মোহিনী পাঠ-৬

Story : মোহিনী
Writer : Nirjara Neera
Part : ৬
.
গোসল করায় মনে হল গায়ে অনেকটা শক্তি ফিরে এলো। নিজেকে অনেক ফ্রেশ মনে হল। যা হোক এখন ভালো করে ভাবতে পারবো কিভাবে এখান থেকে পালাতে পারবো।
গোসল করে যখন গাউন টা পড়লাম। দেখতে ভালোই কিন্তু ওড়না খুজে পেলাম না। পরে মনে পড়ল গাউনে ওড়না থাকেনা। কি করব আমি? গাউন টা খুলে ফেলবো? খুলে ফেললে যদি ফারান রেগে যায় তখন কি করব? সাত পাচ ভেবে গাউনটা খুললাম না। তবে ওড়না ছাড়াও ফারানের সামনে যাওয়া যায় না। একটা আইডিয়া মাথায় এলো। চুলের পানি নেওয়ার জন্য টাওয়েল মাথায় পেছিয়ে ছিলাম। ওইটা দিয়ে চুল ভালো করে মুছে টাওয়েল টা মাথার ওপর ওড়নার মত দিয়ে রাখলাম।
যখন বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলাম তখন রুমে কেউ ছিলনা। যাক ভালোই হল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এবার ওড়না খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু আলমারিতে টা লক করা। কি করবো এখন?
এই সব কথায় চিন্তা করছিলাম তখন বাইরে চার পাঁচ জন লোকের পায়ের আওয়াজ পেলাম। কোন কিছু চিন্তা করার আগেই ফারান রুমে ঢুকে গেল। ও ঢুকতেই ওর নজর প্রথমেে অামার উপর পড়ল। ও হাটা বন্ধ করে দিল। আমি থম থম খেয়ে গেলাম। ও মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে। চোখের পলক টাও ফেলছেনা আমার মনে হয় নিঃশ্বাস টাও নিচ্ছে না। হা করে ও কি দেখছে? আমি একবার ফিরে পিছনে আয়নায় তাকালাম মুখে কোন কিছু আছে কিনা দেখার জন্য। কই না! কিছুই তো নাই। আবার ফিরলাম। ফারান এখনো তাকিয়ে আছে। রুমে আরো কয়েকজন মহিলা প্রবেশ করল। এরা কারা? সবার হাতে কিছু জিনিস পত্র। তারা ফারান কে ডাকছে। কিন্তু ফারান যেন শুনতেই পেলনা। আমি বিব্রত বোধ করলাম। তারপর মনে পড়ল নিশ্চই মাথায় টাওয়েল রাখাই ফারান তাকিয়ে আছে।
আমার দিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে সে মহিলা দের বেডের দিকে ইশারা করল। আর তখন মহিলারা জিনিসপত্র বেডে রেখে চলে গেল। তারপর ফারান খুব দ্রুত আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি চমকে গিয়ে একটু পিছু হটলাম। একটানে বলল
-“মোহিনী আমি তোমাকে একটু করে জড়িয়ে ধরি? ব্যস একটু করে প্লীজ।”
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। শূণ্য দৃষ্টিতে
-“প্লীজ একটু করে। শুধু একটু করে ছোব।”
আমার প্রচুন্ড রাগ হল। তারপরও রাগ প্রকাশ না করে বললাম
-“আপনি আমার হাসবেন্ড নাকি? কেন ছোবেন আমাকে? কে আপনি আমার?”
