#মোহ_নাকি_মায়া
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-২
মায়ার বাবা মাহবুব আলম গ্রামের একজন স্কুল মাস্টার। উনার ইচ্ছে একমাত্র মেয়েকে তিনি শহরে পড়াশোনা করাবেন। ঢাকার একটা কলেজে মায়ার ভর্তি সংক্রান্ত সব কাজ আগেই কমপ্লিট হয়ে আছে। সামনে সপ্তাহে তিনি মায়াকে কলেজ হোস্টেলে দিয়ে আসবেন বলে ঠিক করেছেন। যথাসময়ে তিনি মায়াকে নিয়ে হোস্টেলে দিয়ে আসেন। হোস্টেলের খাবার কিছুতেই খেতে পারে না মায়া। যার ফলে কিছুদিনের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। তখন মায়ার ফুপিমণি গ্রামে এসে এই বিষয়ে মাহবুব আলমের সাথে কথা বলেন এবং জোর করে মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান। বোনের কথায় রাজি হলেও মাহবুব আলম বলে দিয়েছেন মায়ার সকল খরচ উনিই বহন করবেন। মিতুল আহমেদ ভাইয়ের এই কথা নিঃশব্দে মেনে নেন। ছোট বেলায় মায়া তার মাকে হারায়। মেয়ের কথা চিন্তা করে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। মিতুল আহমেদ অনেকবার উনাকে আর মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তবে উনি কিছুতেই বোনের শশুর বাড়িতে থাকবেন না। মিতুল আহমেদ মায়ার সমস্ত জিনিসপত্র গোছগাছ করে মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে যান। বাড়িটা বেশ অনেক গুলোই রুম রয়েছে। মিতুল আহমেদ মায়াকে উনার মেয়ে আশার রুমের পাশের রুমটায় থাকতে দিয়েছেন। মায়া দূরে কোথাও যাওয়ার মতো জার্নি করতে পারে না যার ফলে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে৷ তার যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসে৷ ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয় মায়া। মায়াকে দেখে মিতুল আহমেদ একটা মুচকি হাসি দেন। এরপর তাকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে খাবার খেতে দেন। দুপুরে না খাওয়ার ফলে খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো মায়ার তাই সে খেতে শুরু করে। রাতে ছোট্ট আশা বায়না ধরে মায়ার সাথে ঘুমোবে। তারপর সেদিন থেকেই মায়ার সাথে আশার বেশ ভালোই ভাব জমে ওঠে।
মায়া আশাকে সাথে নিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখছে। এর আগে আর একবার তার এ বাড়ি আসা হয়েছিলো। তখন সে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে এসেছিলো। আশার ডাক পড়ায় সে দৌঁড়ে তার মায়ের কাছে যায়। মায়া হাঁটতে হাঁটতে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাকি সবগুলো ঘর দেখা শেষ হয়েছে মায়ার। কৌতুহল বসত মায়া সেই রুমটার ভেতরে প্রবেশ করে। রুমটা ভেতরে সুনিপুণ ভাবে গোছানো। বিছানার পাশের দেয়ালে একটা ছেলের হাস্যজ্বল মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছবিটা বড় করে টানিয়ে রাখা হয়েছে৷ ছবিটা দেখে মায়ার মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। মায়া পুরো রুমের খুটিনাটি দেখতে থাকে। স্টাডি টেবিলের উপর রাখা একটা শো-পিস বেশ ভালো লাগে মায়ার৷ সামনে গিয়ে স্পর্শ করে সে শো-পিসটাকে। দুদিন পর আজ আহান বাসায় এসেছে। সব এইচএসসি পরিক্ষার্থীদের সাজেক ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। জার্নি করার ফলে বেশ টায়ার্ড হয়েই বাসায় ফেরে আহান৷ এসেই সোজা নিজের রুমে চলে আসে। কারোর আসার আওয়াজ পেয়ে মায়া তড়িঘড়ি করে শো-পিসটা যথাস্থানে রাখতে গিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। যার ফলে সেটা ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যায়। রুমের ভেতর কিছু একটা ভাঙার শব্দ পেয়ে আহান তাড়াতাড়ি করে ভেতর আসে৷ এসে দেখে তার প্রিয় শো-পিসটা মেঝেতে পড়ে রয়েছে আর সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। রাগে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে আহান। এরপর তাড়াতাড়ি করে মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে গর্জে ওঠে।
–হু দ্য হেল আর ইউ?
