মোহ মুক্তি ~ ১১
লেখা : Azyah(সূচনা)
“মজা করছেন রাত বিরাতে?আপনার কি সমস্যা আমার সাথে বলেনতো?ঠিক মত কথা বলেন না!এড়িয়ে যান। সবসময় ভালো লাগে এসব?মনে হচ্ছে রোবটের সাথে বসবাস করছি আমি।আমি ফ্রি হওয়ার চেষ্ঠা করছি!বুঝতে পারছেন না?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে আছেন?আপনি এমন কেনো?”
কাক ডাকা ভোরে অরণ্যের রক্তিম চোখ জোড়া সন্ধ্যাতে আবদ্ধ। এইমাত্র এতগুলো প্রশ্ন সন্ধ্যার পানে ছুঁড়ে মুখ শক্ত করে আছে।নিজের অব্যাক্ত চেষ্টাকে আজ মুখ ফুটে বলেই দিলো। সন্ধ্যার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা আজ চোখে এবং মুখে উভয়েই প্রকাশ্য।
সন্ধ্যা তার চোখে চোখ রেখে বললো, “আমার সাথে আপনার কিসের কথা?”
কপালে রগ ফুটে উঠেছে।হাত অনেকক্ষন যাবৎ মুঠ করে রেখেছে অরণ্য।বললো,
“কিসের কথা?আমাদের সম্পর্কটা ভুলে গেছেন?সম্পর্ক বাদ দেন।একসাথে থাকলে অন্তত বন্ধুত্ব করা যায়।সেটাও দেখছি আপনার দ্বারা হবে না”
“সবাইকে বন্ধু বানানো যায় না।”
“আপনার খুব এটিটিউড বুঝলেন!অনেক ইগো আপনার।”
“কোনো ইগো নেই আমার।কি বললেন আপনি?আপনার আর আমার সম্পর্ক?প্রথমদিন যে পর্দা টেনে দিয়েছেন আমাদের মাঝে।সেই পর্দা রক্ষা করছি আমি।তাছারাও আপনার কেনো সমস্যা হচ্ছে?”
ব্যাকুল হয়ে উঠে অরণ্য।গলা নামিয়ে বলে, “কারণ আমার অসস্তি বোধ হয়।একই ছাদের নিচে থেকে এমন অচেনার মতন ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারছি না।”
হাসতে দেখা গেলো সন্ধ্যাকে। বাকা হাসি,তাচ্ছিল্যের হাসি!অবাক চোখে চেয়ে আছে অরণ্য সন্ধ্যার দিকে।এই প্রথম বোধহয় তার সামনে হেসেছে।তার জন্য হেসেছে।হোক সেটা তুচ্ছ হাসি।
সন্ধ্যা বললো, “শোনেন!আমার মধ্যে কোনো ইগো নেই।আমি একা থাকতে পছন্দ করি।আমার কারো সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয়না।এক কথায় হাজারটা কথা আসে।এত ধৈর্য্য আমার নেই।আমার ব্যক্তিত্ব এটাই।আর আপনার সাথে সেটা আরো আগে নেই।আপনার আমার সম্পর্ক সবার চোখে স্বামী স্ত্রীর হলেও আমার কাছে আপনি একজন মানুষ। ব্যাস!এতটুকুই।”
বলে বালিশ হাতে উঠে দাড়ায় সন্ধ্যা।অরণ্যের অফিস যেতে এখনও অনেকটা সময় বাকি।এই সময়টুকু জমিনে ঘুমিয়ে নেবে। এতে তার কোনো সমস্যা নেই।অরণ্য নরম সুরে ডাকলো,
“সন্ধ্যা”
প্রথমবার অরণ্যের মুখে নিজের নাম শুনে থেমে যায় সন্ধ্যা। মুহুর্তেই অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হানা দিচ্ছে অনেক বছরের তালাবদ্ধ হৃদয়ে। অন্ধকার দূর করতে সূর্যের এক চিলতে রশ্মিই যথেষ্ট।ঠিক তেমন ডাকটা।কারো মুখে নাম ধরে ডাক শুনলেও বুঝি এমন অধীর হয়ে উঠে কেউ?তবে সে নিজেকে সামলাতে জানে।চোখ শক্ত করে বুঝে জোরে শ্বাস টেনে নেয়।ঘুরে তাকায় অরণ্যের দিকে।আকুতি ভরা চোখ আর মুখে গ্লানির ছাপ স্পষ্ট। কোকড়ানো চুলগুলো সামনে ঝুঁকে আছে তার। চোখ ছোট করে বললো,
“আমার সাথে কথা বলা যায় না?”
