Story : মোহিনী
Writer : Nirjara Neera
Part : ৫
.
রাতে রিফাতের জ্বর সেরে গেলো। আঘাত বেশি হওয়ায় ওর জ্বর এসে গিয়েছিল। আম্মু ওকে নিজের হাতে ভাত খাওয়াই দিলো। আসছি পর্যন্ত আম্মু একটুও কথা বলেনি। আমি বুঝতে পেরেছি। আগে থেকে কিছু না বলায় আমার ওপর প্রচুন্ড রাগ করে আছেন। তার ওপর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশি দের এই জ্বালা যন্ত্রনা। রিফাত ছাড়া ঘরে কেউ ভাত খেল না। আব্বু এখনো আসেনি। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। রাত আনুমানিক কত হবে আমার জানা নেই। কান্নাকাটি আর কিছু রাগারাগি বকা ঝকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আব্বু আম্মু কে বকা ঝকা করছেন না তো? লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু কান্নার শব্দ টা আম্মুর না। তাহলে কে আসল ঘরে?
রুম বেড়িয়ে গেলাম দেখতে কি হচ্ছে।
দেখলাম ফারানের বাবা মা দুজনে আসছে। তার মা খুব কান্না কাটি করছে। আর ফারানের আব্বু উনাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মহিলা খুব নাছোড়বান্দা। তিনি আমার আব্বু কে কিছু একটার জন্য অনেক অনুরোধ করছিলেন। আর আব্বু মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সম্ভব না বলে উনাদের কে চলে যেতে বলছিলেন। আমার আম্মু এককোনে বসে ফুপিয়ে কান্না করছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছিল। তাই আমি রুমে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ফারানের আম্মু দৌড়ে আমার কাছে এসে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলেন
-“ওমা! আমার একটা মাত্র ছেলে ফারান। আমার বুকের ধন। ওর কিছু হলে আমি মরে যাব। আমার ছেলে কে বাঁচাও তুমি মা।”
-“আমি বুঝি নি। কি হয়েছে?”
-“ও গাড়ি এক্সিডেন্ট করছে। মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে। আগে থেকেই ওর মাথা আঘাত প্রাপ্ত। তার উপর নতুন আঘাত। আই সিউ তে রাখা আছে এখন। কিন্তু হুশ আসছে না। ডাক্তার বলেছে তাদের সাধ্যমত সব করছে। কিন্তু ও ওর নিজে থেকে চেষ্টা করছেনা।”
-“তো আমাদের কাছে কেন আসছেন? আমরা কি করতে পারি? আমরা তো ডাক্তার না।”
-“তুমিই সব কিছু করতে পারো। ডাক্তার বলেছে আমার ছেলে নিজে থেকে বেঁচে ফেরার চেষ্টা করছেনা। কোনো রেসপন্স করছে না। ও হার মেনে নিচ্ছে। এখন একমাত্র তোমার কথায় আমার ছেলে বাঁচার চেষ্টা করবে।”
-“কিন্তু এখানে আমি কি করব? আমার কথা কেন শুনবে?”
-“এরকম বলিও না। আমি বাঁচবনা। আমার একটা মাত্র ছেলে। তুমি আমার ছেলেকে বাচাও। আমি সব দেব তোমাকে। গাড়ি, বাড়ি, মান, সম্মান আরো যা চাইবে।”
এবার আব্বু কথা বলে উঠল।
-“আপনি চলে যান। আমাদের কিছু করার নেই। হায়াত মউত আল্লার হাতে। তিনি চাইলে আপনার ছেলে বাচবে। আমার মেয়ের দরকার নেই।”
আমার খুব খারাপ লাগছিল ফারানের মায়ের জন্য। বেচারি ছেলের জন্য কি না করতে চাইছেন। কোটি টাকার মালিক হয়েও আমাদের মত গরিব ঘরে ধর্না দিচ্ছিলেন।
এবার ফারানের মা আমার আব্বু কে টলাতে না পেরে আমার আব্বুর পা ধরে ফেললেন। আমার নিশ্বাস এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। আসলে মা জাতি রাই এরকম। নিজের সন্তানের জন্য সৃষ্টিকর্তার সাথে লড়ায়ে যেতে দ্বিধা বোধ করেন না। আমার নিজের চোখে পানি এসে গেল।
