#যখন_দুজনে_একা
৫০ পর্ব
মাহি নিঝুম দের বাসায় এসে যখন পৌঁছালো তার খালুর প্রেসার খুব একটা বেশি দেখলো না। কিন্তু
এসিতে বসেও খালু ঘামছে।
মাহি জিজ্ঞেস করলো, বুকে ব্যথা হচ্ছে খালু?
: বেশি না হালকা একটু চাপ দিয়ে ব্যথা আর পিঠেও ব্যথা লাগছে, ঘাড়েও ব্যথা । মনে হয় গ্যাস এর ব্যথা মাহি। নিঝুম শুধু শুধু তোমাকে এই খারাপ ওয়েদারের মধ্যে আসতে বলেছে।
খালামনি বলল, গ্যাসের ওষুধ তো খাইয়ে দিয়েছি অনেকক্ষণ আগেই কিন্তু ব্যথা কমছে না কেন মাহি ?
মাহির একটু সন্দেহ হলো ।
সে একটা এসপিরিন খাইয়ে দিল ।
খালুর দম ফেলতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে, তার কাছে লক্ষণ খারাপ মনে হচ্ছে।
মাহি এম্বুলেন্স কল করলো।
: খালামনি কে দূরে ডেকে নিয়ে বলল খালুকে হসপিটালে নিতে হবে ।
: বেশি খারাপ অবস্থা মাহি ? নাহার বেগম আতংকিত হয়ে গেলেন!
: বেশি খারাপ কিছু যেন না হয় সেই জন্য নিয়ে যাচ্ছি তুমি এত অস্থির হয়ে যেও না ।
নিঝুম এর ফোন আসছে ,
: কি অবস্থা মাহি ?
: হসপিটালে নিচ্ছি যদিও এসপিরিন খাইয়ে দিয়েছি কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অক্সিজেন লাগবে। আর ইসিজি করানো টা জরুরি। তুই কতদূর?
: আমরা মহাখালী চলে এসেছি।
: কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ?
: ইউনাইটেড , কাছে হবে সেখানেই নিচ্ছি তুই আয়!
এম্বুলেন্স যখন নিচে এসেছে নিঝুমের গাড়িও চলে এলো। মাহি আর নিয়াজ খালু কে ধরে এম্বুলেন্স এ তুলল। মাহি এম্বুলেন্স এ তুলেই খালু কে অক্সিজেন মাক্স পড়িয়েছে। নিঝুম আর খালামনিকে এম্বুলেন্স এ তুলে রওনা করে দিল।
এম্বুলেন্স রওনা করিয়ে দিয়ে মাহি আর নিয়াজ নিজেদের গাড়ি নিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছে।
মাহির টেনশন হচ্ছে ।
রুবা ঘরটা সুন্দর করে গোছালো । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হলো একটু সাজাই যায় ডাক্তার সাহেব এর জন্য আজ। যদিও তিনি খুব একটা সাজগোজ পছন্দ করে না । চুলটা একবার ছেড়ে রাখলো, কিছুক্ষণ পর আবার সাইড করে একটা বেনী করলো ।চোখে হালকা করে একটু কাজল ও লাগালো। ঠোঁটে লিপস্টিক।
রুবা বারবার ঘড়ি দেখছে।
:আচ্ছা খালু র কি বেশি শরীর খারাপ ?
ওর সঙ্গে যাওয়া উঠিত ছিল ! রুবা ভাবছে একটা ফোন দেই। আবার চিন্তা করলো থাক ও হয়তো ফিরে আসছে ড্রাইভ করছে , এখন ফোন দেয়ার দরকার নেই।
রুবা মনে মনে ভাবছে ওর গাড়ি ঢুকলেই বাসায় লুকিয়ে যাবে সে, একটু খোঁজাখুঁজি করুক ওকে । এত সহজে তোমার কাছে কি ধরা দিব ডাক্তার সাহেব !
চিন্তা করে হাসছে সে!
রুবা টিভি দেখাতে মন দেয়ার চেষ্টা করছে।
হসপিটালে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে মাহি ওর পরিচিত কার্ডিওলজিস্ট এর দেখা পেয়ে গেল।
নিঝুমের কাছে এসে বলল, তুই খালামনির খেয়াল রাখ আমি ভেতরে যাচ্ছি।
: আমি ও যাব মাহি!
