যখন দুজনে একা পর্ব-৬৫

0
2883

#যখন_দুজনে_একা

৬৫ পর্ব

দুই দিন সোফায় ঘুমিয়ে মাহি বুঝতে পারছে আসলে যতটা সহজ ভেবেছিল সে ততটা সহজ নয় সোফায় শুয়ে রাত পার করে দেয়া।
তবুও তার কাছে ভালোই লাগছে রাতে যতবার বাচ্চা রা উঠে সেও উঠে ওদের সঙ্গে জেগে থাকে।
কিন্তু ওর আনন্দ খুব একটা স্থায়ী হলো না । তিন দিনের দিন হসপিটালে প্রচন্ড গা ব্যথা শুরু হলো প্রথমে ভেবেছিলো সোফায় থাকছে তাই কিন্তু যখন শরীরের টেম্পারেচার বাড়ছে তখনই বুঝলো আসলে জ্বর এসেছে বলেই খারাপ লাগছে !
বাসায় ফিরে নিজেই বাচ্চাদের থেকে দূরে সরে র‌ইল।
লিভিং রুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মাহি । লাইলি বুয়া কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এলো?
: বুয়া তোমার ভাবি ফ্রি থাকলে ডেকে নিয়ে এসো যাও !
: জ্বি ভাইজান বলে বুয়া চলে গেল রুবাকে আনতে।
কিছুক্ষণ পর রুবা এসে কাছে দাঁড়ালো !
: কখন এলে তুমি ?
: রুবা দেখো তো আমার জ্বর এলো কিনা ?
রুবা মাহির গায়ে হাত দিয়েই বুঝলো জ্বর !
: হুম শরীর যথেষ্ট গরম !
: আমি দাদির রুমে থাকব তুমি আমার জিনিস পত্র এনে দাও ! আমার খারাপ লাগছে খুব!
: ওষুধ খেয়ে নাও আগে !
: দাও , ছেলেরা কি করে ?
: ওরা ঘুমাচ্ছে !
: উঠলে আমাকে খবর দিও আমি দেখে আসব গিয়ে! ভাইরাস জ্বর তো ওদের কাছে থাকা ঠিক হবে না আমার!
: খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার ?
: মাহি রুবার হাত ধরলো তোমাদের থেকে দূরে থাকব সে জন্য কষ্ট হচ্ছে!
: আমি ওষুধ আর তোমার ঘরে পড়ার ড্রেস নিয়ে আসছি !
: হুম!
সাফিয়া বেগম মাহির কাছে ছুটে এলেন !
: হঠাৎ করে জ্বর বাঁধিয়ে ফেললে কিভাবে মাহি?
: বুঝতে পারছি না মা !
: বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকো !
: চিন্তা করো না মা আমি দাদির রুমে থাকব ।
: তুমি তো আবার অসুস্থ হয়ে গেলে নিজেই বাচ্চা হয়ে যাও !
: এখন থেকে আর হব না মাহি হাসলো !
: লাঞ্চ করেছিলে কিছু ?
: কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা, প্লিজ তুমি আর রুবা খাও খাও বলে অত্যাচার শুরু করবে না !
: তুমি একদম খাওয়া ছেড়ে দাও বলেই খাও খাও করতে হয় মাহি !
: তোমরা যেটা করো সেটাকে বলে অত্যাচার !
: আচ্ছা ঠিক আছে এখন রুমে যাও রেস্ট নাও!
: আর দয়া করে কুদরত ভাই কে পাঠাও নতুন এসি আনতে দাদির রুমের এসি কাজ করে না এটা ঠিক ও হবে না । আমাকে মনে হচ্ছে পার্মানেন্টলি ওখানে ই থাকতে হবে ! মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল!
: দেখছি কি করা যায় !
সাফিয়া বেগম উঠে চলে গেল।
রুবা এসে মেডিসিন খাইয়ে দিল ।
: কিছু খাবে তুমি ?
: না , প্লিজ স্যুপ এনে সামনে ধরবে না রুবা বলে দিচ্ছি!
: ঠিক আছে!
: দিশা আপু তো কক্সবাজার তুমি ইচ্ছে করলে গেস্ট রুমে থাকতে পারো !
: দিশা আবার আসবে , বারবার রুম চেন্জ করতে ভালো লাগে না। তারচেয়ে ও বড় কথা একটা মেয়ে বিছানায় ছিল আমি গিয়ে আবার ঐ বিছানায় থাকব ও আসলে আবার উঠে যাব এটা কারো জন্যই সুখকর না ।
: আচ্ছা চলো দাদির রুমে নিয়ে যাই তোমাকে !
: হুম!
মাহি দাদির বিছানায় শুয়ে জ্বর মেপে দেখে একশ তিন।
: মাথায় পানি দিয়ে দেই ?
: না আমি ঘুমাব । রুবা তুমি আমার পাশে একটু থাকো প্লিজ!
: ঠিক আছে আমি আছি তুমি ঘুমাও !
: আচ্ছা থাক লাগবে না বাচ্চাদের কাছে যাও । আমি থাকতে পারব । তুমি দেখো এসি কখন আসবে আমি সব সহ্য করতে পারছি গরম পারছি না !
মাহি ঘুমিয়ে গেছে রুবা উঠে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ওর কপালে ধরলো।
মাহি চোখ খুলে তাকালো !
: দরকার ছিল না এমনি ঠিক হয়ে যাবে !
: তুমি ঘুমাও আমার কাজ আমাকে করতে দাও!
: ছেলেরা কাঁদবে তোমার জন্য ,যাও রুবা !
: আমি আজ তোমার জ্বর না কমা পর্যন্ত কোথাও যাব না ! মা রাখছে ওদের ফরিদা বুয়াও আছে ।
এখন গেঞ্জি খোলো গা স্পঞ্জ করে দেই !
: লাগবে না !
: তোমাকে কথা বলতে না করলাম না মাহি !
: আচ্ছা ঠিক আছে!
রুবার মনটা এত খারাপ লাগছে ! মাহি ওর কোলের কাছে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে !
বিয়ের পর একবার এরকম জ্বর ছিল মাহির, অনেক কষ্ট পেয়েছিল মাহি!

