ময়ূখ পর্ব-২৫

0
2214

#ময়ূখ
#পর্ব-২৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৩.
তীব্র মাথা যন্ত্রণায় কাতর নিভৃত। তিনটা ঘুমের বড়ি খেয়ে পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে। এই দুষ্কর দুনিয়ায় নিজেকে নিজের কাছে গোলকধাঁধার ন্যায় মনে হয় তার। মস্তিষ্ক আর মনের এ এক অসীম দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে বারবার পিষ্ট হচ্ছে নিভৃত।

পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। চড়ুই, কাকের ডাক ভেসে আসছে কানে। মৌন মাথায় কাপড় দিয়ে নিভৃতের ঘরের দরজাটা আস্তে করে খুলে ঘরে ঢুকে। ফজরের নামাজের পর আর ঘুমায়নি সে। নিভৃত খাটে ঘুমে বিভোর। মৌন আলমাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। চোখদুটো তার লালবর্ণ। সারাটা রাত কেঁদেছে। চোখের পানিও বোধহয় শুকিয়ে গিয়েছে এখন। আলমাড়ি খুলে নিজের কালো রঙা ডায়েরিটা বের করে মৌন। ডায়েরির শেষের পাতায় কিছু লাইন লিখে। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট টা খুলে ডায়েরির শেষ পাতায় সেফটিপিনের সহায়তায় লাগিয়ে দেয়। সযত্নে ডায়েরিটা আলমাড়ির ভিতর কাপড়ের ভাঁজে রেখে দুইটা কাপড় ব্যাগে ঢুকায় মৌন। গত চারমাসে তিনটা টিউশনি করিয়ে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা জমিয়েছিলো তা তুলে নেয় ব্যাগে। কালো রঙের বোরকাটা পরে নিভৃতের মুখপানে চায় মৌন। ভালোবাসার মানুষকে কখনো ঘৃণা করা যায়না। নয়তো মৌন করতো। নিভৃত নামক মানুষটাকে মনের সবটা দিয়ে ঘৃণা করতো। চোখের কোণায় জমা হয় বেহায়া নোনাজল। মৌন মুছে নেয়। পেটে বাম হাতটা রেখে বিরবির করে,
‘তোমার কি বাবার খুব প্রয়োজন? তোমার মা যদি তোমার বাবার ভূমিকা পালন করে তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?’

উত্তর আসেনা। দুইমাসের বাচ্চা কি বুঝে মায়ের দগ্ধ মনের কষ্টে বলা বিক্ষিপ্ত কথারমালা!

___________________

দুপুর দুইটা বাজে। মিরা নিভৃতের ঘরে প্রবেশ করেছেন। নিভৃতকে ঘুমে দেখে অবাক হোন তিনি। নিভৃতের শিয়রে বসে ডাকেন,
‘বাবুই। বাবুই উঠ্।’

নিভৃত আস্তে আস্তে চোখ মেলে। ঘুমের ঘোর এখনো যায়নি তার। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেকটা সময় কেটে যায়।
‘আজ এতোবেলা করে ঘুমুচ্ছিস যে? শরীর খারাপ।’

মিরা হাত বাড়িয়ে নিভৃতের কপাল ছুঁয়ে দেখেন। তবে জ্বর নেই। তিনি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছেন। সকালে মৌন ফোন করে বলেছিল বাড়ি যাচ্ছে জরুরি কাজে। তিনি গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তবে মেয়েটা গাড়ি নেয়নি।

‘আম্মু, একটা ব্ল্যাক কফি দিতে বলোতো।’

মিরা কাঁথা ভাজ করছিলেন। কাঁথাটা জায়গামতো রেখে তিনি বললেন,
‘তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নিয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা।’

নিভৃত ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হতেই অফিস থেকে জরুরি কল আসে। না খেয়েই বেরিয়ে যায় নিভৃত। জরুরি কাজের চিন্তায় কাল রাতের ঘটনা এখনো মস্তিষ্ক স্মরণ করেনি। তাই সব ভুলে বসে আছে সে।

