#যখন_দুজনে_একা
৩৯ পর্ব
নিঝুম চুপচাপ নিয়াজের গাড়িতে বসে আছে। নিয়াজ ড্রাইভ করছে । ওর হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে। রুবা যখন সুরাইয়া ম্যাম এর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে ও কল্পনাও করেনি রুবা এই প্রসঙ্গ তুলবে। ওর ভেতর টাতে খুব খালি খালি লাগছে। ওর সামনে রুবা, মাহির জীবনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা টা এভাবে আসবে আর এভাবে ওকে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে ও ভাবিনি কখনো।
বাহিরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে! নিঝুম তাকিয়ে আছে সেদিকে।
: হঠাৎ তোমার কি হলো? নিয়াজ বলে উঠলো।
: নিয়াজের কথায় নিঝুম ফিরে তাকালো, আমি ঠিক আছি।
: তোমাকে কি কেউ আবার কিছু বলল?
: না নিয়াজ সেরকম কিছু না।
: একটা কথা বলব নিঝুম ?
: বলো !
: নিজেকে একটা জায়গায় যত বেঁধে রাখবে তত বেশি কষ্ট পাবে। মাহির পরিস্থিতি যাই হোক, সে এগিয়ে গেছে তুমি আর নিজেকে ওর জন্য কষ্ট দিতে যেও না । কোন কিছুই কারো জন্য আটকে থাকে না নিঝুম!
: নিয়াজ , ভালোবাসা পেয়ে হারানোর কষ্ট কি জানো ? জানলে এত সহজে এই কথা গুলো বলতে না।
: তুমি তো ভালোবাসা পেয়ে হারিয়েছো , আমি তো ভালোবেসেই গেলাম শুধু ,পাওয়ার কিছু নেই !
: নিঝুম নিয়াজের দিকে তাকালো !
: নিয়াজ সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের দুজনের কষ্ট টা এক রকম শুধু কষ্ট পাওয়ার ধরন টা আলাদা!
: নিঝুম অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, তুমি কি বলছো নিয়াজ আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না !
: বোঝার দরকার নেই, নিঝুম তোমার বাসায় চলে এসেছি !
: উপরে চলো কফি খাবে !
: নেক্সট কোন দিন ! ভালো থেকো নিঝুম!
: কথা হবে নিয়াজ থেঙ্কস ফর এভরিথিং , নিঝুম নেমে দাঁড়াল!
: থেঙ্কস এর কিছু নেই , নিঝুম। হাসলো নিয়াজ।
নিয়াজ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল ! নিঝুম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পিছনে। ও কি সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে এখনও চিন্তা করে ?
নিঝুম মনে মনে চিন্তা করলো, পাগল নাকি!
নিঝুম লিফটের ভেতরে ঢুকে গেল!
মাহির গাড়ি যখন বাসায় ঢুকলো বৃষ্টি ততক্ষণে মুষলধারে পড়ছে। রুবা বলল, এত সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে ইচ্ছে করছে বসে বসে দেখি শুধু!
মাহি শুধু হুঁ বলল!
দুজনে ড্রয়িং রুমের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো সাফিয়া বেগম লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছেন!
রুবা শ্বাশুড়ি র কাছে ছুটে গিয়ে কাছ ঘেঁষে বসলো!
সাফিয়া বেগম বললেন, শাড়ি কে পড়িয়ে দিল?
: মা আমি একা পড়েছি , ইউটিউব দেখে !
: তাহলে তো ভালই হলো, আমার দ্বায়িত্ব শেষ!
মাহি সোফায় বসে রুবার কে আর মা কে দেখছে।
: কেমন কাটলো আজ তোমাদের দিন টা , সবাই খুব মজা করেছো তো অবশ্যই!
: রুবা শ্বাশুড়ি র ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল অনেক মজা করেছি মা , এখন খুব টায়ার্ড!
সাফিয়া বেগম , ওর মাথায় হাত রাখলেন!
মাহি দেখছে রুবা কতটা সহজ মায়ের সঙ্গে , ওরা দুই ভাইও মায়ের এতটা কাছে ঘষতে পারেনি বড় হওয়ার পর ! একটা মেয়ে আর মায়ের যেমন সম্পর্ক থাকে রুবা আর সাফিয়া বেগম এর সেরকম সম্পর্ক। তার প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গম্ভীর মা, রুবার সঙ্গে কতটা সহজ ,কতটা আটপৌরে কে বলবে ওরা বউ শ্বাশুড়ি!
মাহি মুগ্ধ হয়ে দুজনকে দেখছে !
সাফিয়া বেগম বলল, মাহির কি হয়েছে এত চুপচাপ কেন?
: কি জানি মা আসার পথে পুরো রাস্তায় শুধু আমিই কথা বলেছি ও শুধু হু হ্যাঁ করে গেছে।
: আমার মনে হয় টায়ার্ড , মা বলল!
