মোহ মুক্তি ~ ৪
লেখা : Azyah(সূচনা)
“সরি”
সরি শুনে প্রথম সন্ধ্যার মুখে প্রতিক্রিয়া দেখতে পায় অরণ্য।অবাক! আশ্চর্য্য!বুঝে উঠতে পারেনি হয়তো কেনো সরি বলছে।প্রশ্ন করার আগেই অরণ্য বলে উঠে,
“আমি জানি আমাদের সম্পর্ক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতন কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না।তবে আপনার প্রতি যে দায়িত্ব আছে সেটা আমি পালন করবো।কিন্তু আপনার সাথে যে খারাপ ব্যবহারটা করেছি সেটা ঠিক হয়নি।তাই সরি বলছি।”
“জ্বি ঠিক আছে” বলে বেরিয়ে যায় সন্ধ্যা।
“আরেকটা কথা”
“হ্যা?”
“নিচে ঘুমোতে সমস্যা হলে… মানে বেডেই ঘুমাতে পারেন।”
“আমার নিচে শুতে কোনো সমস্যা নেই।অভ্যাস আছে।বাসায় মেহমান আসলে অনেক ঘুমিয়েছি মাটিতে”
“এখন এখানে কোনো মেহমান নেই।আর নিচে ঘুমোলে ঠান্ডা লাগবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।দিনশেষে দোষ আমাকেই দেবে সবাই।”
“ঠিক আছে”
“কি ঠিক আছে?”
“বেডেই ঘুমোবো।”
__
মোবাইলের স্ক্রিনে “হীন” নামক পেজটা জ্বলজ্বল করছে।কি বোর্ডে হাত চলছে সন্ধ্যার।কিছু সংখ্যক মানুষ তার লেখার অপেক্ষায়।আজ কি নতুন বাক্য লিখতে যাচ্ছে সে? সন্ধ্যাতো প্রতি সন্ধ্যাবেলায় নিজের মনের ভাব একবাক্যে এখানটায় প্রকাশ করে।আর মানুষ সেটা খুব পছন্দও করে।
সন্ধ্যা লিখলো,
“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী হচ্ছে মানুষ,আর নিকৃষ্টও…”
__
সন্ধ্যা নিজের কাজে মগ্ন আর অরন্য দায়িত্ব পালনে।উভয়েই দায়িত্বের সংসার করছে।মুখ থেকে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে একে ওপরের প্রতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।অনেক ভুল করেও চেষ্ঠা করছে অরণ্যের কাজগুলো ঠিকঠাক করে দেয়ায়।সময়মতো রান্না করে তার মোটামুটি সব কাজেই হাত দিয়েছে সন্ধ্যা।অরণ্যের মুখশ্রীতে সহানুভূতির ছাপটুকু নেই।নির্বিকার, বাক্যহীন!একই ছাদের নিচে থাকা দুজন অপরিচিত মানুষের মতন একসাথে দিন পার করে যাচ্ছে।
ঘরে বসে কাপড় ইস্ত্রি করছে সন্ধ্যা।যথাসম্ভব দ্রুত হাত চালাচ্ছে। অরণ্যের বাড়ি ফেরার আগেই কাজ শেষ করতে হবে।অফিস শেষে ফিরে এসব দেখে নিশ্চয়ই রেগে যাবে।আজ ওভার টাইম অফিসে কাজ করতে হচ্ছে।এসেই খেতে বসবেন।এসব কাজ শেষে খাবার গরম করতে হবে।ভীষণ রকমের রেগে বাড়ি ফিরেছে অরণ্য।আজ অফিসে বেশ কয়েকটা মিটিং ছিলো।তারই মধ্যে বসের চড়া মেজাজ।সব মিলিয়ে বিদ্ধস্ত অবস্থা।দ্রুত বেগে অনবরত কলিং বেল চাপতে থাকলো।দৌড়ে আসে সন্ধ্যা।
দরজা খুলে দাড়াতেই সব মেজাজ এসে পড়লো তার উপর,
“দরজা খুলে সামনে দাড়িয়ে থাকেন কেনো?যত্তসব!”
ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল অরণ্য।অফিস ব্যাগ ফেলেছে বিছানায়। টাই খুলে জমিনে ছুঁড়ে দেয়।ওয়াশরুমে চলে যায়। সন্ধ্যা এসে তার ব্যাগ আর টাই তুলে ঠিক জায়গায় রেখে দিল।ঘরে পড়া কাপড় বের করে বেডের উপর রেখে বেরিয়ে গেলো টেবিলে খাবার সাজাতে।এমনেতেই তার মেজাজ ভালো নেই।অবশ্যই ক্ষুধার্থ হবে।খাবার দিতে দেরি হলে সেই জেদটাও সন্ধ্যার উপর দিয়েই যাবে।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে অরণ্য।বড়বড় কদম ফেলে ডাইনিং রুমে এসে টেবিলে বসে পড়লো।চাপ আর ক্ষুদা মিলে নাজেহাল অবস্থা তার।তার মুখশ্রীর অবস্থা দেখে দ্রুত হাত চালালো।এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।প্লেট এর আওয়াজে বরাবরের মতো ধমকে উঠে,
“কি সমস্যা আপনার?তরতর করছেন কেনো?আর আপনাকে কে বলেছে খাবার এগিয়ে দিতে আমাকে?আমার হাত নেই”
“এগিয়ে দিচ্ছিলাম যেনো আপনার অসুবিধে না হয়।”
“আমার সুবিধে অসুবিধের খেয়াল আপনার না করলেও চলবে।যেদিন থেকে বিয়েটা হয়েছে যন্ত্রণা দিয়েই যাচ্ছেন। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।খাবার টেবিলে মেস ক্রিয়েট করেন।ঘরেও আপনার জন্য শান্তি পাই না।সারাক্ষণ চোখের সামনে ঘুরে বেরান।আমাকে কি একটু একা শান্তিতে থাকতে দেবেন না?”
“সরি আর হবে না”
এক মুহুর্ত দাড়ায়নি সন্ধ্যা।সাথেসাথে নিশ্চুপ স্থান ত্যাগ করেছে।কারো বিরক্তির কারণ হতে চায়না সে।ইচ্ছাকৃত ভাবেতো কখনোই না।তারপরও হয়ে যায়।আজ জেনে গেলো তার আশেপাশে থাকাটাও অরণ্যের বিরক্তির কারণ।তাই সরে গেছে।
খাবার শেষ করে ঘরে ফিরতেই মায়ের ফোন।ফোনের দিকে চেয়ে ভাবলো ফোনটা কি তুলবে?পরক্ষনেই ভাবনা আসলো মায়ের সাথে রাগ করে লাভ নেই। অগ্যতা ফোন তুলে নেয়।
“হ্যালো”
“হ্যালো অরণ্য?”
“হ্যা মা বলো।”
“বৌমা কোথায় রে?”
“মা তুমি আমাকে কল করেছো কি ওর ব্যাপারে জানার জন্য?”
“আহহা রেগে যাস কেনো?আচ্ছা শোন”
“হুম”
“গতকাল রাতেই শয়ন এর বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়েছে।আগামী শুক্রবার বিয়ে।এসে পড়িস কিন্তু বৌমাকে নিয়ে।এটা বলার জন্যই কল করেছি”
“ভেবে দেখবো”
“অরণ্য!ভাবাভাবি বাদ দে।একদিন আগে চলে আসবি।”
মায়ের সাথে কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে।সরাসরি না করে দিলে মা সেটা শুনবে না। ফ্যামিলি প্রোগ্রাম কোনোকালেই অরণ্যের পছন্দ না।তার মধ্যে সন্ধ্যাকে নিয়ে? অসম্ভব!ফোন রেখে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিটে।অনেকটা রাত হয়ে এসেছে।শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। লাইট নেভাতে সুইচ বোর্ডে হাত দিয়েও থেমে যায় অরণ্য।সন্ধ্যা আসেনি এখনও ঘরে।দরজা দিয়ে উকি দিয়ে দেখলো পাশের রুমের বাতি জ্বালানো।সেই ঘরেই আছে হয়তো।প্রশ্ন জাগে অরণ্যের মনে ঘুমোতে আসবে না সে?নাকি সামনে আসতে না করায় রুম ত্যাগ করলো?তার উপর নাকি ভয়ও পায়! ঠোঁট কামড়ে একবার রুমের দিকে চেয়ে ভেবে নিলো।পরপর তোয়াক্কা না করেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে লাইট নিভিয়ে।