____________________

বারোটা নাগাদ ফরিদপুর পৌঁছেছে মৌন। মর্জিনা মুখটা মলিন করে রেখেছেন। নিতু ছয়মাসের গর্ভবতী। শশুর বাড়িতে একটা মোটর সাইকেলের জন্য এখনো অত্যাচার করা হয় তাকে। ভারী ভারী কাজ করানো হয়। তাই নিতুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মর্জিনা। রিপ্ত বাড়িতে নেই। ধানের ব্যবসা দিয়েছে নতুন। সেই সুবাদে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছে। আলম সাহেব এখন বেশি চলাচল করতে পারেন না। শরীর নরম হয়ে এসেছে। পরিবারের খরচ এখন রিপ্তের ঘাড়ে। মৌন একটা মোড়া নিয়ে মিঠা রোদের মাঝে বসে আছে। পিছনে বিস্তৃত ধানক্ষেতের শো শো বাতাস। পুষ্পসহ গ্রামের কয়েকটা মেয়ে গোল্লাছুট খেলছে। মৌন একধ্যানে তাদের দেখছে। পাশে গরুর গোবর দিয়ে ঘুঁটে তৈরী করছে রথি। কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজা তার। মেয়েটা এখন পাক্কা সংসারী।

৭৪.
‘আপা, দুলাভাই কখন আসবো?’

রথির প্রশ্নে তার দিকে ফিরে মৌন। মলিন হেসে বলে,
‘কেন? তোর আপা কি একা থাকতে আসতে পারেনা?’
‘তা না। এমনি বললাম।’

রথি আবার কাজে মন দেয়। হঠাৎ করেই রথির অদ্ভুত লাগছে। এভাবে মৌনর বাড়িতে আসার মানে কি। তাও শশুর বাড়ি না গিয়ে বাবার বাড়ি এলো! রথির মনে ভয় ঢুকে যায়। রিপ্ত অনেক কষ্টে ওঁর হয়েছে। আবার যদি রিপ্তর মন ঘুরে যায়! শিউরে উঠে রথি। মৌন উদাস ভঙ্গিতে মেয়েদের গোল্লাছুট খেলা দেখছে। রথি অনুধাবন করে তার আপাকে তার বিরক্ত লাগছে। বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে!

মর্জিনা রান্নাঘরে লতি কাটছেন। নিতু বলেছিলো শুটকি দিয়ে লতি তরকারি খাবে। তাই এই আয়োজন। পাশে বসে নিতু আচার খাচ্ছে। মৌন মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছিলো। নিতুর আচার খাওয়া দেখে তারও বড্ড ইচ্ছে করছে আচার খেতে। মর্জিনার কাছে গিয়ে পাশে পিঁড়িতে বসে মৌন। চুলার পাড়ে আচারের বয়াম দেখে বলে,
‘মা, একটু আচার দাওনা।’

মর্জিনা কপাল কুঁচকে তাকান। এমনিতেই নিতুর চিন্তা। আলম অসুস্থ,রিপ্ত বাড়ি নেই। ঘরে তাদের যথেষ্ট চাল রয়েছে। তবে মৌনর জন্য আবার বাড়তি রাঁধতে হবে। এতো বড় শশুর বাড়ি ফেলে বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে আসার কোনো মানে হয়! সকালে মাত্র এসেছে। তাই তিনি কিছু বলতেও পারছেন না।
‘কেন? তুই কি পোয়াতি?’

মায়ের প্রশ্নে থতমত খায় মৌন। কি বলা উচিত এখন তার!
‘না, মানে।’
‘মৌন যা তো এক কলসি পানি নিয়ায় কলপাড় থেকে। কাজ করতাছি বিরক্ত করিসনা।’

মৌন সত্যিই অবাক হয়। মায়ের আচরণ, রথির আচরণ এতো অচেনা কেন লাগছে তার!
‘মা, তুমি পুষ্পরে বলো। আমার একটু সমস্যা আছে।’