: তোকে ঢুকতে দিবে না এখন ! আর তোর এখানে থাকা জরুরি ওখানে তো ডাক্তাররা আছেই। রিয়া আপু কোথায়?
: আসছে ওরা দুজন ঢাকার বাহিরে গিয়েছিল রওনা হয়েছে।
ডাক্তার মাহিকে ডেকে পাঠালো । নিঝুম তাঁর মায়ের পাশে বসে আছে।
নাহার বেগম কান্নাকাটি শুরু করলেন, তাঁর মধ্যে হঠাৎ ভয় পেয়ে বসলো কি হবে!
নিঝুম মা কে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
ওর নিজেরই খারাপ লাগছে খুব। কেন সে আজ ছিল না বাসায় খুব অপরাধবোধে ভুগছে সে।
ওর মামা মামি রা চলে এসেছে । নাহার বেগম ওদের দেখেই আরো কান্নাকাটি শুরু করলেন।
নিঝুম নিয়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,
: মাহি এখনও আসছে না কেন ?
: নিঝুম ও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে তুমি যদি এতটা ধৈর্য্যহারা হয়ে যাও আন্টি কে কিভাবে সামলাবে?
: আমি ধৈর্য্য হারা হচ্ছি না আমি গিল্ট ফীল করছি , আমার মনে হচ্ছে বাসায় থাকতাম যদি তাহলে এতটা খারাপ অবস্থা হতো না নিয়াজ?
: ডাক্তার তো কিছু বলেনি এখনও খারাপ কিছু, তুমি অযথা টেনশন করছো । মাহি কে নিয়ে গেছে ও আসলেই বুঝবে সব ঠিক আছে । নিয়াজ নিঝুমের কাঁধে হাত রাখলো।
কিছুক্ষণ পর মাহি বের হয়ে এলো! সবাই ওর কাছে জানার জন্য তাকিয়ে আছে ।
: টেনশনে র কিছু নেই ইসিজি রিপোর্ট টা একটু খারাপ এসেছে তাই আজ ডাক্তার সিসিইউ তে রাখবে । খালামনি আর সবাই বাসায় চলে যাও আমি থাকব এখানে ।
: আমি থাকব মাহি, নাহার বেগম বলল!
: তুমি থেকে কি করবে তোমাকে তো এখন ঢুকতে দিবে না আর এখানে ভীড় করে কি লাভ বাসায় যাও তোমার নিজের শরীর ই তো দেখছি খারাপ হচ্ছে।
সবাই নাহার বেগম কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে।
মাহি নিয়াজের পাশে এসে দাঁড়াল!
নিয়াজ গলা নামিয়ে মাহিকে বলল, কি অবস্থা মাহি তোমার চেহারা কিন্তু অন্য কথা বলছে ?
: একিউট মাইয়ো কার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন । কালকে এনজিওগ্রাম করলে বাকি টা বোঝা যাবে ।
: নিঝুম কে বলা দরকার না মাহি ?
মাহি বলল, বলতে তো হবেই এই ভীড়ের মধ্যে বলতে চাইছি না , খালামনি যে কান্নাকাটি শুরু করেছে!
: উনাদের বাসায় পাঠিয়ে দাও !
: দেখি ,বলে মাহি এগিয়ে গেল ওর খালার দিকে ।
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর খালামনি কে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। মামিরা নিয়ে যাচ্ছে। নিঝুম থাকবে হসপিটালে । মামাদের বুঝিয়ে বলল মাহি।
ছোটমামি এসে মাহিকে বলল,
: বড়পা, দুলাভাই আর রুবা কখন গিয়ে পৌঁছেছে সিঙ্গাপুর মাহি ?
: সন্ধ্যায় মামি । সঙ্গে সঙ্গে মাহির মনে পড়লো রুবার কথা!
ওফ, আমি তো একদম ভুলে গেছি রুবার কথা ! ও বাসায় ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে ! মাহির বুকটা ধক করে উঠলো ।রুবা একা বাসায়। ওর পথ চেয়ে বসে আছে ।মাহির দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিভাবে ভুলে গেলাম !
নিয়াজ মাহির কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল,
: কোন সমস্যা মাহির?
: না সেরকম কিছু না ।
মাহি মোবাইল বের করে টাইম দেখলো রাত দুইটা উপর বাজে !
সে রুবা কে কল করলো,
: হ্যালো রুবা।
: কোথায় তুমি ?
: সরি আমি তোমাকে ফোন দেয়ার কথা ভুলে গেছি , সরি !