আব্বু হার মেনে নিলেন। এক মুহুর্তের জন্য আম্মুর দিকে তাকালেন। তারপর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন
-“আমার মেয়েকে দিতে পারি এক শর্তে।”
-“আমি আপনাদের সব শর্ত মেনে নিতে রাজি। কি চান বলুন।”
-“আমাদের কিছু দরকার নাই। ব্যস আমার মেয়ের সাথে আমি যেতে চাই। শুধু মাত্র আধা ঘন্টার জন্য। আপনার ছেলেকে বিশ্বাস করি না। কখন কি থেকে কি করে ফেলে।”
-“ঠিক আছে। আমরা রাজি। এবার জলদি চলুন।”
আমি আর আব্বু ওদেরই গাড়িতে করে যেতে লাগলাম। বেশি সময় লাগল না। রাত বারোটা অলরেডি বেজে গেছে। রাস্তা ঘাট সুনসান নিরবতা পালন করছে। পৌনে একটা বেজে গেলো হাসপাতালে পৌছাতে পৌছাতে। প্রাইভেট হাসপাতাল। হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে কোন সমস্যা হল না। আমি আর আব্বু নিরবে ওদের পিছনে পিছনে চলছিলাম। এরকম কিছুক্ষন হেটে লিফট বেয়ে আই সিউতে প্রবেশ করলাম। ওখানে ফারানের বাবা মা একটা রুমের নিকট নিয়ে গেলেন। রুম টা দেখে বেশ অবাক হলাম। হাসপাতাল বলতে আমি যা বুঝি তা হল একটা অনেক বড় হল। সেখানে অগুনিত বেড। বেডে রোগে কাতরানো মানুষ অার তার কাছের মানুষ রা। তার উপর জায়গা না পাওয়া মানুষ রা এখানে সেখানে নিচের বেডে শুয়ে। কিন্তু এই রুমটা ঠিক তার উল্টা। মাঝারি সাইজের রুম। অনেকটা ফাইবস্টার হোটেল রুমের মত। তাতে নানা ধরনের যন্ত্র পাতি। দুইজন নার্স দাড়িয়ে দেখা শোনা করছে। ডাক্তার ও দাড়িয়ে চেক আপ করছে। আমি সবকিছু অবাক চোখে দেখছিলাম। কারণ হাসপাতালের এরকম রোগী দেখার দৃ্শ্য শুধু মাত্র আমি টিভিতেই দেখে এসেছি। চারদিক অবলোকন শেষে আমার নজর পড়ল ফারানের ওপর।
সে বেডে শুয়ে আছে নিশ্চুপ ভাবে। চেহারা টা পুরো মলিন আর আঘাতের চিহ্নে ভরা। মাথায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো। নিশ্চই বড় জখম। কারন ব্যান্ডেজ রক্তে লাল হয়ে আছে। চারদিকে এত যন্ত্রপাতি বসানো। স্যালাইন ছাড়া আমি আর অন্য কিছু চিনি না। জীবনে দেখিও নাই। সেকি! নাকের ভিতর দিয়েও একটা স্যালাইন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয় ফারানের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ওদিকে ফারানের আম্মু নিঃশব্দে কান্না করছেন আর ফারানের আব্বু বার বার চোখ মুছছেন। আমার এই মুহুর্তে কি করা উচিত ভেবে বের করতে পারলাম না। চুপচাপ পিছনে দাড়িয়ে রইলাম। ফারানের মা ফারানের কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন।
-“বাবা দেখো তোমার মোহিনী আসছে তোমাকে দেখতে। এবার তো চোখ খুলো। তোমার মায়ের আর সহ্য হচ্ছেনা। ও বাবা উঠোনা। দেখোনা তোমার মোহিনী আসছে।”
.
পাশে থাকা নার্স কে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম
-“ফারান কি সব কথা শুনছে?”
নার্স আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল
-“সব না। কিছু কিছু শুনছে।”
.
ফারানের মায়ের এতসব কথায় ফারানের কোন রেসপন্স পাওয়া গেলনা। তিনি সরে গেলেন বাইরে। রুমে ভীড় করা নিষিদ্ধ। আব্বুও বাইরে দাড়িয়ে। আমি নিজের জামা টা শক্ত করে ধরে ফারানের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি জানি না কেন গেলাম। কিন্তু আমার মনে হল যাওয়া উচিত। আব্বুও বাধা দিল না। ফারানের পাশে আমি বসলাম। তারপর ধীরে ধীরে ওকে ডাকলাম
-“ফারান! ফারান আমি মো-মোহি-হিনী বলছি।”
নো রেসপন্স!