সন্ধ্যায় রুবা বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে । সাফিয়া বেগম বললেন,
: মাহির জ্বরের কি অবস্থা ?
: খুব কষ্ট পাচ্ছে মা !
: বাসার বড় বাচ্চা সে দেখবে কত মেজাজ দেখাবে ! সবচেয়ে আগে খাওয়া বন্ধ করবে ! বাবুর মুখের সামনে খাওয়া নিয়ে তখন কত কাহিনী করতে হবে ! সাফিয়া বেগম হাসছেন!
: মা আমি ওর কাছে থাকলে আপনি এদের সামলাতে পারবেন ?
: মাহির টেক কেয়ার করতে গিয়ে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে যাবে না তো !
: না মা । রুবা মনে মনে ভাবছে অসুস্থ হয়ে গেলে হবে কিন্তু ও মাহির পাশেই থাকবে !

কিছুক্ষণ পর মাহি এসে রুমে ঢুকল !
: এখন কি অবস্থা তোমার ?
: ঠিক আছি মা ! ছেলেদের কোলে দাও একটু সারাদিন ওদের দেখি নাই !
: ভাইরাস জ্বর না তোমার, কোলে নিবে ?
: ছোঁয়াচে কিছু না মা কোলে নিলে কিছু হবে না । আচ্ছা থাক মাহি বাচ্চাদের গালে হাত ছুঁয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে!
: মা আপনার ছেলে রাগ করেছে !
: রাগ করার কি আছে ও নিজে ডাক্তার ও জানে না ভাইরাস জ্বর এখন বাচ্চাদের কাছেই আসা ওর উচিত না !
: যাই বলেন মা ও অভিমান করেছে ! আমি গিয়ে দেখব?
: আচ্ছা যাও কথা বলো , চিন্তা করো না আমি তোমার বাচ্চাদের সামলাচ্ছি তুমি আমার বুড়া বাচ্চা কে সামলাও অভিমান হয়েছে তার ! সাফিয়া বেগম হাসছেন!
রুবা শ্বাশুড়ি র দিকে তাকিয়ে আছে ।