মাহি কোন সমস্যা এত চুপচাপ কেন , মা বলল ?
: কোথায় চুপচাপ টিভি দেখছি , তোমাদের দেখছি!
: সেটাই তো দেখছো কিছু বলছো না দেখেই মা অবাক হচ্ছে!
: টায়ার্ড বেশি , সারাদিন দুইটা জায়গায় দাওয়াত এটেন্ড করে এখন কোন এনার্জি পাচ্ছি না।
: আচ্ছা ঠিক আছে যাও তোমরা রেস্ট নাও , সাফিয়া বেগম বললেন!
: সেটাই মা ,আমি উঠছি বলে মাহি চলে গেল!
সাফিয়া বেগম ফিসফিস করে বললেন,
: রুবা কি হলো ওর ?
: বুঝতে পারছি না মা !
: যাও গিয়ে দেখো !
: ঠিক আছে ,আসি মা বলে রুবা উঠে গেল!
রুবা রুমে ঢুকে দেখে মাহি বারান্দায় দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে!
রুবা ওর কাছে এসে মাহির পিঠে হাত রাখলো ! পিছন ফিরে মাহি হাসি মুখে ওর দিকে তাকালো !
: কি হয়েছে তোমার ?
: সত্যি কিছু হয়নি ! টায়ার্ড লাগছে !
: বুঝলাম কিন্তু তুমি এর চেয়েও বেশি পরিশ্রম করে বাসায় এসে অনেক বেশি হাসিখুশি থাকো!
: মাহি রুবাকে রুমের ভিতরে নিয়ে এসে বারান্দার দরজা টা লাগিয়ে দিল , সেরকম কিছু না রুবা ! ঘুম পাচ্ছে !
: ঠিক আছে তাহলে শুয়ে পড়ো ফ্রেশআপ হও, চেন্জ করো!
: যাচ্ছি বলে মাহি চেন্জ করতে চলে গেল!
রুবা চিন্তায় পড়ে গেল ,আজ বৃষ্টিতে ভিজলো বলে শরীর খারাপ লাগছে না তো ? ও তো বলবেই না !
রুবা শাড়ি চেন্জ করে ঘরের ড্রেস পড়লো। মাহি বেশ কিছু সময় পর ঘরে ঢুকে সোজা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিল!
রুবা এখন শিওর মাহির শরীর খারাপ করেছে !
মাহির কপালে হাত দিয়ে বলল, তোমার কি জ্বর আসছে ?
: না রুবা আমি ঠিক আছি !
: তাহলে কি হয়েছে ?
: ঘুম পাচ্ছে ।
: সত্যি তো ?
: মাহি হেসে বলল সত্যি!
ঠিক আছে আমি এই মেকআপ ধুয়ে আসছি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো , রুবা উঠে গেল!
মাহি ফেসবুকে ঢুকলো , ঢুকে সে তাজ্জব অপার তার প্রোফাইল পুরো ঘেঁটে ফেলছে ! লাইক, কমেন্ট এর ছড়াছড়ি! মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চিন্তা করছে, নতুন যন্ত্রনা শুরু হয়েছে! মোবাইল পাশে রেখে সে রুবা র সুরাইয়া ম্যাম কে বলা কথা গুলো চিন্তা করছে। এই কথা গুলো শোনার পর থেকে তার ভেতরে ঝড় বইছে। রুবার খুব কাছে যেতে ইচ্ছে করছে ! কিন্তু যে দেয়াল রুবা অতিক্রম করেনি মাহি পারবে না কখনো আগ বাড়িয়ে সেখানে হানা দিতে! তাই তার খুব অস্বস্তি লাগছে।
রুবা ওর কাছ ঘেঁষে এসে শুয়েছে। মাহি চোখ বন্ধ করলো! ওর মাথায় হাত রেখে রুবা বলল,
: আমি তোমার মাথা ম্যাসাজ করে দেই?
: আচ্ছা দাও !
মাহি ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
: রুবা তোমার পাসপোর্ট টা কোথায়?
: পাসপোর্ট তো ঐ ঘরে !
: মায়ের ঘরে?
: না তোমার ভাইয়ার ঘরে!
: ও আচ্ছা!
: কেন লাগবে তোমার?
: হুঁ !
: এখন এনে দিব ?
: না থাক তোমাকে আনতে হবে না আমি নিয়ে নিচ্ছি! কালকে আমার দরকার আছে । সিঙ্গাপুর যাব, ভিসার কাজের জন্য লাগবে !
: আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে?
: তোমাকে রেখে যাব ভাবলে কিভাবে?
: না ভাবলাম আমার কি কাজ তাই আমি হয়তো যাচ্ছি না!
: তোমাকে একা রেখে মা ও থাকতে পারবে না !
: আর তুমি?