আমি আবার বললাম
-“আমি মাফ চাচ্ছি। প্লিজ আপনি উঠেন। আপনার বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে।”
নো রেসপন্স!
এবার আমি ফারানের এক হাত মুটোয় ধরলাম। ধরে বলতে বলতে লাগলাম
-“আপনার কি একটুও মায়া হচ্ছেনা! আপনার মা বাবা না খেয়ে আপনার জন্য দিন রাত এক করছেন আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন?”
নো রেসপন্স!
এবার আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। আমি বলতে লাগলাম
-“আপনি আসলে অনেক খারাপ মানুষ। আপনার মা বাবা দুনিয়ার মানুষের কাছে আপনার জন্য লড়তে পারে আর ওদের জন্য আপনি নিজের সাথে লড়তে পারেনা! কাপুরুষ কোথাকার! আমার এখানে আসা ভুল হয়ছে।”
.
ফারান কে কাপুরুষ ডাকায় ওর বাবা মা আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিলেন। আমি ভয় পেয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পারলাম না। ফারান আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। ডাক্তার লাফিয়ে উঠল। তার সমস্ত চিকিৎসা যন্ত্র চেক করতে লাগল।
ফারানের বাবা আমাকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। অথচ এক মিনিট আগেও উনি আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিলেন। ফারানের মা ও কান্না করতে করতে সায় দিলেন। আমার আব্বু এক কোনে দাড়িয়ে নিরবে সবকিছু দেখছিলেন। আমি আবার ফারানের দিকে ফিরলাম। দুহাত দিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম। তারপর ওর সাথে নানান ধরনের কথা বলতে লাগলাম। প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেলো। কিন্তু হাত ধরা ছাড়া আর কোনো রেসপন্স পাওয়া গেলোনা। ডাক্তারের মতে ও এখন বিপদ মুক্ত। আমারও খুব ঘুম আসছিল। এবার আব্বু বলে উঠল
-“অনেক ক্ষন হয়ছে। এবার বাড়ি চল। ওদের ছেলে ভালো হয়ে যাবে। ”
সাথে সাথে ফারানের বাবা বলে উঠল
-“আরেকটু থাকেন।”
-“না। আর থাকা যাবে না। আড়াই ঘন্টা হয়ছে আসছি। চল রেনুমা।”
আমি আব্বুর কথায় উঠতে চাইলাম। কিন্তু ফারানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারলাম না। আব্বু নিজে এসে ফারানের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। আর আমি যেতে যেতে ওর দিকে তাকালাম আর মনে মনে দোয়া করলাম আল্লাহ তুমি ওরে ভালো করে দাও।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারানের রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। লিফটের ব্যবহার জানি না। তাই আমি আর আব্বু সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলাম। তখনি আব্বু বলল
-“একটু দাড়া রেনুমা। আমি একটু হাত মুখ ধুয়ে নিই।”
বোঝা যাচ্ছে আব্বুর ওপর সারাদিন খুব ধকল গিয়েছিল। এখন তাই খুবই ক্লান্ত।
আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। উপর থেকে খুব হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছিল ভ্রুক্ষেপ করলাম না। কারন হাসপাতালে এরকম হৈ চৈ হয়েই থাকে। তাতে কোন ক্ষতির কারন নেই। আমি আব্বুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এদিকে আওয়াজ খুব বাড়ছিল। তারপর দেখলাম নিচ থেকে কিছু ওয়ার্ড বয় দৌড়ে ওপরে যাচ্ছে। আমার মনে হল কোনো সিরিয়াস কন্ডিশনের এর রোগি এসেছে।
এরপরই আমার বুক ধক করে উঠল। এটা ফারান নয়তো?