রাত যখন একটা, অনেকটা সাবধানতার সাথে পা ফেলে ঘরে এলো সন্ধ্যা।একা থাকা অসম্ভব।বাড়িতেও দাদীর সাথে ঘুমোতো সে। অরন্য যেনো বিরক্তবোধ না করে সেই উদ্দেশেই অন্য ঘরে বসে থাকা।মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে দেখে নিলো অরণ্য ঘুমিয়েছে কিনা।ধীরে সুস্থে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বেডটা অনেক বড়।অনায়াসে তিন চারজন ঘুমোনো যাবে।মাঝে গত কয়েকদিনের মতন কোলবালিশ রেখে অন্যপাশে ফিরে সন্ধ্যাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
__
সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে অরণ্যের।সপ্তাহের পাঁচদিন এই সময়টাই তার ঘুম ভাঙ্গার সময়। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও অলস শরীর নিয়ে উঠে বসে।দুইহাত দিয়ে চোখ ডলে নেয় বাচ্চাদের মতন।সন্ধ্যা ঘরে নেই।তবে টেবিলের উপর টাওয়াল, টাই, অফিস ব্যাগ নিত্যদিনের মতন সাজানো।এটা সন্ধ্যার কাজ অরণ্য জানে।কিন্তু সে ঘরে এলো কখন? গেলোইবা কখন?দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় অরণ্য। চটজলদি গোসল সেরে বেরিয়ে আসে। চুল মুছতে মুছতে আরেকদফা বিষম খেলো।পুরো বিছানা গোছানো। পরিপাটি!অফিস ব্যাগ, টাই বাকি জিনিসগুলো বিছানায় সুন্দর করে সাজানো।
কাজগুলো সন্ধ্যা তার অনুপস্থিতিতে করেছে। এতসতো মাথা না ঘামিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে গিয়ে।আজ টেবিলে নতুন মুখ।রেনাহা খালা।কাপে গরম গরম চা ঢেলে দিয়ে সরে যায় সেও।ব্রেড চিবুতে চিবুতে এদিক ওদিক মাথা ঘুরাচ্ছে অরণ্য।একই বাড়িতে থাকা সত্বেও সন্ধ্যাকে গতরার থেকে দেখেনি।দেখার ইচ্ছেও জাগে নি।তবে এই আড়ালে চলে যাওয়াটা ভাবাচ্ছে তাকে।
ফ্ল্যাটে তিনটে ঘর।একটায় অরণ্য থাকে।তার বাবা মা আসলে তার ঘরের ঠিক বরাবর ঘরটায় থাকে। কোনার ঘরটা মেহমানদের জন্য।যদিও এখানে তেমন কেউ আসেনা বেড়াতে।এই ঘরটা বেছে নিয়েছে সন্ধ্যা।নিজের সময় পার করার জন্য।এখানে বারান্দা নেই তবে আছে একটা বিশাল জানালা।জানালার সামনে সামান্য জায়গায় তার সেদিন নিয়ে আসা বেলি ফুলের গাছটা এনে এখানে রেখে দিলো।অরণ্যের আড়ালে।এখানে থাকলে তার সমস্যা হওয়ার কথা না।সেতো এই ঘরে ভুল করেও আসেনা।তাছারাও আছে একটা ছোট বুক শেলফ।পুরনো কিছু বই এখানে।সন্ধ্যার সময় কেটে যাবে এসবের মধ্যেই।দরজা লাগানোর শব্দে আশ্বস্ত হলো অরন্য চলে গেছে অফিসে।চায়ের ফ্লাক্স থেকে এক কাপ চা এনে বসে পরে একটা বই নিয়ে।
মিনিট খানেক পরেই তার পড়ার মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে যান্ত্রিক ফোনটা।বেজে উঠলো।নাম ভাসছে মায়ের। প্রতিদিন এই সময়টায় ফোন দেন।শুধু একটাই প্রশ্ন করেন।”কেমন আছিস”।তারপর নিরব হয়ে যান তিনি।
“হ্যালো মা”
“কিরে মা?কেমন আছিস?”
কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসে সন্ধ্যা।উত্তরে বলে, “এইতো মা আছি।”
“কি করছিস?”
