যখন দুজনে একা পর্ব-৬

0
3171

#যখন_দুজনে_একা

৬ষ্ঠ পর্ব

মাহি রুবার দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে! এই বাড়ানো হাত রুবাকে শুধু কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য না সারাজীবন একসঙ্গে পথ চলার জন্য‌ই !
মাহি তার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রুবার পাশে সে আজীবন থাকবে রুবাকে ভালো রাখতে!

রুবা মাহির বাড়িয়ে দেয়া হাতের দিকে তাকিয়ে আছে ! অনেক দ্বিধা আর জড়তা এই হাত ধরতে তার!

তারপরও সে কাঁপা কাঁপা হাতে মাহির বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরলো কারণ সে জানে এটাই তার ভাগ্য। আর সে এখন দেখতে চায় তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যায় !
নিয়তির সাথে তার একটা কঠিন যুদ্ধ চলছে সে আর কোন কষ্টে ভেঙে পড়বে না ঠিক করছে!

মাহির হাত ধরে সে উঠলো সোফা থেকে !

মাহি বলল, তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি এই গেঞ্জি টা চেঞ্জ করে নেই!

ঠিক আছে !

আমি কি বের করে দিব গেন্জি?

আরে না তার দরকার নেই ! হাসতে হাসতে বলল মাহি, কাপড় কোথায় কোনটা থাকে তুমি জানবে কি করে ?
ভাইয়ার সব কিছু কি তুমি করে দিতে ? বলেই মাহি চুপ করে গেল,কি বলল সে এটা! হঠাৎ এভাবে ভাইয়ার প্রসঙ্গ আনা টাই ঠিক হয়নি!বলেই আফসোস হচ্ছে।

রুবা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ভাইয়ার অন্য সব গুন থাকলেও গোছানো স্বভাবের মানুষ ছিল না!
সব কিছু আমাকে যেমন গুছিয়ে রাখতে হতো আবার তার সামনে হাজির করে দিতে হতো!
মাহি আলমারি থেকে গেন্জি বের করতে করতে বলল, ভাইয়া সব সময় মায়ের আহ্লাদ পেয়েছেতো ,তাই ছোট থেকে মা এসব করে দিত !
জানো যখন লন্ডন গেল পড়তে, তখন এই মায়ের উপর নির্ভরশীল বেশি থাকার জন্য মা কি টেনশন যে করতো ভাইয়ার জন্য !

কিন্তু তুমি তোমার ভাইয়ার থেকে অনেক গোছানো । আমি সব সময় তোমার ভাইয়াকে বলতাম , তোমার রুম তুমি গুছিয়ে রাখো জিনিস পত্র সব কিছু !শিখো কিছু ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে !
বলেই রুবা হাসতে থাকে!
মাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রুবার দিকে ! কত দিন পর রুবা এভাবে হাসছে !
কি সুন্দর লাগছে রুবাকে! মাহি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে!
কত নরমাল ভাবে ভাইয়ার কথা বলছে !

রুবা !
হুম বলো ?
একটা কথা বলি,
বলো?
তুমি এভাবেই হাসিখুশি থাকবে কেমন! তুমি হাসিখুশি থাকলে এই বাড়িটা হাসিখুশি থাকে!
মানে ?
থাক মানে বুঝতে হবে না ! চলো !

এক সেকেন্ড রুবা , আমার মোবাইল টা নিয়ে নেই!

টেবিল থেকে মোবাইল টা নিয়ে দুজন ঘর থেকে বের হয়ে এলো!

দুজন লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল!
সাফিয়া বেগম তার বোন আর ভাইয়ের বউ দের সাথে ওখানে ই বসে আছেন!

মাহিদের বাসাটা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি নিচতলায় বিশাল ড্রয়িং রুম আর তার বাবার স্টাডি রুম ।
বাকি রান্নাঘর থেকে গেস্ট রুম সব দোতলায়!
সাধারণত আত্মীয়-স্বজন এলে দোতলায় বসে সবাই!

মাহি আর রুবাকে আসতে দেখে সবাই ওদের দিকে তাকালো!
মাহির বড় মামি আস্তে করে বলে উঠলো , বড়পা দুটিকে খুব সুন্দর লাগছে একসঙ্গে তাই না ! মাসাআল্লাহ!
সাফিয়া বেগম বললেন, মাসাআল্লাহ বলো পারভীন! এই দুজন‌ই এখন আমার বেঁচে থাকার উছিলা !

