যখন দুজনে একা পর্ব-৪৮

0
3483

#যখন_দুজনে_একা

৪৮ পর্ব

সাফিয়া বেগম ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে আছেন। আজগর সাহেব নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক সময় ই রাতে বিভিন্ন দাওয়াত থাকে তাই আসতে দেরি হয়। আজ সেরকম ই এক দাওয়াতে গেছেন তিনি।
ছোটবোন আর ছোট ভাইয়ের বউ যাওয়ার পর তিনি আর ঘর থেকে বের হননি।
মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। মাহির জন্য, রুবার জন্য।
নিজের জীবনের চেয়ে বেশি এদের দুটোকে ভালোবাসেন তিনি। তার এক সিদ্ধান্তে এরা কোন দ্বিমত না করে বিয়েতে রাজি হয়েছে।
মাহি ছোটবেলা থেকেই নিজের টা আদায় করে নিত বরং শিহাব কম্প্রোমাইজ করে চলতো ।
তিনি জানতেন মাহি মন থেকে এই বিয়ে মেনে নিলে রুবার কাছ থেকে তার ভালোবাসা ঠিকই আদায় করে নিবে। আর রুবা , সে তো সারাজীবন আদর ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে এসেছে মাহির অধিকার বোধ ওর পাগলামো রুবাকে মাহির কাছে নিয়ে ই যাবে , তিনি একরকম নিশ্চিত ছিলেন।
কিন্তু আজ নাহারের কথায় উনি বিচলিত বোধ করছেন, রুবা কি সত্যি নিজের ইচ্ছা র বিরুদ্ধে আপোস করছে না তো ?
মাহির প্রতি একটা অবিচার তো তিনি করেছেন ই, কোন আয়োজনহীন, জৌলুস হীন একটা বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন।
তখন তো পরিস্থিতি সেরকম ছিল না, যে রুবাকে গয়নায় মুড়িয়ে ব‌উ সাজিয়ে ফুলের খাট সাজিয়ে মাহির কাছে পাঠাবেন!
ওদের নিজেদের মানসিক অবস্থা কি তখন এসব নিয়ে চিন্তা করার মত ছিল?
তিনি সব বুঝতে পারছেন কিন্তু তবুও আজ নাহারের কথায় উনার ভেতর টা কেমন নড়াচড়া দিয়ে উঠলো।
খুব অস্থির লাগছে তার। অসহায় বোধ করছেন।
রুবাকে তো খুব সুখী মনে হয় তবে কি রুবা তাকে দেখানোর জন্য , তাকে সুখী করতে মাহির সঙ্গে আপোস করছে ? কিন্তু রুবা তো সেদিন ও কাঁদছিল মাহির জন্য ,মাহির প্রতি ওর আবেগ সাফিয়া বেগম বুঝতে পারে। তাহলে কেন আজ উনার মন এত অস্থির হচ্ছে ?

মাহি বাসায় ফিরতে ফিরতে আজ রাত এগারোটা র বেশি বেজে গেছে। নিচে বাবার গাড়ি না দেখে বুঝতে পারলো বাবাও ফিরেননি।
নিচে বসে সিগারেট খাচ্ছে যখন কুদরত এসে পাশে দাঁড়ালো।
: কিছু বলবে কুদরত ভাই ?
: ভাইয়া পাখির ঘর বানানো হয়েছে দেখবেন না আপনি?
: তোমার ভাবি দেখেছে ?
: জ্বি ভাবি প্রতিদিন আসে পাখির কাছে, খাওয়া দেয় কথা বলেন!
: ভাবির পছন্দ হলেই হবে , আমি সময় পেলে দেখব এসে!
: জ্বি ভাইয়া !
কুদরত চলে গেল । মাহি চরম বিরক্ত হয়ে আছে । সিঙ্গাপুরে র ভিসা সবার টা হয়েছে, অবাক করা বিষয় তার ভিসাটাই হলো না !
বাবা, মা আর রুবা কে ডাক্তার দেখাবে কিন্তু সে ভিসা পায়নি!
