#ময়ূখ
#পর্ব-১২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৪.
‘রিপু ভাই?’
রিপ্ত ঘাড়টা ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে মায়াবী হাসি দেয়। কি প্রাণবন্ত, স্নিগ্ধ সে হাসি!
‘পাশে বসরে মৌনি।’
মৌন রিপ্তর পাশে সবুজ ঘাসে বসে। রিপ্তর একহাতে শাপলাফুল আর অপর হাতে শালুক। রিপ্ত শালুকগুলো এগিয়ে দেয় মৌনর হাতে। মৌন ছুঁলে খেতে খেতে বলে,
‘কি যেন বলবে বলেছিলে রিপু ভাই?’
রিপ্ত পাশ থেকে কয়েকটা ইটের কণা কুড়িয়ে জংলার পুকুরে একে একে ছুঁড়ে মারে। পুকুরের সামনে বিশাল মাঠ, দুইপাশে ধানক্ষেত। মাঠে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া দুইটা গরু বাঁধা। তারা একটানা হাম্বা হাম্বা করে যাচ্ছে।
‘ও রিপু ভাই বলোনা?’
‘গল্প শুনবিরে মৌনি?’
‘কিসের গল্প রিপু ভাই?’
‘এক মন ভাঙা শালিক পাখির গল্প।’
‘শোনাও। কতদিন তোমার গল্প শুনিনা। আগে তো কত রাজা রাণীর গল্প শোনাতে।’
রিপ্ত আবার মলিন হাসে। মেয়েটা কি সেই অবুঝই রয়ে গেল!
‘ছোট একটা গাছের ডালে একটা ছেলে শালিক পাখি থাকতো । বাবা-মা নিয়ে বেশ ছিল সে। তার পাশের গাছের ডালে আরেকটা ফুটফুটে মেয়ে শালিকের জন্ম। ছেলে শালিকটা সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে মেয়ে শালিকটাকে। একটা নামও দিয়েছে জানিস?’
‘কি নাম রিপু ভাই?’
‘ছটফটে পিচ্চি। তবে এই নামটা কেউ জানেনা। হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব। ছেলে পাখিটা হারিয়ে ফেলে তার বাবা-মাকে। তবুও হাল ছাড়েনা সে। মেয়ে শালিকের বাবার কাছে সময় চায়। একসময় অনেক বড় হয়ে তার ঘরের বউ করে তুলবে তার ছটফটে পিচ্চিকে। তবে কি হয় জানিসরে মৌনি?’
‘কি রিপু ভাই?’
‘মেয়ে পাখিটার বাবা তার কথা রাখেনি। আরেক পাখির কাছে বিয়ে দিয়ে দেয় তার ছটফটে পিচ্চিকে। সেদিন যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে তার। বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার পাখি উড়ে গেছে বহু দূর। ত্রী সীমানার বাইরে।’
‘অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।’
‘কার জন্য?’
‘শালিক পাখিটার জন্য।’
রিপ্ত আবার হাসে। তাকে কি আজ হাসার রোগে ধরলো নাকি!
‘তুমি দেখো রিপু ভাই সেই ছেলে শালিক পাখিটাও সুখি হবে। তার জীবনেও সুখ আসবে। আমি দোয়া করি।’
রিপ্ত মনে মনে ভাবে,
‘তুই সেই বোকাই রয়ে গেলিরে মৌনি। বোকাই রয়ে গেলি। সবারবেলা তুই এতো বুঝিস? আমার বেলা কেনো বুঝিস না।’
মৌন সবই জানে। সবই বুঝে। মাঝেমাঝে যে রিপ্ত তাকে ছটফটে পিচ্চি ডাকতো তাও তার জানা। তবে তার হাতে যে কিছু নেই, কিছু ছিলোনা। আর রিপ্তকে সে সবসময় ভাইয়ের নজরেই দেখেছে। বাবার বিপদে যে সে নিজেকে বলিদান করেছে!
নিরবতা চারপাশে। দুজনেই কিছু বলছেনা। জংলা পুকুরটা স্থির হয়ে আছে। পানিগুলো হালকা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। সাদা শাপলাগুলো সবুজ পাতার উপর আপন মনে বসে ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিকটাকে দেখছে। তাদেরও কষ্ট হচ্ছে কি!