“যায়তো।”
“তাহলে বলেন না কেনো?”
“প্রয়োজন হলেতো বলিই”
“প্রয়োজন ছাড়া?”
“সবকিছুরই প্রয়োজনের প্রয়োজন”
___
অরণ্য বিনাবাক্যে বেরিয়ে গেছে অফিসের উদ্দেশ্যে। নাস্তা না করেই।সন্ধ্যা উঠে তাকে দেখতে পায়নি।আজ পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করতো সে।আজ কিনা অরণ্য?তার এই কাজ ভাবনার বিষয়। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ধরে দাড়িয়ে ভাবছে সন্ধ্যা।রাতে এতটা কঠিন শব্দ না শোনালেও হতো।রেগে না খেয়ে চলে যাওয়ার দায়ভার কে বহন করবে? দুপুরের খাবারটাও নেয়নি।তার বদলে যাওয়া স্বভাব বেশ ভাবাচ্ছে।আর গতরাতের কথাগুলো?ফ্রিজ খুলে দেখতেই আশ্চর্য্য তার চরম সীমা অতিক্রম করেছে। বেলী ফুলের মালা! হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে নেয়।মোটামুটি তাজা আছে।এটা এখানে কিভাবে এলো?রেহানা খালাকে জিজ্ঞেস করলে সে আনেননি জানিয়ে দিলেন।তাহলে অরণ্য? মালা জায়গারটা জায়গায় রেখে দিলো সন্ধ্যা।যদি অরণ্য এনেও থাকে তাহলে অবশ্যই সেটা তার জন্য না।
যথাসময়ে বাড়ি ফিরলেও চালচলন পূর্বের ন্যায় নয়। মুখটা একদম রুক্ষ শুষ্ক করে আছে অরণ্য। সন্ধ্যার সাথে তেমন কথা হয়না।এ কদিন যতোটুকু বলেছে সেটাও আজ হয়তো বন্ধ করে দিলো।দেখেও না দেখার ভান করে বিগত ত্রিশ মিনিট যাবৎ ঘরবন্দী। সন্ধ্যা চা হালকা আচে চুলোয় বসিয়ে রেখেছে।দেখে বোঝাই যাচ্ছে মাথা গরম।চা না পেলে আবার গর্জন তুলবে।খট করে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দ্রুত কাপে চা ঢেলে নেয় সন্ধ্যা।ভুলবশত গরম চা হাতে পড়েছে।সেখানে তোয়াক্কা না করেই দৌড়ে গেলো।আজ রেহানা খালা দুপুরেই চলে গেছেন। ব্যাথাকাতর মুখ।অরণ্যকে বুঝতে দিতে চায়না বলে নিজেকে সামলায়।চায়ের কাপ এগিয়ে দিলে অরণ্য মাথা তুলে তাকায়। চুপচাপ কাপ হাতে নিয়ে এক চুমুক দিতে গিয়েও দিলো না।চায়ের কাপ শব্দ করে টেবিলে রেখে বললো,
“হাতে কি হয়েছে আপনার?”
মুখভঙ্গিমা স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল,”চা পড়েছে”
অরণ্য এর গোমড়া মুখ চিন্তায় পরিণত হয়।সামান্য বিচলিত হয়ে গলা উচিয়ে জিজ্ঞেসা করলো,
“গরম চা!”
“হ্যাঁ”
“আপনি কি পাগল?গরম চা পড়েছে এটা এত সুন্দর করে বলছেন কিভাবে আপনি?”
“বেশি লাগেনি”
“চুপ থাকেন!”
