ময়ূখ পর্ব-৯

0
1819

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৯

২৫.
‘নিভৃত তুমি মৌনকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে দিয়ে আসো।’
‘বাবা, তোমার কথায় ফরিদপুর এসেছি। এসব আমি পারবোনা।’

বিরক্ত কন্ঠে বলে নিভৃত। নাজমুল রহমান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেন,
‘আজ দিয়ে আসো। পরে আর যাওয়া লাগবেনা।’
‘আচ্ছা।’

_________________

বিকেলবেলা। আরু,নিরুর সাথে বড় জামগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছে মৌন। পাশে রুমি লাউগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ছে। ছোটমার জন্য লাউপাতা ভর্তা করবে। দিথি, মিথি পাশেই দঁড়িলাফ খেলছে। এবার সাতবছরে পড়লো দুইটা। এতো দুরন্ত!
আরু হাসিমুখে বললো,
‘কিরে ভ্যাবলি কপাল লেগেছে তোর। এতো সুন্দর বর পেয়েছিস। আমাদের তো বিয়ের পর একটা ফোনও করলিনা।’

মৌন মলিন হেসে বললো,
‘হ্যাঁ রে খুব কপাল লেগেছে। একেবারে সোনায় সোহাগা।’

সে যে কতটা কষ্টে আছে তাদের কি করে বুঝাবে। একটা মেয়ে জীবনে সবচেয়ে বেশি চায় স্বামীর আদর, সোহাগ, ভালোবাসা। টাকা, পয়সার ঊর্ধ্বে এক টুকরো ভালোবাসা। মৌনর তো এই আসল জিনিসটাই নেই। আদোও কখনো পাবে কিনা সন্দেহ। সব জেনে শুনেই তো সে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। বাকিটা কি হয় সময়ই বলবে।

নিরু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মৌনর মতো মেয়ে যে এতো বড় ঘরের বউ হবে তা এখনো অবিশ্বাস্য লাগে নিরুর। যদিও ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে মৌন। তবুও এই মেয়ের এতো রাজকপাল! রুমি লাউপাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে,
‘কেন গো মৌন! আমাদের নিভৃতকে স্বামী করে পাওয়া সোনায় সোহাগা না?’
‘সেটাই তো বললাম বড়ভাবি।’

রুমির ডাক পড়ায় সে চলে যায়। নিরু জামগাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘রুহানি ভাবি ছিলো ছোটভাইয়ার যোগ্য স্ত্রী। যেমন সুন্দর তেমন গুণ। গানে শুনেছিলাম জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল। তার উপর রুহানি ভাবির বাবা বড় ব্যবসায়ী। ভাগ্য কত নির্মম। এক হয়েও তারা এক হলোনা। মাঝখানে তোর কপাল লাগলো।’

নিরুর মুখের কথা প্রচুর গাঁয়ে লাগে মৌনর। তবে সে কিছু বলেনা। এই বাড়িতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাকে পছন্দ করলেও কিছু কিছু মানুষের কাছে সে চক্ষুশূল।

‘আহ্, নিরু এসব কেমন কথা।’
‘কেন আরু ভুল কিছু বললাম?’
‘সামান্য স্কুল মাস্টারের মেয়ে হয়ে….

আর কথা বাড়াতে পারেনা নিরু। মিনা হাতে প্লেট নিয়ে এগিয়ে আসে। তাদের সাথে বসে। মৌনর কাছে শ্যামবর্ণের ছিপছিপে গড়নের মিনাকে খুব ভালোলাগে। মৌন তাকে ছোটভাবি ডাকে। তবে মিনার জন্য কষ্টও হয়। বিয়ের দশবছরেও কোনো বাচ্চা হয়নি। তা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তবে সুজন তাকে ছেড়ে দেয়নি। প্রত্যেকটা বিপদে আগলে রাখে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে।
‘কেমন আছো মৌন?’
‘ভালো আছি ছোটভাবি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আল্লাহ রাখছে ভালো।’
‘কোথায় ছিলেন দেখলাম না এতক্ষণ?’
‘আর বলোনা তোমার ভাইয়ের সাথে চর কমলাপুর ব্রিজ গিয়েছিলাম। তোমার ভাইকে তো চিনো যখন যেটা মাথায় আসে। সে নাকি ঘুরতে যাবে।’