৩৫.
ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় আসে নিভৃত। হঠাৎ তার নজর যায় দূরে পুকুরপাড়ে বসে থাকা দুইজন মানব-মানবীর দিকে। একজনের পাশ ঘেঁষে অপরজন বসা। হলুদরঙা শাড়ির আঁচলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটা সেই মেয়েটা না! পাশে বসা ছেলেটার মুখ আবছা। কি যেন দিচ্ছে মেয়েটার হাতে। নিভৃত বুঝতে পারছেনা তবে তার হাত মুঠ হয়ে আসছে। প্রচুর রাগ লাগছে। রাগে নিজের মোবাইলটা পাশে ছুঁড়ে ফেললো সে। পায়চারি করলো কতক্ষণ ঘরে। এমন লাগছে কেন? টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পটা একটা আছাড় মারলো মেঝেতে।
অতঃপর খাটে গিয়ে বসলো। মৌন ঘরে ঢুকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেঝেতে ল্যাম্পসেড ভেঙে পড়ে আছে। মৌনর মাথায় ঘুমটা নেই। কানে গুঁজে রেখেছে শাপলা ফুল।
‘কি হয়েছে আপনার?’
হঠাৎ মেয়েটার কন্ঠ শুনে নিভৃত তার দিকে তাকালো। চোখ দুটো লালচে ভয়ানক লাগছে। কানে গুঁজে রাখা ফুলটা দেখে তরতর করে রাগ বেড়ে গেলো নিভৃতের। খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো মৌনকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে কেবল। হঠাৎই নিভৃতের অধর ছুঁয়ে দিলো মৌনর অধর। নিভৃতের এমন আক্রমণে চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মৌনর। নিভৃত ক্রমশই হিংস্র হয়ে উঠছে। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাঁড়ালো মৌন। সিক্ত কন্ঠে বললো,
‘এমন করছেন কেন আপনি?’
হুঁশ ফিরলো নিভৃতের। নিজের আচরণে অবাক হচ্ছে নিভৃত। সে এমন করছে কেন! তবে মৌনের কানে গুঁজে রাখা ফুলটা দেখে আবার এগিয়ে গেলো মৌনর দিকে। মৌন ভয়ে গুটিয়ে আছে। নিভৃত মৌনর কাছে গিয়ে গাল চেপে ধরে বললো,
‘কেন আমায় বিয়ে করলি তুই? তোকে ফোন করে মানা করেছিলাম না আমি। কেন এসেছিস আমার জীবনে। লোভী, ছোটলোক। তুই, তোর বাবা সবকটা ছোটলোকের দল।’
মৌনের মুখ চেপে ধরায় সে কিছু বলতেই পারছেনা। নিভৃত মৌনর কানে গুঁজে রাখা ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে বললো,
‘সঙ সেজেছিস! কি ভাবিস? সঙ সাজলেই আমাকে পাবি? আমার রুহানির জায়গা নিবি?’
মৌন কিছু বলতে না পেরে কেবল চোখের পানি ফেলছে। এমন করছে কেন নিভৃত। হঠাৎ নিভৃত গর্জন করে বলে,
‘ছেলেটা কে ছিল তোর সাথে?’
মৌন অবাক হয়। কোন ছেলের কথা বলছে নিভৃত?রিপু ভাইয়ের?
‘কি চুপ কেন? কে ছিল পুকুরপাড়ে তোর সাথে?’
‘রিপ্তভাই। আমার চাচার ছেলে।’
রিপ্তর কথা শুনে মৌনকে ছেঁড়ে দেয় নিভৃত। রিপ্তকে তো সে চিনে। অনেকভালো একটা ছেলে। তবুও কেন জানি রাগ লাগছে তার। মৌনকে টেনে ঘরের বাইরে বের করে ব্যাগটা তার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বলে,
‘একদম এই ঘরে ঢুকবিনা।’
৩৬.
নিভৃত কথাটা বলেই বেরিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে গিয়ে মাকে বলে হনহনিয়ে গাড়িতে উঠে ঢাকার পথে রওনা দেয় সে। মিরা, নাজমুলও বুঝতে পারছেনা হয়েছেটা কি!
