#ময়ূখ
#পর্ব-১৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৬.
মৌনকে নিজের কাছে টেনে নিলো নিভৃত। মৌনেরও কষ্ট লাগছে। একটা মানুষ অপর একটা মানুষকে ঠিক কতোটা ভালোবাসলে এমন পাগলামি করতে পারে! মৌন নিভৃতের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিভৃত হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মৌনের চিবুকের লাল তিলটা। কেঁপে উঠলো মৌন । অতঃপর মৌনকে কোলে তুলে নিলো সে। এলোমেলো পায়ে ঢুলতে ঢুলতে অগ্রসর হলো সামনে। নিভৃতের চোখের চাহনী অন্যরকম লাগছে। মৌন ভেবেছে হয়তো প্রতিদিনের মতো আজো তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাচ্ছে নিভৃত। তবে নিয়তি হয়তো তা চায়নি।
‘আমার তোমাকে চাই রুহানি।’
‘তোমাকে কোথাও যেতে দিবোনা আমি।’
মৌনর হাজার চিৎকার, আর্তনাদ শুনলোনা নিভৃত। মৌন একধ্যানে তাকিয়ে রইলো কেবল রুহানির হাসোজ্জল ছবিটার দিকে। মনে মনে বললো,
‘আমাকে ক্ষমা করো আপু। আমি অপারগ ছিলাম। আমি চাইনি আমাদের শুরুটা এভাবে হোক। তোমার ভাগের ভালোবাসাটা আমি নিতে চাইনি আপু।’
চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। সকালে হয়তো তাকেই শুনতে হবে সে সুযোগ সন্ধানী, বিশ্বাসঘাতক!
______________________
ঘুম থেকে উঠে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইলো নিভৃত। আশেপাশে অবলোকন করে বুঝতে পারলো কোনো অঘটন ঘটে গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো সে। মৌন রান্নাঘরে। মিটি মৌনর পাশে ঘুরঘুর করছে। তবে আজ মৌন মিটিকে আদর করছেনা, কথা বলছেনা। একধ্যানে সবজি ভাজি করছে কেবল।
‘এই মেয়ে!’
চিৎকার করে বললো নিভৃত। মৌন কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি।
‘এই কথা কানে যায়নি?’
‘কি?’
সাদা পোশাক পরিহিত মৌন। কোমর সমান চুলগুলো হালকা ভেজা। মুখের সামনে কয়েকটা এলোমেলো চুলের বিচরণ। শরীরের হলদে ফর্সা রঙটা যেন গাঢ় লাগছে খানিকটা। মাথায় উড়না দেওয়া তার। চোখ দুটো লাল। বোধহয় কেঁদেছে মেয়েটা। এতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে কেন! নিভৃত কথা খুঁজে পায়না। আমতা আমতা করে বলে,
‘তুমি আমার সুযোগ নিয়োছো কেন?’
মৌন কোনো জবাব না দিয়েই আবার সামনে ফিরে সবজি ভাজিতে মন দিলো। জোর করবে নিজে। কাছে টানবে নিজে। কৈফিয়ত দিতে হবে তার! সে কি এতো সস্তা!
নিভৃত উত্তর না পেয়ে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। মিটি উড়ে মৌনর কাঁধে বসলো। মৌন আজ তার সাথে আহ্লাদ করছেনা কেন! মিটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে পাশে রাখলো মৌন। চিৎকার করে বললো,
‘মিটি একদম আহ্লাদ করবিনা। এই পৃথিবীতে সবাই আমাকে ব্যবহার করে তুইও করতে চাস! আমি কি খেলনা? আমি কি ভোগ্যবস্তু! মন চাইলো খেললাম আবার ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আবার আমাকে ব্যবহার করে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসছে!’
‘মিটির উপর রাগ দেখিও না। আমি তো মদ্যপ ছিলাম। তুমি তো বাঁধা দিতে পারতে?’
