যখন দুজনে একা পর্ব-২৪

0
2929

#যখন_দুজনে_একা

২৪ পর্ব

রুবা আর মাহি র গাড়ি যখন গেট দিয়ে ঢুকছে নিঝুম তখন পোর্চের উপর দাঁড়িয়ে ! হঠাৎ ওর মনটা ভালো হয়ে গেল! মাহিকে দেখার জন্য সেই মেডিকেল কলেজ এ পড়ার সময় উদ্বগ্রীব হয়ে থাকতো হঠাৎ আজ সেরকম ফীল করছে !
রুবা তুমি আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার মাহি কে নিয়ে চলে যাচ্ছো, ওর ঘরে তোমার দুনিয়া সাজাচ্ছো তোমরা ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো আমি দর্শক এর মত দেখব ! আমি পারছি না সে সব সহ্য করতে ।
আমি জানি মাহি এ সব কিছু আমাকে দূরে ঠেলে দেয়ার জন্য করছে !
তোমার প্রতি এই যে ওর দ্বায়িত্ব সব খালাম্মা র জন্য আর কিছু না ! তুমি আবার এটাকে ওর ভালোবাসা ভেবো না।
মাহি তার নিঝুম কে কখনো কষ্ট দিতে পারে না ! ও আমাকে উজার করে ভালোবাসে!
আমি পারব না মাহি কে তোমার জন্য ছেড়ে দিতে , নিঝুমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে !
অন্ধকার বলেই এই ছাদে ওকে কেউ দেখছে না ! ও চুপ করে বসে আছে!
এখান দিয়েই মাহি যখন নিজের ঘরে যাবে তখন ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে!
অনেক হয়েছে দ্বায়িত্ব কর্তব্য এবার নিজেদের জন্য বাঁচতে হবে আমাদের মাহি!
আমি তোকে কষ্ট দিচ্ছি মাহি , কিন্তু কি করব বল নিজেকে কোন ভাবেই ফিরাতে পারি না !
নিঝুম চোখের পানি মুছে অপেক্ষা করছে মাহির জন্য!
রুবা আর মাহি দোতলায় উঠে এলো!
সাফিয়া বেগম ডাক্তার কি বলল সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে !
মাহি মায়ের পাশে গিয়ে বসলো , ওর শরীরে বসে থাকার শক্তি টুকু নেই মনে হচ্ছে!
মায়ের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে মাহি, জানতে চাইছে ডাক্তার কি বলল !
মাহি ইশারায় মা কে আস্বস্ত করলো!
রুবা বুয়াদের সঙ্গে ডিনার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে!
মাহি র খুব ভালো লাগছে ওর এই ব্যস্ততা টা ! নিজের কষ্টের থেকে বের হচ্ছে রুবা!
মাহি মনে মনে ভাবলো নিঝুম কে দেখছি না , মনে হয় চলে গেছে । ভালোই হয়েছে ও ইদানিং যা পাগলামী শুরু করেছে একটা যাচ্ছে তাই অবস্থা সৃষ্টি না করে থামবে না মনে হচ্ছে এই মেয়ে।

মাহি উঠে রুবার কাছে গিয়ে বলল, আমি রুমে যাচ্ছি তুমি মোবাইল টা তোমার কাছে রেখো কিছু লাগলে আমি ফোন দিব আর প্লিজ তাড়াতাড়ি রুমে এসো!
তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে ?
এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না , আমি রুমে যাচ্ছি!
চলো আমি তোমাকে দিয়ে আসি , রুবা বলল!
না তুমি থাকো সবার সঙ্গে কিন্তু কোন কাজ করার দরকার নেই ডাক্তার তোমাকে এখনো রেস্ট এর কথাই বলল তো শুনলে!
রুবা মাথা নাড়লো !
আমি যাচ্ছি রুমে !
মাহি সবার কাছ থেকে বলে রুমে র দিকে চলে গেল !