বলেই মিষ্টি করে হাসলো মিনা। কি নির্মল সে হাসি! মৌনর মনটা ভালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগের খোঁচা মারা কথাগুলো শুনে যেই খারাপ লাগা কাজ করছিলো তা যেন কেটে গেলো নিমিষেই।
‘মৌন ছোটভাবিকে ভুলে গেছো। ছোটভাবি কিন্তু তোমার কথা ভুলিনি। আজ জানতাম তোমরা আসবে তাই চর কমলাপুর ব্রিজ থেকে কবুতরের মাংসের চপ আনছি। তোমার যে খাবারটা পছন্দ তা কিন্তু ভুলিনি।’

বলেই প্লেটের ঢাকনাটা সরিয়ে একটা চপ মৌনর হাতে দেয় মিনা। আরু, নিরুকেও দেয়। মৌন অবাক হয় মানুষ এতো ভালোও হয়!

২৬.

গল্প, আড্ডা, হাসি ঠাট্টায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। জামগাছের হালকা টিয়া পাতাগুলো শো শো বাতাসে উড়ছে। মগডাল থেকে একটা কাঠবিড়ালি উঁকি দিয়ে চার রমণীর কথোপকথন শুনছে। তবে তার মস্তিষ্ক কিছু ঠাউর করতে পারছে কিনা সন্দেহ! বোকা কাঠবিড়ালি একসময় ক্লান্ত হয়ে যায় তবুও রমণীদের গল্প ফুরায় না। তবুও কাঠবিড়ালি দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বসে বসে গল্প শুনে। রমণীদের হাসি দেখলে তার ঠোঁটটাও প্রসারিত হয়। যদিও তার ঘরের রমণী এসব দেখলে তাকে ত্যাগ করবে। এমনিতেই তার বদনাম। সে নাকি অন্য নারীতে আকৃষ্ট। এই স্ত্রী জাত মানেই ভেজাল!

__________________

নিভৃত কিছুক্ষণ যাবত ঘুরঘুর করছে। বাবা বলে দিয়েছে মেয়েটাকে তার বাড়ি দিয়ে আসতে। নিভৃত বাবা-মাকে বলেছিলো সাথে যেতে। তবে তারা নাকি কাল একেবারে বিয়েতে যাবে। একদিকে নিভৃত খুশিই হয়েছে। বেয়াদব মেয়েটাকে বাড়িতে পাঠাতে পারলে সে শান্তিতে রাতে থাকতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো নিভৃত মেয়েটার নাম ভুলে গেছে। তাই চাইলেও ডাক দিতে পারছেনা। এখন তাদের আড্ডার মাঝে গিয়েতো বলতেও পারবেনা,
‘এই মেয়ে আসো।’

আরু নিভৃতকে খেয়াল করে বললো,
‘ছোটভাইয়া কিছু বলবে?’

আরুর কথায় বাকি তিনজনও সেদিকে তাকালো। নিভৃত থতমত খেয়ে বললো,
‘হ্যাঁ।’

আরু উৎসাহী হয়ে বললো,
‘কি?’
‘ওকে একটু দরকার?’

আঙুল উঁচিয়ে মৌনকে দেখালো। মৌন অবাক। বাহ্বা! হঠাৎ ভূতের মুখে রামনাম!
মিনা হেসে বললো,
‘বউকে দরকার ভাই?’

নিভৃত জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল। এসব আদিখ্যেতা তার বিরক্ত লাগে। মৌন এগিয়ে এলো নিভৃতের দিকে। খোঁচা মারা কন্ঠে বললো,
‘আজ সূর্য বোধহয় পশ্চিম দিকে উঠেছে।’
‘কেন?’
‘না, আপনে আমায় ডাকলেন?’
‘ইচ্ছায় ডাকিনি। যাও গিয়ে রেডি হয়ে নাও। সময় দিলাম দশমিনিট।’
‘কোথাও যাবো আমরা?’