: খালুর কি অবস্থা ?
: হসপিটালে নিয়ে এসেছি , হার্ট অ্যাটাক কালকে এজিওগ্রাম করবে ডাক্তার।
: ও আচ্ছা এখন কোন হসপিটালে আছো ?
: ইউনাইটেড!
: বাসার কাছেই আমি চলে আসব ?
: তুমি এখানে এসে কি করবে, আর এখন ভিজিটর ঢুকতে দিবে না ।
ও ঠিক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না মাহি।
: আমার তোমাকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে রুবা, তুমি একা কিভাবে থাকবে রাতে, আমার তো এখান থেকে যাওয়ার উপায় নেই ?
: আমি থাকতে পারব তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না । নিঝুম আপু , খালামনি কে সামলাও।
: খালামনি বাসায় চলে গেছে নিঝুম আছে।
: তুমি নিঝুম আপুর পাশে থাকো এখন নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করছে?
: এখনো বলি নাই খালুর অবস্থা !
রুবা বলল, আমি ভালো থাকব , আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না প্লিজ।
: ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, তুমি তো ভয় পাবে রুবা , তুমি ফরিদা বুয়া কে ডেকে তোমার কাছে থাকতে বলো।
: ঠিক আছে বলছি।
: সরি রুবা !
: ডোন্ট সে সরি এখন বিপদের সময় তোমার ওখানে ই থাকা উচিত। আমি নিজের বাসায় আছি এবং সিকিউর আছি।
: লাভ ইউ রুবা , তুমি একটু ভয় পেলেই আমাকে কল করবে মনে থাকে যেন !
: থাকবে ।
: রাখছি !
মাহি কথা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রুবা একা বাসায় ওর বুকের ভেতরে খচখচ করছে । রুবা ভয় পাবে, রুবা ভয় পাবে!
নিঝুম মা কে গাড়িতে তুলে দিয়ে এলো । মামা মামি দের সাথে মা চলে গেলেন বাসায়। মাহি আর নিয়াজ বসে আছে ওয়েটিং রুমে।
নিঝুম এসে পাশে বসলো মাহির। নিয়াজ ইশারা করলো মাহি কে ।
মাহি নিঝুম কে আস্তে আস্তে খালুর অবস্থা টা বলল !
নিঝুম কান্নাকাটি শুরু করেছে।
মাহি নিঝুমের হাত ধরলো ,
: এভাবে কান্নাকাটি করলে কি হবে নিঝুম? এখন স্টেবল আছে কালকে এনজিওগ্রাম হবে ইনশাআল্লাহ খুব একটা খারাপ অবস্থা হবে না।
: আমি একটু দেখতে যাব, প্লিজ নিয়ে যা মাহি!
: এখন গিয়ে কি করবি ?
: প্লিজ মাহি ।
নিয়াজ বলল, মাহি ওকে একটু নিয়ে যাও দেখে আসুক।
: ঠিক আছে আমি আগে কথা বলে আসি বলে
মাহি উঠে গেল।
নিয়াজ নিঝুমের মাথায় হাত রাখলো , তুমি তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে এভাবে কান্নাকাটি করছো দেখতে ভালো লাগছে না !
নিঝুম চোখ মুছলো !
: নিয়াজ তুমি বাসায় যাও অনেক রাত হয়ে গেছে !
: আমি ঠিক আছি নিঝুম, এখন তোমার পাশে থাকতে চাইছি।
: বুঝলাম কিন্তু এখন মাহি আছে কালকে ওর হসপিটালে যেতে হবে তখন তুমি এসে থাকলে আমার আরো ভালো লাগবে !
নিয়াজ হেসে বলল , ঠিক আছে আমি আর কিছুক্ষণ থেকে তারপর যাচ্ছি। বারিধারা থেকে আসতে আমার বেশি সময় লাগবে না তুমি যে কোন দরকারে ডাকবে আমাকে কথা দাও।
: ঠিক আছে ।
মাহি ওয়েটিং রুমে ঢুকে বলল,
: নিঝুম চল , বেশিক্ষণ থাকতে পারবি না জাস্ট পাঁচ মিনিট। পরিচিত ডাক্তার ছিল বলেই যেতে দিচ্ছে।
: ঠিক আছে ।
ওরা সিসিইউ র দিকে এগিয়ে গেল ।
রুবা ফরিদা বুয়া কে ডাকেনি ।ওরা আগেই ঘুমিয়ে গেছে ।
ও চুড়ি, কনের দুল, টিপ সব খুলে রাখলো। ওর ভয় লাগছে না কিন্তু খুব খালি খালি লাগছে। এত বড় বাসায় আগে কোনদিন সে একা থাকেনি।
ড্রেস চেঞ্জ করে সে সোফায় গিয়ে শুয়ে টিভি চ্যানেল একেরপর এক বদলাচ্ছে কিছুই দেখতে ইচ্ছে করছে না।
মাহির জন্য ওর মনটা কেমন করছে।
কি ভেবে ছিল মাহি কি হয়ে গেল ! হাসলো রুবা !