: আমি ও না , সারাক্ষণ মনে হবে আমার পাগল টা কি পাগলামি করছে ,বলে ই মাহি হো হো করে হেসে দিল!
: সব সময় আমার পিছনে লাগতেই হবে, তাই না ?
: হাসছে মাহি! আমি পাসপোর্ট নিয়ে আসছি কোন আলমারি তে বলো মাহি উঠে গেল।
: তোমার ভাইয়া র কাপড়ের আলমারির ড্রয়ারে!
: তুমি থাকো আমি নিয়ে আসছি বলে মাহি উঠে গেল!
মাহি শিহাবের রুমে ঢুকলো ! মা রেগুলার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে, তাই মনেই হয় না যে ঘর টাতে কেউ থাকে না! মাহির মনে হচ্ছে হয়তো ভাইয়া আছে এখানে কোথাও!
মাহি সোফা টা তে বসলো ! এখানে বসে কত গল্প করতো দুই ভাই! শিহাবের বিয়ের পর সে আসতো না রুমে ,রুবা থাকতো দেখে !
মাহি আলমারি খুলল, শিহাবের কাপড় , স্যুট, পাঞ্জাবি সব থরেথরে সাজানো। ঘড়ি , বেল্ট! পারফিউম! সব আছে শুধু ভাইয়া নেই। মাহির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
রুবা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো ,
: পাও নি ?
: মাহি চোখ মুছলো!
: আমি খুঁজে দিচ্ছি বলে রুবা ড্রয়ার খুলে বের করলো ওর পাসপোর্ট।
: একটা জিনিস দেখবে , রুবা বলল!
: কি ?
: এদিকে আসো বলে শিহাবের শার্ট গুলো কে দেখিয়ে রুবা বলল, তোমার ভাইয়ার গায়ে র ঘ্রাণ টা পাবে এসো।
: মাহিও রুবার মত শার্ট গুলো তে নাক ঘষলো! ওর বুকটা কাঁপছে । তারপর আলমারি টা লাগিয়ে রুবার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো রুম থেকে।
চলো আমার ঘুম পাচ্ছে রুবা !
: মনে মনে ভাবছে কি বলবে সে , রুবা আবার ইমোশনাল হয়ে যাবে আবার রাতভর কাঁদবে!
: রুবা চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। মাহি ও আলো নিভিয়ে দিল!
দুজনেই চুপ করে আছে।
মাহি রুবার মাথায় হাত রেখে বলল, ঘুমাও!
সকালে উঠেই এখন প্রতিদিন নিঝুম নিয়াজের গুড মর্নিং মেসেজ পায় !
ও গুড মর্নিং লিখে রিপ্লাই দেয়।
নিয়াজ প্রতিদিন কোন না কোন বাহানায় ফোন দেয়।
একদিন না দিলেই নিঝুমই অবাক হয় !
এর মধ্যে একদিন রিয়া আর নিঝুম সাজ্জাদ এর জন্য শপিং এ গেল কি মনে করে নিঝুম নিয়াজ কে কল দিল নিয়াজ যাবে কিনা সঙ্গে।
সত্যি সত্যি নিয়াজ ও এসে হাজির হলো।
রিয়া তো বলেই ফেলল,
: তুমি এত শান্ত লক্ষী টাইপ ছেলে কিভাবে হলে এই যুগে?
: নিয়াজ মনে হয় আপুর এই টাইপের কথায় লজ্জা ই পেয়ে গেল।
নিঝুম এনজয় করছে নিয়াজের কোম্পানি টা। খুব অন্যরকম একটা ছেলে। কথা বলে কম কিন্তু খুব বুঝে শুনে বলে। কলেজে থাকতে ওকে এভাবে নোটিশ করেনি।
অনেক ভালো একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। নিঝুম বুঝতেই পারছে না কিভাবে নিয়াজের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলল!
আসলেই কি জীবন কোন শূন্যস্থান রাখে না ?
কোন না কোন নামে শূন্যস্থান টা পূর্ণ করে ফেলে। কখনও প্রেমিক কখনো বন্ধু নামে।
রিয়ার বিয়ে এই সপ্তাহে ই নিঝুম খুব ব্যস্ত। এনগেজমেন্ট এর পর ছয় মাস পর বিয়ে হচ্ছে তাও কোন কাজ মনে হচ্ছে গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
মাহির গতকাল নাইট ডিউটি ছিল কিন্তু সকালেও আসেনি । খুব ব্যস্ত, মোবাইল এ চার্জ নেই বিকেলে আসবে ,বাসার ল্যান্ড ফোনে কল করে বলল। বুয়া ফোন ধরেছিল বুয়াকে বলল, মা আর রুবা কে বলে দিও বলে রেখে দিল।
সাফিয়া বেগম মনে মনে বললেন, মাহি তুমি আজকেই ব্যস্ত হয়ে গেলে আজ রুবার জীবনে একটা বিশেষ দিন।
( চলবে )