মাহি লিভিং রুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল! মায়ের কথায় তার খুব কষ্ট লেগেছে । বাচ্চাদের কাছে যেতে দিচ্ছে না থাকতে দিচ্ছে না ! আচ্ছা সব দাদিরা কি নাতিদের নিয়ে এমন করে ?
মাহি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে!
রুবা ওর পাশে এসে মাথায় হাত রাখলো!
: যাও রুবা তুমি ও এখান থেকে যাও ! তোমার শ্বাশুড়ি তোমাকে নিষেধ করেনি আসতে !
: নিষেধ করবে কেন , আশ্চর্য! আর আমি ছাড়া তোমার টেক কেয়ার কে করবে শুনি!
: তোমার শ্বাশুড়ি কে গিয়ে বলো আমাকে আরো দুই টা তিনটা বিয়ে করাতে । তারপর আমি আরো নাতি নাতনি পয়দা করে দিব তখন আমাকে বাসা থেকেই বের করে দিতে পারবে সে !
: এত অভিমান রুবা হাসছে !
: হাসবে না রুবা !
: আচ্ছা ঠিক আছে হাসব না ! কি খাবে বলো বানিয়ে দেই ?
: প্লিজ বলেছি না খাওয়া খাওয়া করবে না !
: এত জ্বালাবে না তো মাহি । অবাক হয়ে যাই এত বুঝদার একজন মানুষ অসুস্থ হলেই ছোট বাচ্চা কিভাবে হয়ে যায় !
: তুমি এখানে বসে থাকো উঠবে না।
মাহি রুবার হাত ধরে রাখলো!
: অসুস্থ হয়ে তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম তাই না রুবা?
: খুব ঝামেলায় ফেলে দিলে , অসুস্থ তো আমিই বেশি থাকি তুমি তো সেই বিয়ের পর একবার কয়দিন জ্বরে ভুগলে তোমার সেবা তো করতেই পারি না উল্টো সেবা যত্ন আমি নেই তোমার। আমিই অসুস্থ হয়ে তোমাকে বেশি কষ্ট দেই সব সময় !
: রুবা জ্বর হয়ে ভালোই হয়েছে তুমি আমার পাশে বসে আছো কতদিন তুমি আমার পাশে এসে বসো না!
: তুমি আমাকে খুব মিস করো ?
: অনেক অনেক মিস করি রুবা । আমাদের বিয়ের পর কোন দিন এক রাত ও তোমাকে ছাড়া থাকিনি এখন এক‌ই বাসায় থাকি এমন‌ও যায় তোমার পাশে একটু সময় বসা যায় না ! তুমি মিস করো না আমাকে ?
: রুবা ঝুঁকে মাহির কপালে চুমু খেয়ে বলল খুব।

হ্যালো লাভ বার্ডস !
দিশা লিভিং রুমে ওদের সামনে এসে দাড়ালো !
রুবা একটু লজ্জা পেয়ে গেল !
: কি অবস্থা তোমাদের ?
: এই তো , কখন এলে ? মাহি জিজ্ঞেস করলো!
: হঠাৎ করে ঢাকার অফিসে একটা কাজ পড়লো বিকালে র ফ্লাইটে চলে এসেছি সোজা অফিসে গেলাম সেখান থেকে এই যে বাসায় এসে ঢুকছি!
তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন মাহি ?
: ভাইরাল ফিভার !
: ও আচ্ছা রেস্ট নাও পরে কথা হবে । রুবা কেমন আছো ?
: আমি ভালো আছি , চা এখন দিতে বলব আপনার জন্য, নাকি ফ্রেশ হয়ে এসে খাবেন আপু ?
: পরেই খাই আচ্ছা তুমি আমাকে আপনি করে বলবে না প্লিজ রুবা !
: আচ্ছা ঠিক আছে !
দিশা গেস্ট রুমের দিকে চলে গেল !
আপু ফ্রেশ হয়ে আসুক তারপর একসঙ্গে সবাই চা খাই চলো !
: আমার কিছু ভালো লাগছে না রুমে গেলাম বলে মাহি উঠে রুমে চলে গেল।