মাহিকে মেসেজ দিল ,সে ঠিক আছে লিখে।
এসব চিন্তা করতে করতে ওর চোখ লেগে গেল ঘুমে।
নিঝুম সিসিইউ থেকে বের হলো কাঁদতে কাঁদতে ! ওর খুব খারাপ লাগছে !
: নিঝুম কান্নাকাটি বন্ধ কর। এরকম করলে কিন্তু তোকেও বাসায় পাঠিয়ে দিব , মাহি বলল!
: না আমি থাকব যাব না !
: থাকবি কিন্তু কান্নাকাটি করলে পাঠিয়ে দিব সেটা বললাম!
: তুই সব সময় আমার উপর জোর করবি না মাহি!
: ঠিক আছে জোর করব না , মাহি হাসলো !
নিয়াজ কোথায়?
: ওকে বাসায় চলে যেতে বলেছি অনেক রাত হয়েছে !
নিঝুমের আবার খুব কান্না পাচ্ছে!
মাহি বলল, আবার কাঁদছিস কেন ?
: জানিস কালকে যখন বিয়ে বাড়ির জন্য বের হয়ে যাচ্ছি আব্বু আমার সঙ্গে ফান করছিল । বলল, নিঝুম এখন তোমার ফ্রেন্ড দের তোমার বিয়ে দাওয়াত দেয়ার সময় হয়েছে। আমি বললাম , দেরি আছে আব্বু। তখন আব্বু বলল, কবে আমি মরে গেলে বলেই হাসা শুরু করলো আমি ধমক দিলাম আব্বু কে।
আর দেখ রাতেই কি অবস্থা হলো! আব্বুর কিছু হয়ে যাবে না তো মাহি?
নিঝুম কাঁদছে!
: মাহি নিঝুমের মাথায় হাত রাখলো।
নিয়াজ কফি নিয়ে এসে ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখে নিঝুম আর মাহি বসে আছে । নিঝুম মাহির ঘাড়ে মাথা রেখে কাঁদছে।
ও দাঁড়িয়ে গেল।
মনে মনে ভাবলো, ভালোবাসা আর নির্ভরতা কখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না কিছু কিছু সম্পর্ক থেকে।
নিঝুম যত চেষ্টাই করুক মাহি ওর কাছে থাকলে ও মাহির প্রতি দূর্বল হয়ে যায়। আজ এই সংকটময় রাতে নিঝুম যার কাঁধে মাথা রাখলে বেশি সাহস, শক্তি পাবে সেই আছে নিঝুমের কাছে। আর কারো কি প্রয়োজন আছে ওর?
নিয়াজ দুই পা পিছলে গেল। ওর বুকের কোথায় যেন চিনচিন করছে।
হঠাৎ মনে হলো ওর , আমি তো জেনেই নিঝুম কে ভালোবেসেছি তাহলে কেন আমি এত কিছু ভাবছি । নিঝুমের মনে যাই থাকুক , মাহি এখন তার বউ কে পাগলের মত ভালবাসে।
আর নিঝুম কে সব কিছু র পরও নিয়াজ পেতে চায় ওর ভালোবাসা দিয়ে নিঝুম কে অর্জন করতে চায়।
নিয়াজ এগিয়ে গেল ওদের কাছে !
নিঝুম চোখ মুছে তাকালো নিয়াজের দিকে ! মাহি চুপচাপ চোখ বন্ধ করেছিল ।
: তোমাকে না দেখে ভাবলাম তুমি চলে গেছো, নিঝুম বলল!