অবশ্যই আল্লাহ কাছে শুকরিয়া করি আপা! আপনার সংসার যেন এদের দিয়েই ভরে থাকে।

রুবাকে হাত বাড়িয়ে নিজের বুকের কাছে টেনে নিলেন সাফিয়া বেগম!
কি অবস্থা মা তোমার ?
রাতে শরীর খারাপ করেছিল মাহি বলল!
এখন ঠিক আছি মা!
আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ!
খেয়েছো?
হুম!
মাহি তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে এসে বস!
আমি ঠিক আছি তোমরা গল্প করো!

মাহি আশেপাশে তাকালো নিঝুম কোথায়, মনে মনে ভাবছে সে!
ওর সাথে কথা বলা দরকার!

মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মেসেঞ্জার এ নিঝুম এর মেসেজ!

“ভালোই তো উন্নতি হলো ডাক্তার বাবুর, এক রাতেই ব‌উয়ের ড্রেসের সঙ্গে কালার ম্যাচিং গেঞ্জি পড়া শুরু করে দিলি! কনগ্রাচুলেশন!”

তাইতো খেয়াল ই করেনি সে , আকাশী কালারের গেঞ্জি পড়েছে ! আর রুবাও আকাশী কালারের সালোয়ার কামিজ!
কাকতালীয় ব্যাপার , কিন্তু কে বুঝবে তাকে মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

মাহি রিপ্লাই দিল,

কোথায় তুই, তোর সাথে কথা আছে আমার?

” আমি নিচের স্টাডি রুমে ” নিঝুম লিখলো!

মাহি নিঝুমের সঙ্গে কথা বলতে চায় !

মা আমি আসছি একটু বলে উঠলো মাহি!

বাহিরে যাবে, সাফিয়া বেগম প্রশ্ন করলো ?

না বাসায় ই আছি ,বলে মাহি নিচের নেমে এলো।

নিচের স্টাডি রুমে ঢুকে মাহি দেখে, একটা কর্নারে নিঝুম দাঁড়িয়ে দরজা দিকেই তাকিয়ে আছে !
তার জন্য‌ই অপেক্ষা করছে ।

মাহি ভেতরে ঢুকে দরজা টা চাপিয়ে দিল ।
ইদানিং এই স্টাডি রুমে বাবা আর আসে না । ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে তো বাবা নিজের ঘর থেকেই খুব একটা বের হয় না ! চেম্বারে যায় না। আদালতে যায় না। পরিচিত কারো সঙ্গেও কথা বলে না। একদম চুপ হয়ে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে নিজেকে। যেন নিজেকে নিজে সাজা দেয়া।

মাহি নিঝুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো!

বল মাহি কি বলবি, নিঝুম বলল?

কি শুরু করেছিস তুই?

বারে আমি কি করলাম?

সকাল সকাল এই বাসায় আসা, সবার সামনে যা খুশি মুখে আসছে আর বলে যাচ্ছিস, রুবা কে নিয়ে কি অসভ্য ইঙ্গিত পূর্ণ কথা বলছিস ?
এসবের কি মানে নিঝুম?

আমি তো আগেই বলেছি বাসর ঘর থেকে বের হ‌ওয়া প্রেমিকের চেহারা দেখতে এসেছি। দেখি কোথাও কোন লাভ বাইট নেই তো বলেই নিঝুম মাহির মুখের আশেপাশে তাকালো।

নিঝুম! জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো মাহি ! এনাফ ইজ এনাফ!

হঠাৎ করে ই নিঝুম কিছু না বলেই মাহিকে অবাক করে দিয়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো!

আমাকে ক্ষমা করে দে মাহি আমাকে ক্ষমা করে দে সকাল থেকে তোর সাথে কত খারাপ কথা বলছি ! বিশ্বাস কর ,আমি আসতে চাইনি তোদের বাসায় । খালাম্মা আম্মা কে ফোন দিয়ে বলল আমাকে নিয়ে আসতে রুবার শরীর খারাপ ! আম্মা জোর করে এনেছে আমাকে।
আমি ডিউটি আছে বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম ! তখন আপু বলল আমি ছুটি নিয়েছি! আমি আসতে চাই নাই! আমার দিকে তাকিয়ে দেখ মাহি ! কয়টা রাত আমি ঘুমাই না ! কালকে সারাটা রাত বারবার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাই নিজেকে শেষ করে ফেলি! কিন্তু পারলাম না রে!
আমি পারছি না তোকে ছাড়া থাকতে , তোকে ছাড়া বাঁচতে মাহি!
আমাকে মেরে ফেল তুই প্লিজ আমাকে মেরে ফেল! কিভাবে বাঁচবো তোকে ছাড়া বল মাহি! কাঁদছে নিঝুম।

