ম্যাচ পয়েন্ট
পর্ব তিন
(ভায়োলেন্স এলার্ট)
আজকের দিনটা অন্যরকম, আজকে সব কিছু আগের মত অসহ্য লাগছেনা। ছোট বোনটা ঘাড়ের উপর চড়ে আছে, আজকে ওকে বকে দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে না শফিক । মার রান্না করা পাতিল ভর্তি ঝোলের মধ্যে একটু খানি ডাটার তরকারিও আজ সে হাসিমুখে খেয়েছে। তার মাথায় কেবল ঘুরছে দুই থেকে চার, চার থেকে আট।
” শফিক আছিস নাকি? ” দীপ্তর কণ্ঠ।
বাইরে বের হতেই তার মেজাজ আবার সামান্য খারাপ হল। লুঙ্গির উপর বাহারি রঙের জামা, আবার গামছাও ঝুলিয়েছে গলায়। একটা রঙচটা চটের ব্যাগ ও আছে সাথে। স্পষ্টতই মাছের ব্যাপারী মনে হচ্ছে দীপ্তকে। কে জানে, কাছে গেলে মাছের গন্ধ ও পাওয়া যাবে হয়ত।
” চল একটু হেঁটে আসি”
দীপ্তর মুখে ” তুই” হঠাৎ করে একটু কানে লাগে বৈকি। সে আগামী দুই বছরের মধ্যে একজন বিশিষ্ট পুর-প্রকৌশলী হয়ে যাবে। তারপর সে নিজে কন্সট্রাকশন ব্যবসায় নামবে। মূলধনের ঝামেলা মনে হচ্ছে মিটে গেছে। এই সময় দীপ্তর মত ইন্টার ফেল একজন….
” চল চল” দীপ্ত তাড়া দেয়, ” জরুরী কথা আছে। তোর জন্য খুব জরুরি। ”
তারা দুজন হাঁটতে থাকে চিরচেনা রাস্তায়, বেশ কিছুক্ষন, নীরবে। একসময় অধৈর্য হয়ে উঠলো শফিক। তার ঘুম পেয়েছে, বহুদিন পর আজ সে শান্তিতে ঘুমাবে। হতচ্ছাড়া দীপ্ত কি বলতে চায় কে জানে?
” মদ ধরেছি। খাঁটি বাংলা মদ।” দীপ্ত বিশ্রী গলায় হেসে বলল এক সময়, ” খাবি নাকি? ”
ডিপার্টমেন্ট এর পিছনে শফিক দুই একবার ” ডাইল” নামক এক পদার্থ সেবন করার চেষ্টা করেছে, তার ভালো লাগেনি। আর তাছাড়া তার পড়াশোনা বাঁ তার ক্ষুরধার মস্তিস্ক কোনভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়, এমন কিছু সে করতে চায়নি কখনো।
সে দেখল, দীপ্ত তার ব্যাগের ভেতর থেকে বোতল বের করে এনেছে, ” তুই না খাস, ভদ্র লোক, আমি খাবো। বস একটু আমার সাথে ”
কলেজের মাঠে বসে শফিক বলেই ফেলল, ” ইয়ে দীপ্ত, জরুরি কথাটা বলে ফেল। আমার ঘুম পাচ্ছে। সকালে একটু কাজ আছে “।
” হাহাহাহা ” গলায় তরল চালান করার জন্য হয়ত তার হাসিটাও অনেকটা তরল এখন, ” সেদিন…. ” সে থেমে থেমে বলল, ” আমি গেছিলাম তোদের পিছে পিছে। ভাবছিলাম হঠাৎ গিয়ে চিৎকার দিয়ে চমকে দিব “।
শফিকের শরীর শীতল হয়ে গেল, অবশ্য মস্তিস্ক চলছে ঝড়ের গতিতে, ” কোনদিন? ”
” তুই জানিস কোনদিন। শোন, আমি মুখ বন্ধ রাখবো। আমাকে কি দিবি বল। ”
অস্বীকার করার পথ নেই আর, ” কি চাস? ”
