়া করলাম না। এবার পানি নিয়ে মুখে ধরে অল্প অল্প করে ঢালছিলাম আর ও চুক চুক করে খাচ্ছিল। আমি আমার অজান্তে আমার বাম হাত ওর থুতনি উচু করে ধরেছিলাম যাতে ওর পানি খেতে সুবিধা হয়। কিন্তু কিছু সময় পর আমার হাতে চাপ অনুভব করলাম। দেখলাম ফারান আমার হাত আলতো করে স্পর্শ করছে। কিন্তু ওর চোখ এখনো বোজা। আমার কলিজা ধুক ধুক করতে লাগল। পানি পান করা শেষে আমি অপর হাতে পানির গ্লাস টা রাখলাম। তারপর পাশে রাখা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিলাম। এরপর আমার বাম হাত সরাতে যাব এমন সময় ও চোখ খুলল। ঠিক চোখ খুললো না। চোখ খোলার চেষ্টা করছিল। যেন আবছা ভাবে আমাকে দেখার চেষ্টা করছিল। আমি দ্রুত আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ফারান হুট করেই শক্ত করে চেপে ধরল আমার হাতটা। তারপর অতি কষ্টে চোখ খুলতে সক্ষম হল। এরপর অস্পষ্ট স্বরে বলল
-“মোহিনী!”
আমি কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে হাত ছাড়াতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। অসুস্থ মানুষের শরীরে এত শক্তি কোথ থেকে আসে বুঝলাম না। ও আবার বলল
-“আমার মোহিনী!”
ফিস ফিস করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম
-“আমার হাত ছাড়ো!”
-“মোহিনী আমি তোমাকে ভালবাসি। দেখ তোমার ভালবাসা আমার কি অবস্থা করেছে। আমাকে ছেড়ে যেওনা মোহিনী।”
-আমি মোহিনী না। আমি রেহনুমা। শুনেছেন আপনি! এবার ছাড়ুন।”
-“না। তুমি আমার মোহিনী। তোমাকে কোথাও যেতে দিব না।”
এই কথা বলে ফারান ওঠার চেষ্টা করছিল। তখন আমার হাতের উপর চাপ কমে আসল। আসি ওকে ধাক্কা দিলাম। সে আবার বিছানাই পড়ে গেল। আমি দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। নিচে নেমে প্রথমে ঢকঢক করে পানি পেটে চালান দিলাম। গায়ের কাপুনি টা থামছে না। ফারানের কথা মন পড়তেই শরীরে লোম খাড়া হয়ে গেল ভয়ে।
.
বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইলাম। আর একদিন, শুধু আর একদিন, এরপর এখান থেকে চলে যাব। তারপর এই ঝামেলা মিঠে যাবে। মারোয়ার হাসি মুখের দিকে তাকালাম। নিজের জন্য এদের খুশি নষ্ট করতে পারি না। প্রথমে নিজেকে শান্ত করলাম।
এরপর মারোয়ার সাথে আমি খুনসুটি তে যোগ দিলাম। মারোয়া আমার একজন ভালো বন্ধুর মত হয়ে গেছে। অসম বয়সিদের মধ্যে যে ভালো বন্ধুত্ব্ব হতে পারে তা আমাকে আর মারোয়া কে না দেখলে কেও বুঝবে না। সবাই নাচছিল। মারোয়াও নাচল খুব। আমি নাচলাম না। নাচ করা না, নাচ দেখা আমার পছন্দ ছিল। মারোয়া কে সাপোর্ট করছিলাম। নাচা শেষ হলে আমরা দুজনে ক্ষুধা লেগে গেল। কাউন্টারে খাবার রাখা ছিল। আমি আর মারোয়া বেছে বেছে প্রতিযোগিতা করে খেতে লাগলাম। কাউন্টারে পিঠ রেখে দাড়িয়ে মারোয়া আর আমি তার মুখোমুখি দাড়িয়ে। তাই আমার পিছনে যে কেউ আসলে মারোয়া আগে দেখতে পাবে। আমাদের খানা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবুও ওইখানে দাড়িয়ে সালাদের জন্য কাটা ফল, গাজর চিবুচ্ছিলাম। খেতে খেতে মনে হল মারোয়ার কথা থেমে গেছে। কারন জানার জন্য ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু ও বড় বড় চোখ করে আমার পিছনে তাকিয়ে আছে। আমার পিছনে কি আছে যে ও এইভাবে আমার পিছনে তাকিয়ে অাছে? আমি পিছন ফিরে তাকাতে যাব তখন কেউ একজন আমার কানের খুব কাছে এসে ফিস ফিস বলল
-“তোমাকে খুব খুব সুন্দর লাগছে। একদম পরীর মত।”
আমি শিউরে উঠলাম। ধীরে ধীরে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম ফারান দাড়িয়ে। ঘোলাটে চোখ, উসকো খুসকো চুল,গায়ে কালো একটা সাধারন শার্ট, টল মলে পা যেন এখনি পড়ে যাবে। আমার মনে হল যেন নেশা গ্রস্থ ব্যাক্তি।
ওকে হঠাৎ এভাবে সামনে দেখে আমি বোবা হয়ে গেলাম। কথা বের হচ্ছে না গলা দিযে।
-“আ-আ-আপনি এখানে?”
