–তুমি তো সেদিন বলেছিলে আমি তোমার যোগ্য নই। তাই তোমার জন্য একটু একটু করে নিজেকে যোগ্য বানিয়েছি আমি। অপেক্ষার প্রহর যে শেষ হয় না আহান ভাই। কবে আসবে তুমি?
মেঘাচ্ছন্ন আকাশটার দিকে তাকিয়ে, আনমনে কথাটি বলল মায়া। আজ সাতটা বছর ধরে আহানের জন্য সে অপেক্ষারত। কিন্তু তার এই অপেক্ষা কদর আহান কখনোই বোঝেনি তাইতো বছরের পর বছর দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই পেছন থেকে আহানের ছোট বোন আশা চেচিয়ে বলে উঠলো…..
–ভাবীপু জানিস সামনে সপ্তাহে ভাইয়া দেশে ফিরছে। এসেই নাকি আমাদের বেশ বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দেবে।
–তুই সত্যি বলছিস আশা। আমার আহান ভাই ফিরে আসছে। এই বুঝি আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চললো!
–হ্যাঁ রে হ্যাঁ! তুই এই রাতের বেলা ছাদে কি করছিস? চল ভাইয়া ভিডিও কল দিয়েছে, দেখবি চল।
–তুই যা আমি আসছি।
আশা চলে যাওয়ার কিছু সময় পর মায়াও ছাদ থেকে নিচে নেবে আসে। দূর থেকে একপলক মোবাইলের স্ক্রিনে তাকায় সে। দূর থেকেই চোখের দেখা দেখে নেওয়া যাকে বলে আরকি। তারপর আর সারারাত মায়ার ঘুম আসে না। খুশিরা যে সারা শরীর জুড়ে বিচরণ করছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত কখন শেষ হয়ে আসে তার কোনো ইয়াত্তা নেই মায়ার। প্রতিদিনকার রুটিন অনুযায়ী ফজরের নামাজ পড়েই হাঁটতে বের হয়। ছোট্ট পার্কে বেশ কিছুক্ষণ রাউন্ড দিয়ে ক্লান্ত হয়ে একটা ব্যাঞ্চে বসে মায়া। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ একজন “মায়া” বলে ডাকতে থাকে। মায়া পেছন ফিরে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিরবির করে বলে “ওহ নো এই পাগলটা আবার” মায়াকে এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে মানাফ তড়িঘড়ি করে তার কাছে আসে আর বিচলিত কন্ঠে বলে…
–আপনার কি হয়েছে মায়া? এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন কেন? শরীর খারাপ করছে কি?
–আমার মাথা, আমি ধরেছি তাতে তোর কি? তোকে কতবার বলেছি আমাকে বিরক্ত করবি না। কথা কানে যায় না?
–আপনি সবসময় আমার সাথে এমন করেন কেন? আমি তো শুধু আপনার সাথে একটু কথা বলতেই আসি।
ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে কথাটি বলে মানাফ। তার কথা শুনে মায়া ফিক করে হেসে দেয়৷ এক দৃষ্টিতে মায়ার হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে মানাফ৷ আর মনে মনে ভাবে “আপনার মায়ায় আমি দিনকে দিন অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছি। আপনি কি তা বুঝতে পারেন মায়া?” মানাফকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া নিজের হাসি থামিয়ে বলে….
–সকাল সকাল এখানে কি করছিস? নামাজ পড়েছিস?