ফারান তোয়াক্কা করল না। শুধু হাত দিয়ে একবার আমার গাল ছুতে চেষ্টা করল। কিন্তু আমি মাথা সরিয়ে নিলাম। কারন এটা গুনাহ। ফারান আমার কাছে নন মেহরাম পুরুষ। এতদিনে আল্লায় জানে ফারানের জন্য কত পাপ হয়েছে।
ফারান একটা নিশ্বাস ফেলে চলে যেতে লাগল। আর ওকে চলে যেতে দেখে আমি ফেলার জন্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম কিন্তু তার আগেই ফারান হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি চমকে উঠলাম। ফারান না গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর এত জোরে চেপে ধরেছে যে আমি ঠিকমত নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। দু হাতে ওকে ধাক্কা দেবার বৃথা চেষ্টা করছিলাম। আমার ভেজা চুলে নাক ঢুবিয়ে ফিস ফিস করে ফারান বলতে লাগল
-“তুমি আমার কে জানো? তুমি আমার মোহিনী। আমার আত্মার সঙ্গী। আমার সোলমেট। আর তোমার হাসবেন্ড হতে আমার বেশি সময় লাগবেনা।”
আমি ওর দু হাতের চাপে পিষ্ট হতে হতে গলা থেকে দুটো শব্দ বের করতে পারলাম
-“আমাকে ছাড়েন।”
সে কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলতে লাগল
-“এত সুন্দর কেন তুমি? আমি তো নিশ্বাসই নিতে পারছিলাম না। আর এত মিষ্টি গন্ধ কেন তোমার? যদি পানির ফোটা হতাম তাহলে চুল থেকে, শরীর থেকে আমি কখনোই নামতাম না। কিন্তু এখন আমার প্রচুন্ড জ্বলুনি হচ্ছে, হিংসা হচ্ছে। তোমার চুল বেয়ে এক ফোঁটা এক ফোঁটা পানি তোমার ঘাড়ে পড়ছে। ইশ মনে হচ্ছে এক একটা পানির ফোঁটা আমি শুষে নিই। আমি পারবোনা তোমাকে না জড়িয়ে থাকতে। হোক পাপ।”
.
ফারান এভাবে বকবক করছিল আর আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না ওর চাপে। কোন রকম বললাম
-“আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা।”
ফারান কথা থামিয়ে বলল
-“আমি জানি আমি খুব হট এ্যান্ড হ্যান্ডসাম। তাই নিশ্বাস নিতে পারছনা। অসুবিধা নেই আমি জড়িয়ে ধরছি তোমাকে।”
আমি বোবা হয়ে গেলাম। একদম আত্ম প্রশংসা!
আমি আবার বললাম
-“আমার ব্যথা লাগছে।”
এবার ফারান ছেড়ে দিল। সাথে সাথে আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম
-“মোহিনী!
আমি তাকালাম না ওর দিকে। এরপর ফারান বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। আর আমি বড় বড় করে নিশ্বাস নিচ্ছি। না এভাবে তো চলতে পারে না। আমাকে যে করে হোক এখান থেকে চলে যেতে হবে।
.
রাতে ফারান আবার খাবার নিয়ে আসল। এবার আর ওড়না নিয়ে সমস্যা নাই। ওড়না মহিলারা এনেছিল শপিং ব্যাগে। ওখান থেকে পেয়েছি।
আমি চুপচাপ বিছানায় বসে ছিলাম। ফারান নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগল। ওর হাতে খেতে আমার অস্বস্তি লাগছিল। তাই বললাম
-“আমি নিজ হাতে খাই?”
-“না।”
-“প্লিজ!”
এবার ও চোখ গরম করে তাকাল। আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছিলাম। কি সব খাওয়াচ্ছে আল্লাই জানে। দূর দূরান্ত পর্যন্ত এসব খাবারের নাম জানি না আমি। সব ঝোল জাতীয়। নিশ্চয় সু্প। আমাকে দিচ্ছে তারপর নিজে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে দুপুরে আনা সব জিনিস পত্র বের করতে লাগল। একটা ব্যাগ থেকে গাউন বের করল। গাউন টা খুবই ভারী কাজের। এত ভারী গাউন কে পড়ে? আমি হা করে থাকিয়ে থাকলাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারান বলল
-“কি পছন্দ হয় নি? না হলে বলো আমি আরো এনে দিচ্ছি।”
ব্যাগ থেকে টকটকে লাল রংয়ের ফিনফিনে নরম ওড়না বের
করে বলল
-“এটা দেখো! এটা পছন্দ হয়ছে?”