: তোমাদের জন্য কফি আনতে গিয়েছিলাম।
নিঝুম হাত বাড়িয়ে কফি নিলো ।
মাহি কফির কাপ নিয়ে ওদের পাশ থেকে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। মাহির রুবার জন্য খারাপ লাগছে। ও পুরো বাড়িতে একা। যে রুবাকে সে, একা একটা মিনিটের জন্য কোথায় রেখে শান্তি পায় না আজ পুরো বাড়িতে রুবাকে একা থাকতে হচ্ছে! হোক নিজের বাড়ি নিজের ঘর তবুও তো একা ।
হসপিটাল থেকে বাসায় যখন ফিরছিল আজ, নিজে একা থাকবে কিভাবে খালি ঘরে তাই ভাবছিল।
তারপর রুবাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে কাছে পেয়ে এই রাতটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল ওদের । কিন্তু এখন রুবা একা তার ঘরে, আর সে হসপিটালে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল মাহি।
জীবন টা আসলেই এক অনিশ্চয়তা ! এক মিনিট আগেও বলা যায় না এক মিনিট পর কি হবে!
রুবার তো তার জীবনে আসার কথা ছিল না ! রুবা আজ তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সত্য। নিঝুমের তার জীবনে আসার কথা ছিল কিন্তু নিঝুম আর সে এখন ভিন্ন পথের যাত্রী।
এটাই তাহলে জীবন, অনিশ্চয়তা র এক খেলাঘর।
উপর থেকে একজন লিখে যাচ্ছেন আর নিচে সবাই শুধু দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
নিয়াজ এসে পাশে দাঁড়ালো ,
: মাহি আমি তাহলে আসি, কালকে কখন চলে যাবি তুই হসপিটালে, আমি থাকব তখন এখানে?
: থেঙ্কস নিয়াজ, আমি জানাব তোকে !
নিয়াজ চলে গেল । নিঝুম লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল ।
সারারাত মাহি কখনো বসে কখনো হেঁটে কাটিয়ে দিল। নিঝুম চেয়ারে বসে ঘুমিয়েছে কখনো, আবার কখনো মাহির পাশে এসে বসেছে।
:থেঙ্কস মাহি !
: থেঙ্কস কেন ?
: তুই অনেক করছিস !
: তাই বুঝি অনেক কি করলাম আমি ?
: এই যে সারারাত তুই এখানে পড়ে রইলি ! সব একা সামলাচ্ছিস।
: ও আচ্ছা এই জন্য , আমি তো জানি এগুলো আমারই করার কথা সব সময়!
: তোর করার কথা হবে কেন!
: খালামনির নিজের কোন ছেলে নেই সারাজীবন আমাকে আর ভাইয়াকে খালামনি আর খালু নিজের ছেলের মতো আদর করে গেছে। এখন আমি আমার দ্বায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেলাম।
: তারপরও থেঙ্কস।
: খালামনি, ছোটমামা, বড় মামা সবার জন্য আমার দ্বায়িত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না তাদের কারো ছেলে সন্তান নেই। ভাইয়া নেই তাই সবার পুরো দ্বায়িত্ব আমার একার।
সবাই অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী কিন্তু ছেলে সন্তান এর ঐ দ্বায়িত্বে র বাহিরেও দ্বায়িত্ব থাকে খোঁজ খবর নেয়া সেটাই আমাকে পালন করতে হবে। আমি সেটা আনন্দ নিয়েই করতে চেষ্টা করি।
: তাই বুঝি তুই সব দ্বায়িত্ব পালন করিস ?
: ইচ্ছা আছে ,চেষ্টা করি জানি না পারি কতটুকু!
: আমি খবর পেলাম পারছিস তুই। তানহা- মানহা কে রেগুলার ফোন দিয়ে খবর নিস। শ্রুতি – মিতি ও তোর জন্য পাগল। ভাইয়া ভাইয়া করে সারাদিন।
আপু তো সারাজীবন তোর উপর দূর্বল। তুই ও খোঁজ রাখিস।
: পারি না রে ব্যস্ততা র জন্য সব সময় হয়ে উঠে না।
: আমার প্রতি কি দ্বায়িত্ব পালন করছিস বলতো শুনি?
: মাহি হাসলো, তোর জন্য যে দ্বায়িত্ব পালন করতে চাই তুই তো তার অধিকার দিবি না কখনো!
: কোন দ্বায়িত্ব , নিঝুম অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ?
: থাক বাদ দে নিঝুম!
: না বল শুনি , অধিকারের যখন প্রশ্ন তখন শুনতে ইচ্ছে করছে!
: তোকে স্যাটল দেখতে চাই , তোর জীবনটা সুন্দর হয়েছে এটা দেখতে চাই !