–হ্যাঁ পড়েছি। আমি তো আপনার সাথে দেখা করতেই এসেছি।
–এই তোর কি আর কোন কাজ নেই।
–আছে তো! এই তো সকাল সকাল আপনাকে চোখের দেখা দেখে গেলাম এরপর বাবার সাথে অফিসে যাবো। ওহ হ্যাঁ আপনাকে তো বলাই হয়নি, কালই আমি বাবার অফিসে জয়েন করেছি।
–ভালোই করেছিস। এখন যা তো। আমি বাসায় যাবো।
–চলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
–তুই বড় নাকি আমি বড়? আমি একা যেতে পারবো।
মায়া বসা থেকে উঠে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হাঁটতে শুরু করে। মানাফও উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে। সে জানে এখন মায়ার পেছনে গিয়েও তার কোনো লাভ হবে না। বরঞ্চ তাকে দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেবে মায়া। মানাফ যখন কলেজে প্রথম দিন যায় তখন তাকে সিনিয়র দের কাছে রেগিং এর শিকার হতে হয়। তখন সে কিছুটা বোকাসোকা টাইপের ছিলো। কারো সাথে খুব একটা কথা বলতো না৷ মায়া সেদিন তাকে সিনিয়রদের রেগিং এর থেকে বাঁচায়। মায়া তখন অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো। ওদের কলেজ এবং ভার্সিটি পাশাপাশিই ছিলো। সেদিনই মায়ার সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। মানাফ তারপর থেকে একমাত্র মায়ার সাথেই বন্ধুত্ব করে। সে কখনো মায়াকে সিনিয়র আপু বলে সম্বোধন করেনি। সবসময় আপনি বলে সম্বোধন করেছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই মায়া বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে দেখে তার ফুপিমণি কিচেনে সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন। সাথে ফুলি নামক একজন পরিচারিকা রয়েছে৷ আর আশা ডাইনিং টেবিলে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। আজ তার ভার্সিটি যেতে একদমই ভালো লাগছে না। তবুও তার মা মিতুল আহমেদ জোর করে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছেন। পড়ালেখা নিয়ে হেলাফেলা উনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। মায়া একপলক তার ফুপিমণির দিকে তাকিয়ে আশার পাশে গিয়ে বসে। আশা তাকে দেখে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে…
–ভাবীপু একটু মাম্মাকে বল না। আজ আমার ভার্সিটি যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না।
–এগুলো বললে হবে? সামনে না তোর ১ম বর্ষের সেমিস্টার এক্সাম। আহান ভাই আসলে তো তোর পড়ালেখা লাটে উঠবে।
–তুইও মাম্মার মতো কথা বলছিস? যা তোর সাথে কথা নেই।
–এমন করে না বোনু।
মায়া উঠে আশার গালে একটা চুমু দিলে সে ফিক করে হেসে দেয়। মায়া নিজের রুমে চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। সে আহানের বাবা আশরাফ আহমেদের অফিসের ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত। মায়া ফর্মাল ড্রেসআপে অফিসে যাওয়ার তৈরি হয়ে ড্রইং রুমে আসে। মায়াকে দেখে আশরাফ আহমেদ একটু হেসে তাকে বসতে বলে। সে আশার পাশে বসে পড়ে। আশাও ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। নাস্তা শেষ আশরাফ আহমেদ তাদের দু’জনকে নিয়ে যাবেন। এরপর তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে৷ ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলে তখনই আসরাফ আহমেদের ফোনে আহানের ভিডিও কল আসে। উনি কল রিসিভ করে কথা বলতে থাকেন। মায়া একপলক আহানের দিকে তাকায়। বিদেশ গিয়ে আগের থেকে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে আহান। ভাবতেই ভেতর ভেতরে নার্ভাসনেস কাজ করতে থাকে মায়ার। কলে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই আহান মায়াকে দেখে ফেলে এবং বলে…
–পাপা! মেয়েটা কে?
–কেন তুই চিনতে পারছিস না? ও তো আমাদের মায়া।
মায়ার নামটা শোনা মাত্রই পুরনো কিছু একটা মনে পড়ায় আহান কল কেটে দেয়। মায়া মন খারাপ করে জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে লুকিয়ে আহানকে দেখতে পেলেও আজ অনেকগুলো বছর পর আহান মায়াকে দেখেছে। বিদেশে যাওয়ার পর কখনোই আহান মায়ার সাথে কথা বা দেখতে চায়নি। আগে বেশির ভাগ সময়ই আহান তাকে হেয় করেই কথা বলতো যার কারণে মায়া তারপর থেকে আর আহানকে নিজের মুখ কখনোই দেখায়নি। মায়া চুপ করে বসে রয়েছে, হুট করেই মন খারাপে’রা জেঁকে বসেছে। আশা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে মায়ার মন খারাপ তাই সে এটা সেটা বলে তাকে হাসানোর চেষ্টা করতে থাকে৷ কিছুতেই তার মন ভালো হচ্ছে না, বার বার শুধু সাত বছর আগে আহানের চলে যাবার দিনটার কথা মনে পরছে।
সাত বছর আগে….
মায়ার বাবা মাহবুব আলম গ্রামের সাধারণ একজন স্কুল মাস্টার। উনার ইচ্ছে একমাত্র মেয়েকে তিনি শহরে পড়াশোনা করাবেন। ঢাকার একটা কলেজে মায়ার ভর্তি সংক্রান্ত সব কাজ আগেই কমপ্লিট হয়ে আছে। সামনে সপ্তাহে তিনি মায়াকে কলেজ হোস্টেলে দিয়ে আসবেন বলে ঠিক করেছেন। যথাসময়ে তিনি মায়াকে নিয়ে হোস্টেলে দিয়ে আসেন। হোস্টেলের খাবার কিছুতেই খেতে পারে না মায়া। যার ফলে কিছুদিনের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে।
চলবে?……..
#মোহ_নাকি_মায়া
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#সূচনা_পর্ব