বাবা যদি এখন না যেতে চায় তাকে ছাড়া তাহলে আবার বাবার ট্রিটমেন্ট পিছিয়ে যাবে! কি করবে সে বুঝতে পারছে না !
সিগারেট শেষ করে আর‌ও কিছুক্ষণ বসে রইল সে।
উপরে উঠে এলো যখন, নিরব এক বাসা আজ উপরে। মা কি বাবার সঙ্গে গেছে ? তাহলে তো ফোন দিয়ে জানায় মা, যে রুবা বাসায় একা?
বুয়া এসে পাশে দাঁড়ালো ,
: পানি র বোতল দিমু ভাইজান?
: না লাগবে না , মা কোথায় বুয়া?
: আম্মা নিজের ঘরে শুইয়া আছে ,আর ভাবি নিজের ঘরে ।
: ঠিক আছে যাও !
মাহি নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। খুব টায়ার্ড লাগছে । রাস্তার জ্যাম টা বেশি কষ্ট দেয়।
ঘরে ঢুকার আগেই শুনতে পাচ্ছে রুবার হাসির শব্দ।
ঢুকে দেখে রুবা সোফায় শুয়ে টিভি দেখছে! ওকে দেখে হাসি দিয়ে উঠে বসলো।
: মাহি সোফায় গিয়ে বসলো ! কি অবস্থা তোমার?
: টিভি দেখছিলাম ! রুবা টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিল!
: মোবাইল টা চার্জ এ লাগিয়ে দাও তো রুবা!
: কি হয়েছে , মন খারাপ তোমার রুবা প্রশ্ন করলো?
: কেন দেখে মনে হচ্ছে মন খারাপ ?
: না অন্য দিন রুমে ঢুকে আমাকে দেখে স্মাইল দাও কিন্তু আজ দাও নি তাই মনে হলো।
: ও আচ্ছা টায়ার্ড লাগছে, রুবা মার কি শরীর খারাপ ?
: না তো, সন্ধ্যায় খালামনিরা চলে যাওয়ার পর ঘুমাচ্ছেন তাই আমি আর ডাকি নাই!
: কেন তোমাকে কিছু বলেছেন, আমি দেখে আসি !
: একটু অপেক্ষা করো আমিও যাব একসঙ্গে যাই!
রুবা মাহির ঘাড় মেসেজ করে দিতে নিলো !
: থেঙ্কস রুবা ! আমি ড্রেস টা চেন্জ করে আসি তুমি ডিনার দিতে বলো!
: ঠিক আছে।
মাহি উঠে গেল!

মাহি মায়ের রুমে র দরজায় নক করছে,
: মা আসব?
: এসো মাহি।
সাফিয়া বেগম ঘরের আলো জ্বালালেন ।
: কি খবর মা তোমার শরীর খারাপ ?
: না শরীর খারাপ না এমনি শুয়ে ছিলাম ! তুমি কখন এলে ?
: আমি কিছুক্ষণ আগেই এলাম কিন্তু মা তুমি তো কখনো এই সময় শুয়ে থাকো না তোমার কি মন খারাপ তাহলে?
মাহি সোফায় গিয়ে বসলো।
: না মাহি সেরকম কিছু না ! তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না !
: তাহলে চলো ডিনার করি মা !
: যাও তুমি আসছি আমি !
মাহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এসো মা রুবা ডিনার দিচ্ছে বলে মাহি রুম থেকে বের হচ্ছে যখন, সাফিয়া বেগম মাহি কে ডাকলেন,
: মাহি!
একটু এদিকে এসো তো বাবা !
মাহি বিছানায় মায়ের পাশে গিয়ে বসলো ! তার একটু অবাক লাগছে মায়ের গলাটা শুনে , কেমন যেন ঠান্ডা গলায় কথা বলছে মা !
: কি হয়েছে মা ?
: মাহি আমাকে একটা কথা বলবে ?
: বলো মা , তার আগে বলো তোমার কি হয়েছে এভাবে কথা বলছো কেন ?