আমি মনের কথাটা শেষ করতে পারলাম না। সেই মুহুর্তে ফারান এসে হাজির। যেই ভাবে বেডে শোয়াতে দেখে এসেছিলাম সেভাবেই। পরিবর্তন শুধু চোখে। সিড়ির উপরে দাড়িয়ে আছে আমাকে দেখে। আমি নিচে সোফায় বসে আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাশের বাথরুমে উনি ঢুকেছিলেন। ফারান কে দেখে দাড়িয়ে গেলাম। ফারানের গায়ে একটা শার্ট জড়ানো তবে বোতাম খোলা মনে হল তাড়াহুড়া করে পড়েছে। পুরা শরীর রক্তে জব জব করছে। আমার মনে হল ফারান কিছুটা দুলছে। যতটা না লাল তার শরীর, তার চেয়ে চোখ দুটো বেশি লাল হয়ে আছে। সিড়ির দিকে নামতেই একটা ওয়ার্ড বয় ফারানকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। ফারান কিছু বলল না। শুধু এক বার বয় টার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ওই দৃষ্টি দেখে বয় কিছুটা ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হল। তারপরও সে ফারান কে চেপে ধরে রাখল আর আমি অস্পষ্ট স্বরে আব্বুকে ডাকতে লাগলাম। ফারান ওয়ার্ড বয় টাকে হেচকা টান দিয়ে সামনে এনে নিচে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে পারল না বয়টি। হুরহুরে সিড়ি দিয়ে পড়তে লাগল। শেষে ওয়ার্ড বয় টি গড়িয়ে আমার কাছে পায়ের কাছে এসে থামল। কাতরাচ্ছে ছেলেটি। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে কয়েক জায়গায়। আমি মুখে হাত দিয়ে ফেললাম। মনে মনে ঢোক গিললাম। তারপর ফারানের দিকে তাকালাম। এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। বরঞ্চ তার চোখের দৃষ্টি দেখে এটা মনে হল যে ওর রাস্তায় যে আসবে তাকে সে এভাবে শেষ করে দিবে। ফারান ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো।
তারপর আমার কয়েক হাত দুরত্বে এসে দাড়াল। এদিকে আব্বুও বের হচ্ছেনা। আমার খুব ভয় লাগছিল। কিন্তু ফারান খুব শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“মোহিনী চল আমার সাথে।”
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে ক্ষীণ স্বরে আব্বু কে ডাকতে লাগলাম।
-“আ-আব্বু!”
ফারান এবার গর্জে উঠে বলল
-“মোহিনী শেষ বারের মত বলছি চল আমার সাথে।”
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও আরো এক পা এগিয়ে এলো আর আমি আরো পিছে হটে দেয়ালের সাথে লেগে গেলাম। সাথে সাথে আব্বু বের হয়ে এলো। আব্বু কে বের হতে দেখে আমার জানে পানি এল। সাথে সাথে আমি আব্বুকে ঝাপটে ধরলাম। আব্বুও বেশ অবাক হয়ে বলল
-“তুমি এখানে কি করছো? যাও এখান থেকে।”
ফারান আমার আব্বুর দিকে তাকালোই না। বরং কথা না শোনার ভান করে আমাকে বলল
-“তুমি তাহলে আসবেনা? তাই না? ঠিক আছে।”
এই বলে ফারান আমাকে ধরতে যাবে তখন আব্বু বাধা দিল। বাধা পেয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। আব্বু কে দু হাতে ধরে প্রচুন্ড জোরে দেয়ালের দিকে ধাক্কা মারল। আব্বুর মাথাটা সশব্দে বাড়ি খেল দেয়ালে। বাড়ি খেয়ে নিচের সিড়ির দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি শূণ্য দৃষ্টিতে আব্বুর গড়িয়ে যাওয়া দেখতে লাগলাম। আর সাথে সাথে আব্বু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রক্তে পুরো ফ্লোর ভরে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে নিচে নেমে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আব্বু সাড়া দিচ্ছিল না। আর ফারান সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি কিছুতেই যাচ্ছিলাম না। বেশ কয়েক জন মানুষ জমায়েত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভয়ে কেউ আমাদের সাহায্য করলনা। ফারান দুহাত দিয়ে আমাকে দাড় করাল। কিন্তু আমি আমার আব্বুর কাছে যেতে চাচ্ছিলাম। তাই ওকে কিল, ঘুষি যতটা সম্ভব মারছিলাম। তাতে কোনো লাভ হলনা। ফারান আমাকে এক ঝটকায় কাধে তুলে নির্বিঘ্নে হাটতে লাগল যেন আমি কোন কাগজের পুতুল। আমি ওর পিঠে অবিরত কিল ঘুষি মারতে লাগলাম। আর আশে পাশের মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলাম। কিন্তু কেউ কোন সাহায্য করলনা। আমি চিৎকার করে কান্না করছিলাম আর হাত পা ছড়াচ্ছিলাম। কিন্তু ফারান ছিল নির্বিকার। সে এক মনে কাধে করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে লাগল। আমি ওকে অনুরোধ করতে লাগলাম। ফারান তাও শুনল না। আমার আব্বু কোন অবস্থায় আছ, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানি না। শেষে হাল ছেড়ে দিলাম। কোথায় নিয়ে যাবে যাক। শুধু কান্না করতে লাগলাম।
