যখন দুজনে একা পর্ব-৪

0
3782

#যখন_দুজনে_একা

(৪র্থ পর্ব )

চোখটা মুছে মাহি আবার পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালো। রুবার সামনে বসে থাকা টা এত সহজ নয় তার জন্য ।
কি সম্পর্ক কি হয়ে গেল !
ভাইয়া , তুই এভাবে আমাদের ফেলে কেন চলে গেলি রে?
ছোট থেকে তোর খেলনা, তোর স্কুল ব্যাগ, তোর গেঞ্জি তোর ঘর পছন্দ করতাম কেড়ে নিতে চাইতাম তুই কখনো আদর করে দিয়ে দিতি, কখনো মায়ের আদেশে দিয়ে দিতি আবার কখনো আমিই কেড়ে নিতাম বলেই কি তুই তোর ভালোবাসা তোর বউ তোর সন্তান ও আমাকে দিয়ে চলে গেলি!
আমি কি এসব চেয়েছিলাম রে !
ভাইয়া এই ,এই বারান্দায় বসে কত কত রাত গল্প করতাম আমরা মনে আছে !
লুকিয়ে সিগারেট খেতাম দুই ভাই এখানে !
তুই যখন লন্ডন চলে গেলি পড়তে, আমি খুব একা হয়ে গেলাম তোকে ছাড়া আমার গল্প গুলো শোনার কে ছিল বল !
আজ‌ও দেখ তুই ছাড়া আমি কত একা !

ভাইয়া নিঝুমের ব্যাপার টা তোকে যেদিন প্রথম বলেছিলাম মনে আছে তুই কত হেসেছিলি ! খুশি হয়েছিলি। ডাক্তার ডাক্তার বিয়ে হ‌ওয়াই ভালো বলেছিলি তুই।

নিঝুম কে বললাম যখন তোকে বলে দিয়েছি ও খুব রাগ করলো , তোর সামনে আসতে কি লজ্জা তার ।

ভাইয়া বাসায় আর কেউ জানে না নিঝুম এর ব্যাপার টা তুই ছাড়া । ভালোই হলো কথাটা তোর আর আমার মাঝেই থেকে গেল !
আমি নিঝুমের অপরাধী !
মাকে কথা দিয়েছি রুবা কে ভালো রাখবো তাই নিঝুম কে দেয়া কথা ফিরিয়ে নিতে হলো আমার!
আজ নিঝুম কষ্ট পাচ্ছে ,আজ তোর রুবা র ভেতরে হাহাকার !
আমার রং এ ওকে সবাই রাঙ্গিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু আদো কি সম্ভব! ওর মনের ভেতরের সব রং নিয়ে তুই চলে গেছিস আমি চেষ্টা করেও কি পারব সেখানে রং ভরে দিতে!

আমি মা কে কথা দিয়েছি । জানিস তুই , তুই চলে যাওয়ার পর কত কি হলো ভাবি কে নিয়ে !
একদিন ভাবির বাবার বাড়ির লোকজন আসলো তারা ভাবিকে নিয়ে যাবে সঙ্গে!
মা বলল, সঙ্গে নিয়ে যাবেন মানে কোথায়?
ওরা বলল , ভাবির বাবার বাড়ি ।
মা বলল সেখানে তো কেউ নেই আর নিজের বাড়ি থাকতে রুবা ওখানে কেন যাবে?
তখন ভাবির এক মামা বলে উঠলো কম বয়সী বিধবা মেয়েকে তারা শ্বশুরবাড়ির আশ্রিত হয়ে থাকতে দিবে না । যেখানে ওর কোন মান সন্মান থাকবে না ।
মা তো অবাক!
রুবার মান সম্মান থাকবে না মানে ? এটা ওর স্বামীর ঘর !
ওরা বলল, যেখানে স্বামী ই নেই সেখানে আবার কিসের ঘর ।
আজ আপনারা আছেন একদিন আপনারা মারা যাবেন সেদিন কি হবে রুবার?
দেবর আর দেবরের ব‌উ এর আশ্রিত হয়ে থাকবে ?
কি বলছেন আপনারা এসব, মা অবাক হয়ে বলল ?
আর আপনাদের সাথে গেলে কি হবে সেখানে? সেখানে খুব সন্মানের জীবন পাবে ?
হ্যাঁ পাবে ! আমরা আমাদের ভাগ্নী কে বিয়ে দিতে পারি আবার, ওর কি বা বয়স হয়েছে? নিজের সংসার পাবে , সন্মান পাবে !
মা ওদের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
এমনকি মাকে হসপিটালে ভর্তি করা লাগলো।

ভাবি তখন কোন হুঁশ এ নেই! প্রচন্ড শরীর খারাপ তার আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম আমরা হয়তো তোর বাচ্চা টা কে টিকিয়ে রাখতে পারবো না !