ওড়নাটা দেখতে বিয়ের ওড়না মত।
-“এগুলো কিসের জন্য?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-“তুমি জানো না?”
আমি মাথা নাড়ালাম। জানি না
-“এগুলো আমাদের বিয়ের জন্য। আর গাউনটা আমি নিজে পছন্দ করেছি তোমার জন্য। কালকে সকালে আমাদের বিয়ে। তুমি তৈরি থেকো।”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি কি শুনছি। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম
-“কি বললেন? বিয়ে! আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা। কখনোই না।”
রাগে আমার শরীর কাপছিল। কিন্তু ফারান কে চুপচাপ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে দেখে আমার রাগ চলে গিয়ে ভয় স্থান নিল। এখনো শরীর কাঁপছিল তবে ভয়ে। ফারান দাঁতে দাঁত চেপে বলল
-“কি বললে তুমি?”
-“আ-আ-আমি বি-বিয়ে করবনা।”
-“তুমি বিয়ে করিও না। বিয়ে আমি করব। এখানে সব গহনা আছে। আর এ ব্যাগেও বাকি সব জিনিস আছে।”
এই বলে চলে যেতে লাগল। আবার পিছন ফিরে বলল
-“তুমি চাও বা না চাও বিয়ে কাল সকালে হবে। তো কাল সকাল পর্যন্ত সময় আছে। নিজেকে মানিয়ে নাও। আমি কোন সমস্যা চাই না।”
এই বলে ফারান ঠাস করে দরজা টা বন্ধ করে চলে গেল। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। কি করব বুঝতে পারছিনা। চোখ ফেটে কান্না বেড়িয়ে এলো। আমি কোথায় ছিলাম এর এখন কোথায় আছি? জানি না আব্বু কেমন আছে? কাল সকালে আমার বিয়ে। ফারান কে বিয়ে করলে আমার জীবন টা তছনছ হয়ে যাবে। কান্না করছিলাম। তখন হঠাৎ নজর গেল টেবিলের ওপর কিছু একটা রাখা। উঠে দাড়ালাম। ফারানের ফোন। খাওয়ার সময় এখানে রেখেছিল হয়ত। নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। আমার মনে আশা জেগে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিলাম। কিন্তু আবার হতাশ হতে হল। এটা লক করা। কি হবে পাসওয়ার্ড। ফারান দিলাম, পুরো নাম দিলাম, আরো কয়েকটা নাম দিয়ে দেখলাম। হচ্ছেনা।
ফোনটাতে পাসওয়ার্ড কি হবে মনে করছিলাম। হঠাৎ একটা নাম মনে পড়ল কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলাম “মোহিনী”
আর সাথে সাথেই ফোনের লকটা খুলে গেল। এটা কেন হল না ভেবে রিফাতের ফোনে কল দিলাম। ফোন টা বন্ধ। আব্বুর টাতে কল দিলাম। সেটাও বন্ধ। কি ব্যাপার! সব ফোন বন্ধ কেন? এবার কি করব? আর কারো নাম্বার আমার মুখস্ত নেই। আছে! মারোয়া দের টা। সাথে সাথে কল দিলাম। রিং বাজছে কিন্তু কেউ ধরছেনা। আবার করলাম, এবারও কেউ ধরল না। আর তিন বার করলাম। কিন্তু কেউ ধরল না। এবার শেষ বারের মত করব। প্লীজ কেউতো ধরিও। কল করলাম। রিং বাজছে। শেষে কেউ একজন ফোন ধরল। এটা মারোয়া। আমি কোন বনিতা না করে বললাম
-“মারোয়া তোমার আম্মু কে ফোন দাও।”
-“ম্যাম আপনি?”