মৌন কথাটা বলে উঠে যায়। মর্জিনা বিরক্তিসহ তাকিয়ে পুষ্পকে হাঁক ছাড়েন।

শাপলাবিল থেকে মাগরিবের আজানের মায়াবী সুর শুনে বাড়ি ফিরে মৌন। কি অদ্ভুত! কেউ তার খুঁজ করেনি। এমন কি পুষ্পও না।

আলমের সাথে খানিকটা সময় কাটিয়ে খাবার খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে মৌন। মা কি সুন্দর বড় আপাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। মৌনর ইচ্ছে জেগেছিলো মায়ের হাতে ভাত খাবে। কিসের যেন একটা বাঁধা। মা,বোনের অদ্ভুত ব্যবহার কি সেই বাঁধা!

রাত দশটা। নিভৃত ক্লান্তচিত্তে বাড়ি ফিরে। ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

কেটে গিয়েছে দুইদিন। নিভৃত এখন পাগলপ্রায়। মেয়েটা কোথায়? বাড়িতে আছে কি? তার সামনে আসেনা কেন?

‘আম্মু?’
‘কিছু বলবি বাবুই।’
‘আম্মু, ও কোথায়?’
‘কে?’
‘তোমার বউমা।’
‘মৌনর কথা বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘মৌন তো গ্রামে গেছে।’

নিভৃত অবাক হয়ে। অবাক কন্ঠে বলে,
‘কবে?’
‘গত পরশু।’

এরমানে মেয়েটা সেই ঘটনার পরেরদিনই বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। আর নিভৃত ভেবেছে রাগে হয়তো সামনে আসেনা।
‘আম্মু, আমি ফরিদপুর যাচ্ছি।’
‘এখন?’

নিভৃত কোনো কথা শুনলোনা। নিজের সাদা রঙা মার্সিডিজ নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সে।

৭৫.
সবাই খেতে বসেছে দুপুরে। মর্জিনা নিতুকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। রথি, পুষ্প পাশে বসে খাচ্ছে। আলম আগেই খেয়ে উঠেছেন। মৌন রুইমাসের তরকারি নিতে যাবে তখনই মর্জিনা বলেন,
‘আর বলিস না মৌন। রুই মাছ এতো দাম! জব্বার জেইল্লা তে মাছ কিননেরই কথা না। একটা মাছ নাকি তিনশ টাকা। বাপরে বাপ।’

মৌন মাথাটা নিচু করে পাশে রাখা বাটিতে ডাল থেকে দুই চামচ ডাল নেয়। হায়! যাদের সুখের জন্য নিজে বলি হলো আজ তারা তাকে মাছের দাম শুনাচ্ছে! জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত!

রিপ্ত এখনো ফিরেনি। রিপ্তের সাথে কথা বলছিলো রথি। রিপ্ত এখন অনেকটাই ভালো ব্যবহার করে তার সাথে। রথি কি জানে রিপ্তের ভালো ব্যবহারের পিছনে মৌনর অবদান ঠিক কতোটা!

‘রথি, বোন।’

মৌনর কণ্ঠ শুনে তড়িঘড়ি করে কলটা কেটে দেয় রথি। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘কিছু বলবা আপা।’
‘তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস বোন?’
‘না।’
‘তো কথা বলিস না কেন?’
‘আমি কি আজাইরা বাপের বাড়ি থাকি? ঘর আছে, সংসার আছে। ধান সিদ্ধ করা আরো কত কাজ। তোমার সাথে গল্প করি কখন।’

মৌন রথির কথায় খুবই কষ্ট পেয়েছে। সত্যিই কি সে বাবার বাড়ি অহেতুক পড়ে আছে? কতটা যন্ত্রণায় এসেছে সেই তো জানে। স্বামী গাঁয়ে হাত তুলে, পেটে একটা বেড়ে উঠছে। এদিকে স্বামী নাকি বাচ্চা চায়না। কোথায় যাবে মৌন। সে তো অকুল পাথারে পড়েছে।

নিজের ঘরে ঢুকে মৌন। মোবাইল ঘেঁটে কাঙ্খিত নাম্বারটা খুঁজে। যদি সে ব্যাক্তিটা একটু আশ্রয় দেয়।

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here