আল্লাহর অশেষ রহমত এ ভাবির শরীর এখন ঠিক আছে ! ডাক্তার টোটাল বেড রেস্ট দিয়েছে।

মা যেদিন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরলো হঠাৎ করে গভীর রাতে আমার ঘরে এসে হাজির হলো !
অসুস্থ মা আমাকে না ডেকে নিজেই আমার রুমে এসে বসলেন!
অবাক হয়ে মা কে বললাম , আমাকে ডাকলেই হত মা ।
মাহি তোমার সাথে আমার কথা আছে?
বলো মা !
আমি তোমার কাছে অনেক বড় একটা জিনিস চাইব তোমাকে দিতেই হবে !
কি চাইবে ?
মাহি তুমি ই একমাত্র পারো রুবা আর শিহাবের সন্তান কে আমার কাছে দিতে !
আমি কিভাবে ওরা তো আমাদের ই আছে।
ভাবি তো তোমার ই আছে ! আর বেবি এখন অনেক সেইফ আছে তোমাকে সোনোগ্রাফি রিপোর্ট টা দেখাচ্ছি আমার কাছেই আছে !

মাহি ! মা চিৎকার করে উঠল !
আমি ওদের কোন ভাবেই রুবাকে নিয়ে যেতে দিব না !
মা এটা মগের মুল্লুক নাকি ! ওরা এসে বললেই ভাবি কে চলে যেতে হবে আর আমরাও দিয়ে দিব!
তুমি অযথাই চিন্তা করছো?
মাহি ওরা কিন্তু একটা কথাও ভুল বলেনি!
মানে? মায়ের কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!

বাইশ বছরের বিধবা রুবার জীবন কি এমনই থাকবে সারাজীবন? আজ আমি আছি তোমার বাবা আছে কিন্তু আমরা চলে গেলে?

মা কি বলছো আমি নেই ভাবির কাছে ?

আমি আমার ভাইয়ের ব‌উ বাচ্চা কে সারাজীবন দেখে রাখতে পারবো না ?

মাহি , একদিন তোমার সংসার হবে ! তুমি তোমার সংসার নিয়ে নিজের প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে !আর তোমার ব‌উ যে বিধবা জা কে সহজ ভাবে মেনে নিবে তার কি নিশ্চয়তা?

মা এসব কি বলছো তুমি? তুমিও ঐ গ্রাম্য অশিক্ষিত লোক গুলোর কথা ধরে বসে আছো !

না মাহি !
তবে এটা তো সত্যি রুবার জীবন থেকে সব রং সব সুখ শেষ হয়ে গেছে ! একটা সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই এতিম হয়ে জন্ম নিবে!

মা প্লিজ এভাবে বলো না , আমার কষ্ট হয়!!

মাহি এটাই সত্যি। শিহাবের মা হয়ে আমি এই সত্য টা মেনে নিয়েছি তোমরাও না‌ও।

কি করব মা ভাবির জন্য ,বেবিটার জন্য বলো?

আমার কাছে একটাই সমাধান আছে মাহি !

বলো আমাকে , ভাবির ভালোর জন্য সব করব আমি।

তুমি রুবাকে বিয়ে করো মাহি ! প্লিজ বাবা!

মাহি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না ! মা কি সব যা তা বলছে ! এও কি সম্ভব !

ভাবি ভাইয়ার বিয়ে করা স্ত্রী ! ভাইয়া নেই তাই বলে সে ! অসম্ভব!
ভাবি কোন দিন ওকে মাহি বলে ডাকে নি ! সেই প্রথম দিন থেকে ভাইয়া বলে ডাকে ! মাহি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মা কিসব বলছে!

এটা কখনো হতে পারে না মা!