-“মারোয়া যা বলছি তা করো।”
-ম্যাম আম্মুতো নাই।
কোথায় তোমার আম্মু? জলদি উনাকে ফোন দাও।
-“ম্যাম আম্মু…”
মারোয়া আর কথা মারোয়ার কথা শেষ হল না। কারো কণ্ঠ শোনা গেল ওপাশ থেকে। এটা মামুন। সে মারোয়া কে বকা দিচ্ছিল আমার সাথে কথা বলার জন্য। তারপর ফোন টা কেটে দিল। আমি আবার করলাম। ধরল না। আবারও করলাম। এবার ধরল। ধরেই আমাকে একটা ঝাঝরি মারল
-“কেন ফোন করতেছো? কি চাই?”
ঝাঝরি শুনে আমি দমে গেলাম। তবুও মিন মিনে গলায় বললাম
-“এরকম করে বলবেন না। মারোয়ার আম্মু কে ফোন টা দিন। আন্টির সাথে শুধু একটু করে কথা বলব। ফারান আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। কাল সকালেই সে আমাকে বিয়ে করে নিবে। আমার কিছু করার প্রয়োজন। প্লিজ আন্টি কে দিন।”
-“বিয়ে করতে চাচ্ছে ভালো কথা। বিয়ে করে ফেলো। এখানে কেন ফোন করছো? এত কিছু করার পরও তোমার শান্তি হয় নাই? ধনী ঘরের ছেলে তোমাকে বিয়ে করছে এটা তোমার সাত জনমের ভাগ্য। না হলে ফারানের ড্রাইভারেরও বউ হওয়ার যোগ্য না তুমি। আর যদি বিয়ে করতে না চাও তাহলে মরে হলেও যাও কিন্তু এখানে আর ফোন করবেনা।”
ঠাস করে মামুন ফোনটা রেখে দিল। আমি কিছু তেই কান্না থামাতে পারছিলাম না। টলটলিয়ে চোখের পানি সব ঝরে পড়ছিল। মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা ধরে ধুমরে মুচড়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে কাদতে পারছিলাম না, হাউমাউ করে আমি কাঁদতে লাগলাম।
অনেক টা সময় কেটে গেলো এরই মাঝে। ফারান আর আসেনি। এমন কি ফোনের খোঁজেও না। হয়ত বুঝতে পারে নি। আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে রিফাত কে ব্যর্থ কল করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ফোনটা একটু কেঁপে আবার বেজে উঠল। এটা রিফাত। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফোনটা ধরলাম।
-“হ্যালো রিফাত!”
-“আপু!”
-“রিফাত কিছু একটা কর। ফারান নাকি কাল সকালে আমাকে বিয়ে করবে। প্লিজ!”
-“হুম আমি জানি। তুই টেনশন করিস না। এক কাজ কর।”
এই বলে রিফাত আমাকে একটা কাজ করতে বলল। তারপর রিফাত ফোন কেটে দিল। আমি ফোনের কল ডিটেইলস সব ডিলিট করে দিলাম। ফোনটা ঠিক যেভাবে ছিল সেভাবে অফ করে রেখে দিলাম।
কিন্তু এই ভেবে আমি অবাক হলাম যে রিফাত এত কিছু কিভাবে জানল। রিফাতের সাথে কথা বলে কিছুটা ভালো লাগছিল।
.
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে গোসল সেরে নিলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম পরিকল্পনা মত যেন সব ঠিক হয়ে যায়।
ঠিক সকাল সাড়ে আট টায় ফারান আসল খাবারের ট্রে নিয়ে। আমি চুপচাপ খাচ্ছিলাম। কিন্তু অনেক নার্ভাস লাগছিল। ফারান কি বুঝল জানি না। সে হুট করে জিজ্ঞেস করল
-“কি হয়েছে?”
-“কই কিছু না।”
-“তাহলে ঠোট দুটো কে নাজেহাল করছো কেন?”
তাড়াতাড়ি ঠোট কামড়ানো বন্ধ করে বললাম
-“এমনি!”
