মোহ মুক্তি ~ ২
লেখা : Azyah(সূচনা)
ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলের তাগিদে ব্যস্ত নগরী ঢাকায় পাঠিয়েছিলো তাকে।সে এই ঢাকাকেই আপন করে নিয়েছে।অথচ জাহানারা বেগম এবং মারুফ মোর্শেদ সাহেবের মন অর্ধ পাকা রাস্তায় বেশি টানে।উচু দালানে আয়েশ করে থাকার থেকে টিনের ঘরটা তাদের বেশি প্রিয়। জিবনদশায় ছেলের সমস্ত ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিয়েও জীবনসঙ্গী বাছার ক্ষেত্রে তার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।অবশ্য অরণ্যের অনিচ্ছা থাকা সত্বেও বাবা মার আবদার মেনে নিয়েছে।মনে আশা ছিল বাবা মা তার জন্য ভালোটাই করবে।দুর্ভাগ্যবশত এই “ভালোটাই করবে” জীবনে কাল হতে চলেছে। আঁধারে ঢেকে দিচ্ছে তাকে।
“আন্টি?”
কোনো উত্তর দিলেন না জাহানারা বেগম।নিজের মতন কাপড় গোছাচ্ছেন।ডাকটা না শোনার মতন ছিলো না।তারপরও কোনো প্রতিক্রিয়া দিলেন না?রেগে নয়তো? সন্ধ্যার চিন্তা হলো।ঘরে ঢুকে সামনে বসে পড়লো।
পূনরায় ডাকলো,
“আন্টি?”
“কে আন্টি?”
“কেনো আপনি?”
“বিয়ে হয়েছে তোমার। শ্বাশুড়ি হই আমি। মা বলে ডাকবে।”
“জ্বি আচ্ছা”
“কিছু বলবে?”
“আজ না গেলে হয় না?আমি এবাড়িতে এসেছি পুরো একদিনও হয়নি।কিছুই জানি না,বুঝি না।এত দ্রুত চলে যাচ্ছেন।কি করে সামলাবো?”
জাহানারা বেগম খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন, “প্রথমদিন থেকে যে একা যুদ্ধ করে বেচেঁ থাকে।সেই আসল যোদ্ধা।আর সেই জয়ী।আমি জানি তুমি পারবে।নাহয় আমি নিজে থেকেই এখানে রয়ে যেতাম।”
__
বাবা মাকে বাসে তুলে দিতে গেছে অরণ্য।সেই সুযোগে সন্ধ্যা পুরো ঘরটা গোছানোর জন্যে উদ্যত হলো।বেশ এলোমেলো হয়ে আছে।এক এক করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ভয়ে! দ্বিধায়।পুরো ঘরটা পরিপাটি করে বেরোতেই কলিং বেল বেজে উঠে। বোধহয় অরণ্য এসেছে।সন্ধ্যা দরজা খুলে দাড়ালে ভাজ পড়ে তার কপালে।মুখটা কেনো জেনো অসহ্যকর লাগে তার কাছে।আজ থেকে প্রতিদিন দেখতে হবে?মনটা তেতে উঠলো এই ভেবে। সন্ধ্যাকে এড়িয়ে সরাসরি ঘরে চলে গেছে।ঘরে প্রবেশ করেই চারিপাশে চোখ বুলায়।সাজানো গোছানো।অথচ দমবন্ধকর লাগছে।কেননা যে এতটা সাজিয়েছে তাকে মোটেও পছন্দ নয় অরণ্যের।
অহেতুক চিৎকার করে উঠলো, “এগুলো কে করেছে!”
সন্ধ্যা দৌড়ে এলো।দরজা থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে।বুঝে উঠতে পারছে না রেগে যাওয়ার কারণ কি?অরণ্যকে পর্যবেক্ষণ করে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো,
“কোনগুলোর কথা বলছেন?”
ঘুরে তাকায় অরণ্য। চোখজোড়ায় রাগ। কোমরে দুইহাত রেখে প্রশ্ন করে,
“ঘর কে গুছিয়েছে? কাল আমার অনুমতিবিহীন আমার আলমারি পর্যন্ত খুলেননি।আজ নিজে থেকে আমার সব জিনিস স্পর্শ করেছেন?তাও আবার নিজের মতন করে?বাবা মা চলে যাওয়ার পর দাবি খাটাতে এসেছেন?”