রুবা উঠে গেল কিচেনের দিকে । বুয়াকে চা বানাতে বলল সবার জন্য ! মাহির জ্বর হলে কিছু খেতে চায় না । তারপরও সে মাহির জন্য স্যুপ বানাতে শুরু করলো অনেক জোর জবরদস্তি করতে হবে সে জানে তারপরও চেষ্টা করতে হবে খাওয়ানোর।
দিশা এসে কিচেনে ঢুকলো!
: কিছু লাগবে আপু ?
: না তোমার সঙ্গে গল্প করতে এলাম !
: কেমন লাগছে বাংলাদেশে এসে ?
: খুব ভালো , অনেক বছর পর আসলাম!
: আপনার একটা জিনিস খুব ভালো লাগছে আমার, আপনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না এদেশের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ নেই !
: কে বলল যোগাযোগ নেই , রুবা আমাদের বাসায় সবাই খাঁটি বাঙালি। এখনো আম্মু ছুটির দিনে সকালে ঢেলা খিচুড়ি বেগুন ভাজি করবে সবাই তাই খায়। কোন একটা উপলক্ষ হোক আত্মীয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব এ বাসায় ভরে যাবে।
আমাদের পাসপোর্ট টা নীল কিন্তু মনের ভেতরটা লাল সবুজ ! বলেই হো হো করে হেসে দিল দিশা !
: হাসছো যে আপু ?
: আব্বু র ডায়লগ টা কপি করে দিলাম তো তাই হাসছি ! এটা আব্বু সব সময় বলবে !
: চাচা খুব বাংলাদেশ কে মিস করেন উনার সাথে কথা বলে বোঝা যায় !
: হুম! কি করছো তুমি রুবা ?
: মাহি র জন্য স্যুপ বানাচ্ছি ! যদিও খাবে কিনা শিওর না !
: খাবে না কেন ?
: অসুস্থ থাকলে কিছু খেতে পারে না ,উনি তখন বেবি হয়ে যান ! মা কে আমাকে খুব জ্বালাতন করে!
: তাই ?
: হুম!
: তোমাদের দুজনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে রুবা !
: আমি ভাবলাম বলবেন অবাক লাগছে !
: কেন সবাই অবাক হয় বুঝি ?
: কেউ কেউ হয় আসলে আমাদের রিলেশন টা এক রকম ছিল আগে এখন আরেক রকম তো তাই !
: আগে রিলেশন কি ছিল সেটা বড় কথা না , এখন যে রিলেশন এ দুজন বাঁধা সেটার মধ্যে ভালোবাসা টা কতটুকু ,কন্সটেন্সি টাই আসল! আর আমার মনে হচ্ছে তোমরা দুজন মেইড ফর ইচ আদার!
: রুবা হাসলো !
: সত্যি বললাম কিনা বলো রুবা ?
: আপু ও আমার জন্য অনেক কিছু তারচেয়েও বড় কথা আমিই ওর সব !
: এই বিশ্বাস টা, এই রিয়েলাইজেশন টাই সবচেয়ে বড় ! তোমার জন্য সে কতটুকু এর চেয়ে তুমি তার জন্য কতটা সেটাই আসল!
কত মানুষের একটা পুরো জীবন কেটে যায় এই জিনিস বুঝতে গিয়ে রুবা।