: এটা কি তোর দ্বায়িত্ব?
: তুই যদি দিস তাহলে দ্বায়িত্ব!
: একবার তো দিয়েছিলাম তারপর কি হলো ?
: তখন এক সম্পর্কে পারিনি এখন অন্য সম্পর্কে করতে চাই !
: তখন প্রেমিক হয়ে পারিস নি বলে এখন কি ভাই হয়ে যেতে চাইছিস হেসে দিল নিঝুম ?
: এভাবে বলছিস কেন ? আমি তোর বন্ধু হয়ে না হয় তোর ভালো টা চাইতে পারি । হ্যাঁ আমি এখনো সেই অধিকার পাই কিনা সেটা তোর উপর নির্ভর করে । আমরা ফাস্ট কাজিন সেটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না নিঝুম।
নিঝুম মনে মনে বলল , যাই করিস না কেন তুই আমি তোর কাছ থেকে কোন অধিকার কেড়ে নিতে পারিনি মাহি।আমার সবটা জুড়ে এখনো তোর অধিকার ই আছে তুই কষ্ট দিস আর ভালোবাসা দিস আমি সবই হাসি মুখে নিব!
আমার বরং কোন অধিকার নেই তোর উপর মাহি।
: কথা বলছিস না কেন নিঝুম?
: আমার সব কিছু তে তোর অধিকার আছে , তুই যা খুশি করতে পারিস !
: নিঝুম , আমি তোকে ভালো আছিস দেখতে চাই সেটা বললাম।
: ঠিক আছে তুই ভালো রাখার ব্যবস্থা কর আমি রাজি আছি তোর যেকোন উদ্যোগ এ। বিয়ে দিতে চাইছিস দে !
: মাহি নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হাসছে !
: হাসছিস কেন ?
: কারণ বুঝতে পারছি না রেগে গিয়েছিস নাকি সত্যি বলছিস?
: সত্যি সত্যি বলছি তোর উপর এখন আর রাগ করিনা। একটা সময় অনেক রাগ করতাম খুব কষ্ট দিতাম তোকে মাহি ।
: রাগ হওয়া আর কষ্ট দেয়ার কিন্তু এখনই বেশি কথা কিন্তু যখন দরকার ছিল না তখন ই দিতি। হাসলো মাহি।
: মানুষ সব হারিয়েই বুঝে কি হারিয়েছে আর তখন সে রিয়েলাইজ করে সেই সময়ের ভুল গুলো।
: তবে দেখিয়েছিলি রাগ একদিন মনে নেই, পূর্বাচল নিয়ে রোদের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছিলি। তারপর কি জ্বরে পড়লাম তুই কিন্তু ভালো করেই জানতি আমার রোদ সহ্য হয় না ! আমি কষ্ট পাইনি, এটা তোর কাছ থেকে পাওনা ই ধরে নিয়েছিলাম। আমি কষ্ট দিয়েছি তোকে তুই ফিরত দিলি কোন একটা উপায়ে সামান্য কিছু।
: সরি রে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আর একটা কথা ঐ দিন আপুর বিয়ের দিন রাতে তোর বুকে নখ এর আঁচড় লেগে গিয়েছিল সে জন্যেও সরি, আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেলফ দ্যাট মোমেন্ট।
: প্লিজ নিঝুম একটু খেয়াল রাখিস ঘরে বউ আছে আমার এরকম করিস না আর বলেই হাসা শুরু করলো মাহি , খুব অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম রুবার সামনে । নিঝুম ও হাসছে ।
বাদ দে এসব কথা নিঝুম!
: খালাম্মা , রুবাদের কি খবর কখন গিয়ে পৌঁছেছে সিঙ্গাপুর?
: মানুষের বিয়ের পর বউ রেখে স্বামী বিদেশ সফরে যায় তোর তো দেখি উল্টা তোর বউ তোকে রেখে দেশের বাহিরে গেল ! হাসলো নিঝুম।
: আমিও ব্যাতিক্রম হতে পারিনি ।
: মানে ?
: রুবা যায় নি ও বাসায়ই আছে !
: কি বলিস, যাওয়ার আগে আগে আমার সামনে আম্মু কথা বলছিল ফোনে খালাম্মা র সঙ্গে, খালাম্মা বলল উনারা তিন জন কিছুক্ষণের মধ্যে বের হয়ে যাবেন এয়ার পোর্টে এর উদ্দেশ্যে!