: আমি ঠিক আছি , তুমি আমাকে সত্যিই করে বলো তো তুমি রুবার সঙ্গে সুখী তো ?
: মাহি মায়ের কাছ থেকে হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হলো , মা এই কথা কেন বলছো তুমি?
: তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও মাহি।
: মাহি মায়ের হাত ধরলো , মা আমি রুবাকে নিয়ে হ্যাপি তুমি এসব প্রশ্ন কেন করছো আমি বুঝতে পারছি না !
: আমাকে খুশি রাখতে ,তুমি বা রুবা কম্প্রোমাইজ করছো না তো ?
: না মা আমরা কেউ ই কম্প্রোমাইজ করছি না তুমি রুবাকে চিনো না , রুবা তোমার সঙ্গে অভিনয় করতে পারবে ?
: ছোটবেলা থেকেই তোমার নিজের বিয়ে নিয়ে অনেক ইচ্ছা ছিল কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে, আমার ছোট ছেলেটার জীবনটা আমি কম্প্রোমাইজ এর খাতায় লিখে দিলাম ! কোন আয়োজন করিনি এমনকি রুবাকে তোমার সামনে একটু সাজিয়ে ও পাঠাইনি! যে তুমি কখনো কম্প্রোমাইজ করতে না সেই তোমাকে জীবনের সবচেয়ে বিশেষ একটা অধ্যায় এ পুরোই কম্প্রোমাইজ করিয়ে দিলাম!
এক অন্ধকার রাতে আমার ছেলে টা নিজের নতুন জীবন শুরু করলো ! কোন আলোই জ্বালিয়ে দিলাম না ওর জন্য আমি! তোমার তো এটা পাওনা ছিল না মাহি !
সাফিয়া বেগম এর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে!
মাহি উঠে মায়ের সামনে দাঁড়ালো!
: কি হয়েছে মা , হঠাৎ আজ তুমি এই কথা বলছো? আমার তো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
: মাহি তোমাদের দুজনকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় !
:মা আমার আর রুবার বিয়ে যে পরিস্থিতি তে হয়েছে সেই পরিস্থিতি তে তোমার কি কোন আয়োজন , কোন উল্লাস করার কথা ছিল , উপায় ছিল ? বলো। আমি এত কম্প্রোমাইজ , মানিয়ে নেয়া এতকিছু ভাবিনি। তখন তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলেছো রুবার জন্য, আমাদের সবার জন্য বিয়েটা দরকার ছিল তাই বিয়েটা করেছি। তারপর এই বিয়ের উদ্দেশ্য ছিল রুবাকে স্বাভাবিক জীবন দেয়া আমি সেই চেষ্টা করেছি। এবং এক পর্যায়ে মা আমি রুবাকে ভালোবাসাতে শুরু করেছি।
এবং তুমি তো আমার চেয়ে বেশি রুবাকে চিনো , রুবার চোখে মুখে কি আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পারছো না মা ?
: সাফিয়া বেগম মাথা নাড়লেন !
: তাহলে মা , আর ব‌উ সাজা, বা বর সেজে লোকজন খাইয়ে বিয়ে করতেই হবে এমন তো কথা নেই। অনেক বিয়েই তো হুট করে হয়ে যায় আর বিবাহিত জীবনে র সুখ টাই বড় মা । আমার বাড়ির দেয়াল আলো করার দরকার কি যেখানে আমার ঘর আলো হয়ে আছে মা। এবং সেটা তুমি ই করে দিয়েছো রুবাকে দিয়ে । আয়োজন , উল্লাস করা , খরচ করা এসব কি কোন ম্যাটার করে ?
: সাফিয়া বেগম ছেলের মাথায় হাত রাখলেন!
: মা তুমি রিয়া আপুর বিয়ের আয়োজন দেখে এরকম ভাবছো তাই না ? আমার মনে কোন কষ্ট নেই মা ! প্লিজ তুমি এসব ভেবে কষ্ট পেয়ো না।
এখন চলো তো খেতে যাই !
: তুমি যাও আমি আসছি !