তারাও তৈরি হয়ে মৌনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মৌন নিজেকে ঠিক করে কেবল স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তার জীবনটা এতো অদ্ভুত! এতো দুর্বিষহ কেন!
বাবা-মাকে ফোন করে একবার জানিয়েছে সে চলে যাচ্ছে। আসার পথে হঠাৎ দৌঁড়ে এসে গাড়ি থামায় রিপ্ত। মৌন দরজা খুলে বেরিয়ে এলে বলে,
‘চলে যাচ্ছিসরে মৌনি?’
‘হ্যাঁ, রিপু ভাই।’
রিপ্ত হাতের খাঁচাটা মৌনর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘নে আজ থেকে মিটি তোর।’
মৌন অবাক হয়ে বলে,
‘তোমার এতো শখের পায়রা আমায় দিয়ে দিলে রিপুভাই?’
‘আরে নে। খেয়াল রাখিস আমার মিটির।’
‘আচ্ছা, রিপুভাই।’
‘ভালো থাকিসরে মৌনি।’
বলেই পিছু ঘুরে রিপ্ত। সে তার চোখের জল মৌনকে দেখাতে চায়না। মৌন হালকা কন্ঠে বলে,
‘যে তোমার ভাগ্যে ছিলোনা তার জন্য কষ্ট পেয়োনা রিপু ভাই। তুমি অনেক ভালো। দেখো তোমার জীবনেও একদিন কেউ আসবে। যে তার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব ক্ষত মুছে দিবে।’
রিপ্ত অবাক হয়ে শুনে। পিছনে ফিরে কিছু বলবে তার আগেই কালো গাড়িটা অনেকদূর চলে গেছে। অনেক দূর।
_________________
মৌন বসে আছে গাড়ির পিছনের সিটে। সামনে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছেন নাজমুল সাহেব আর পাশে বসে আছেন মিরা। দুজনেই ছেলের জন্য চিন্তিত। হঠাৎ কি হলো! মৌন একধ্যানে তাকিয়ে আছে বাইরে। পাশে বেতের খাচায় বন্দি মিটি বাকবাকুম বাকবাকুম করে ডাকছে। সাদা রংয়ের সুখী পায়রা মিটি। লেজের দিকে অনেকসুন্দর পাখাগুলো ছড়ানো। রিপ্ত কাউকে ধরতে দিতোনা মিটিকে। আর আজ তাকে দিয়ে দিলো। মৌন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যেন রিপ্তর জীবনে এমন কেউ আসে যে তাকে হাসিতে খুশিতে ভরিয়ে রাখবে।
বাইরে শো শো বাতাস বইছে। মৌনর খুবই মন খারাপ লাগছে। আর কবে গ্রামে আসবে সেটাও তার জানা নেই। অন্যমনস্ক হয়ে হাত চলে যায় ঠোঁটে। দুয়েক জায়গায় কেটে গিয়েছে। ক্ষত ঢাকতে মৌন লিপস্টিক লাগিয়েছে। সাজের ভিতরে লুকিয়ে ফেলেছে নিজের কষ্ট, যন্ত্রণা।
কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকার পর মৌন হঠাৎই যেন একটা রহস্যের জট ছাড়ালো। নিভৃত কি রিপ্তর সাথে তাকে দেখে এমন আচরণ করেছে? তবে বাকি কথাগুলো! আর নিভৃত তো মৌনকে ভালোবাসেনা। তাহলে এমন আচরণের মানে কি!
মৌনর নিজেকে খুবই ছোট লাগে। নিভৃত কি সহজে বলে দিলো ছোটলোক। মৌনর বাবাকে কোন সাহসে ছোটলোক বললো সে। মৌনর বাবা তো কেবল টাকা চেয়েছিলো। নিভৃতের বাবা-মাই তো শর্ত দিয়ে তাকে বউ করে নিয়েছে। মৌন চুপচাপ বসে থাকে। বাড়িতে গেলে নিভৃত আবার কি করে তাই দেখার বিষয়।
(চলবে)…..