আজ সন্ধ্যার মা নীরব হননি।প্রশ্ন করছেন।মনটা হয়তো আজ ভালো তার।অবশ্যই বাবা শিখিয়ে দিয়েছেন।ফোন করলে যেনো মন খারাপ করে বসে না থাকে।নাহয় মাতো মেয়ের চিন্তায় থাকতেন।
“সময় কাটাচ্ছি মা”
“খাওয়া দাওয়া করিস ঠিকমতো?”
“করি”
“কিযে করিস আমারতো জানা আছে।বিয়ে হয়েছে তোর এবার নিজের যত্ন নে”
“নিজের যত্ন দিলে কি আমি অপ্সরা হতে পারবো?”
এবার নীরবতারা গ্রাস করে নিল সন্ধ্যার মার পাশটায়।চুপ করে গেলেন।কি করবেন?কি বলবেন?মেয়েটা এমনি। সন্তান যেমনি হোক বাবা মার কাছে অমূল্য।কিন্তু সমাজের কাছে?
“মা তুমি টেনশন করো না।আমি ভালো আছি। অন্তত এখন আর আমার জন্য পাড়ার লোকের কাছে তোমাদের এটা শুনতে হবে না আপনার মেয়ে যে কালো।বিয়ে টিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগবে।”
মায়ের কাছ থেকে এখনও কোনো উত্তর আসছে না।নিশ্চই চোখটা ভিজে এসেছে।নয়নে অস্রু টলমল করছে।করলেও কি? মিথ্যে বলেনি সন্ধ্যা। সত্যটা আবার মুখের উপর বলে দেওয়ার স্বভাব তার।
___
প্রতিদিনের মতন ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। একবার কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় রেহানা খালা।তাকে দেখে অবাক হলো।আজ সন্ধ্যা নয় রেহানা খালা দাড়িয়ে।সকাল থেকে অরণ্যের টুকটাক কাজ তিনিই করেছেন।তার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসলো,
“আপনি এই সময়?বাড়ি যাননি?”
“না স্যার।আমি আজকে রাত পর্যন্ত কাজ করবো”
“কেনো?”
“সব কাজ ছাইড়া দিছি।বড় আপা কল দিয়ে বলছে এবাড়িতে সারাদিনের কাজ নিতে।তই আরকি”
“বড়ো আপা?”
“আপনার আম্মা”
“ওহ”
সন্ধ্যা বেলায় সন্ধ্যার বিচরণ নেই ঘরে।ঘরটা গোছানো।টাওয়াল বেডের উপরে রাখা। জানা আছে অরণ্য এসেই ফ্রেশ হতে যাবে।সময় নিয়ে ফ্রেশ হয় অরণ্য।ফিরে এসে দেখলো রেহানা খালা এসে দাড়িয়ে আছেন।হাতে চায়ের কাপ। এমনেতে সন্ধ্যা এনে দিয়ে যায় তাকে চা।আজ সে নেই।বাড়িতে থাকা সময়ে তার ছায়াটুকু দেখা যায়নি। অদৃশ্যের মতন তার সমস্ত কাজ করে দিচ্ছে।দায়িত্ব পালন করছে।আড়ালে আবডালে।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অরণ্য।নিজ চোখে দেখছে পর্দার আড়ালে সচক্ষে দেখলো প্রকৃতি তার আলো কমিয়ে আঁধারে ছেয়ে যায়।ঠিক সেই সময়ে ফোনে নটিফিক্যাশন আসে।তার প্রিয় পেজ “হীন”।নতুন একটি লেখা এসেছে সেখানে।অরণ্যের আজও জানা হলো না এত সুন্দর লেখনীর পেছনে যে আছে। বাস্তববাদী কথাবার্তায় ভরপুর তার ওয়াল।মনে হয় অনেক ক্ষোভ এই পৃথিবীর প্রতি তার।আবার হুট করে এই ভাবনার পরিবর্তন হয়।বোধ হয় সেই এই পৃথিবীকে সবচেয়ে সুন্দর করে ভালোবাসে।প্রতি সন্ধ্যায় একটু টুকরো সুন্দর বাক্য কে উপহার দেয়।সে কি নারী?নাকি পুরুষ?কে সে?
“আঁধার নেমেছে দেখেছো?কি করতে এই অন্ধকার রজনী না থাকলে?দিনের আলোয় কিভাবে লুকাতে নিজের নীরবের কান্নাগুলোকে?আঁধার আছে বলেই আলোর মূল্য এতবেশি।”
চলবে..