সন্ধ্যার চিন্তার বাইরে তার হাত টেনে নিয়ে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে পানির নিচে হাত ধরে রেখেছে। নিজের হাতটাও ভেজাচ্ছে।
“কি করছেন!বললাম বেশি লাগেনি আমার”
“গরম চা কোনো যেনোতেনো কথা না সন্ধ্যা। খবরদার পানির নিচ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করেছেনতো!”
“আমার হাত যতটা না পুড়েছে এরচেয়ে বেশি চেপে রেখে আপনি ব্যাথা দিচ্ছেন”
অনেক শক্ত করে চেপে ধরেছিলো হাত।বুঝতে পেরে হাত ছেড়ে দেয় অরণ্য। ঘাবড়িয়ে গিয়ে খেয়ালই করা হয়নি সে ব্যথা দিচ্ছে সন্ধ্যাকে।একহাত ছেড়ে অন্যহাত চেপে ধরে।টেনে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।গোলগোল চোঁখে চেয়ে আছে অরণ্যের দিকে সন্ধ্যা।এমন করার কোনো অর্থ আছে? বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আঙ্গুল তুলে খবরদারি করলো অরণ্য।
বললো, “উঠবেন না। বার্ণল ক্রিম কোথায় দেখছি। ক্রিম লাগিয়ে তারপর আপনার ছুটি হবে”
এক পা ভাঁজ করে বসে আছে অরণ্য।মাথাটা নিচু করে। গভীর মনোযোগী হাতে ক্রিম লাগাতে।প্রথমে সন্ধ্যাকেই ক্রিমটি এগিয়ে দিয়েছিল নিজে নিজে লাগিয়ে নিতে। পরক্ষনেই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন আনে।তার মতে সন্ধ্যা এই কাজের অযোগ্য।পারবে না করতে।তাই নিজেই এই দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়।সামনে বসে সন্ধ্যা। পলকহীন আখি। দৃষ্টি বিভ্রম।চোখের সামনে বদলে যাওয়া একটা মানুষ!মায়া দেখাচ্ছে তার প্রতি?না সহানুভূতি?নাকি অন্যকিছু?
ধ্যানে ফিরে সন্ধ্যা বললো,
“ফ্রিজে বেলী ফুলের মালাটা আপনি এনেছেন?”
অরণ্যের হাত অল্প সময়ের জন্যে থমকায়।তাহলে সন্ধ্যার চোখে পড়েছে। বিভ্রান্তি কাটাতে ছোট করে বললো, “হুম”
“বেলী ফুল বেশিদিন রাখলে নষ্ট হয়ে যায়।ফুলগুলো কোনো দরকারে এনেছিলেন?”
বোকার মতন প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায় অরণ্য।সন্ধ্যা তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,
“না মানে আপনার প্রয়োজন না হলে ফেলে নেই।অর্ধেক প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে”
হতভম্ব হয়ে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে রইল অরণ্য।শখ করে এনেছিল তার জন্য?সে ফেলে দেওয়ার কথা বলছে? এতটাও নির্বোধ মনে হয়না তাকে।যে এটাই বুঝবে না মালা কেনো এবং কার জন্য আনা হয়েছে।বুঝদার মানুষের মুখে অবুঝের মতন প্রশ্ন বেমানান।
অরণ্যও তার কথার বিপরীতে বলে ফেললো, “ফেলে দেন নাহয় যা ইচ্ছে করেন।”
__
“কোথায় তুই?”