: হুম শেষ মুহূর্তে বাবা রুবাকে রেখে গেছে । আমি রাতে রুবাকে রুমে দেখে সারপ্রাইজ হয়ে গেছি!
: তারমানে রুবা বাসায় একা , তুই এখানে !
: হুম !
: তোর তো রুবার পাশে থাকার কথা ছিল কেমন হলো ব্যাপার টা তুই আগে বলবি না !
: আমার এখানেই থাকার কথা এখন নিঝুম , রুবা ঠিক আছে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে।
: তারপরও খালাম্মা, খালু কেউ নেই বাসায় সম্পূর্ণ একা রুবা !
: সেটাই চিন্তা করছি এখন ঘুমাচ্ছে মনে হয় !
: আমার খারাপ লাগছে মাহি !
: চিন্তা করিস না রেস্ট নে তুই আমি খালুর খবর নিয়ে আসছি বলে মাহি উঠে চলে গেল!
মাহি মোবাইল বের করে রুবাকে মেসেজ পাঠালো! জেগে থাকলে রিপ্লাই দিবে , তখন না হয় কথা বলা যাবে, ইনবক্স করলো
” রাত ঢের – বাড়িবে আরো কি
এই রাত ! বেড়ে যায়,
তবু চোখাচোখি হয় নাই – দেখা,
আমাদের দুজনার- দুইজন একা ! ”
সকালের দিকে মাহি চেয়ারে বসেই ঝিমুচ্ছে । নিঝুম ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে । ওর খুব ইচ্ছে করছে মাহির চশমা টা চোখ থেকে খুলে নিতে। কিন্তু সব ইচ্ছের এখন আর প্রবেশাধিকার নেই নিঝুমের ।
মাহির চোখ দুটো সব সময়ই ওর দূর্বলতা । ও সব সময় বলতো , এত সুন্দর চোখের কি দরকার ছিল একটার ছেলে মানুষের।
পুরান অনুসারে গৌতম বুদ্ধের পুত্র রাহুল ছিল সবচেয়ে সুন্দর চোখের অধিকারী পুরুষ। ওর চোখ কি তোর চোখের চেয়ে সুন্দর ছিল রে মাহি ? আমার তো মনে হয় না ।
নিঝুম কফি আনতে গেল।
কফি এনে মাহি কে ডাকলো !
: কফি নে !
: নিঝুম এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না ! আচ্ছা দে খাই !
: কফি শেষ হওয়ার আগেই ডাক্তার ওদের ডাকলো।
মাহি আর নিঝুম দুজনেই উঠে গেল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে।
দুপুরে নিঝুমের বাবার এনজিওগ্রাম করানো হয় । পাঁচটা আর্টারিতে ব্লক ধরা পড়ে । ডাক্তার ইমিডিয়েট বাইপাস করতে হবে কিনা সেই ডিসিশন নিবে আজই।
নিঝুম এর মা কান্নাকাটি করছে। রিয়া আর সাজ্জাদ সকালে এসে পৌঁছেছে। ওরা শ্রীমঙ্গল গিয়েছিল ঘুরতে।
মাহি আজ হসপিটালে যায়নি। ওদের এই অবস্থায় রেখে সে বাসায়ই যেতে পারছে না ।
এনজিওগ্রামের পর মাহির খালুর অবস্থা হঠাৎ খারাপ করেছে।
উনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল আবার।
মাহির খুব টেনশন হচ্ছে। মা দেশে থাকলে তাও একটু সাহস পাওয়া যেত।
রুবার সঙ্গে সকালে কথা হয়েছে ওর।
মাহি কে স্বান্তনা দিচ্ছিল।
মাহি দুপুরের পর একাই হসপিটালে রয়েছে নিঝুম কেও পাঠিয়ে দিয়েছে বাসায়। সন্ধ্যায় নিঝুম ফিরে আসলে ও বাসায় যাবে।
দুই দিন ধরে ঘুম নেই চোখে এখন মাথা ধরেছে । মাইগ্রেন এর পূর্বাভাস ।
ওয়েটিং রুম মোটামুটি খালি মাহি সেখানেই বসে আছে।
ওর চোখ বারবার লেগে যাচ্ছে। একটা সময় সত্যি ই ওর চোখ লেগে গেল ঘুমে।
রুবা যখন হসপিটালে র নিচে গাড়ি থেকে নামছে নিঝুমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
: কি অবস্থা আপু?