সন্ধ্যার চোখজোড়া বিস্মিত। ঘর গোছানো আর অধিকার খাটানোতে বিরাট তফাৎ।এই তফাৎএই গড়মিল হয়ে যাচ্ছে।খুব সাধারণ একটি কাজ করেছে সে।এতে রেগে যাওয়ার কোনো মানে নেই।অথচ সন্ধ্যা নিজের স্বভাব বজায় রেখে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে বললো,
“এলোমেলো হয়ে ছিলো।ভাবলাম আপনি ঘরে নেই গুছিয়ে রাখি।…আচ্ছা নেক্সট টাইম আর হবে না।আপনি কিছু মনে করবেন না।প্রথম ভুল বলে ক্ষমা করে দেন।”
“আমার জীবনের প্রথম ভুল আপনি!”
“জ্বি”
বলে চলে গেলো সন্ধ্যা।এই ঘরের কোনোকিছুই নিজের মনে হয় না। ড্রয়িং রুমে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে দাড়িয়ে। বসবে?যদি সে এটাও বলে বসে এখানে আপনার বসার অধিকার নেই?দাড়িয়ে রইলো।বড়বড় চোখ মেলে পুরো ঘরটা দেখে নিচ্ছে।হুট করে মনে পড়লো ক্ষুদা পেয়েছে।সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি।মানুষ সে!ক্ষুদা অনুভব করে।তবে এখানেও সংকোচ।অল্পসময়ের ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে পা বাড়ালো ঘরে।
“আপনি দুপুরে কি খাবেন?”
“বাহির থেকে খেয়ে এসেছি আমি”
“ওহ! আর রাতে?”
“যা ইচ্ছে করেন গিয়ে।”
“ঠিক আছে”
যা ইচ্ছে করেন গিয়ে কথাটিকে এক ধরনের সম্মতি হিসেবে নিয়েছে সন্ধ্যা।অন্তত রান্নাটা করতে পারবে কিচেনে গিয়ে। জাহানারা বেগম যাওয়ার আগেই কিচেনের কোথায় কি রাখা দেখিয়ে গেছেন।কষ্ট হলো না খুঁজতে আর।কিচেনে গিয়েই মাছ বের করেছে।যেহেতু যা ইচ্ছে করতে বলা হয়েছে মাছের ঝোল করবে সিদ্ধান্ত নেয়। ভাত বসিয়ে মাছ রান্না শেষ করলো প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে।রান্না করলো ঠিকই কিন্তু নিজে খাবে না। ভাতের প্রতি অরুচি তার অনেকদিন।ঠিকমতো খায় না।খেতে ইচ্ছে হয়না।খাবারে অনীহা তাকে রোগা পাতলা দেহের অধিকারী বানিয়েছে।তার দরকার এককাপ চা।চায়ের সাথে রুটি।সকালে তৈরি রুটি আর চা বানিয়ে মিনিট পাঁচেক পর ঘরে ফিরে এসে দেখলো অরণ্য ঘুমিয়ে পড়েছে।আলতো পায়ে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে বসে।
অরণ্যের ঘুম ভেঙেছে সন্ধ্যা সাতটায়।চোখ খুলে মাথার উপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে চোখ যায়।কিছুসময় চেয়ে উঠে দাড়ালো।মাথাটা আজ যন্ত্রণা করছে।চা খাবে।মাকে ডাকতে গিয়েও আটকে গেলো। মাতো সকালেই চলে গেছে।কেমন যেনো মা?অল্পদিন এসে কাছে থাকে।বছর খানেক এর অভ্যাস করে দিয়ে যায়।হুট করে মনে পড়লো আরো একজন আছে এখন বাসায়।নিজে বানিয়ে খাবে তারপরও তাকে বলবে না।বাড়িতে যিনি রান্না করেন তিনিও আসছেন না কিছুদিন যাবত।নতুন মানুষ খুঁজতে হবে। ডাইনিং পেরিয়ে কিচেনের দিকে এগোতে পা আটকে গেলো।টেবিলে চা আর বিস্কুট সাজানো।খানিকটা অবাক হলো অরণ্য। ধোঁয়া ওড়ানো চা।মাত্রই বানানো হয়েছে বোধহয়।
কিচেন থেকে সন্ধ্যা বেরিয়ে বললো,
“চা নাস্তা টেবিলে রাখা আছে।আপনি ইচ্ছে হলে খেয়ে নিবেন”
পা বাড়িয়েছে অরণ্যের সামনে থেকে চলে যাওয়ার উদ্দেশে।সে থামিয়ে বলল, “আপনি জানলেন কি করে?”