মাহি ফিসফিস করে বলল, ছাড় আমাকে কেউ ঘরে ঢুকে পড়লে খুব বাজে একটা ব্যাপার হবে ! দরজা খোলা, ছাড় নিঝুম!

আমি ছাড়তে পারবো না মাহি, বলে আরো শক্ত করে নিঝুম মাহিকে জড়িয়ে ধরলো !

নিঝুম প্লিজ ছাড় ! প্লিজ!

নিঝুম ছেড়ে দিল মাহিকে !
মাহি ওকে ধরে নিয়ে একটা চেয়ারে বসালো!
নিঝুম একটু শান্ত হ!

নিঝুম ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে!

আমি কি করব বলতে পারিস তুই নিঝুম! সব তো তুই জানিস!

চোখ মুছতে মুছতে নিঝুম বলল, মাহি আচ্ছা বলতো এখন আমাদের সম্পর্ক টার কি হবে ?
মানে?
মানে তুই নিশ্চয়ই রুবাকে নিয়ে পুরোপুরি দাম্পত্য জীবন কাটাতে শুরু করে দিবি না ?

মাহি অবাক হয়ে বলল,নিঝুম তোর কথার মানে বুঝতে পারছি না ?

মানে খুব সোজা তোর আর রুবার সম্পর্ক টা কেমন হবে বা হচ্ছে বলতো আমাকে ? আমি জানতে চাই!

কি জানতে চাস ? কি বলতে হবে তোকে?

তোর আর রুবার সম্পর্ক!

তুই কি পাগল হয়ে গেলি!

হ্যাঁ হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি! বল তুই আমাকে? উত্তেজিত হয়ে রাগে কাঁপছে নিঝুম!

তাহলে শোন , আমি আর রুবা এখন স্বামী স্ত্রী! এটাই এখন আমাদের সম্পর্ক! জানাতে পারলাম তোকে?

মাহি !

চিৎকার করে লাভ নেই, তুই যখন আমার অসহায়ত্ব টা বুঝতে চাইছিস না আমি আর পারছি না তোকে বোঝাতে। আমি অক্ষম !
শোন রুবা আর আমার সম্পর্ক কেমন হবে , কোন দিকে যাবে জানি না ! কিন্তু তুই তো ভালো করেই জানিস আমি কেমন?
বিয়ে যেহেতু আমি করছি আমি চেষ্টা করবো এই সম্পর্ক টা সততার সাথে , দ্বায়িত্বে র সঙ্গে পালন করতে!
এখন রুবা আমাকে কবে ,কখন , কিভাবে , কতটুকু গ্রহণ করবে সেটা ও জানে!
আমি আমার সব রুবার উপর ছেড়ে দিয়েছি !

নিঝুম তীব্র গলায় বলল, আর ভালোবাসা মাহি? ভালোবাসা ও কি ডিউটি শিফটের মত শিফট করে ফেলেছিস?

জানি না!

কেন জানিস না ? জানতে হবে?

রুবা যদি কোন দিন ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় সেদিন আমিও দিব !

সব রুবা নির্ধারণ করবে মাহি? বাহ্! রুবা, রুবা , রুবা! তোর সব কিছু এখন রুবা!

হ্যাঁ আমার সব কিছু এখন রুবা!

মাহি কিভাবে পারলি রে তুই!

নিঝুম , আমাকে পারতে হচ্ছে রে ! এছাড়া সত্যি বললাম তো কোন উপায় ছিল না , নেই!

সত্যি ই ছিল না মাহি!

না ছিল না!

তাহলে আর কি! ভালো থাকিস , সুখে থাকিস!

নিঝুম আর কিছু না শুনে ই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মাহি নিঝুমের পিছনে তাকিয়ে রইল শুধু!

চেয়ারে বসে চোখে র পানি মুছতে মুছতে মনে মনে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিস নিঝুম! ক্ষমা করে দিস।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here