: এই তো চলো উপরে যাই মাহি উপরেই আছে।
: চলো।
: তুমি রাতে একা ছিলে। আমি তো জানি ই না মাহি ভোর রাতে বলল। আমি শুনে অবাক। আমার খুব খারাপ লাগছে।
: আপু প্লিজ এভাবে বলো না আমি নিজের বাসায় ছিলাম লোকজন ছিল বাসায়।
কথা বলতে বলতে ওরা উপরে উঠে এলো। নিঝুমের একটা ফোন এসেছে সে রুবাকে দেখিয়ে দিল মাহি ওয়েটিং রুমে আছে। যাও।
নিঝুম করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে দেখলো,
যে কাজটা ও করতে পারেনি রুবা অবলিলায় করার অধিকার রাখে।
রুবা মাহির পাশে বসেই ঘুমন্ত মাহির চোখ থেকে চশমা খুলে নিল। মাহি চোখ খুলে তাকালো ।
রুবাকে দেখে কি সুন্দর করে হাসছে মাহি। রুবার হাত ধরলো।
নিঝুম দূর থেকে দেখছে রুবা মাহির কপালে হাত ছুঁয়ে আছে।
এই অস্থির মুহূর্তে ও নিঝুমের বুকের কোথাও যেন একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে সে রুবা আর মাহি কে দেখে।
ও সরে গেল ওদের কাছ থেকে।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে।
মাহি রুবাকে বলল,
: মা কে কিছু বলোনি তো ?
: না , খালি খালি টেনশন করবে।
: সেটাই, সরি রুবা তুমি সারারাত একা ছিলে।
: এক কথা আর কয়বার বলবে তুমি?
: আমি টেনশনে ছিলাম !
: কিন্তু আমি তো ভালো ছিলাম কোন ভয় পাইনি , টেনশনে র কিছু নেই তোমার।
: রুবার নাক টেনে দিয়ে মাহি বলল, আমার সাহসী মুরগির বাচ্চা !
: নিঝুম আপুকে ডাকো আমি খাবার নিয়ে এসেছি।
: নিঝুম তো বাসায় গেছে !
: আমরা একসঙ্গে ঢুকলাম হসপিটালে আপু ফোনে কথা বলছিল।
: মাহি উঠে গিয়ে নিঝুম কে ডাকতে গেল।
: কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন নিঝুম।
: ফোনে কথা বলছিলাম!
: কথা তো শেষ তারপরও দাঁড়িয়ে আছিস ভেতরে আয়!
: নিঝুম হেসে বলল, সারাদিন পর বউ এর সঙ্গে দেখা হল তোর তাই ভাবলাম বিরক্ত না করি!
: বিরাট ভেবেছিস তাই না , চল ভেতরে।
মাহি আর নিঝুম ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখে রুবা মাহির জন্য আর নিঝুমের জন্য বক্সে করে খাবার এনেছে, ফ্লাক্সে করে চা এনেছে।
মাহি খাচ্ছে। রুবা আর নিঝুম কথা বলছে।
রুবা নিঝুম কে চা ঢেলে দিল মগে এবং নিজেও নিল।
একটা সময় নিঝুম খেয়াল করলো মাহি রুবার চায়ের মগ থেকে চা খাচ্ছে।
দুজনে কি সুন্দর ওর সঙ্গে গল্প করছে আর একই মগ থেকে চা খাচ্ছে। ওর দেখে ভালই লাগছে। কি সুন্দর দুজনের ক্যামিস্ট্রি ।
নিঝুম দুজনের সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ওদের চোখে মুখে র লেগে থাকা শান্তি টা , ভালোবাসা টা দেখছে। হাজব্যান্ড, ওয়াইফের ভালোবাসা কি এমনই হয়?
বাহিরে আবার বৃষ্টি হচ্ছে নিঝুমের মনটা তার আব্বু র জন্য টেনশনে ভরে যাচ্ছে ।
মনে মনে সে বলল, আব্বু তুমি সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি আমিও মাহি , রুবার মত আপু আর সাজ্জাদ ভাইয়ের মত জীবনটা কারো নির্ভরতায়, কারো চিন্তায়, কারো ভালোবাসায় কাটানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছি। আব্বু তুমি আয়োজন করো মাহি তো বললই সে দ্বায়িত্ব নিবে আমার সুন্দর জীবন খোঁজার। দেখা যাক এবার কি করে মাহি!
( চলবে)