একটা ঢোক গিলে মারোয়ার দিকে তাকালাম। সেও কিছু বুঝতে পারছে না। এরপর চারদিকে তাকালাম। চারপাশে সব মেহমান। আজ আমার মান সম্মান সব যাবে। ইয়া আল্লাহ তুমি রক্ষা কর।
-“কে-কেন আসছেন এখানে? কি চাই?”
-“তুমি জান না কি চাই!”
এই বলে ফারান আমার হাতে থাকা আধ খাওয়া ফলের ঠুকরোটা নিল। নিয়ে ওইটা খেয়ে ফেলল। আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। কি করে লোকটা কারো এটো খেতে পারে! ইয়াক!
এ অসুস্থ ব্যক্তির পাল্লায় আমি পড়তে চাই না। এখনি সরে পরা উচিত। আমি পিছু হটতে শুরু করলাম। কিন্তু ও আরো কাছে আসছিল। এবার ওইখান থেকে দৌড়ে পালাতে চাইলাম। কিন্তু ফারান তার আগে হাত দিয়ে ফেলল। ওই পাশ দিয়ে যেতে চাইলাম ওইখানেও ফারান ঝট করে হাত রেখে দিল। আমি শিউরে উঠলাম। এক প্রকার বন্দি হয়ে গেলাম। পিছনে কাউন্টার সামনে ফারান। নিঃশ্বাস না নিতে পেরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সাহায্যর জন্য এবার মারোয়ার দিকে তাকালাম। ও এতক্ষন হা করে তাকিয়ে দেখছিল কি হচ্ছে। আমি যখন করুন চোখে তাকালাম তখন ও বুঝতে পারল আমার সাহায্যের দরকার। তখন সে বলে উঠল
-“ফারান ভাইয়া আমার ম্যাম কে ছেড়ে দাও।”
ফারান এতক্ষন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কথা শুনে ফারান ফোঁস করে মারোয়ার দিকে তাকাল। চোখ লাল করে। আর তক্ষুনি মারোয়া ফারানের ঘোলাটে চোখ দেখে ভয়ে এক দৌড়ে ওখান থেকে পালাল। এবার আবার ফারান আমার দিকে তাকাল। আমি ভয়ে কুল কুল ঘামছিলাম। সে আমার চোখে চোখ রেখে বলল
-“আমার মোহিনী!”
-“আ-আ-মা-মাকে যেতে দিন।”
-“কোথায় যাবে তুমি? তোমার জায়গা তো এখানে আমার বুকে।”
(ও হাত দিয়ে তার বুক দেখিয়ে বলল)
এই বলে আমার ডান হাত জোড় করে টেনে নিয়ে ওর বুকের বাম পাশে চেপে ধরল। আমি ভয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। ও সাথে সাথে আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল
-“তুমি ভয় পেয়োনা। আমি তোমার কোন ক্ষতি করবোনা।”
এই বলে সে আমার হাত দুটো নিয়ে দেখতে লাগল। আর বলতে লাগল
-“খুব সুন্দর লাগছে তোমার হাত দুটো। এই হাত দুটো আমার। কেউ কোনো দিন আমাদের আলাদা করতে পারবেনা।”
এই কথা বলে আমার হাত দুটো মুখের মধ্যে চেপে ধরে গন্ধ শুকতে লাগল। শরীর ঝিন ঝিন করা অনুভূতি। আমি হাত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কান্না ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। ইতিমধ্যে আশে পাশের মানুষরা খেয়াল করতে শুরু করল। কেউ কেউ ডাকও দিল। কিন্তু ফারানের ওদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আমার হাতের মেহেদীর গন্ধ নিতে ব্যস্ত। এক সময় সে এলোপাতারি আমার হাতে চুমু খেতে লাগল। আমি হাত নিতে চেষ্টা করায় সে আরো জোড়ে চেপে ধরল। আমি চিৎকার দেওয়ার সাথে আশে পাশের মানুষ ওকে চেপে ধরল। এরই মধ্যে মারোয়া তার আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসল। মারোয়ার আম্মু প্রথমে কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু অনেক কষ্টে ছাড়া পেয়ে আমি এক দৌড়ে গিয়ে মারোয়ার আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। ঠক ঠক করে কাপঁছিলাম আমি। আর ওদিকে ফারান কে সবাই চেপে ধরে ছিল। সে তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করছিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। মারোয়ার আম্মু আমাকে ধরে আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন কি হল। তিনি সরাসরি গিয়ে ফারান কে গিয়ে কষে এক থাপ্পড় লাগাল আর বলল
-“কি করলি তুই এটা? এই মেয়ে আমার কাছে আরেকজনের আমানত। এখন ওর মা বাবার কাছে আমি মুখ দেখাব কি করে?”