“আসছি”
“দ্রুত আয় এখানে সব রেডি”
ফোন কাধে গুজে হাত চালাচ্ছে অরণ্য আর কথা বলছে আবিদের সাথে।আজ তাদের রওনা হওয়ার দিন। ব্যস্ততায় শুধু ছোট করে উত্তর দেয় অরণ্য,
“হুম ঠিক আছে”
আবিদের জড়াজড়িতে ট্রিপে যেতে বাধ্য হয় অরণ্য।ট্রিপের সকল দায়িত্বে যারা আছে তার মধ্যে একজন না গেলে কেমন দেখায়?একবিন্দু ইচ্ছে ছিলো না তার।মূল কারণ সন্ধ্যা।আজকাল তাকে আড়াল থেকে টেনে হিচড়ে বের করে নিজের সামনে রাখতে ইচ্ছে হয়।রাতের বাস। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে অরণ্য।দুদিনের ট্রিপে অত কিছু প্রয়োজন নেই তারপরও অল্প অল্প করে এক লাগেজ ভর্তি হয়ে গেছে।সাথে একটি কাধ ব্যাগ। গোছগাছ করার সময়ও মনটা আনচান করছে। সাধ্যের মধ্যে থাকলে এখনই ক্যানসেল করে দিতো ট্রিপ।সবশেষে ভেজাল বাঁধলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসে। কাপড়ের স্তুপে মানি ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছে না। আধ ঘন্টার মধ্যে বেরোতে হবে।পুরো বিছানা,আলমারি তন্ন তন্ন করেও পেলো না। অগ্যতা এগিয়ে গেলো ডাইনিং রুমের দিকে।আজ রাতটা রেহানা খালা থাকবে সন্ধ্যার সাথে।সকালেই সে তার বাড়ি চলে যাবে বাবার সাথে। ডাইনিং রুমে গিয়ে দাড়াতেই সন্ধ্যার হাসির শব্দ শোনা গেলো।রেহানা খালার সাথে কোনো বিষয়ে ঠিক সেদিনের মতনই হাসছে।আজ হাসির জোর বেশি।এটা খুবই অবাক করার মতন বিষয়।অরণ্য তাদের সামনে গিয়ে দাড়ায়। রেহানা খালার দিকে তাকাতেই সে রান্নাঘরে চলে যায়।হুট করে সন্ধ্যার হাত চেপে ঘরে টেনে নিয়ে এলো অরণ্য।দরজা বন্ধ করে ঠিক তার মুখ বরাবর দাড় করিয়েছে।
রাগী গলায় বললো, “খালার সাথে এত কি হাসি আপনার শুনি?”
“হাসির কি আছে মানে?এটা কেমন প্রশ্ন?”
“কেমন প্রশ্ন?কই আমাকে দেখে,আমার সাথে কোনোদিন হাসতে দেখিনিতো!”
“আপনার সাথে হাসার কোনো কারণ আছে?”
“সেটা থাকবে কেনো?আমি দুদিনের জন্য যাচ্ছি।বাড়ি যাবেন। ফ্যামিলিকে সময় দিবেন। স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবেন তাই এত খুশি তাই না?”
“কিসব আবোল তাবোল বলছেন আপনি?”
“সত্যিই বলছি।আমার সামনে এই হাসি কোথায় থাকে?আমার সামনে মূর্তি হয়ে থাকেন!”
একের পর এক ভিত্তিহীন কথা বলে যাচ্ছে অরণ্য।তার হাসি এতটাই বিষাদ করে দিলো তাকে?রেগে যেতে বাধ্য করলো?এখন কি তার এই সামান্য হাসিতেও বাঁধা প্রদান করা হবে?
“আপনার দেরি হচ্ছে”
“আপনি কি মানুষ?হাসতে জানেন না?কাদতে জানেন? সেটাও হয়তো জানেন না।কোনো ইমোশন নেই আপনার?কষ্ট হয় না আপনার?এত স্বাভাবিক কি করে থাকেন আপনি?আপনি আসলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার অন্তরালে একজন অস্বাভাবিক মানুষ!”
ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে সন্ধ্যা।ঠিক অরণ্যের চোখে চোখ রেখে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাড়িয়ে সবটা কথা শুনলো তার। ঢোক গিলে উত্তর দিলো,
“আমি কাদলে ভেঙে গুড়িয়ে যাবো।অভিযোগ করবো,অভিমান করবো।অধিকার চেয়ে বসবো।আমাকে কাদতে বাধ্য করবেন না।আমার তিলেতিলে গড়ে তোলা এই শক্ত স্তম্ভ নাড়ানোর চেষ্টা করবেন না।আমাকে আমার মতন অনুভূতিহীন থাকতে দেন।”
চলবে..