ম্যাচ পয়েন্ট
পর্ব ২
” দীপ্তর সাথে দেখা হয়েছে? ” রায়হান জানতে চাইল। পাঞ্জাবী হয়ত ওর প্ৰিয় পোশাক, অথবা হয়ত জানে পাঞ্জাবীতে কোন কারণ ছাড়াই ওকে সিনেমার নায়কের মত লাগে। শফিকের মুখ তিতা হয়ে গেল। সে জবাব দিল না।
” দেখা হয়নি না? হবেও না। বিয়ে পর্যন্ত ঠিক ছিল, যেদিন থেকে জানল বৌ এর বাচ্চা হবে, আমার সাথেও দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। হাহাহা। ”
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারেনি বলে দীপ্ত আর পড়েনি। বাবার মাছের ব্যবসায় নাম লিখিয়েছিল সানন্দে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে আবার এখন নাকি বাবাও হবে। শফিক পিচিক করে থুতু ফেলল।
” তোর কথা বল ” রায়হানের কণ্ঠ দরাজ, ” প্রেম ট্রেম হল দুই একটা? ”
” না ” নিজের অজান্তেই খুব দ্রুত উত্তর দিয়ে দেয় শফিক। দিয়ে থমকে যায়, এত তাড়াতাড়ি স্বীকার না করলেও হত। তারপর সামলে নেয় নিজেকে, খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে বসে ” আর তুই? ”
” তুই তো জানিস” রায়হান হালকা কণ্ঠে বলল, পাঞ্জাবির পকেট থেকে এখন বের হয়ে এসেছে সিগারেট আর দিয়েশলাই, ” নিজের কাছে অস্বীকার করার চেষ্টা করতে চাইলে করতে পারিস। কিন্তু এটাই সত্যি”।
আহ! আগুনের হলকা কি পুড়িয়ে দিয়ে গেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত? আচ্ছা ঠিক এরকম মুহূর্তে কি মানুষ আত্মহত্যা করে?
” আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইনা, দুঃখ ও প্রকাশ করবো না, কেন বল তো? আমরা দুজনেই রাজকন্যা আর রাজত্ব চেয়েছিলাম। আমি জাস্ট জিতে গেছি। হাহাহাহা”।
শফিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের প্রতিটা রোমকূপ, মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষ ঈর্ষায়, অসহায় ক্ষোভে আবারো পুড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, ঠিক এরকম মুহূর্তে কি মানুষ আত্মহত্যা করে? নাকি হত্যা?
” রাবেয়া ভীষণ লক্ষী, নরম একটা মেয়ে। আর নরম শুধু মন হিসেবে বলছিনা কিন্তু ” রায়হানকে কথা বলার নেশায় পেয়েছে যেন, ” আর শোন, ওর সব আমার জানা। ও কি দিয়ে আজকে দুপুরে ভাত খেয়েছে, তাও বলে দিতে পারি। অবশ্য সেটা কিন্তু ওর আমাকে বলতে হয়নি… ”
একটা মুহূর্ত। একটা ক্ষন। সুন্দর করে বলতে গেলে একটা পল। শফিক দেখলো তার হাত পৌঁছে গেছে রায়হানের গলার পেছনে। আর অসতর্ক রায়হানের মাথা সে ঠুকে দিচ্ছে ব্রিজের দেয়ালে। একবার, দুইবার, শত বার। আর তার খারাপ লাগছে না। একটুও না। যখন নিশ্চিত হোল এই ছেলে আর সিগারেটের টুকরো শেষ টান দিয়ে এই নদীতে ফেলবে না কখনো, তখন তার নিশ্চপ্রাণ শরীরটা সেই নদীতে ফেলে দিতেও তার বাঁধলো না।
***
খবরটা এল এইভাবে, ” কর্ণফুলি নদীতে ছাত্রের লাশ উদ্ধার”। এইসব খবর খুব বিচিত্র। কখনো দুই সন্তানের পিতার লাশ উদ্ধার, কখনো শিক্ষকের লাশ উদ্ধার ( সেই শিক্ষক কারো পিতা হলেও উল্লেখ করা হয়না ), বাচ্চা থাকলে মায়ের লাশ উদ্ধার, না থাকলে গৃহ বধূর লাশ উদ্ধার… কে সিদ্ধান্ত নেয় কি লিখতে হবে…. শফিকের ভাবনায় ছেদ পরে। হলের রুমমেট রেজা অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
” তোমার খোঁজে পুলিশ এসেছে” সে বলল, ” নিচে দাঁড়িয়ে আছে “।
শফিক জানত এটা হবে, আজ নয় কাল। সেই রাতের পরের সকালেই সে ঢাকা চলে এসেছিলো, না তাড়াহুড়ো করে নয়। তার আসবার কথাই ছিল। এরপর সাত দিন গেছে। কি হয়েছে সে অনুমান করতে পারে। দুদিন হয়ত সবাই অপেক্ষা করেছে রায়হানের জন্য, তৃতীয় দিন খোঁজ শুরু হয়েছে। চতুর্থ দিন লাশ পাওয়া গেছে ঘটনাক্রমে। নাও পাওয়া যেতে পারত, কিন্তু পাওয়া গেছে, কি আর করা যাবে।
বিশাল ভুঁড়ি আর পান খাওয়া দাঁতের পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখেছি সামান্য স্বস্তি বোধ করে সে, এর সাথে খেলা খেলতে হয়ত খুব কস্ট হবেনা। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর পর সে চোখে পানি নিয়ে এল। তবে এই পানির পুরোটাই মিথ্যে না, রায়হান তার সেই ন্যাংটো কালের বন্ধু, একটু অশ্রু তার প্রাপ্য।
” যখনি বাড়ি যেতাম” সে বলল প্রশ্নের জবাবে, ” আমি, রায়হান, দীপ্ত টেম্পু করে পতেঙ্গা চলে যেতাম। সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই। দূর থেকে জাহাজ দেখা যায়, শব্দ শোনা যায়, এগুলি খুব ভালো লাগার জিনিস ছিল আমাদের…. ” এইটুকু বলে সে থামল। সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে এখন। উফ!!