-“এমন নার্ভাস হচ্ছো কেন? আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো নাকি? বিয়েই তো করছি। জোর করে ইনটিমেট হচ্ছি না।
এই কথায় আমি মাথা নিচু করে বললাম
-“আপনার ফোন ভুলে রেখে গিয়েছেন।”
টেবিল থেকে ফোনটা এনে ফারানের হাতে দিলাম। ফারান সন্ধিগ্ন চোখে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে। এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল ফোন চেক করতে লাগল। আমি আমতা আমতা করতে বললাম
-“আমি কিছু করিনি। ফোন লক ছিলো।”
-“ফোনটা লক না থাকলে কি করতে?”
এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি মাথা নিচু করে রাখলাম।
খাওয়া শেষ হলে ফারান যেতে যেতে বলল
-“তৈরি হয়ে নাও। তোমার হাতে ারর এক ঘন্টা সময় আছে। কিছু মেইড আসবে। তারা তোমাকে তৈরি হতে সাহায্য করবে।”
-“দাড়ান”
ভ্রু কুচকে ফারান দাড়ালো। আমি ধীরে ধীরে ফারানের সামনে দাড়ালাম
-“আমার একটা কথা ছিল।”
-“কিছু লাগবে?”
-“আমি বিয়েতে রাজি। তবে…”
এই কথায় ফারানের চোখে মুখে হাসি দেখা দিল কিন্তু তবের সাথে সাথে সেটা মিলিয়ে গেল।
-“আমি বিয়ে আব্বু আম্মুর দোয়া নিয়ে করতে চাই।”
এক টানে বললাম কথাটা।
-“স্টুপিড আইডিয়া!”
বলেই ফারান চলে যেতে লাগল। আমি আবার পথ আটকে দিলাম
-“আমি বিয়ে করবো তো। কিন্তু পিতা মাতার দোয়া না থাকলে নাকি বিয়ে সুখের হয় না তাই।”
-“লাগবেনা ওদের দোয়া।”
এইটা বলে ফারান দরজা খুলতে যাচ্ছিল। আমি ওর হাত ধরে ফেললাম। ফারান একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ভ্রুক্ষেপ না করে বললাম
-“প্লিজ!”
ফারান একটা নিশ্বাস ফেলে আমার হাত ধরল। তারপর কিছু একটা ভেবে বলল
-“ঠিক আছে তবে কোনো উল্টা পাল্টা কাজ করবেনা আর সবসময় আমার পাশে থাকবে।”
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু সেই সাথে ভয়ও হচ্ছিল। কারন ফারান যদি কোন ভাবে জেনে যায় তাহলে আমাকে আস্ত রাখবেনা।
কিছুক্ষনের মধ্যে তৈরি হযে গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ফারান আসবে।
.
অবশেষে ফারান এলো। আমি আগে আগে বেরুতে চাইলাম। কিন্তু ফারান হাত ধরে ফেলল
-“সামনে না। আমার পাশে পাশে হাটবে।”
কিছুটা বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না। যেতে দিচ্ছে এটাই বড় কথা।
রুম থেকে বের হলাম পাক্কা দুই দিন পর। এই দুই দিন আমি একট রুমের বন্দিনী হিসেবে ছিলাম। রুম থেকে তো মুক্তি পেলাম। কিন্তু ফারান থেকে না। সে আমার হাত ধরে রাখল। বাংলোর বাইরে গিয়ে দেখলাম দুটো গাড়ি। ফারানকে জিজ্ঞেস করতেই বলল বিয়ের সব সরঞ্জাম নেওয়ার জন্য একটা নেওয়া হয়ছে। আমি কিছু বললাম না। যা ইচ্ছা করুক। গাড়িতে উঠে বসলাম। এখানেও হাত ছাড়াছাড়ি নাই। এটা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি তে ছিলাম। তাই ফারান কে বললাম
-“হাত টা একটু ছাড়েন।”
-“উহু। হাত ধরেছি ছাড়ার জন্য না। ধরে রাখার জন্যে।”
কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম
-“কতক্ষণ ধরে রাখবেন?”
এই প্রশ্নে ফারান এক মুহুর্তের জন্য আমার দিকে তাকালো। তারপর বলল
-“মরন পর্যন্ত!”