মারোয়ার আম্মুর কথায় ফারান বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না। সে কাতর স্বরে
-“ফুপি তোমার যতক্ষন খুশি আমাকে মার। কিন্তু প্লিজ আমার মোহিনী কে আমাকে দিয়ে দাও। তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাইবো না। প্লীজ ফুপি।”
.
মামুন, ফারানের বাবা মা মারোয়ার দুই মামা-মামী সাগর ভাই সবাই চলে আসল। আমি জানতে পারলাম না এরপর কি হল। কারণ মারোয়ার আম্মু আমাকে ততক্ষণে উনার রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন। আমি একা হয়ে গেলাম। বাইরে এখনো শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আমি কাঁদতে লাগলাম। কতক্ষণ ধরে কাঁদতেছি তা আমার জানা নেই। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল মারোয়ার আম্মুর আওয়াজে। আমি ঘুম থেকে উঠে বসলাম। বাইরে শোরগোলের আওয়াজ আর আসছেনা। কেমন নিরব হয়ে আছে সবকিছু। মারোয়ার আম্মু ব্যাগ গোছাচ্ছেন আর আমাকে বলছেন হাত মুখ ধুয়ে নিতে। আর সামনে মামুন দাড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে বুঝলাম না। আন্টি আরেকবার তাড়া দিলেন। আমি প্রশ্ন না করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। হাত মুখ ধুয়ে বেড়ুলে আন্টি আমার সামনে দাড়াল।
-“তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মামুন তোমাকে দিয়ে আসবে। আর কালকে বিয়ে শেষ হলেই আমরা চলে আসব। তোমাকে এখানে রাখার ভরসা পাচ্ছি না। ভালো থেকো।”
.
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল। আমি আন্টি কে জড়িয়ে ধরে থাকলাম কিছুক্ষন। এরপর মামুন গলা খাকড়ি দিয়ে বলল
-“দেরি হয়ে যাচ্ছে। জলদি আস তুমি।”
এই বলে মামুন ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি আর আন্টি বের হলাম। নিচে নেমে দেখলাম পুরো বাড়িতে কারো সাড়া শব্দ নাই। সবাই মনে হয় ঘুম। শুধু মাত্র জেগে আছে মারোয়ার আম্মু আর মারোয়ার বড় মামা মহিবুল সাহেব। তিনি এ অবস্থার জন্য আমার কাছে মাফ চাইলেন। আমি সায় দিলাম। এখানে কারো হাত নেই। বাইরে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। মামুন ড্রাইভারের পাশে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করলো। বাড়িটা একটু একটু অদৃশ্য হচ্ছে। আমার চোখের পানি বাধ মানছিল না। যতক্ষণ মারোয়ার আম্মু কে দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। এরপরে জানালার কাচ তুলে দিলাম। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ছিড়ে। এভাবে মারোয়ার আম্মু ফারানের নজর থেকে আমাকে আড়াল করতে মাঝ রাতে নিঃশব্দে কেউ না জানে মত গাড়িতে তুলে বাড়ির জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
মামুনের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-“কয়টা বাজে?”
-“তিনটা!
-“বাড়ি পৌছতে পৌছতে তো তাহলে একদম সকাল হয়ে যাবে।”
-“হুম।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাবতে লাগলাম।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here