মাহি মাকে জড়িয়ে ধরলো ,
: প্লিজ মা এসব সিলি বর – ব‌উ সাজা , বিয়ে বাড়ি সাজানো এসব নিয়ে মন খারাপ করো না। আমি তো ছোট থাকতে বলতাম তিনটা বিয়ে করব একজন তোমার সেবা করবে, একজন দাদীর সেবা করবে, আর একজন আমার সেবা যত্ন করবে তাহলে কি এখন তিনটা বিয়ে করতে হবে আমাকে ! মাহি হো হো করে হেসে উঠলো !
সাফিয়া বেগম ও হেসে উঠলেন!
: তোমার দাদীকে এই কথা বলতে তুমি মাহি!
: জানি তো মা ! দাদী বড় হ‌ওয়ার পর ও এই কথা মনে করিয়ে দিত আমাকে । আমি বলতাম দাদী অবশ্যই আমি তিন বিয়ে করব ,মা কে একটু রাজি করাবেন আপনি। দাদী খুব মজা পেতো।
: তুমি তোমার দাদীর আদর বেশি পেয়েছো ।
: হুম। এখন চলো মা অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে ।
: তুমি যাও আমি আসছি মাহি।
মাহি মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মাহি মন এমনিতেই ভিসা না হ‌ওয়ার জন্য খারাপ ছিল এখন মায়ের কথা শুনে আরো খারাপ হয়ে গেল।
বিয়েটা শুরুতে তার জন্য কম্প্রোমাইজ ই ছিল। কিন্তু একটা সময় রুবার প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়েই রুবাকে ভালোবাসা শুরু করে ।
তার উপর রুবার নির্ভরশীলতা গুলো যত বেড়েছে সে তত রুবার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে।
রুবার কষ্ট গুলো , রুবার ছেলেমানুষী গুলো তাকে রুবার কাছে নিয়ে গেছে।
একটা মানুষের সঙ্গে দিন রাত কষ্ট, আনন্দ ভাগাভাগি করতে করতে ই একটা সময় তার উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়ে যায় কিন্তু রুবার তো কষ্টটা অন্য ছিল ,শিহাবের সৃত্মির এত কাছাকাছি থেকে মাহি যদি অধিকার বোধ দিয়ে এগিয়ে না যেত তাহলে কখনোই সে পারতো না মাহির কাছে আসতে। আজ রুবাও মাহিকে ভালোবাসে । যদিও সে মনের দেয়াল টপকে আর এগিয়ে আসতে পারছে এখনো, এতে কোন সমস্যা তো হচ্ছে না , রুবা আজ না হোক কাল , কাল না হোক পরশু আসবেই ।
: এখানে বসে আছো কেন তুমি?খেতে এসো।
রুবা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মাহি টের পায়নি।
: হুম চলো , মা এসেছে?
: মা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য !
ওরা খেতে বসেছে !
সাফিয়া বেগম এর মনটা এখন ভালো হয়েছে। মাহির সঙ্গে কথা বলে খুব হালকা লাগছে।
: মা আপনার শরীর খারাপ ছিল ,আমি গিয়ে দেখি আপনি ঘুমাচ্ছেন তাই ডাকি নাই!
: না রুবা এমনি শুয়ে ছিলাম শরীর খারাপ লাগলে আমিই তোমাকে বলতাম।
মাহি চুপচাপ খাচ্ছে। কোন কিছুই তার ভালো লাগছে না।
খেয়ে উঠে মাহি মা কে বলে নিজের রুমে চলে এলো।
তার খুব অস্থির লাগছে। বাবা মা কে বলতে হবে সে ছাড়াই যেতে হবে তাদের। বাবার চিকিৎসার কোন দেরি করাতে চায় না সে। এখন রাজি হয়েছে বাবা আবার কখন পিছিয়ে যায় তার ঠিক নেই।
রুবার জন্য শুধু মনটা খারাপ লাগছে , কিভাবে থাকবে রুবাকে ছাড়া এই কয়টা দিন , রুবাই বা থাকবে কিভাবে!