সাফিয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন , আমি তোমার কাছে অনুরোধ নিয়ে এসেছিলাম মাহি তোমাকে এখন‌ই সিদ্ধান্ত নিতে হবে না তুমি ভেবে চিন্তে জবাব দাও!

মা সেই রাতে বের হয়ে গেল আমার রুম থেকে । তারপর দুই রাত ঘুমাতে পারিনি আমি । হসপিটালে ও যাই নাই ! চেম্বারে ও না।

সারাক্ষণ মায়ের কথা গুলো বারবার মাথায় ঘুরছিল ।
দুদিন পর আমি মাকে তার কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত টা জানিয়ে দিয়েছি !

সেদিন মা খুব খুশি হয়েছিল !

ফ্যামিলি র লোকজন সবাই কে খবর দিয়ে মা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল একদিন । মায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করলো না !
শুধু সবাই বলল, রুবা কি চায়?
মা বলল, আমি রুবার সঙ্গে কথা বলেছি !

তার এক মাস পর। তুই চলে যাওয়ার চার মাস পর আজ আমার আর রুবার বিয়ে হয়ে গেল রে ভাইয়া!

মায়ের যুক্তির কাছে হেরে গেলাম রে আমি!
এই অসুস্থ , দুঃখি বাড়িটাকে আমি আগের অবস্থায় ফিরাতে চাই ! তোকে ফিরাতে পারি নাই কিন্তু আর সবাই কে কষ্টের সাগরে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচাতে তো পারব! এতে আমার যত কষ্টই হোক ভাইয়া !

মাহি চোখ মুছলো !

হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে ! ঘরে এসে ঢুকলো সে !

রুবা ওয়াস রুমে !

ভেতর থেকে বমি করার শব্দ হচ্ছে! আবার ওর শরীর খারাপ লাগছে ! ছুটে সে ওয়াস রুমের দরজা র কাছে এলো !

ভাবি! বলতে গিয়েও আটকে গেল মাহির!

হাত দিয়ে নক করলো শুধু !

তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ? কি হলো ? কোন সমস্যা!

রুবা দরজা খুলে দিল !

কি হয়েছে তোমার ? একি অবস্থা! আমাকে ডাকলে না কেন? রুবা আবার বেসিনে গিয়ে বমি করা শুরু করলো!
মাহি গিয়ে ওর কানের দুপাশে ধরলো !
রুবা বলে উঠলো , সরো ভাইয়া !

সঙ্গে সঙ্গে মাহি পিছিয়ে গেল!

তোমার শরীর থেকে সিগারেট এর গন্ধ আসছে! বারান্দায় এত সিগারেট খাচ্ছিলে গন্ধে আমার সারা শরীর গুলিয়ে গেছে!

মাহি লজ্জা পেয়ে গেল ! সরি , সরি আমার খেয়াল ছিলনা । আর কখনো সিগারেট খাব না ! তুমি চোখে মুখে পানি দাও একটু ভালো লাগবে!

তুমি একটু দূরে যাও এখনো গন্ধ আসছে ।

তুমি কাপড় বদলে নাও বলে মাহি ওয়াস রুমে র দরজা বন্ধ করে বের হয়ে এলো!

মাহি সিগারেট এর প্যাকেট টা ফেলে দিল।
ঘরে রাখা কয়টা মোম জ্বালিয়ে দিল সিগারেটের গন্ধ টা যেন চলে যায় !

রুবা শাড়ি কাপড় বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে ঘরে ঢুকলো !

এখন ঠিক আছো তুমি ?

ঠিক আছি!

মাহি কেবিনেট থেকে তার কাপড় বের করে ওয়াস রুমে ঢুকে গেল ! ভালো করে গোসল করলো যেন শরীরে সিগারেট এর গন্ধ না থাকে ।

ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে মাহি দেখে রুবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ! মাহি পাশে গিয়ে দাঁড়ালো !

এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে তুমি ভেতরে চলে আসো !

ভাইয়া , সরি !
তুমি সরি বলছো কেন?

আমার জন্য তোমার জীবন টা নষ্ট হয়ে গেল!

তোমার জন্য আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে কে বলল রুবা!
নিজেকে এভাবে দোষারোপ করো না । আমরা দুজন ই পরিস্থিতি র স্বীকার!
ভাগ্য আমাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
আমি চেষ্টা করবো তোমাকে ভালো রাখতে !