“আপনার মা বলে গেছেন।অফিস থেকে ফিরে আপনি এই সময় চা খান।”
স্বাভাবিক সংক্ষিপ্ত সুরে উত্তর আসলো, “ওহ”
অফিসের কাজগুলো সেরে নিচ্ছে অরণ্য। মনোযোগ সম্পুর্ণ কাগজ – পত্রের দিকে।মুখের ভাবসাব বিরক্তিকর।হয়তো কাজের কোনো ঝামেলায় আটকে সবকিছু এলোমেলো করে রেখেছে।সামনেই জমিনে বসা সন্ধ্যা।লাগেজ থেকে এক এক করে তার জিনিস বের করে একপাশে রাখছে।বেশ শব্দও করে একবক্স চুড়ি হাত ফসকে পড়ে ছড়িয়ে পরে।সঙ্গেসঙ্গে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো অরণ্য।
ধমকের সুরে বলে উঠে, “দেখছেন না কাজ করছি?কমন সেন্স নেই আপনার?কাজ করছেন নিঃশব্দে করা যায় না সেটা? টুকটাক আওয়াজ করেই যাচ্ছেন সেই কখন থেকে!”
চুড়িগুলো জমিন থেকে তুলতে তুলতে সন্ধ্যা উত্তর দেয়, “আই অ্যাম রিয়েলি সরি”
__
মাত্রই ভাত আর তরকারি প্লেটে তুলে নিয়েছে। গোমড়া মুখে!বরাবর নিশ্চুপ দাড়িয়ে সন্ধ্যা। বসার অনুমতি পায়নি।ভাত মুখে পুড়ে নিয়ে বিচিত্র মুখ বানালো অরণ্য।কপাল অত্যাধিক কুচকে দিয়েছে।খাবার মুখ থেকে ফেলে গটগট করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নাক টেনে বলে,
“এটা তরকারি? তরকারিতে মরিচ দিয়েছেন নাকি মরিচে তরকারি?”
“ঝাল বেশি হয়ে গেছে?”
“বেশি? সিরিয়াসলি?আপনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন না?আমি আপনাকে মেনে নেইনি, ধমকেছি।সবকিছুর প্রতিশোধ নিচ্ছেন!”
“এমন কিছুই নয়”
“এত ভদ্র আর ভালো সাজবেন না।উপরেউপরে ভালো সেজে এভাবে আমাকে ঝাল খাবার খাওয়ালেন। সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না।তাই না?”
“আমি ঝাল বেশি খাই।আমার আন্দাজ মতো দিয়েছি।ভুল হয়ে গেছে আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো ”
মুখে নেই কোনো ভয়,নেই কোনো সংকোচ।অনুশোচনাবোধটুকু নেই।শক্ত পাষাণ মুখখানা।সন্ধ্যার অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অরন্যের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।সে কি মানুষ?নাকি রোবট?মানুষ পরিস্থিতি সাপেক্ষে রিয়েক্ট করে।আর সে?
“আপনার টেস্ট অনুযায়ী খাবার খেতে হবে আমাকে আজকাল?”
সন্ধ্যা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, “নেক্সট টাইম থেকে খেয়াল রাখবো।”
খাবার প্লেট দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে গেলো অরণ্য।আজ বোধহয় রাতের খাবারটা কপালে নেই।তার চেয়ে দুর্ভাগ্য এই মেয়ে।যাকে বিয়ে করে নিজের বউ বানিয়েছে।তার চেয়ে অদ্ভুত সে! অদ্ভুত! আশ্চর্য্য!
__
“আন্টি আমাকে বলবেন উনি কতটুকু ঝাল খান খাবারে?আজ রান্না করেছিলাম বেশি ঝাল হয়েছে বলে খেতে পারেননি। আন্দাজটা বলে দিন আমাকে।”
“তুমি আমাকে আবার আন্টি বলেছো?”