ফারান হাসপাতালের নিচে এসে দাড়াল। ওখানে ওদের গাড়ি রয়েছে।
একটা কালো রংয়ের গাড়ির সামনে এসে দাড়াল। তার পর ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ছুড়ে মারল। আর আমি মাথায় বাড়ি খেলাম। ফারান ওই পাশ দিয়ে গাড়িতে ঢুকল। আমি গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। কারন লক করে দিয়েছে ফারান। আমার আর কিছু করার নেই। গাড়ির এক কোনে বসে শুধু ফুপিয়ে কান্না করছিলাম। ফারান এক মনে নির্বিকারে গাড়ি চালাচ্ছিল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। এ রাস্তাও আগে কখনো দেখি নি। কিছুক্ষন পর গাড়ি থামল। তাকিয়ে দেখলাম সামনে পুলিশ পোষ্ট। চেকিং এর জন্য থামাচ্ছে। ফারান এক মুহুর্তের জন্য তাকাল আমার দিকে। তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল যে আমি যেন পুলিশের সামনে উল্টা পাল্টা কিছু না করি। করলে তা একদম ভাল হবে না। কিন্তু আমি কখনো এই সুযোগ ছাড়বোনা। আর ফারান মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরল। পুলিশ টা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ফারান গাড়ি স্টার্ট করে দিলো। আমি গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশ লোকটির দিকে তাকিয়ে বাচানোর জন্য চিৎকার করলাম। পুলিশটি প্রথমেে চমকে উঠলেও পরে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। ফের আমি কিছু আর দেখতে পেলাম না। সবকিছু পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমাকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে ফারান গাড়ি স্লো ডাউন করল। তারপর আমার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিতে চাইলে আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। সে দাঁত কিড়মিড় করে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন পাওয়া গেল। বোঝা যাচ্ছে ওরা আমাদের ফলো করছিল। অগত্য ফারান গাড়ি জোড়ে চালানো শুরু করল। এবার সে অনেক দ্রুত চালানো শুরু করল যে আমার মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেল। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এমনিই আমার গাড়িতে চড়লে বমি সমস্যা অাছে। আমার খুব তখন বমি আসছিল। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম
-“গাড়ি থামাও জলদি।”
ফারান আমার দিকে তাকালো না। আমি আবার চিৎকার করে বললাম
-“প্লিজ গাড়ি থামাও। আমার খুব বমি আসছে। জলদি গাড়ি থামাও।”
এবার অবিশ্বাস্য চোখে ফারান তাকালো আমার দিকে। আমার চেহারা দেখে সে বুঝতে পারল। আমি সত্যি না মিথ্যা বলতেছি। পিছনে পুলিশের গাড়ি দেখে বলল
-“আরেকটু অপেক্ষা কর।”
-“আমি অপেক্ষা করতে পারব না। না হলে গাড়িতে করে দেব।”
-“আচ্ছা আচ্ছা গাড়িতে করিও না।”
ফারান কি করল বুঝতে পারলাম না। কিন্তু পেছন থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন পাওয়া যাচ্ছিল না। গাছপালা পূর্ণ জায়গায় গাড়ি থামাল। আমি দু হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে ছিলাম। গাড়ি থামতেই দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওইটা এখনো লক করা। লক খোলার জন্য ফারানের দিকে তাকালাম। ফারান বলল
-“কোন রকম পালানোর চেষ্টা করবেনা।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। দরজা খোলা হলে এক দৌড়ে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটু দূরে বমি করতে লাগলাম। ফারান আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসল। সে আমাকে ধরে রাখল। যখন বমি করা শেষ হল তখন আমার শরীরে আর ছিটে ফোটা শক্তি রইল না দাড়াবার। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। কারন আমি উপোস ছিলাম। ফারান আমাকে ধরে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে দিতে লাগল। তারপর একটু পানি খাওয়ালো। কিন্তু আমার শরীর মানছিল না। অবশ হয়ে আসছিল। ফারান রুমাল দিয়ে মুখ মুছে কোন রকম গাড়ির সিটে বসাল। আমি সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। দু চোখে ঘুম নেমে আসল। এর পর আর কি হয়েছিল তা আমার মনে নেই।
.