এক রাত নিঝুম দের বাসায় গিয়েই থাকতে পারেনি ও, আর দেশের বাহিরে গিয়ে থাকবে কিভাবে !
মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে এসব কথাই ভাবছিল সে।

রুবা রুমে ঢুকে ভেবেছে মাহি ঘুমিয়ে গেছে । ও খুব সাবধানে শব্দ না করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মাহির ঘুম খুব পাতলা একটু শব্দ হলেই ভেঙে যায়। তাই মাহি ঘুমিয়ে গেলে সে খুব সাবধানে হাঁটাচলা করে।
রুবা ,
: ও তুমি ঘুমাও নি ?
: না জেগেই ছিলাম!
: মাহি তোমার কি হয়েছে বলোতো , বাসায় আসার পর থেকে দেখছি চুপচাপ, খাওয়ার সময় ও কোন কথা বললে না কারো সঙ্গে কি হয়েছে?
: মন টা সত্যিই খারাপ আমার!
রুবা উঠে বসলো ,
: কেন, কি হয়েছে ?
: আমাকে ছাড়া কয়টা দিন থাকতে পারবে না তুমি ?
: তুমি কোথাও যাচ্ছো ? রুবা অবাক হয়ে গেল!
: আমি না তুমি যাচ্ছো মা আর বাবার সঙ্গে সিঙ্গাপুরে!
: আর তুমি ?
: আমার ভিসা হয়নি !
: কেন ?
: এমনি !
: তোমাকে ছাড়া কিভাবে যাব ?
: সেটা সমস্যা না বাবা আছে । বাবা তোমাদের খেয়াল রাখতে পারবে ।‌এখন না গেলে বাবা যদি পরে আর না যেতে চায় তাই আমার ভিসা কবে হবে তার জন্য প্ল্যান পোস্টপন করতে চাইছি না ।
: রুবা চুপ করে রইলো কি বলবে সে বুঝতে পারছে না !
: তোমার ডাক্তার দেখানো টাও জরুরি তাই যাও বাবা মায়ের সঙ্গে।
রুবার মনটা খারাপ হয়ে গেল । একটা কষ্ট বুকের কাছে দলা পাকিয়ে উঠলো। ওর চোখ ছলছল করছে।
মাহি ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
: তোমার কি মন খারাপ হচ্ছে ?
: না আমি অনেক আনন্দ পাচ্ছি রুবা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল!
: এই বোকা মেয়ে আট দশ দিনের ব্যাপার মাত্র ! আর আমাদের প্রতিদিন ভিডিও কলে দেখা তো হবেই !
: হুম ! ঠিক আছে ঘুমাও এখন বলে রুবা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
মাহি মুখ টিপে হাসলো ! রুবার গালের সঙ্গে গাল চেপে বলল ,
: তোমার যে রাগ ও আছে আজকে দেখলাম রুবা! মাহি বলল,
: আমি কিন্তু একটা জিনিস জানি বলব,
: কি ?
এদিকে তাকাও রুবা !
রুবা পাশ ফিরলো !
: এক দিক থেকে ভালোই হলো আমার থেকে কয়দিন দূরে থাকলে, সিঙ্গাপুর থেকে আসার পর তোমার আমার লাইফ টা চেঞ্জ হয়েও যেতে পারে।
: কি চেন্জ হবে ?
: এখন বলব না তখন কথা টা মিলিয়ে ‌নিও মিসেস মাহির আজগর । মাহি রুবার গাল টিপে দিল।

মাহি চোখ বন্ধ করলো ! মন মেজাজ সব খারাপ !
রুবা আর কোন কথা বলছে না । ওর মনটাও সত্যি খুব খারাপ লাগছে ।
মাহি র ও কিছুই ভালো লাগছে না ।
রুবা হঠাৎ বলল,
: আচ্ছা আমাকে ছাড়া তোমার খারাপ লাগবে না ? বাসা টা খালি থাকবে তুমি কিভাবে থাকবে ?
মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল!
