ময়ূখ পর্ব-৩০

0
2611

#ময়ূখ
#পর্ব-৩০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৮.
মৌনকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো নিভৃত। পাগলের মতো চিৎকার করছে সে।।মৌনর রক্তে লেপ্টে যাচ্ছে তার শরীর। দুইজন নার্স আর একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন। ওটিতে নেওয়া হলো মৌনকে। নিভৃত বাইরে পায়চারী করছে। মিরা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। হচ্ছে কি এসব! প্রথমে নাজমুল সাহেব প্যানিক এটাক করলেন এখন আবার মৌন। মিরা এগিয়ে গেলেন নিভৃতের দিকে। নিভৃত উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছে। মিরা জড়িয়ে ধরলেন নিভৃতকে। নিভৃত কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে। ভেজা গলায় নিভৃত বললো,
‘আম্মু, আমার মৌন। আমার বাচ্চা। ওদের কিছু হলে আমি যে মরে যাবো আম্মু।’
‘হুস্। এসব বলেনা বাবুই। আল্লাহর কাছে চেয়ে দেখ। আল্লাহ নিরাশ করবেন না।’

ডাক্তার বেরিয়ে এসেছেন। নিভৃতকে ইশারা করলেন তার কেবিনে যেতে। নিভৃত দৌড়ে গেলো। ডাক্তার এমজাদ চেয়ারে বসলেন। নিভৃতকে বসতে ইশারা করলেন তিনি। নিভৃত চেয়ারে বসলো।
‘আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর? আমার সন্তান?’

উৎকন্ঠিত স্বর নিভৃতের। যেনো শ্বাস নিতে পারছেনা সে।
‘দুজনেই ভালো আছে।’

নিভৃতের চোখেমুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো সে।

‘আপনার স্ত্রী অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন এবং অতিরিক্ত চাপ ও পেটে আঘাতের ফলে রক্তপাত হয়েছে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে আরো বড় কিছু ঘটতে পারতো।’

নিভৃতের কর্ণকুহরে কিছুই যাচ্ছেনা। সে ছটফট করছে কখন মৌনর কাছে যাবে। ডাক্তার এমজাদ আগে থেকেই নিভৃতকে চিনেন। তিনি গলার স্বরটা একটু গম্ভীর করে বললেন,
‘মি.নিভৃত।’
‘জ্বি।’
‘অনেক সময় আঘাত বা পানি বেশি থাকার কারণে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সময়ের আগেই জরায়ু থেকে সরে আসে। এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যাকে বলে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’। যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয় বটে। এই সময় এসব রোগীকে আমরা হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সির রোগী হিসেবে শনাক্ত করে চিকিৎসা করি।’
‘হাই রিস্ক মানে! আমার স্ত্রীর কিছু হবেনা তো ডক্টর!’
‘দেখুন সেটা তো আর আমি বলতে পারবোনা।’

নিভৃত দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে,
‘বলতে পারেবেন না মানে কি! তাহলে আপনি ডক্টর হয়েছেন কেন?’

৮৯.
ডাক্তার এমজাদ মোটেও রাগ করলেন না। তার ক্যারিয়ারে এমন অনেক পাগলাটে স্বামী, পরিবারের সদস্য তিনি দেখছেন। একদিন তো একজন তার কলার পর্যন্ত ধরেছিলো। এমজাদ মৃদুস্বরে বললেন,
‘মাথা ঠান্ডা করে বসুন মি.নিভৃত।’
‘আমার স্ত্রী, বাচ্চা বিপদের মুখে আর আপনি আমাকে মাথা ঠান্ডা করতে বলছেন ডক্টর!’
‘দেখুন মি.নিভৃত আপনি আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি বোধহয়। জন্ম, মৃত্যু সবই তো আল্লাহর হাতে। আমরা কেবল চেষ্টা করতে পারি।’

হঠাৎ নিভৃত ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে। দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে দেয় সে। এতদিন পর পেয়েও কি সে আবার হারিয়ে ফেলবে! ডাক্তার এমজাদের বড়ই মায়া হচ্ছে। তিনি নরম স্বরে বললেন,
‘এভাবে ভেঙে পড়বেন না নিভৃত। আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।’

নিভৃত নিজের চেক শার্টে চোখ মুছলো। ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কোনো উপায় কি আছে ডক্টর?’
‘আপনার বাচ্চার সবে সাড়ে পাঁচমাস। ছয়মাস হলেও সিজার করা যেতো। এখন রক্তপাত অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। আপনাদের ভাগ্য ভালো যে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’ খুবই অল্প পরিমাণে হয়েছে। তাই বাচ্চাকে মাতৃগর্ভে আরো কিছুদিন রাখা যাবে।’
‘আমার এখন কি করতে হবে ডক্টর?’
‘আপনার স্ত্রীকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। ভারী কাজ করা যাবে না একদমই। দুশ্চিন্তামুক্ত ও সদা হাসিখুশি থাকতে হবে। আই রিপিট কোনো ক্রমেই রোগীকে মানসিক চাপ দেওয়া যাবেনা। তলপেটে আঘাত, চাপ লাগা বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না। দূরবর্তী স্থানে বা ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ করা যাবে না। সহবাস থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। কি মেনে চলতে পারবেন তো মি.নিভৃত?’
‘ইয়েস, ডক্টর।’
‘গুড। আসলে সৃষ্টিকর্তা আপনার সহায় তাই আপনার স্ত্রীর থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ইনফেকশনজনিত কোনো সমস্যা নেই। থাকলে সমস্যা হতো।’
‘আমি ওকে কবে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো?’
‘কালকেই নিয়ে যেতে পারবেন। তবে কথাগুলো মাথায় রাখবেন। আর খাবারের ব্যাপারে একটু সতর্কিত হতে হবে। উনি একদমই খাওয়া দাওয়া করেন না। শরীরে পানি জমার দরুন শরীর ফোলা দেখা যায়। তবে উনার শরীরে পুষ্টির অভাব রয়েছে। সেই সাথে প্রেসক্রাইভ করা মেডিসিনগুলো নিয়মিত খাওয়াবেন। আমি বারবার বলছি নিভৃত কোনো ক্রমেই উনাকে মানসিক চাপ দেওয়া যাবেনা।’
‘আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ডক্টর।’
‘আপনার স্ত্রীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সকালে জ্ঞান ফিরবে। কেবিনে শিফট করে দিবে কিছুক্ষণ পর।’
‘আচ্ছা,ডক্টর। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘এটা আমার কর্তব্য মি.নিভৃত।’
‘ডক্টর এমজাদ। আই এম সরি। আসলে…..
‘ইট’স ওকে মি.নিভৃত। আমি কিছু মনে করিনি। এসবের আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।’
মুচকি হাসলেন ডাক্তার এমজাদ। নিভৃত লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। সে আসলেই লজ্জিত।
______________________

মিরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে ছিলেন বাইরে। নিভৃতকে বের হতে দেখে নিভৃতের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।
বিচলিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ডাক্তার কি বললো বাবুই?’
‘দুজনে ঠিক আছে আম্মু।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’

নিভৃত হঠাৎ করেই মাকে জড়িয়ে ধরলো। মিরা ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। নিভৃত কাঁদছে। কাঁদুক। কিছু কিছু সময় মানুষকে কাঁদতে দিতে হয়। তাতে তার মন হালকা হয়।

৯০.
সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে বারান্দায়। ফিনাইল আর স্যাবলনের ভ্যাপসা একটা গন্ধ। রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা বাইরে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। হয়তো তারা এখানেই রাত কাটিয়েছেন। এপেলো হাসপাতালে বিশাল বড় হলরুম। সেখানে সারি সারি নীল, হলুদ চেয়ার রাখা। অনেক গুছানো পরিবেশ। সরকারি হাসপাতাল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও সবই টাকার খেলা। মৌন বেডে শুয়ে আছে। ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রথমেই হাতটা চলে গিয়েছিলো পেটে। তবে পেটটা উঁচুই আছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো মৌন। বাচ্চাটাই যে তার একমাত্র অবলম্বন। মৌন পাশে তাকিয়ে দেখে নিভৃত মেঝেতে বসে তার বেডে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মৌন তাকিয়ে রইলো একটানা। এই নিষ্পাপ মুখটাকে হয়তো সে অনেক অনেক ভালোবাসে। সারাজীবন বেসে যাবে। হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেললো নিভৃত। মৌনর দিকে তাকিয়ে দু ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি প্রাণপাখি লুকিয়ে লুকিয়ে রাজপুত্রকে দেখা হচ্ছে বুঝি?’

মৌন ভেংচি কেটে অপর দিকে মুখ ঘুরালো। নিভৃতের সাথে কথা বলতে সে আগ্রহী নয়। মিরা হাসিমুখে কেবিনে ঢুকলেন। মৌনর মাথার কাছটায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কি মা। এতো রাগ আপনার। গর্দভটার সাথে রাগ করে বাবা-মাকে ফেলে চলে গেলেন?’
‘আসলে মা…..
‘হুম, বুঝেছি আমি আর বলতে হবেনা। আর কোনোদিন এভাবে আমাদের রেখে যাবিনা মা।’
‘মা, বাবা কেমন আছেন?’
‘অনেকটা ভালো।’

নিভৃত বাইরে গিয়ে স্যুপ নিয়ে এসেছে। রাতের শার্টটা পরিবর্তন করে একটা টি-শার্ট পরেছে সে। নার্স স্যালাইন খুলে বলেছিলেন সকালে ঘুম ভাঙলে কিছু খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে। মিরা মৌনকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়েছেন। মৌন ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আবার বেডে শুয়ে পড়েছে। তলপেটে চিনচিন একটা ব্যথা হয়। যা দরুন হাঁটা খুবই কষ্ট। হাত নাড়াচাড়াও করা যায়না৷
নিভৃতকে ঢুকতে দেখে মিরা বেরিয়ে গেলেন। নিভৃত মুচকি হেসে বেডের পাশে চেয়ারটায় বসলো। হাতে গরম স্যুপের বাটি। মৌন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। যদিও তার প্রচুর পরিমাণে ক্ষুধা লেগেছে।
‘জান, একটু খেয়ে নাও।’

মৌন অন্যদিকে ফিরেই বললো,
‘একদম এসব উদ্ভট নামে আমাকে ডাকবেন না।’
‘তাহলে কি ডাকি। আচ্ছা, আমার ময়না পাখি, আমার বাবুর আম্মু স্যুপটা খেয়ে নাও।’

মৌন কপাল কুঁচকে নিভৃতের দিকে তাকালো। নিভৃত হাসছে। মৌনর কপাল আরো কুঁচকে গেলো। বুড়া, ধামড়া ছেলের আবার ঢং! হুহ্!

(চলবে)….

(এতো এতো রিকুয়েষ্ট! আপু আরেকটা পর্ব দেন। আরেকটা পর্ব দেন। এই যে দিলাম। এবার পাঠকগণ আমি যে এক্সামের পড়া রেখে গল্প লিখেছি আমাকে কি দিবেন বলেন?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here