“সরি মা”
ফোনের অপরপ্রান্তে জাহানারা বেগম।মুচকি হাসলেন।বললেন,
“আমার ছেলে বেশি ঝাল খেতে পারে না বুঝলে।তুমি ঝাল খাও?”
“জ্বি”
“আচ্ছা ওর জন্য অল্প ঝাল দিয়ে আলাদা করে তুলে রাখবে।তারপর নিজের মনমতো ঝাল,মসলা দিয়ে নিবে।তাহলেই হলো।”
“সমস্যা নেই আমি কম ঝাল খাবার খেতে পারি”
জাহানারা বেগম দ্রুত উত্তর দিলেন, “তুমি তোমার স্বামীর জন্য পছন্দকে ত্যাগ করছো।তোমার স্বামীকেও তাহলে ঝাল খাওয়া শিখাও।সম্পর্কে দুজন সমানসমান হওয়া উচিত”
“কিসের সম্পর্ক মা?”
জাহানারা বেগমের কন্ঠস্বর থেমে গেলো।ফোনের অন্যপাশে চোখটাও নেমে এসেছে।মা ডাকটা মধুর লাগছে।অথচ প্রশ্নটা অনেক তিক্ত।নিজেকে অপরাধী মনে হতে শুরু করলো।মেয়েটার সাথে অন্যায় করে ফেললো নাতো সে? তারও হয়তো স্বপ্ন ছিল।স্বামীর সাথে একটা স্বাভাবিক সংসার এর।ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে সেই যোগ্য পাত্রীর জন্য অযোগ্য ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো নাতো?ছেলে হিসেবে কোনোদিনও অরণ্য অযোগ্য নয়।কিন্তু স্বামী হিসেবে?
হটাৎ সন্ধ্যা বললো, “আপনি চিন্তা করবেন না।আমি এদিকটা সামলে নিবো। মাঝেমধ্যে!… নাহ প্রতি সপ্তাহে আসবেন।”
“যেদিন তোমাদের একটা মজবুত সংসার হবে তখন আসবো।এর আগে আসবো না”
“কিন্তু….”
“কোনো কিন্তু না।যাও আমার ছেলের কিছু লাগবে কিনা দেখো ”
গভীর রাত,
সম্পূর্ণ রুম অন্ধকারে ঢাকা। বিদঘুটে অন্ধকার।কিচ্ছুটি দেখার কায়দা নেই।বারান্দার ঠিক পাশটায় শুয়ে সন্ধ্যা।জমিনে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।নিজেকে সবকিছুতে মানিয়ে নিলেও যেনো অন্ধকারে মানিয়ে নিতে পারেনা।ভয় করে।গতরাতে মরিচা বাতির আলোতে ঘরের অন্ধকার কেটে গেলেও আজ সেটা নেই।ভয়টা বেশি ভর করার আগেই উঠে দাড়ায় সন্ধ্যা।মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে বিছানা নিয়ে যায় ঠিক বেডের পাশে। এককাত হয়ে শুয়ে আছে অরণ্য।এপাশ থেকে অরণ্যকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিশ্চিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
কাচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো শব্দে। পুরুষালী শব্দ। আর্তনাদের! তৎক্ষনাৎ উঠে হাতড়ে লাইট জ্বালিয়েছে সন্ধ্যা।নিচে চেয়ে দেখলো অরণ্য বসে আছে মাটিতে।পা ধরে। ব্যথায় কাতর চেহারা।
লাইট জ্বলে উঠায় সন্ধ্যার দিকে চেয়ে উচ্চস্বরে বললো,
“আপনি এখানে কি করছেন!আপনার জন্য বোধহয় আমার পা-টা ভাঙলো!”
“কিন্তু আপনি ব্যথা পেলেন কি করে?”
“এখানে এসে শুয়েছেন কেনো?আমি নিচে নামতে গিয়ে পড়ে গেছি আপনার গায়ে ধাক্কা লেগে।কি করছিলেন এদিকে?আমার কাছাকাছি এসে …”
“আমার ভয় করছিলো তাই এপাশটায় শুয়েছি এসে।ভেবেছিলাম আপনি আছেন।এটা ভেবে ভয় কেটে যাবে”
চলবে..