: থাকতে হবে রুবা ! আমি হসপিটালে ব্যস্ত হয়ে থাকব আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না ।

সাফিয়া বেগম বুঝতে পারছেন না কি করবেন। মাহি তাদের সঙ্গে যাবে না । এমন নয় যে তিনি আর মাহির বাবা একা দেশের বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবেন না । ছেলেরা পড়াশোনা র জন্য বরং তাদের সঙ্গে যেতে পারতো না । সারাজীবন তিনি এবং মাহির বাবা একাই দেশের বাহিরে গেছেন বিভিন্ন কাজে ।
কিন্তু আজ মাহি কে রেখে একা তারা তিনজন সিঙ্গাপুর যাবেন শুনে মন টা কেমন খচখচ করছে।
মাহি কোন ভাবেই শুনতে রাজি না তার ভিসা হ‌ওয়ার অপেক্ষা করে বসে থাকা।
মাহি সব সময় তার কথা মানিয়েই ছাড়ে তার বাবা কে।
আগামী তিন দিনের মধ্যে ই হয়তো যাচ্ছেন উনারা মাহি তো তাই বলল!
শিহাব চলে যাওয়ার পর মাহি আর রুবা কে দেখে দেখে ই বেঁচে থাকার শক্তি পান। মাহি কে রেখে দেশের বাহিরে যেতে উনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
রুবার ও নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে কিন্তু মাহি কার‌ও কথা শুনবে না !
: মা আপনার ছেলের জন্য দ‌ই পুডিং বানাই ?
রুবা পাশে এসে দাঁড়ালো সাফিয়া বেগম এর।
: যা খুশি বানাও আমি মাহির উপর রাগ করে আছি !
: কেন মা ?
: বললাম ওর ভিসা হোক তারপর যাই সবাই এক সঙ্গে! ও শুনতেই চাইছে না আমার কথা ! কিছু কিছু বিষয়ে ও এত জিদ করে কারো কথা শুনতে চায় না।
রুবা তুমি একবার বলে দেখো তো মাহি কে আমার মনটাই টানছে না।
: মা লাভ নেই আপনার মাহি অনেক জিদি , ও যখন বলেছে আমাদের যেতে হবে তখন আমাদের যেতেই হবে !
: হুম। সাফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বিকালে মাহি বাসায় ফিরে এলে রুবা বলল,
: মা তোমার উপর রাগ করেছে!
: মাহি হেসে বলল, কেন ?
: কেন আবার ,তুমি জিদ করছো তাই !
মাহি হেসে দিল !
: আচ্ছা সেই জন্য রাগ হয়ে আছে। আমি তো মায়ের রাগ আরো বাড়িয়ে দেয়ার কাজ করে এসেছি।
: কি করেছো ?
: ট্র্যাভেল এজেন্ট তোমাদের টিকিট কর্নফাম করেছে সেই খবর নিয়ে এসেছি। তোমরা পরশু দিনের পর দিন সকালে র‌ওনা হচ্ছো।
: ও আচ্ছা । রুবা একটু থমকে গেল ।
রুবা আমার কাছে এসো ! মাহি রুবার হাত ধরে পাশে বসালো !
: দেখো মা আর তুমি মন খারাপ করছো আমি বুঝতে পারছি কিন্তু তোমাদের কি ধারনা আমার তোমাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না ? কিন্তু ভিসা হয়নি আমাকে তো আর ভিসা ছাড়া ঢুকতে দিবে না চেঙ্গী এয়ার পোর্টে ?
: আমরা কিছু দিন পরে যেতে পারতাম ?
: হুম যেতে পারতাম ! কিন্তু তখনও ছুটি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে আমার, আবার পিছিয়ে যেতে পারে তখন?
: বুঝতে পেরেছি !
: রুবা তুমি মন খারাপ করো না সিঙ্গাপুর থেকে আসো তোমাকে বলেছিলাম না আমি আর তুমি গ্রীস আর নর‌ওয়ে যাব ।
: তখন দেখা যাবে আমার ভিসা হচ্ছে না , রুবা বলল!