গাড়ির ঝাকুনি খেয়ে চোখ খুললাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। তবে বাইরে সূর্য টা একটু একটু উকি মারছিল। দেখলাম আমি এখনো চলন্ত গাড়িতে। সিট থেকে মাথা তুললাম না। মাথা রেখেই দেখলাম ফারান এখনো গাড়ি চালাচ্ছে। তবে অনেক বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। আমি তাকানোই ফারান আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার হাসি আসছিল না। মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হল মফস্বল কোথাও চলে আসছি। গাছগাছালি তে ভরা আবার পাকা সুদৃশ্য দালান দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর গাড়িটি একটা গেইটের সামনে থামল। হর্ন বাজাতেই ভেতর থেকে দারোয়ান বেড়িয়ে এলো। ফারান কে দেখতেই সালাম দিয়ে গেইট খুলে দিলো। মনে হল আগের পরিচিত। আমি তারপরও সিট থেকে মাথা তুললাম না। গাড়ি টা ভিতরে ঢুকাতেই দেখলাম এটা একটা বাংলো। আমি কোন জায়গায় আছি এই মুহুর্তে তা জানিনা ঠিক করে। অনুমান ও করতে পারছিলাম না। গাড়ি থেকে নেমে ফারান আমার পাশের দরজা খুলে দিল। আমি চমকে উঠলাম। সে আমাকে কোলে তুলে নিল। শিউরে উঠলাম আমি। তাড়াতাড়ি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম।
-“কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে! আমি কোথাও যাবনা আপনার সাথে।”
ফারান উত্তরে শুধু বলল
-“শসসসসহ।”
সে আমাকে চুপ করতে বলছিল। কিন্তু আমি চুপ করছিলাম না। আমার চিৎকারে দারোয়ান আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকাল। ফারান কি যেন ইশারা করল দারোয়ান তা দেখে তাড়াতাড়ি গেইট বন্ধ করে দিল।
আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। আর আমার ঝাপটানো দেখে ফারান আরো শক্ত বুকের সাথে চেপে রাখছিল।
এরপর ফারান একটা রুমের সামনে এসে দাড়াল। তখন আমার বুক ধকধক করতে লাগল। না জানি রুমে নিয়ে কি করবে? এর উপর ভরসা করতে পারিনা। রুমে ঢোকার আগে আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। কিন্তু দূর্বল শরীরে কিছুই করতে পারছিলাম না।
ফারান দরজা খুলল লাথি মেরে। কড়া একটা শব্দে দরজা খুলে গেল। আমি কান্না শুরু করে দিলাম। ও আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। আর আমি উঠে গেলাম। সাথে সাথে ফারান আমার হাত ধরে ফেলল। কান্না জড়িত কন্ঠে আমি বললাম
-“আ-মিই চ-চ-লে যাব।”
-“কোথায় যাবা?”
গম্ভির কন্ঠে বলল ফারান।
-“আমার আব্বুর কাছে যাব।”
-“সম্ভব না। এখন থেকে এখানে থাকবে। এটাই তোমার ঘর।”
-“নাহ্ আমি আব্বুর কাছে যাবো।”
এই কথা বলে আমি রাগে দুঃখে ফারানকে ধাক্কা দিলাম। ফারান টাল সামলাতে পারল না। কেননা এই মুহুর্তে সেও শারীরিক ভাবে দুর্বল ছিল। ফারান মেঝেতে পড়ে গেল। আমি দরজার দিকে দৌড়ালাম।
সাথে সাথে ফারান হুংকার ছাড়ল। কিন্তু আমি পরোয়া না করে প্রাণপনে দৌড়াতে লাগলাম। বাড়ির বাইরে বেরুতে যাব দেখলাম ও খানে দারোয়ান বসে আছে। গেইট বন্ধ। আমি আবার ভেতরে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু ফারানের ডাক শুনতে পেলাম
-“মোহিনী চলে আস বলছি। ভালো হবে না। মোহিনী!”