‘আপনার সাথে কোনো কথা আমি বলতে চাচ্ছিনা নিভৃত। আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না দয়াকরে।’
চলে গেলো নিভৃত। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মৌন। তার জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন! কেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো না! কেন স্ত্রী হয়েও এসব কথা শুনতে হচ্ছে তার!
৪৭.
মিরা, নাজমুল আর দিলারা বাড়ি ফিরেছেন আজ তিনদিন। মৌন গেস্টরুম ছেড়ে বাধ্য হয়ে নিভৃতের রুমে থাকছে। নাজমুল অসুস্থ। তাই কোনো ঝামেলায় যেতে চায়নি সে। যদিও নিভৃত দুইবার চেষ্টা করেছিলো তার সাথে কথা বলতে। তবে সে এড়িয়ে গেছে। কি দরকার! এতো ছন্নছাড়া সম্পর্কের!
বারান্দায় বসে নিজের ডায়েরিতে হাত বুলাচ্ছে মৌন। কালো মোটা একটা ডায়েরি। সেই দশম শ্রেণীতে থাকতে কিনেছিলো সে। এই ডায়েরিতে তার প্রিয়ের বসবাস। তার একতরফা ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে অজস্র কল্পনার অনুভূতি লিখা। আচ্ছা, খুবই কি খারাপ হয়ে যেতো ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পেলে। একটা সুন্দর সংসার হতো তাদের। প্রেমময় ছন্দে মেতে উঠতো প্রতিটা সময়। খুব কি খারাপ হতো? মৌনর চোখ ভিজে উঠে। বেহায়া চোখ বারণ মানে না। অশ্রুতে লেপ্টে দেয় কাজলাক্ষী চোখ। লেপ্টে কালো করে দেয় চোখের আশেপাশে! চোখের পানিটা মুছে কিছু লাইন ডায়েরিতে লেখে মৌন,
‘তোমাকে পাওয়ার যন্ত্রণায় আজো ছটফট করি আমি। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ তুমি প্রিয়। তোমার সাথে ভালোবাসার সংসার সাজানোর স্বপ্ন যে অপূর্ণ রয়ে গেলো আমার! এই যে শুনছো তুমি! মনে রেখ তোমার একটা পাগলাটে প্রেয়সী ছিলো, আছে আর চিরজীবন থাকবে প্রিয়।’
দেয়ালে মাথাটা ঠেকায় মৌন। একতরফা ভালোবাসায় ভিষণ কষ্ট। ভিষণ!
________________
‘মৌন, নিভৃত।’
নাজমুল সাহেবের ঘরে দাঁড়িয়ে দুজন। নাজমুল সাহেব আগের থেকে সুস্থ অনেকটা। তাদের ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। মিরা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। নিভৃত জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলবে বাবা?’
‘হ্যাঁ। তোমাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হয়েছে। তা নিশ্চিত জানো।’
‘হয়েছে। তো?’
নাজমুল সাহেব বালিশের নিচ থেকে একটা খাম বের করে নিভৃতের হাতে দিলেন।
‘এটা কি বাবা?’
‘দেখ।’
মৌনও তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টের বুকিং কাগজ।
৪৮.
‘বাবা, তুমি অসুস্থ। আর আমরা ঘুরতে যাবো!’
নাজমুল হাসলেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘তুমি তো তোমার সুস্থ বাবাকেও অসুস্থ বানিয়ে দিবে দেখছি। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আছে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে। তোমরা ঘুরে এসো।’
মৌন বললো,
‘বাবা-মা তোমরাও চলো।’
মিরা জবাবে বললেন,
‘এবার তোরা যা। পরেরবার আমরা সবাই মিলে যাবো।’
নিভৃতের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলোনা মৌন। নিভৃতের নিরবতা বলছে সে যেতে রাজি। কোনো প্রতিক্রিয়া, রাগারাগি ও করলোনা!
________________
‘এই মেয়ে?’