” সেদিন ও গেলাম, আমি আর রায়হান। দীপ্তকে খুঁজে পাইনি। তারপর…
” তারপর? ” পুলিশ অফিসার সন্দীহান।
” সেদিন ওর সাথে খুব কথা কাটাকাটি হল। এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই, রাবেয়াকে ভীষণ ভালবাসি আমি। কিন্তু রাবেয়া রায়হানের সাথে একটি সম্পর্কে জড়িয়েছিল। আমি ওকে খুব বকলাম। সত্যি কথা বলতে, দুই একটা ঘুষি ও মেরেছিলাম। খুব রাগ করে বলছিলাম, তোর মুখ আর কোনদিন দেখতে চাইনা…. ” এই পর্যায়ে শফিক ঝরঝরে করে কেঁদে ফেলল, ” যদি জানতাম সত্যিই আর দেখা হবেনা….
” এগুলি পতেঙ্গায়? ”
” জ্বী। আমি ওকে রেখে একাই চলে আসলাম তারপর। ”
” কিন্তু লাশ পাওয়া গেছে নাসিরাবাদে, ব্রিজের নিচে… ”
” আমি বলতে পারবোনা ও কখন ফিরেছিল। আমি সারারাত বাড়িতে বসে কেঁদেছি। সকালে বাস ছিল, ঢাকায় চলে আসি এরপর। ”
পুলিশ লোকটার হয়ত তাড়া আছে, কথা বাড়ালো না আর। বরং শফিকের পিঠে হাত রেখে বলল, ” যার কথা বললেন, ওই রাবেয়া, খুব খারাপ অবস্থা তার। সম্ভব হলে দেখে আসবেন “।
শফিক মনে মনে বাসের ভাড়া হিসেব করছে তখন। কিছুদিনের মধ্যেই দুই বার বাড়ি যাওয়া, বেশ কতগুলি টাকা বেরিয়ে যাবে সত্যি। কিন্তু নরম মাটিতে শাবল চালাবার সময়টা মোক্ষম এখন। কে জানে, ঠিক মত বীজ বপন করতে পারলে গাছ গজিয়ে যেতেও পারে।
***
” রাবেয়া” মৃদুস্বরে ডাকে শফিক। কি প্রচন্ড বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে আছে মেয়েটা!! চুল আঁচড়ানো নয়, পোশাক আলুথালু। আর চোখের দৃষ্টি। জানালা দিয়ে দূরে হারিয়ে আছে কোথাও। তবু কি অদ্ভূত সুন্দর! শফিক ঢোক গিলল।
এইটা রাবেয়ার শোবার ঘর। আজকের আগে কোনদিন ভাবেনি শফিক, এই কামরায় প্রবেশ করতে পারবে। অথচ আজ মেয়ের মা নিজ থেকে তাকে পৌঁছে দিয়েছেন এখানে। সময়ের সাথে কত কিছু পরিবর্তন হয়!!
রাবেয়া অনেকক্ষন পর তাকালো, কান্নার মত একটু হাসির চেষ্টা করে বলল, ” শফিক? এসেছো তুমি? তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সাথেই ওর শেষ দেখা হয়েছিল তো!”
শফিক ঠিক পরের দিনই আসেনি। আরো পাঁচ দিন অপেক্ষা করে এসেছে। সে রাবেয়ার কষ্ট সামান্য ম্লান হবার জন্য এইটুকু সময় দিয়েছে। আর সে জানে, তাকে দেখলে রাবেয়ার ভালো লাগবে, একটু হলেও। সেই ভালো লাগটুকু জাগাতেও একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল।
সে এগিয়ে গেল। অশ্রুমাখা নারীমুখ তার ভালো লাগে। সিনেমার হলে নায়িকাদের কান্নার দৃশ্য দেখে সে মাঝে মাঝে বাথরুমে চলে যায়। আর এ তো জ্বলজ্যান্ত মানুষ, তার ওপর তার ভালবাসার মানুষ।
রাবেয়া হয়ত এত কথা বুঝতে পারেনা। সে হঠাৎ প্রায় ঝাঁপিয়ে পরে জড়িয়ে ধরে সামনে থাকা যুবককে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ” ওরা বলছে রায়হান বাজে লোকদের সাথে মিশত। মাদক সেবন করত। মাদকের টাকার জন্যই নাকি ওকে… ”
শফিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। এত সৌভাগ্য করে সে পৃথিবীতে জন্মছিল, এতদিন একবারও মনে হয়নি তো!
সে খুব সন্তর্পনে আলিঙ্গন করলো রাবেয়াকে, সতর্ক রয়েছে, কামভাব প্রকাশ হবার সময় এখনো আসেনি। তবে তার মন বলছে, আসবে। সেই সময় আসবে। একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে এখন।
(ইয়াজমিন রুমানা)