হঠাৎ রুবা মাহির তীব্র চিৎকার শুনতে পেলো। কিচেন থেকে বের হয়ে সে শুনে সত্যিই মাহি পুরো বাসা কাঁপিয়ে রুবা রুবা বলে চিৎকার করে ডাকছে !
রুবা দৌড়ে মাহির ঘরের দিকে ছুটে এলো!
কি হয়েছে ? রুবা কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাহি রুবাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে ,
: আমার ছেলেরা কোথায় ? আমার ছেলেরা কোথায় রুবা ? তুমি কোথায় ছিলে রুবা ?
: ছেলেরা রুমে আছে মায়ের কাছে ! কি হয়েছে তোমার, এমন করছো কেন ?
মাহির চেহারার মধ্যে তীব্র ভয়ের ছাপ দেখে রুবাই ভয় পেয়ে গেল! মাহির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে !
স্বপ্ন দেখেছো ?
রুবা আমার ছেলেরা কোথায় ওদের নিয়ে আসো প্লিজ । একবার নিয়ে আসো । আমি ওদের দেখব !
মাহির চিৎকার শুনে লাইলি বুয়া ছুটে এলো ! দিশাও এসে দরজায় দাঁড়ালো!
রুবা কি করবে বুঝতে পারছে না !
মাহি এতটা ভয় পেয়ে গেল স্বপ্ন দেখে , কি স্বপ্ন দেখেছে?
প্লিজ রুবা আমার ছেলেদের নিয়ে এসো।
রুবা ছুটে গেল নিজের ঘরের দিকে !
রুবা ঠাস করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই সাফিয়া বেগম অবাক হয়ে গেলেন!
এত জোরে তো এই ঘরের দরজা খোলা হয় না এখন!
রুবার চেহারা দেখে সাফিয়া বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন ।
: কি হয়েছে রুবা ?
: মা আপনার ছেলের কি হয়েছে বুঝতে পারছি না ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করা শুরু করেছে , ছেলেদের দেখতে চাইছে । রীতিমত কাঁদছে মা ! আমি ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছি মা প্লিজ!
: হ্যাঁ চলো দেখি কি হয়েছে ?
দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে সাফিয়া বেগম আর রুবা মাহির রুমে গিয়ে ঢুকলো !
: মাহি তখন‌ও ছটফট করছে ভয়ে!
রুবা ছেলেদের ওর পাশে শুইয়ে দিল ! মাহি ওদের বুকে জড়িয়ে ধরে র‌ইলো কিছুক্ষণ ।
সাফিয়া বেগম আর রুবা তাকিয়ে আছে । রুবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ! সে সাফিয়া বেগম এর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল ,
: মা ওর কি হয়েছে এরকম করছে কেন ছেলেদের নিয়ে?
: ছেলেদের নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে তাই ভয় পেয়েছে ! কিছুক্ষণ থাকুক ঠিক হয়ে যাবে !
মাহি বলল, মা ওদের নিয়ে যাও !
:থাক মাহি তোমার কাছে থাকুক কিছুক্ষণ !
না আমার অনেক জ্বর নিয়ে যাও ওদের !
সাফিয়া বেগম আর ফরিদা বুয়া বাচ্চাদের কোলে তুলে নিল !
রুবা তুমি ওর পাশে থাকো । আমার মনে হয় ওর মাথায় পানি দেয়া দরকার পুরো শরীর তো লাল হয়েগেছে জ্বরে!
: আমি দেখছি মা !
সাফিয়া বেগম বাচ্চাদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন!
রুবা মাহিকে বাথরুমে নিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলো ! কিছুক্ষণ মাথা শরীরে পানি দেয়ার পর শরীর মুছিয়ে ঘরে নিয়ে এলো!
: কাগজ কলম এনে দিচ্ছি কি কি ওষুধ খেতে হবে এখন লিখে দাও আনাতে হবে !
: ওষুধ খেয়েছি তো !
: আমার মনে হচ্ছে শুধু প্যারাসিটামল এ কাজ হবে না অন্য ওষুধ ও লাগবে!
: পরে দেখা যাবে । মাথা যন্ত্রণা করছে শুতে দাও বসে থাকতে পারছি না !
মাহি বিছানায় শুয়ে পড়লো !
রুবা মাহির কাছে এসে বলল , একটু কিছু খাও ভালো লাগবে!
: এখন না আরেকটু পর খাব প্লিজ রুবা!
: ঠিক আছে সত্যি খাবে তো ?
: সত্যি।
: এখন বলো কি স্বপ্ন দেখে এত ভয় পেলে ?
: এখন বলতে ইচ্ছে করছে না !
: ঠিক আছে পরে বলো !
: রুবা
: হুম !
: তুমি আমাকে ফেলে কোথাও চলে যাবে না তো ?
: রুবা মাহির প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেল ! মাহির কানের কাছে এসে বলল ,
: কোথায় যাব আমি , আমার যাওয়ার কোন জায়গা আছে ?
: মাহি রুবাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো আচমকাই ! ওর জ্বর আবারো বাড়ছে!
রুবা মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ওর খুব খারাপ লাগছে । এত গুলো মাস নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য মাহির দিকে ফিরেও তাকায়নি । কি খাচ্ছে, কখন খাচ্ছে ! কোন খবর রাখতো না সে। এখন ছেলেরা হ‌ওয়ার পরও ছেলেদের নিয়ে সে ব্যস্ত। গত দেড় মাসে একবার ও ভালো করে দুটো কথা বলতে পারেনি সে মাহির সঙ্গে ! মাহির দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না। যে মানুষটা তার সব কিছুর এত খেয়াল রাখে , তাকে এত ভালোবাসে , এত প্রায়োরিটি দেয় তার প্রতি এতটা কেয়ারলেস হয়ে গেল সে কিভাবে ?
মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্ত্রীর দ্বায়িত্ব কিভাবে সে ভুলে গেল !
সবকিছু র আগে মাহির প্রতি মনোযোগী হ‌ওয়ার দরকার ছিল আমার! এসব চিন্তা করে
রুবার চোখে পানি চলে এসেছে। মা কে বলে সে মাহির কাছেই থাকবে আজ !
এই অবস্থায় একা রেখে যাবে না সে মনে মনে ঠিক করল !