আমি জানি ভাইয়া!
তোমার ভাইয়া আমাকে বলে গেছে!

ভাইয়া বলে গেছে! কি বলে গেছে ভাইয়া, মাহি অবাক হয়ে বলল !

তোমার ভাইয়া যাওয়ার সময় বলে গেছে, রুবা আমার অনুপস্থিতিতে মা আর মাহি তোমার সব খেয়াল রাখবে!

তোমার ভাইয়া কখনো মিথ্যা আশ্বাস দেয় না !

দুজনেই চুপ করে আছে। দুজনের মাঝে যেন মহাকালের নিস্তব্ধতা।

মাহি‌ই বলে উঠলো,চলো ভেতরে চলো !
আর একটা কথা তুমি আমাকে আর ভাইয়া বলে ডেকো না! এখন তো সবকিছু বদলে গেছে তাই না।
রুবা মাহির দিকে তাকিয়ে মাথাটা উপর নিচ করলো।
ভেতরে এসো বলে মাহি ঘরের ভেতর ঢুকলো।

রুমে ঢুকে ই রুবা আবার বমি করতে বেসিনে ছুটে গেল । হঠাৎ করে ই তার শরীর টা খারাপ হয়ে গেল!

মাহি ওকে ধরে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল! তুমি রাতে কি খেয়েছো?

রুবা চুপ করে আছে !

কিছু খাওনি ? সে জন্যই এত বমি হচ্ছে! এখন কিছু এনে দেই খাও !

না না প্লিজ আমি কিছু খেতে পারব না !

তোমার শরীর তো অনেক খারাপ চোখ ডেবে গেছে !

একটু। শরবত নিয়ে আসি ভালো লাগবে!

লাগবে না !

চুপ করো তুমি ! মাহি শরবত আনতে চলে গেল !

রুবার চোখ ভিজে গেল ! শিহাব ও এমন যত্ন নিতো ওর !

কিচেনে ফ্রীজ খুলে দেখে সেখানে বোতলে জুস রাখা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এলো মাহি!

এই নাও উঠে বসো!

রুবা হাত বাড়িয়ে গ্লাস টা নিলো !

দুই ঢুক নিয়ে পাশে সাইড টেবিলে রেখে দিল গ্লাস টা!

আর খাবে না ?

না প্লিজ!

ঠিক আছে এখন ঘুমিয়ে যাও !

তুমি ঘুমাবে না?

আমি আছি এখানে খারাপ লাগলে ডাক দিও!

প্লিজ সিগারেট খেও না !

তুমি ভয় পেও না আমি আর সিগারেট খাব না !

রুবা চোখ বন্ধ করলো ! ওর মাথা ঝিমঝিম করছে !

মাহি ঘরের সব লাইট নিভিয়ে দিল শুধু দূরে একটা ল্যাম্প সেইড জ্বালিয়ে রাখলো!
এসি টা অন করে দিল আর রুবার গায়ে একটা চাদর টেনে দিল!

সারাদিনে র ধকলে রুবা একটু ক্ষনেই ঘুমিয়ে গেল!

মাহি বিছানায় এসে বসলো , ঘুমন্ত রুবার দিকে তাকিয়ে রইল সে ! এই টুকু বয়সে কত কষ্ট সহ্য করেছে এই মেয়ে ! নিজের মা বাবা কেউ নেই, যে স্বামী তাকে এত ভালোবাসতো সেও চলে গেল ! আর কত কষ্ট ওর ভাগ্যে লিখা আছে আল্লাহ?

মাহি মনে মনে বলল, রুবা আমি জানি না স্বামীর ভালবাসা তোমাকে কতটা দিতে পারব কিন্তু তোমাকে সুখী রাখার চেষ্টা আমি করে যাব প্রমিজ!

আচ্ছা একটা মানুষ নিজের ভেতরে কারো জন্য ভালোবাসা জমা রাখলে তখন কি অন্য কারো ভালোবাসা তার মন কে স্পর্শ করতে পারবে?

বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মাহি বড় ইজি চেয়ার টাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল !

সে জানে আজ রাতেও ঘুম আসবে না তার !

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here