রুমে ঢুকে সোজা বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ল ! ড্রেস টা চেঞ্জ করতে হবে উঠার ও শক্তি পাচ্ছে না ! না আগে জ্বর টা মেপে দেখি কত ? মাহি উঠে থার্মোমিটার টা ঝেড়ে মুখে দিল !
দুই মিনিট পর হাতে নিয়ে দেখে ১০৪° মাথায় , শরীরে পানি দিতে হবে !
গেঞ্জি টা খুলে বিছানায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম আচমকাই পিছন থেকে এসে ওকে জাপটে ধরলো !
ঘটনার আকস্মিকতায় মাহি পুরোই হতভম্ব!
মাহি প্লিজ তুই আমার সঙ্গে এরকম করিস না , আমি তোর এই ব্যবহার সহ্য করতে পারছি না ! নিঝুম ওকে ধরে কেঁদে যাচ্ছে!
মাহি এক ঝটকায় নিঝুম কে পেছন থেকে টান দিয়ে সামনে আনলো!
কি হচ্ছে কি নিঝুম ?
মাহি প্লিজ তুই বল আমার কথা শুনবি বল আগে ?
কি কথা শুনব তোর ?আর তুই কি পাগল হয়ে গেলি এভাবে আমার বেড রুমে এসে জড়িয়ে ধরছিস! যা শুরু করেছিস আমি তো খুব ভয়ে আছি তোর হাবভাব দেখে ! তুই সর্বনাশের খেলায় মেতেছিস , নিঝুম!
আমি কিছু জানি না মাহি আমার মাথা কাজ করছে না !
নিঝুম নিঝুম প্লিজ তুই বস এখানে বস বলে ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল মাহি!
গেঞ্জি টা আবার পড়লো, নিঝুম আমার কথা শুন , মাহি নিঝুমের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো ওর শরীর এত খারাপ লাগছে কিন্তু সবচেয়ে জরুরি এখন নিঝুম কে বোঝানো!
নিঝুম, আমরা আর আগের মতো নেই তোকে বুঝতে হবে ! আমি তোকে চিট করে বলিস আর তোকে স্বার্থপরের মত ফেলে বলিস এগিয়ে গেছি ! আমি আর তোর মাহি নেই !
নিঝুম কাঁদছে!
আমাকে এখন যেভাবে পারিস ভুলে যা ! তোর সামনে অনেক বড় একটা জীবন পড়ে আছে তুই এভাবে তোর জীবনটা নষ্ট করিস না ! আমার অনুরোধ!
আমাকে দেখ আমি এগিয়ে যাচ্ছি সত্যি এগিয়ে যাচ্ছি! খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি! মাহি হাঁপিয়ে যাচ্ছে কথা বলতে বলতে , তবুও তাকে এই কথা গুলো নিঝুম কে আজ বলতেই হবে !
আমি পারব না মাহি কখনোই পারব না !
পারবি নিঝুম চেষ্টা করে দেখ , আমি পেরেছি !
আমি তোকে ফেলে আগাতে পারছি নিঝুম ! আমাকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে!
তুই তোর ভেতর টাতে রুবা কে জায়গা করে দিয়ে দিয়েছিস মাহি ? বলে মাহির বুকে হাত রাখলো নিঝুম!
মাহি চুপ করে আছে !
নিঝুম , রুবাকে জায়গা করে দিতে পেরেছি কিনা জানিনা তবে একটা চেষ্টা করে যাচ্ছি রে ! সবাই কে ভালো রাখার!
তুই যে সর্বনাশের নেশায় আমার দিকে বারবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিস , একবার চিন্তা করে দেখ তো আজ এখন এখানে মা , খালামনি কিংবা রিয়া আপু আসলে কি হবে এভাবে আমাদের দেখলে ? রুবার কথা বাদ দিলাম, ওদের সবাই যে প্রশ্ন করবে তার উত্তর আমরা কি দিতে পারবো?
রুবা কোন প্রশ্ন করবে না ও যদি বুঝে কিছু ও শেষ হয়ে যাবে অপরাধ বোধে !
আমরা কি আমাদের পরিবারের সন্মান টা শেষ করে দিব কিনা বল? খালামনি কিংবা মা একে অপরের সামনে কিভাবে মুখ দেখাবে? এটা আগে হলেও একটা কথা ছিল এখন বর্তমান অবস্থায় সেরকম কিছু হলে দুই পরিবারের ভাঙ্গন ঠেকাতে পারব না আমরা!