সাফিয়া বেগম আর আজগর সাহেব মাহির দাদির রুমের দরজায় নক করলো !
রুবা ঘুমন্ত মাহিকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল!
কি অবস্থা এখন মাহির?
: মা জ্বর তো এখনো অনেক!
সাফিয়া বেগম মাহির মাথায় হাত রাখলো!
: রুবা তুমি ডিনার করে এসো অনেক রাত হয়ে গেছে আমি মাহির কাছে আছি !
: সমস্যা নেই মা ও উঠলে এক সঙ্গে ডিনার করব !
: মাহি কিছুই খাবে না ওর আশায় বসে থেকো না ! কি স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে বলেছে কিছু ?
: না মা !
: এই ছেলে আমার বড় হবে না কখনো , ছোট থেকেই অসুস্থ হয়ে গেলে সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাবে ! সে নাকি আবার ডাক্তার এবং দুই ছেলের বাবা!
: আহ্ সাফিয়া সব মানুষ তো আর এক হয় না ! যত কিছুই বলো ও তো সবার ছোট‌ই ছিল সব সময় আজগর সাহেব বললেন!
রুবা তুমি থাকো আজ মাহির সঙ্গে তোমার শ্বাশুড়ি বাচ্চাদের রাখতে পারবে !
হ্যাঁ রুবা ওদের নিয়ে তুমি চিন্তা করো না ! আমি রাখছি ওদের, লাগলে তোমাকে ডেকে নিব!
শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে রুবা মাহির মাথার পাশে গিয়ে বসলো!
দরজায় দিশা নক করছে ! আসব রুবা ?
: এসো আপু !
মাহি খালি গায়ে ঘুমাচ্ছে রুবা চাদর টেনে দিল গায়ের উপর!
: কি অবস্থা এখন ওর ?
: জ্বর আছে এখনো !
: চিৎকার শুনে তখন আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম !
: ছেলেদের নিয়ে ভয়ের কোন স্বপ্ন দেখেছে হয়তো !
: তাই হবে , অসুস্থ থাকলে মানুষের মন দূর্বল থাকে তখন যত উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে । নতুন বাবা মায়ের ভয়ের সব স্বপ্ন থাকে বাচ্চাদের ঘিরেই । তুমি চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে সব!
: জানি আপু !
: তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে তুমি খুব কেয়ারিং ওয়াইফ !
: না আপু ওর মত কেয়ারিং হতে পারব না কখনো ! পুরো প্রেগন্যান্সিতে ও যা টেক কেয়ার করেছে আমার কি বলব আপনাকে ! আমার নিজের মা ও এত টা পারতো না !
: দারুন তো !
: বললাম না আপনাকে, মাহি অন্য রকম আর দশটা মানুষের মত না !
: আমারো তাই মনে হচ্ছে রুবা !
: নেক্সট ছুটির দিনে তোমাদের দুজনের সঙ্গে অনেক গল্প করব মাহি ও আশাকরি ততদিনে সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!
: জ্বি আপু।
: এখন রেস্ট নাও তুমি আমি আসি!
: থ্যাঙ্কস আপু।