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। গাড়ি চলতে শুরু করল। এবারও জানালা লক করা। সিটে মাথা রেখে বাইরে দৃশ্য দেখতে লাগলাম। জানিনা কি হবে? রিফাতের কথা অনুযায়ী নিয়ে তো যাচ্ছি। কিন্তু ফারান যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে বসে? তখন কি হবে? শিউরে উঠলাম।
ফারান কে দেখে মনে হচ্ছিল যে সে এসব নিয়ে একবারে মাথা ঘামাচ্ছে না। সর্বদা মুখের মধ্যে হাসি লেগে আছে। তারপর হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল
-“তোমার না গাড়িতে বমি আসে?”
-“হুম!”
-“আমার সাথে গেলে বমি আর হবে না।”
-“গতবারও আমি আপনার সাথে আসছিলাম!”
-“হ্যা আসছিলে। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল।”
আমি আর কিছু বললাম না। ফারান নিজেই নিজেই কথা বলতে লাগল। আমি কিছু শুনছিলাম কিছু শুনছিলাম না। বাড়িতে যাওয়ার নিশ্চয়তাই আমার চোখে ঘুম নেমে আসছিল। কখন দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো জানতেই পারলাম না। যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য মাথার উপরে। ফারান ডাকছিল আমাকে।
কি ব্যাপার? কি হল? বাইরে বেরুলাম। কার টা থামানো হয়েছে একটা লোকাল হোটেলের সামনে আশে পাশে আরো দু একটা ছোট খাট দোকান আছে। এটা কোন জায়গা? চারদিক টা মোটামুটি গাছগাছালি ঘেরা।
একটা ঘাট বাধানো ছোট পুকুর ও রয়েছে। ফারান হাত ধরে পুকুর ঘাটে নিয়ে গেল। সেখানে নিয়ে বলল
-“হাত মুখ ধুয়ে নাও।”
আমি প্রশ্ন করলাম না। ঘুম থেকে উঠেছিলাম তাই হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। খুব ভালো লাগছিল। ফ্রেশ মনে হচ্ছিল। ফারানও হাত মুখ ধুয়ে নিল। দুহাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝেড়ে নিচ্ছিল তখন ওকে দেখতে ভালোই লাগছিল।
-“এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা ভালো না।”
এই কথায় আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে না দেখার ভান করতে লাগলাম। ফারান একটু হেসে বলল
-“চলো!”
হোটেল ভাত, চা নাস্তা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। আমি ভাত খেলাম। ফারান আমার দেখা দেখি ভাত নিল। কিন্তু মনে হল ও ভাতে অভ্যস্ত না। ভাত খাচ্ছিল ও চামচ দিয়ে! একবার মনে হল ওকে বলি। আবার মনে হল না থাক। কি দরকার এত আন্তরিকতা। খাওয়া শেষ হলে আমি যখন কারে উঠতে যাবো তখন ফারান বাধা দিল। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালাম। ও বলল
-“এদিকে আস!”
-“কোথায়?”
একটু হেসে সে বলল
-“বহু দূরে!”
ও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর হাটার পরে একটা প্রায় খোলামেলা জায়গায় নিয়ে এলো। এরপর ফারান আমার চোখ ধরে ফেলল। আমি বললাম
-“কি করছেন?”
-“শসসহ”
ফারান আমাকে চুপ করতে বলছিল। বেশ কিছু দূর এগোনোর পর সে হাত সরিয়ে নিল। আমি চোখ খুললাম। দেখলাম একটা বিশাল দীঘি। পানি খুবই পরিষ্কার। ছোট ছোট সোনালি রুপালী মাছ। আমি আস্তে আস্তে পানি গুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। ঠান্ডা শীতল পানি। আমার খুব ভাল লাগছিল। ছোট ছোট মাছ গুলো আমার হাতে ঠোকর মারছিল। এরকম সৌন্দর্য্যমন্ডিত দীঘি আমি দেখি নাই। বলতে গেলে দীঘির এক কোনে ছোট ছোট শাপলা ফুল ফুটে আছে। দরিদ্র হওয়ার কারনে আমার কখনো ভ্রমন করা হয় নি তাই এসব কিছুর জন্য আমার চোখ এখনো শিশু।
-“মোহিনী!”