মাহি উঠে দাঁড়ালো , তুই যা নিঝুম আমি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছি তুই ও নে ! তুই ও জানি স্বার্থপর হতে পারবি না আমি ও পারি নাই! আগেও পারিনি এখন তো আরো পারব না।

নিঝুম উঠে দাঁড়ালো মাহির হাতটা ধরে বলল, তুই একবার শুধু একবার নিজের আর আমার জীবন টা চিন্তা কর মাহি আর সবাই একদিন দুইদিন কষ্ট পাবে তারপর সবকিছু একটা সময় ঠিক হয়ে যাবে , দেখিস!
নিঝুম প্লিজ , মাহি হতাশ হয়ে বলল।
তোকে দোহাই লাগে এসব বলিস না ! এখন যা এঘর থেকে বাসা ভর্তি লোকজন! রুবা আসবে যেকোনো সময় !
মাহি আর দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে পড়ে যাবে ওর শরীর গুলিয়ে বমি আসছে !
নিঝুম কোন ভাবেই মানছে না ! ওকে আবার ধরতে আসার আগেই , মাহি দৌড়ে ওয়াস রুমে ঢুকে গেল আর হরহর করে বমি করলো ওর মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবার দশা !
মাহি শাওয়ার ছেড়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো ! দেয়াল টা ধরে কাঁদছে মাহি !
নিঝুম আমাকে ক্ষমা করে দিস না । তোর অপরাধী হয়ে আমি বাঁচতে পারব কিন্তু কোন ফ্যামিলির কষ্টের কারণ হতে পারব না আমি ! তুই ভালো থাকলে তোর ফ্যামিলি ভালো থাকবে, রুবা আর মা ভালো থাকলে আমার ফ্যামিলি টা ! তোরা যে যাই বলিস আমি স্বার্থপর , আমার ভেতরে যে কষ্ট টা আছে আমি কাউকে দেখাতে পারি নাই !
আমি পারি নাই!
রুবা ও একা ছিল ,আমিও একা যখন দুজনেই একা ছিলাম আমরা একে অপরের একা থাকাটা থেকে এক সঙ্গে বের হ‌ওয়ার চেষ্টা করছি । তুই ও চেষ্টা কর নিঝুম ভালো থাকার!

মাহি অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইল একটা সময় গা কাঁপা শুরু হলো ভেজা কাপড় খুলে সে কোমড়ে টাওয়াল জড়িয়ে বের হয়ে এলো!
ততক্ষণে নিঝুম চলে গেছে ! কোন রকমে একটা শটস পড়লো তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো কম্ফোটারের নিচে । তার সারা শরীর কাঁপছে !

মেডিসিন বক্স টা কাছে নেয়ার শক্তি পাচ্ছে না ! মনে মনে বলল , রুবা তুমি কোথায়?

রুবা যখন রুমে আসলো মাহি তখন‌ও কাঁপছে কিন্তু এত খারাপ লাগছে শরীর যে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না !
রুবা ওর পাশে বসে দেখে মাহির চোখ লাল হয়ে আছে শরীর কাঁপছে!
তোমার শরীর তো কাঁপছে ! খুব ঠান্ডা লাগছে গায়ে কিছু পড়োনি কেন?
তাড়াতাড়ি একটা টিশার্ট বের করল রুবা , মাহি কে ধরে পড়িয়ে দিল!
তোমার শরীরে অনেক জ্বর তো এখনো! কথা বলছো না কেন ?
মাহি হাত বাড়িয়ে রুবার হাতটা ধরলো ফিসফিস করে বলল , আমি ঠিক আছি তুমি চিন্তা করো না !