অনেক রাতে মাহির ঘুম ভাঙলো ! রুবা ওর পাশে শুয়ে আছে। মাহি ওর হাত ধরতেই রুবার ঘুম ভেঙ্গে গেল!
: জ্বর কেমন দেখি তোমার ?
: আগের চেয়ে কমেছে ! তুমি এখানে কেন রুবা ?
: তোমাকে এই অবস্থায় একা রেখে কিভাবে যাই বলো ?
: তুমি যাও ছেলেদের কাছে , ছোটটা তোমাকে ছাড়া কেঁদে ঘর মাথায় তুলবে !
: কাঁদলে মা ডাকবে বলেছে! মা ই বলল এখানে থাকতে !
: তাই নাকি ?
: হুম!
: তুমি প্রমিজ করেছিলে ঘুম থেকে উঠে খাবে ! সে জন্য আমিও কিছু খাইনি !
: কি খেতে হবে এখন ?
: তুমি যা চাইবে !
: তোমার সেই জাও কাচ্চি বিরিয়ানী টা হবে রুবা মাহি হাসছে ?
: বললে সেটাও করে দিব !
: থাক আরেক দিন খাব ঐ জিনিস , এখন আমি শিওর তুমি ঠিকই স্যুপ বানিয়েছো সেটাই আনো খাই তোমার আত্মা ঠান্ডা করি যাও!
: রুবা হেসে উঠে গেল !
সামান্য স্যুপ খেয়ে মাহি রেখে দিল । রুবা ওষুধ খাইয়ে দিল ।
পাশে বসে রুবা বলল , মাথার যন্ত্রণা কমেছে তোমার?
: আগের চেয়ে কম !
: কতদিন পর তোমার পাশে শুয়ে আছি রুবা !
: হুম ! হসপিটালে যেদিন ভর্তি হলাম তার আগের দিন রাতে ছিলাম এক সঙ্গে!
: আচ্ছা একটা কথা বলো তো এত ভয় পেলে কি স্বপ্ন দেখে ? আমি তো বিয়ের পর তোমাকে স্বপ্ন দেখে ভয় পেতে দেখিনি কখনো !
: মাহি চুপ করে আছে !
: বলবে না ?
: থাক স্বপ্ন তো স্বপ্ন‌ই ওসব বলে কি হবে ?
: তারপরও শুনি !
: মাহি রুবার হাত ধরলো । দেখলাম আমি ছেলেবেলার মত মাঠে ফুটবল খেলছি বন্ধুদের সাথে ! হঠাৎ পড়ে গেলাম কে জানি হাত বাড়িয়ে দিল উঠার জন্য চোখে রোদ পড়ছে বলে দেখতে পারছি না তার মুখ । হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার হাত ধরে টেনে তুলছে ভাইয়া ! ভাইয়া বলছে , উঠ মাহি দৌড় দে ! আমাকে ভাইয়া টেনে তুলল । তারপর আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় এসেছি । এসে তোমাকে এত ডাকছি দেখি তুমি কোথাও নেই । রুমে ঢুকে দেখি আমার ছেলেরা একা বেডে শুয়ে আছে তোমার জন্য কাঁদছে কিন্তু তুমি নেই । আমি ওদের রেখে তোমাকে খুঁজতে বের হয়েছি রুম থেকে। আবার রুমে ঢুকে দেখি এবার ওরাও নেই বেডে আমার ঘর টা শূন্য পড়ে আছে রুবা ।
স্বপ্ন বলতে বলতে মাহি কেঁদে দিল!
রুবা মাহিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো !
রুবা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না । তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি রুবা । আমার ছেলেদের কি হবে তোমাকে ছাড়া ?
: আমি কোথাও যাচ্ছি না তুমি ভয় পেয়ো না প্লিজ!
অসুস্থ হয়ে দেখি তুমি আমার মত হয়ে গেছো মাহি!
রুবা মাহির চোখ মুছিয়ে দিল।
: তোমার ভাইয়া কে স্বপ্ন দেখে ইনসিকিউর হয়ে গেছো তুমি ?
: জানি না !
: শোন আমি জানি জীবন কোন সিনেমার ক্লাইমেক্স না যেখানে মৃত মানুষ ফিরে আসবে তারপরও বলব , আমার জীবনে এখন তুমিই সব , তুমি ই এক মাত্র সত্যি । তুমি আর আমাদের ছেলেরা ছাড়া আমার জীবনে আর কোন সত্য নেই! বাকি সব দুই সেকেন্ড এর স্বপ্ন মাহি ।
রুবা মাহিকে অনেক অনেক মাস পর গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলো, মাহির ঠোঁটে চুমু খেলো !
ঘুমাও তুমি এখন!
: তুমি চলে যাবে না তো রুবা ?
: না !
: আজ তুমি আমার পাশে না থাকলে সত্যি আমার অনেক কষ্ট হত রুবা !
: আমি জানি তো! এখন ঘুমাও!
: মাহি রুবার কপালে চুমু খেল ।

জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না শিহাবের জন্যে ও এই পৃথিবীর কিছু থেমে থাকেনি। জীবন ঘুরতে থাকে !
ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যায় ! শিহাবের মত যারা হারিয়ে যায় তারা কখনো ফিরে আসে না !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here