চেচিয়ে বলার কারণে মায়া কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। এর আগে কখনোই কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। ভয়ে এক প্রকার জড়োসড়ো হয়ে গেছে মায়া। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকালেও তার হাত পা প্রচন্ড রকমের কাঁপছে। মায়াকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে আহান পুনরায় চেচিয়ে বলে….
–টেল মি ইউ ইডিয়ট!
আহানের চেচামেচি শুনে মিতুল আহমেদ দৌঁড়ে ওর রুমে আসে সাথে আশাও। মিতুল আহমেদ গিয়ে আহানের হাত থেকে মায়ার হাতটা ছাড়িয়ে এনে নিজের আড়াল করে মায়াকে। আশাও তার মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলের এমন রাগ দেখে মিতুল আহমেদ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং জানিয়ে দেন এখন থেকে মায়া এই বাড়িতেই থাকবে। মায়ের কথা শুনে আহান আড়চোখে একবার মায়ার দিকে তাকায়। ভয়ে মেয়েটা এখনো জড়োসড়ো হয়ে এখনো মিতুল আহমেদের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তে মায়াকে একটা জোকার ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না আহানের কাছে৷ কালো রঙের একটা ঢিলাঢালা গোল জামা পড়েছে, মুখে কোনো প্রসাধনী ব্যবহার নেই আর চুল গুলো দুই বেনী করে রাখা৷ কিছু সময় পর আহানের রাগ কমে এলে সে একবার মায়ার দিকে তাকায় তারপর তার মাম্মাকে বলে….
–এই জোকারকে যেন আমি আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।
সেদিনের পর থেকে মায়া ভুল করেও আহানের সামনে যায় না। যখন আহান বাড়িতে না থাকে তখন তার অগোছালো রুমটাকে গুছিয়ে দিতে চেষ্টা করে৷ আহান সবসময় মায়াকে হেয় করার চেষ্টা করে। তারপরও মায়া আহানের জন্য একটা আলাদা টান অনুভব করে। অষ্টাদশী কন্যার মনে এক নতুন অনুভূতি, নতুন আবেগ দোলা দিয়ে যায়। আহানকে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে তার বেশ ভালোই লাগে। মায়া এখানে এসেছে প্রায় ছয় মাস হতে চললো মিতুল আহমেদ হয়তো কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন তাই তিনি উনার ভাইকে কল করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উনাদের বাড়িতে চলে আসতে বলেন। জরুরি তলব পেয়ে মায়ার বাবা মাহবুব আলম ছুটে আসেন বোনের বাসায়। মায়া কলেজ থেকে ফিরে তার বাবাকে দেখে মায়া খুশিতে দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। মায়ার ছেলেমানুষী দেখে মাহবুব আলম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। সেদিন রাতটা মাহবুব আলম বোনের বাসায় থেকে যায়। মিতুল আহমেদ নিজের হাতে ভাইয়ের পছন্দের সকল খাবার রান্না করেন। মায়া তার ফুপিমণিকে নিজের মতো করে সাহায্য করতে থাকে। ডাইনিং টেবিলে সবাই একসঙ্গে খাবার খেতে বসে৷ মিতুল আহমেদ আর মায়া সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে থাকে। বাড়িতে আজ মায়ার বাবা এসেছেন বলে আহান চুপচাপ মায়ার বেড়ে দেওয়া তরকারিটা খেয়ে নেয়৷ অন্য সময় হলে হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতো। মাহবুব আলমকে দেখে নিজের রাগ সংযত করে রেখেছে আহান। তার মামাকে সে সবসময় সম্মান করে তবে কোনো এক অজানা কারণে মায়াকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। আহানের এই শান্ত থাকাটায় মায়া মনে করে, হয়তো সে আর তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। খাওয়া দাওয়ার পর যে যার রুমে চলে যায়। আহান রুমে এসে নিজের রাগকে আর সংযত করতে না পেরে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মা’রে। মিতুল আহমেদ আর উনার স্বামী আশরাফ আহমেদ যান মাহবুব আলমের জন্য রাখা বরাদ্দকৃত রুমে এবং কিছু একটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন।
চলবে?…….