” টাকা আর কি? ” দীপ্ত খ্যাক খ্যাক করে হাসছে, ” মেয়ে তো তুই পটিয়ে ফেলবি, জানি। আমার জন্য অন্তত…. হেঃহেঃহেঃ.. ”
শফিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তীরে এসে তরী ডোবা কি একেই বলে? অশিক্ষিত, দরিদ্র একটা ছেলে। এর লোভ এই জীবনে শেষ হবেনা, এটা নিশ্চিত। আর সেটার চেয়েও বড় সমস্যা হল, ও মুখ বন্ধ রাখবে না। পৃথিবীর সমস্ত টাকার বিনিময়ে ও না।
” জেনেই যখন ফেলেছিস,” শফিক নিজেই ব্যাগে হাত দিয়ে আরেকটা বোতল বের করে আনল এবার, ছোট একটা চুমুক দিয়ে বলল, ” কত চাস? ”
” তুই বল? এত বড় দাও মারলি? ”
নাহ, হত্যার দায়ে শাস্তি হবার জন্য অবশ্যই তার জন্ম হয়নি। আর রাবেয়া? রাবেয়া যখন জানবে? ঝড়ের গতিতে শফিক চিন্তা করতে লাগল। বিভিন্ন কোন থেকে, উল্টে পাল্টে, উপর নিচ করে। সমাধান খুঁজে পেলোনা। এত বড় ভুল সে করলো কি করে?
নিজের এক চুমুক দেয়া বোতলটা সে এগিয়ে দিল দীপ্তর দিকে। দীপ্ত বেশ আনন্দিত বুঝা যাচ্ছে, আসন্ন অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তাকে বেশ খুশী করে দিয়েছে । কোনদিকে আর তার খেয়াল নেই। সে দুটো, তারপর তিনটে বোতল খালি করে দিল অনায়াসে।
” আর নেই” শফিক ঘোষণা করল এক সময়, ” চল শালা মাতাল, বাড়ি যাবি চল… ”
দীপ্ত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল, কাঁদছে এখন, ” তোরা সব বড় বড় লোক, রাবেয়া হবে তোর বৌ, আর আমার বৌ একটা বিশ্বাস কর, রাতে ঘুমাতে গেলে মুরগির গুর গন্ধ পাই… ”
এতসবের মধ্যেও শফিক মুচকি হাসে এই কথায়। সত্যি, স্কুলে বাঁ কলেজে থাকতে বোঝা যায়নি তাদের তিন জনের জীবন এইভাবে তিনদিকে মোড় নেবে। কি বিচিত্র সময়ের খেলা!
রাত বেজেছে দশটা, দুই একটা ট্রাকের আনাগোনা শুরু হয়েছে এখন। এই ট্রাকগুলি যাবে মোহনায়, জাহাজ থেকে মাল নিয়ে ছড়িয়ে পরবে দেশের আনাচে কানাচে। একটা পাড় মাতাল লোক কি অসাবধানে একটা ট্রাকের নিচে পরে যেতে পারেনা?
ভাবনাটা আসতেই শফিকের শরীরের সব রক্তবিন্দু মাথায় এসে জমা হল। দীপ্ত আর কি নেশা করেছে, তার চেয়ে শতগুন ভয়ংকর এক নেশায় হঠাৎ শূন্যে উড়ে যাবার মত হালকা অনুভব করল সে। আসলেই তো? এর চেয়ে ভালো সমাধান আর কি হতে পারে?
তবে বড় ভাবনার বিষয় হল, মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সমবয়সী দুই বন্ধুর মৃত্যু, দুজনের সাথেই শেষ দেখা শফিকের, অত্যন্ত সন্দেহজনক এই প্রশ্নের কি উত্তর হতে পারে?
রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে শফিক কান তীক্ষ করে রাখলো। ট্রাক আসার শব্দ কি শোনা যাচ্ছে? সে দাঁড়িয়েছে অন্ধকারে। ট্রাক এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে। দীপ্ত এখনো কাঁদছে প্রায় তাকে জড়িয়ে ধরে।
গণিতের জটিল জটিল সমাধান শফিকের বাম হাতের খেলা, ট্রাকটা কত গতিবেগে আসলে ঠিক কখন তার সামনে দিয়ে যাবে, সেটা মনে মনে হিসেব করে টানটান স্নায়ু নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর তিন… দুই…. এক….
দীপ্ত পরে গেছে, ট্রাকটা গেছে ওর ওপর দিয়ে। শফিক আর অপেক্ষা করলো না। পিছনে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
***
মায়ের ধাক্কায় ঘুমের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে শফিক। মা, নাকি সুরে প্রায় কোকাছে পাশে বসে, ” কার যেন নজর লাগছে তোদের উপর। তুই আর এইখানে থাকিস না বাপ্। চলে যা। আজকেই চলে যা… ”
ধরমড় করে উঠে বসল সে, চোখ কচলাচ্ছে, ” কি হয়েছে মা? কি হয়েছে? ”
” ওই যে দীপ্ত… (কান্না)… সে তো কালকে রাতে গাড়ির নিচে চাপা পড়ছে রে… মনে হয় বাঁচবো না…”
মনে হয়? খট করে কানে বাজে কথাটা। মনে হতে যাবে কেন? না বাঁচার ই তো কথা ছিল? মাতাল হলেও দীপ্ত টের পেয়েছিল ঠিক ঠিক যে তাকে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে! তার ওপর দীপ্তর মাথায় আছে রায়হানের গোপন কথাও। এখন “মনে হলে” হবে?
রাবেয়ার বাবা এখানকার বড় মানুষ, শফিক ভদ্রস্থ হয়ে রওনা দিল সেখানে। হাসপাতালের ব্যাপারটা উনি জানলেও জানতে পারেন।
রাবেয়া বসার ঘরেই বসেছিল, শফিককে দেখে এক চিলতে আলোর আভাস দেখা গিয়েই আবার মিলিয়ে গেল তার চোখ থেকে। বলল, ” এসব কি হচ্ছে বলো তো শফিক? আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে দূরে? ”
শফিকের বুকে ছলকে ওঠে রক্ত, হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু মুখে তার কষ্টের ছায়া, ” জানো নাকি কেমন আছে? ”
” তুমি জানোনা?একটু আগেই হাসপাতালে মারা গেছে ও… ”
শফিক খুব গোপনে বড় করে নিশ্বাস ফেলল। ওদিকে রাবেয়া বলে চলেছে, ” ভীষণ রকম মাতাল ছিল বুঝলে?তবু ডাক্তার বলছিলো, আর দুই এক সেকেন্ড ট্রাকটা এদিক সেদিক হলেও পায়ের উপর দিয়ে চাকা যেত, বাঁচান যেত । কিন্তু একদম সঠিক সময়ে ঠিক ঘাড়ের পাশটায় আঘাত লেগেছে… বাঁচানো যায়নি তাই….
এইটা ম্যাচ পয়েন্ট। এইযে এক সেকেন্ড পরে ট্রাক আসাটা। শফিক বেঁচে গেল।
***
রান্নাঘর থেকে রাবেয়ার গুনগুন কণ্ঠের গান ভেসে আসছে। এই বয়সেও দারুন ভালো গান গায় সে। গান গাইতে গাইতেই চলে এসেছে ড্রয়িং রুমে, পেছনে দাঁড়িয়ে হাত বোলাচ্ছে শফিকের মাথায়।
হেসে বলল, ” কি? তোমার প্লেয়ার হেরে গেল তো? ”
শফিক সাহেবের মুখে একটা দুর্বোধ্য হাসি খেলা করে গেল। অসুবিধা নেই। সিনার জিতে গেছে।
” সিনার” রা সবসময়ই জিতে যায়।
(শেষ )
( ইয়াজমিন রুমানা )