আমি চমকে উঠলাম। কারন এতক্ষন আমার ফারানের কথা একদম মনেই ছিল না। সে আবার বলল
-“এই দীঘির বৈশিষ্ট্য কি জানো?”
-“কি?”
-“এই দীঘি তে জোয়ার ভাটা হয়।”
-“দীঘিতে কখনো জোয়ার ভাটা হয় না।
-“রাইট। কিন্তু এই দীঘি তে হয়।”
এরপর ফারান দীঘির একটা কোনা আমাকে দেখালো। ছোট পাহাড় এর মত উচু ঢিবি দীঘির এক কোনা। ওই কোনায় একটা ফাটল। ওই ফাটল দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন জল এসে পড়ছে দীঘিতে। একেবারে ঝরনার মত।
আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি। আসলেই এত সুন্দর দৃশ্য আমি কখনো দেখি নি। ঝরনার মত এক নাগারে ওপর থেকে পানি পড়ছে। পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ঘেমে এরকম ছড়া অহরহ বয়ে যায়। আবার সেসব ছড়া যদি উচু জায়গা থেকে পড়ে তাহলে হয়ে যায় ঝড়না। কিন্তু খটকা লাগল। আমি বললাম
-“এটাতো পানি এসে জমা হচ্ছে। কিন্তু দীঘির পানি বাড়ছে না।”
-“ঠিক ধরেছো। কেউ জানে না এই পানি কোথায় যায়। আর এটাই এই দীঘির রহস্য। কেউ কেউ বলে এই দীঘির নীচে সুরঙ্গ আছে। তা দিয়ে পানি অন্য খানে চলে যায়। আর আমিও এটা বিশ্বাস করি। যখন প্রথম দেখেছিলাম তখনি কিনে নিই। কারন এটার সৌন্দর্য্যে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।”
তারপর ফারান আমার দু হাত ওর দু হাতে নিল। বলতে লাগল
-“মোহিনী আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।”
-“বলেন।”
-“মোহিনী! আমি তোমাকে প্রথম দেখি মারোয়া কে আনতে গিয়ে। যখন তুমি দরজা খুলেছিলে আর তোমাকে প্রথম নজর দেখেছিলাম। একটা নিষ্পাপ মিষ্টি সুগন্ধ আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। সে গন্ধে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখের পলক তুলে তোমাকে দেখতেই যেন মনে হল ভোরে ফোটা সদ্য প্রস্ফুটিত কোন সাদা ফুল। আর তোমার ঘুমন্ত চোখ দুটো! একবার খুলছিল, আরেকবার বন্ধ হচ্ছিল। ইশ আ-আমি! আমি তোমাকে কেমন করে বোঝায় যে আমার কেমন লাগছিল! তোমার ভেজা ভেজা চুল কিছুটা তোমার গালের উপর পড়ছিল। মনে হচ্ছিল আস্তে করে জিহ্বা দিয়ে চুল টা সরিয়ে দিই। এত কিছু পেয়েও তুমি আমার না ভেবে নিজেকে ছন্নছাড়া লাগছিল। একটি মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর সে মিষ্টি সুগন্ধটা অাসছিল তোমার কাছ থেকে। আমার তক্ষুনি মনে হচ্ছিল তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার সুগন্ধ টা নিই। কিন্তু তুমি ভয় পেয়েছিলে। তাই কিছু করিনি। ওখান থেকে এসে আব্বু আম্মু কে তক্ষুনি জানিয়েছি যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, তোমাকে আমার করতে চাই। কিন্তু ওরা রাজি হচ্ছিল না। আমার প্রচুন্ড রাগ হয়। মনে হচ্ছিল সব কিছু ধ্বংস করে দিই। কিন্তু যখন তোমাকে জানালার পাশে দেখি আমার চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে উঠে। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত পবিত্রতা তোমার চারপাশে ছেয়ে আছে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here