: না হলে নাই আমি ছুটি নিয়ে তোমাকে নিয়ে কোন জঙ্গলে চলে যাব কিছুদিনের জন্য।
: না বাবা আমার জঙ্গল খুব ভয় করে সাপ ,পোকা মাকড় আর জোঁক থাকে জঙ্গলে!
: তোমার জঙ্গল ভয় করে , থান্ডারিং ভয় করে জোঁক ভয় পাও আর কি কি ভয় পাও ?
: একবার কি হয়েছিল জানো সিলেটে চা বাগানে ঘুরতে গিয়ে আমার পায়ে জোঁক কামড় দিয়ে বসে ছিল আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম ভয়ে । আব্বা তো অস্থির হয়ে গিয়েছিল।
: সিরিয়াসলি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে?
: হুম , এখনো ভাবলে শরীর ঘিনঘিন করে উঠে !
: মাহি হাসছে , আচ্ছা যাও যাব না জঙ্গলে ! তুমি বুঝলে একটা ফার্মের মুরগী রুবা ! ঐ যে ছোট ছোট বয়লার বাচ্চা গুলো থাকে না হিট দিয়ে রাখতে হয় খুব সেনসেটিভ । আগে তোমার আব্বা আর আম্মা তোমাকে মুরগির বাচ্চার মত রাখছে এখন আমার মা । মাহি হো হো করে হাসছে।
: কি মুরগির বাচ্চা ! তুমি এটা বলতে পারলে ! আর তুমি কি করো একা যেতে দিয়েছিলে তানহা- মানহার সঙ্গে শপিং এ ?
: মুরগির বাচ্চা দেখেই যেতে দেই নি ! আমার মুরগির বাচ্চা যদি কোন শিয়াল নিয়ে যায় হা হা!
: ভেরি ফানী , এখন চলো মা র সঙ্গে কথা বলো । মার মন খুব খারাপ !
: ঠিক আছে চলো !

সাফিয়া বেগম নিজের ঘরে বসে আলমারি গোছাচ্ছেন।
: মা আসব?
: এসো !
: রুবা বলল, তোমার মন খারাপ ?
: আমি ঠিক আছি মাহি।
: তোমাদের ফ্লাইট কিন্তু পরশু দিনের পরদিন সকালে মা।‌
: ঠিক আছে আমি গোছগাছ শুরু করছি।
: মা খুব বেশি রাগ করে আছো? প্লিজ মা তুমি তো আমাকে বোঝার চেষ্টা করো !
: মাহি ঠিক আছে আমি বুঝতে পেরেছি। এখন তোমার বাবার সব ট্রিটমেন্ট এর কাগজ পত্র আর রুবার গুলো গুছিয়ে দাও। তুমি যেহেতু যাচ্ছো না সব আমাকে ই গুছিয়ে নিতে হবে।
: ঠিক আছে মা আমি সব তোমাকে রেডি করে দিচ্ছি।
মাহি রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে মা ডেকে বলল,
: মাহি একটু রুবাকে পাঠিয়ে দাও তো।
: ঠিক আছে মা।

রুবা শ্বাশুড়ি র ঘরে ঢুকলো,
: মা ডাকছেন।
: হুঁ রুবা এদিকে এসো ! তোমাকে কিছু জিনিস দিব তোমার জন্য ই রাখা ছিল আমার কাছে ।
: কি মা ?
: বসো আমার সামনে , এই বক্সে একটা টিকলি আছে এটা আমার শ্বাশুড়ির ,পুরোনো ডিজাইনের আর এই বক্সে আছো দুটো গোলাপ বালা এগুলোর‌ও উনার । আর এই গলার সীতা হার এটা আমার বিয়ের সময়ের আর এই যে আটটা চুড়ি , সবচেয়ে সুন্দর একটা জিনিস দেই এই যে খোঁপা র কাটা টা দেখছো সোনার এটাও তোমার দাদী শ্বাশুড়ি র এই সব গয়না রাখো ।
: কি করব এগুলো দিয়ে মা ?