চুলে বেণী করছিলো মৌন। নিভৃতের ডাকে ডিভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কিছু বলবেন?’
‘দেখো আমি যেতে রাজি হতাম না। তবে ডাক্তার বলে দিয়েছেন বাবাকে কোনো স্ট্রেস না দিতে। তাই তোমার সাথে যেতে রাজি হয়েছি। এতে খুশি হওয়ার দরকার নেই।’
‘আপনার কেন মনে হলো আমি খুশি হয়েছি?’
‘মিথ্যে বলবেনা। তুমি মুচকি মুচকি হাসছিলে কেন?’
‘অদ্ভুত তো! আমার মুখ আমি হেসেছি! তাতে আপনার কি? অদ্ভুত!’
‘সবই বুঝি। তোমাকে কিন্তু আমি পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারি। তাই এতো খুশি হয়ে লাভ নেই।’
‘কচু বুঝেন। আমাকে ধাক্কা দিলে আপনাকে নিয়ে পড়বো আমি।’
‘আচ্ছা, আমার কথার প্রেক্ষিতে তোমার সব উত্তর কি আগে থেকেই রেডি থাকে?’
‘আসলে আপনি আমার জাত শত্রু। তাই আপনাকে সঠিক প্রতিত্তোর না করতে পারলে শরীর নিশপিশ করে। উত্তর অটোমেটিক মুখে এসে যায়।’
‘স্টুপিড।’
‘আমি জানি। নতুন কিছু বলুন।’
নিভৃত অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালো। এই মেয়ে তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। একে নাজিমগড়ের টিলা থেকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে বলে মনস্থির করলো নিভৃত। কিন্তু তাতে তো আরেক সমস্যা এই মেয়ে নাকি তাকে নিয়েই পড়বে!
_________________
‘সাবধানে যাস।’
‘ঠিক আছে মা। দোয়া করো। আর মিটির খেয়াল রেখো মা।’
‘আমার দোয়া সবসময় তোদের সাথে আছে পাগলী। তোর মিটির কোনো অযত্ন হবেনা।’
সবার থেকে বিদায় নিয়ে মৌন, নিভৃত বেরিয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে। নিভৃতের খয়রী রঙা টয়োটা প্রিমিউ এফ ই এক্স আপনমনে ছুটে চলেছে রাস্তায়। মৌনর বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। এই প্রথম নিভৃতের সাথে কোথাও যাচ্ছে সে। নীল রঙের উড়নাটা মাথায় টেনে দিলো সে। আড়চোখে তাকালো নিভৃতের দিকে। কালো জ্যাকেট, জিন্স প্যান্ট পরনে তাকে অনেক সুদর্শন লাগছে। ফর্সা হাতে ঘড়িটাও মানিয়েছে খুব। অদ্ভুত লোকটা গাড়ির ভিতরও সানগ্লাস পরে ড্রাইভ করছে। একটা ভেংচি কাটলো মৌন। এসব উদ্ভট স্টাইল দেখলে তার গাঁ জ্বলে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। শো শো বাতাস বইছে। ঢাকার রাস্তায় মানুষের হিড়িক। সূর্যের দাপটে বিস্তার চলছে। শুষে নিচ্ছে মানুষের পরিশ্রমী মনোভাব। ক্লান্ত, অবসাদে ভরে দিচ্ছে যেন। ভ্যাপসা গরম চারদিকে। বৃষ্টি হওয়ার লক্ষন হয়তো! আর কিছুক্ষণ পরেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টির তালে নেচে উঠবে ধারা। ক্লান্ত, অবসাদে ছন্দহীন মানুষগুলোও একটু ছন্দের সন্ধান পাবে। সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টে কি অপেক্ষা করছে মৌন, নিভৃতের জন্য!
(চলবে)…….
(পাঠকগণের কাছে একটা প্রশ্ন। মৌন কাকে একতরফা ভালোবাসে? কেন পূর্ণতা পায়নি তার একপাক্ষিক ভালোবাসা?’)