রাতে কিছু ই খেতে পারলো না মাহি , একটু স্যুপ অনেক জোর করে রুবা দিল আবার ছুটে ওয়াস রুমে গিয়ে বমি করলো!
রুবা অস্থির হয়ে শ্বাশুড়ি কে ডেকে নিয়ে এসেছে ! সাফিয়া বেগম বললেন, জ্বর আসলে মাহি এই, খাবে না বমি একদম কাহিল হয়ে যাবে! এবার এত উইক হয়ে গেল কিভাবে?
মাহি ওষুধ খাও বাবা বলে তিনি প্যারাসিটামল দিলেন!
তুমি ডাক্তার তুমি ই ভালো জানো কি করতে হবে মাহি!
মা আজ রাতটা দেখি কালকে জ্বর না কমলে ব্লাড টেস্ট করাব ঠিক আছে !
রুবা মাথায় জল পট্টি দিয়ে দিচ্ছে !

মা রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর মাহি রুবাকে জিজ্ঞাসা করল , তোমার তো খাওয়া হয়নি রুবা তাই না ?
আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না ! আমি সুস্থ আছি ! তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না !
আমি ঠিক আছি রুবা ! তোমাদের গেস্ট গেছে ?
খালাম্মা, রিয়া আপু খেয়ে তারপর গেছে নিঝুম আপুর জরুরি ফোন এসেছিল তাই আগেই চলে গেছে !
মাহি শুধু বলল, ও
তুমি খাওনি কেন?
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না !
যাও খেয়ে আসো রুবা !
প্লিজ পরে !
না এখন যাও !

মাহি একরকম জোর করেই রুবাকে খেতে পাঠালো ! শরীরের কাঁপুনি টা বন্ধ হয়েছে কিন্তু খুব কাহিল লাগছে!

রুবা ডিনার করে এসে দেখে মাহি ঘুমিয়ে গেছে ! ও ঘুমন্ত মাহির দিকে তাকিয়ে আছে ! এই মানুষ টার মাঝে যে একটা বাচ্চাও বাস করে মাহি অসুস্থ না হলে সে জানতো না !
কি অস্থির করলো সবাই কে সারাদিন!
রুবা ওর কপালে হাত রাখলো ! এই কটা দিন ওর কত খেয়াল রেখেছে আজ নিজে অসুস্থ হয়ে গিয়ে একদম বাচ্চা হয়ে গেছে!
থেঙ্কস মাহি আমার অন্ধকার জীবন টা কে আবার আলোয় ভরিয়ে দেয়ার জন্য ! আবার বাঁচতে শেখানোর জন্য ! আবার একটা স্বাভাবিক জীবনের পথ দেখানোর জন্য !
আমি সারাজীবন তোমার এই সেক্রিফাইস এর মূল্য আমার ভালোবাসা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব ! আমি চেষ্টা করবো তোমাকে ভালো রাখতে মাহি !
খুব তাড়াতাড়ি আমি হয়তো পারব না কিন্তু অচিরেই আমি আমাকে তোমার রঙ্গে ভরে দিব মাহি ! আমি সেই চেষ্টা ই করছি!

রুবা মাহির ঘুমন্ত মুখটা স্পর্শ করলো ! ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ! আজ এটা সুখের অশ্রুজল সে কিছুতেই থামাবে না !

রাতে মাহির জ্বর আবার এসেছে সারারাত রুবার হাতটা ধরে শুয়ে থাকলো মাহি ! বাচ্চাদের মত কখনো গুটিসুটি মেরে !

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here