আমি ফারানের কথা না শুনে আপাতত লুকানো যাই এমন জায়গা খুজছিলাম। বাংলো হলেও ঘরটা বেশ বড়। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে একটা রুমে ঢুকলাম। পেছনে ফারানের গর্জন শোনা গেল। সাথে সাথে আমার বুক কেপে উঠল ভয়ে। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে হাঁপাতে লাগলাম। ফারান নিশ্চই খুব কাছে চলে আসছে। কেননা ওর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। ও আমাকে ডাকছিলো। এরপর আমি সামনে তাকালাম। এই রুমের ভিতর আরেকটা ছোট রুম। রুমটাই মনে হল আমার স্টোর রুম। পুরানো বাতিল জিনিস সব এখানে ভর্তি। তাড়াতাড়ি ছোট রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এই রুমটা গুমোট অন্ধকার আর সাথে ভ্যাপসা গন্ধ। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আমার এখানে। আমি চুপচাপ ভাঙা একটা চেয়ারের পাশে হাটু মুড়ে বসে রইলাম। আমার আব্বু আম্মু আর রিফাত কে খুব মনে পড়তে লাগল। আমি নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলাম। পাছে কান্নার আওয়াজ শুনে ফারান এসে যাই তাই মুখের উপর হাত দিয়ে চেপে রাখলাম। কিন্তু চোখের পানি বাধ মানছিলনা। হঠাৎ দড়াম করে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। কিভাবে খুলল? আমি তো ওটা বন্ধ করেছিলাম ভেতর থেকে। ভয়ে আমি আরো জোরে মুখ চেপে রাখলাম। যতটা সম্ভব আওয়াজ না করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার হৃদপিন্ডের আওয়াজ টাকে চুপ করাতে পারলাম না। ওটা অত্যন্ত বড় আওয়াজে বাজতে লাগল।
-“মোহিনী!”
ফারান আবার ডাকল। এবার সে ছোট রুমটার সামনে দাড়িয়ে। করাঘাত করতে লাগল।
-“মোহিনী দরজা খুলো।”
এভাবে কিছুক্ষন করাঘাত করার পর ফারানের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সে অন্যদিকে যাচ্ছে। আমি পায়ের আওয়াজ অন্যদিকে যাওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। পাশে ভাঙা চেয়ারে ভর দিয়ে দিতেই মট মট শব্দে আমি চেয়ার সহ পড়ে গেলাম। পায়ার খোঁচায় হাত ছিলে গেল। কিন্তু এ শব্দ ফারান কে হুট করে ডেকে আনল। সে দৌড়ে এসে দরজা টা উপর্যুপরি লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলল। আমি তাড়াতাড়ি চিৎকার দিয়ে পিছু হটতে চাইছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। কারন আমার পেছনে দেয়াল ছিল। ফারান ফোঁস ফোঁস শব্দে আমাকে দাড় করিয়ে কাধে তুলে নিল। আমি আপ্রান চেষ্টা করছিলাম ওই রুমে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু ফারান আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল। এর পর রুমে ঢুকে প্রথমে সে দরজা বন্ধ করে দিল আমাকে কাধে রেখেই। তারপর ফারান আমাকে বিছানায় ছুড়ে মারল। আমার দিকে দাত কিড়মিড় করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল সে। আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম।
-“আ-আম-আর কা কা ছে আসবেনা। আ-আমি বলে দিলাম।”
আমি পিছু হটতে লাগলাম। কোথায় যাব দরজা তো বন্ধ। ফারানের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে নির্ঘুম রাতের জন্য। খুবই ভয়ঙ্কর লাগছিল ওই লাল চোখ দুটোর জন্য। পিছু হটতে হটতে পিঠে শক্ত কিছু লাগল। আমি চমকে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখলাম এটা দেওয়াল। দেওয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। আমি কি করব এখন?
-“বলছি না কাছে না আসতে। আসছেন কেন?”
-“আমি আসবনা তো কে আসবে? মামুন? ও আর কখনো তোমার কাছে আসতে পারবেনা। আমি ছাড়া আর কেউই আসতে পারবেনা।”
ফারান একদম কাছে চলে আসছিল। এমনকি আমি যদি হাত দিয়ে ওর বুকে চেপে বাধা না দিতাম তাহলে ও আরো কাছে চলে আসত। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ওর বুকের হৃদপিন্ডের শব্দ পর্যন্ত আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। ফারান তার দু হাত আমার দু পাশে রেখে আমার ঘাড়ের দিকে মাথা এগিয়ে নিতে লাগল। তখন আমি খুব অসহায় বোধ করলাম। চারদিকে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। ফারান ততক্ষণে আমাকে শুকতে লাগল। সাথে সাথেই আমার চারদিকের দুনিয়াটা ঘুরতে লাগল। আমি টুপ করে ফারানের বুকে ঢলে পড়লাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
.