উৎসাহী গলায় বলে মৌন। নিভৃত বিরক্তি কন্ঠে বলে,
‘কেবল বাবার কথায় তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবো। তোমার সাথে ঘুরতে যাবো! মানে তুমি ভাবলে কিভাবে!’

মৌন কথা বাড়ায় না। ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে আসে। সুমনা, মিরা, নাজমুল সবার সাথে কথা বলে নিভৃতের সাথে রওনা দেয় নিজের বাড়ির দিকে। যদিও মৌন বলেছিলো হেঁটে যেতে। কেবল দশ মিনিটের রাস্তা। তবে নিভৃত তার কথায় পাত্তা দেয়নি।
কালকে বিকেলে আলম কল করে জিজ্ঞেস করেছিলো পুষ্প, রথিকে পাঠাবে কিনা। মৌন মানা করে দিয়েছে।

২৭.
পাকা রাস্তা ধরে সোজা গেলেই মৌনদের বাড়ি। দুইপাশে কেবল ধানক্ষেত। সবই ব্যারিষ্টার বাড়ির। এক দুইটা বাড়িও আছে। মার্সিডিজ গাড়িটা এসে থামলো মৌনদের বাড়ির সামনে। আর সামনে যাওয়া যাবেনা। কারণ বাড়ির সামনে চিচিঙ্গা, কুমড়োর টাল। নিভৃত গাড়ি থামিয়ে বলে,
‘এই মেয়ে এখন কি আমার ভিতরেও যেতে হবে?’
‘আপনি না গেলে আমার অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই সাথে আসলে ভালো হয়।’

নিভৃত মুখটা বিকৃত করে বললো,
‘চলো।’

গাড়ি থেকে নামতেই পুষ্প, রথি দৌঁড়ে আসে। রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়ের সাথে বানানো মাচায় বসে গল্প করছিলো দুজনে। বাড়িতে গেলেই মা কাজ দেয়। তারউপর আজ তাদের আপা আসবে। দুজনে তো তৈরিও হয়ে গিয়েছিলো ব্যারিষ্টার বাড়ি যাবে বলে। তবে বাবা মানা করেছে বলে যাওয়া হয়নি।
‘আপা, কেমন আছো?’

‘ভালো, তোরা কেমন আছিস?’
‘আমরাও ভালো।’

অতঃপর তারা তাকায় ছয়ফুট লম্বা সুদর্শন দুলাভাইয়ের দিকে। পরনে দামি জ্যাকেট, প্যান্ট, জুতা। নিভৃত এসবে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে কেবল! বাবা-মায়ের উপর রাগ লাগছে প্রচন্ড। রথি কিছু বলবে তার আগেই মর্জিনা এগিয়ে এলেন। মাকে দেখে দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরলো মৌন। এই পান খেয়ে মুখ লাল করা মানুষটাকে সে ভিষণ ভালোবাসে। মর্জিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। তারপর নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাবা, তুমি আসছো আমি অনেক খুশি হইছি। ভিতরে আসো।’
‘জ্বি, আন্টি।’

উঠানে এসে দাঁড়াতেই নিভৃতকে ঘিরে ধরলো একঝাঁক মহিলা। যেন সে কোনো এলিয়েন। আগেরবার গোপনে বিয়ে করে চলে গিয়েছিলো সেটাই ভালো ছিল। এখন এই একঝাঁক মহিলার কাছ থেকে তাকে কে বাঁচাবে! অস্বস্তিতে মুখ কালো হয়ে আসে তার। কাঙ্খিত ব্যাক্তিটিকে খুঁজে সে। তবে মেয়েটি তো বোনদের পেয়ে তাকে রেখেই পালিয়েছে। একবার মেয়েটাকে হাতে পাক। নিভৃতও মজা বুঝাবে।

(চলবে)…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here