: এগুলো মাহির ব‌উ এর জন্য রেখেছিলাম। এগুলো তো মাহির ব‌উ হিসেবে তোমার ই প্রাপ্য । তাই না ! মাহি তার দাদীর খুব আদরের নাতি ছিল তিনি তার গয়না মাহির ব‌উ এর জন্য একদম বলে রেখে গেছেন যে দিতেই হবে। আমার দ্বায়িত্ব ছিল তোমাকে দেয়া আজ দিয়ে দিলাম।
: আমাকে তো কম গয়না দেননি আপনি আর কেন মা?
: আর কাকে দিব রুবা ? আমার যা আছে মরে গেলে সেটাও তোমার । হাসলেন সাফিয়া বেগম।
: এখন আপনার কাছে রাখেন কোন দিন লাগলে চেয়ে নিব!
: না একদিন তুমি সব গয়না পড়বে আমি দেখব , আগে যা দিয়েছি সেগুলো না আজ যা দিলাম। মাহির ব‌উ হিসেবে যা দিলাম।
: ঠিক আছে মা , সিঙ্গাপুর থেকে আসার পর আপনাকে মাহির ব‌উ সেজেই দেখাব ! মনে মনে রুবা বলল, একদিন আপনার মাহির জন্যেও যে ব‌উ সাজতে হবে আমার ।
: এখন যাও মাহিকে নিয়ে দেখাও এগুলো।
: ঠিক আছে মা ! বলে রুবা শ্বাশুড়ি র রুম থেকে বের হয়ে এলো।

রুবা রুমে গিয়ে মাহিকে সব দেখতে দিল। মাহি হেসে বলল ,
: আমি এগুলো দেখে কি করব ?
: মা বলল দেখাতে!
: ঠিক আছে দেখলাম। রুবা এখানে কিন্তু তিন জনের গয়না সব তুমি একাই দখল করো না !
: তিন জন কে ?
: আমার তিন ব‌উ !
: মানে ?
: আমি আমার দাদিকে কথা দিয়েছিলাম তিনটা বিয়ে করব একটা দাদীর জন্য , একটা মায়ের জন্য, একটা নিজের সেবার জন্য !
: আমি কোন জন ?
: তুমি মায়ের আহ্লাদী তুমি মায়ের জন ঠিক আছে!
: ঠিক আছে ! বেঁচে গেলাম তোমার সেবা যত্ন আর করতে হচ্ছে না এখন আমার সব ফোকাস মা এবং ওয়ানলী মা।
: রুবা কে বলে তোমার বুদ্ধি নাই ? এত বুদ্ধি তোমার , কি দারুন কথা বললে!
: কেউ বলে নাই বুদ্ধি নাই তুমি ই বললে শুধু। রুবা হাসছে।
: আমার ভাগের টা রেখে দিচ্ছি তুলে বাকি দুইজনের টা তুমি গুছিয়ে রাখো কি বলো!
মাহি হাসতে হাসতে বলল, মাফ চাই তোমার কাছে রুবা আমার ভুল হয়ে গেছে !
: আর বলবে কোন দিন এমন কথা?
: কোন দিন না এই যে কানে ধরলাম!

দুই দিন চোখের পলকে চলে গেল। রুবাদের ফ্লাইট সকালে ছিল যেটা সেটা পিছিয়ে দুপুরে হ‌ওয়াতে ঝামেলা হয়ে গেল । মাহি এয়ার পোর্টে তো যেতেই পারছে না সকালে তার হসপিটাল এ যাওয়াটাও জরুরি হয়ে গেল দুইটা ওটি থাকাতে।
তার মানে রুবা এবং বাবা মা যাওয়ার আগেও থাকতে পারবে না সে । মাহির প্রচন্ড মন খারাপ । কিন্তু সে কাউকে এটা বুঝাতে চাইছে না।
রাত থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি রাস্তায় পানি জমবে , থাকবে প্রচন্ড জ্যাম একটা বিরক্তিকর দিনের শুরু হবে কালকে !
ওফফ….

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here