যখন চোখ খুললাম নিজেকে অপরিচিত জায়গায় আবিষ্কার করলাম। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছু মনে করতে পারলাম না। পরে সব মনে পড়তেই ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। আমি খুব সুন্দর একটা বেডে এতক্ষন শুয়ে ছিলাম। ফারান কে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। আমি মনে মনে ভাবলাম। বিছানা থেকে নামতেই মাথাটা আবার ঘুরে উঠল। আমি এখনো উপোস। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বিছানা থেকে নামলাম। দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। মানে ফারান আমাকে এখানে আটকে গেছে। আমাকে পালাতে হবে। জানালা, বাথরুম সব চেক করলাম। নাহ! ফারান কোন দিকে পালানোর পথ রাখলোনা। হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। কি করব আমি এখন? আব্বু কেমন আছে কে জানে? ঠিক তখনি বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি বিছনাই উঠে কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে রইলাম। আমার বুকের ধক ধক শব্দ পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছে কেউ প্রচুন্ড জোরে আমার ভিতরে হাতুড়ি দিয়ে পিঠাচ্ছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। টেবিলে মনে হয় কিছু রাখল। তারপর ধীরে ধীরে আমার পাশে এসে বিছানায় বসল। আমার কাধে হাত রেখে মুখটা কানের কাছে নিয়ে আসল। তারপর বলল
-“আমি জানি তুমি জেগে আছ মোহিনী। আমার সাথে চালাকি না করে উঠে বস।”
ফারান আরেকবার ডাকল। কিন্তু আমি চোখ জোর করে বন্ধ করে রাখলাম। ফারান আবার বলল
-“তুমি উঠবেনা! ঠিক আছে। তাহলে আমাদের বাসর এখনি হবে।”
এই বলে ফারান উঠে দাড়াল আর আর বোতাম খুলতে লাগল। আর আমি শার্ট খোলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি কাথা পেচিয়ে দুপ করে উঠে বসলাম।
ফারানের ঠোঁটের এক কোনে হাসির আভাস ফুটল। এধরনের হাসি খুবই মারাত্মক। এই হাসিটাকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। আর তাছাড়া অনেকটা ফ্রেশ লাগল ফারান কে। নিশ্চয় গোসল, খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব হয়েছে।
ফারান টেবিল থেকে প্লেট নিল। প্লেট নিয়ে আমার পাশে বসল। তারপর নিজেই খাইয়ে দিতে চাইল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ফারান বাম হাত আমার চিবুক ধরে মুখ ফেরাল। তারপর আবার দিতে চাইল। কিন্তু আমি মুখ খুললাম না। মুখ না খোলায় সে আমার চিবুক ধরে তার মুখের কাছে নিয়ে গেল। প্রথমেে বুঝলাম না যে ফারান আমার চিবুক ধরে তার মুখের কাছে কি করতে চাচ্ছিল। পরে ওর ঠোট হা করতে দেখে বুঝতে পেরে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তাড়াতাড়ি বললাম
-“এইতো খাচ্ছি। এবার খাইয়ে দেন।”
এবারও সে শয়তানি হাসির আভাস। আমি কোন আওয়াজ করলাম না। চুপচাপ খেয়ে নিলাম। আমার ক্ষুধা ও প্রচুন্ড ছিল। আর ফারান আমি যেন ভিন গ্রহের প্রাণী ঠিক সেভাবে দেখতে লাগল।
খাওয়া শেষ হলে ফারান প্লেট নিয়ে চলে গেল। কিন্তু কিছুক্ষন পর আবার চলে আসল। এসে আলমারি থেকে কিছু কাপড় বের করল। এটা অফ হোয়াইট রঙের গাউন। আমার হাতে দিয়ে বলল
-“যাও বাথরুমে গিয়ে গোসল করে এসো।” আর শোনো উল্টা পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবানা। করলে বুঝোই তো কি হবে? আমাদের এক হতে সময় লাগবেনা।”
শেষের লাইনটা অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলল। এর পর চলে যাচ্ছিল। আমি ওর যাওয়ার দিকে চোখ রাখছিলাম। কিন্তু সে আবার কি মনে করে ফিরে আসল। আমার কাছাকাছি এসে আমার কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে ফিস ফিস করে বলতে লাগল
-“একটু কালির ফোটা লাগায় দিয়ো কানের পেছনে। যাতে আমার নজর না লাগে।”
আমি সরু চোখে ফারানের দিকে তাকালাম। সে কিছুক্ষন ভেবে আবার বলল
-“আমার নজর তো তোমার উপর পড়েই গিয়েছে। কালির ফোটাও আমার নজর ফেরাতে পারবেনা। তুমি যে আমার মোহিনী!”
এই বলে ফারান আমার কপালে নিজের ঠোট দিয়ে একটু খানি স্পর্শ করে চলে গেল। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি হল?
.
(চলবে)