#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_10
আজ মাসের শেষ। হাতে টিউশনির টাকা পেয়ে বেশ খুশী তুরান । বাবা-মা আসার পর কয়েক দিন ধরে হাত একদম খালি ছিলো। চারটা টিউশনি করে পনেরো হাজার এর মত টাকা পায়। মাস শেষ হওয়ার সাথেই সাথেই সবাই টাকা দিয়ে দেয়। এই ব্যাপার টা তুরানের কাছে ভালো লাগে। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে মায়ের জন্য হাজার খানেক টাকার মধ্যে একটা শাড়ী কিনে তুরান। আর বাবার জন্য শার্ট। বাবা-মা বোধ হয় বেশী দিন থাকবে না। দুই-চার দিন পরেই গ্রামে চলে যাবে। তুরানের মায়ের শহরে মন টানে না একদম।ঠিক মত খোলা আকাশ দেখা যায় না,রাস্তায় যানবহনের জন্য হাঁটা যায় না। চারদিকে শুধু ইট পাথরে গড়া ভবন।
বাসার কাছে আসতেই রুপার কথা মনে পড়ে তুরানের। রুপার জন্য একটা আইসক্রীম নিলে মন্দ হয় না। মেয়েটার হয়ত মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়েছে। ওর আচরনে রাগ না করাই ভালো। রুপার পছন্দের দুইটা আইসক্রীম নিলো।
বাসায় ঢুকার সময়ই দেখা হয়ে গেলো রুপার সাথে। তুরানকে দেখেই কোন কারন ছাড়া হেসে দেয় রুপা।
-‘রুপা বেগম হাসছেন কেন?’
রুপার হাসি আরও বেড়ে যায়। হাসির শব্দ এত মনমুগ্ধকর হতে পারে?
-‘বেগম কি?’
তুরানও হেসে দেয়। বলে,
-‘এমনি বললাম আর কি । তোমার পুরো নামটা কি?’
-‘নাম আবার অর্ধেক হয় বুঝি?’
-‘এই ধরো মানুষের অনেক গুলো নাম থাকে। ডাক নাম,আসল নাম ইত্যাদি,ইত্যাদি।’
-‘তো আমার নাম কি নকল?’
এখন রুপা কে মোটেও অস্বাভাবিক মনে কত না। যেন সম্পূর্ন সুস্থ একজন মানুষ।
কথা বাড়ায় না তুরান। রুপা কে কিভাবে যে আইসক্রীম দিবে সেটা ভাবছে। আনইজি লাগছে ব্যাপার টা।
-‘কি হলো ভ্যাবলাকান্ত মশাই চুপ মেরে রইলেন কেন?’
রাগান্বিত কন্ঠে তুরান বলে,
-‘ওই ভ্যাবলাকান্ত মশাই কি?’
-‘আপনি কথায় কথায় রেগে যান কেন বলুন তো?সাইকোলজি বলে যদি কোন মানুষ সামান্য ব্যাপারে রেগে যায় তবে তাঁর ভালোবাসা প্রয়োজন।’
রুপার কথা শুনে চোখ কপালে উঠে যায় তুরানের । বিড়বিড়িয়ে বলে,
-‘সাইকোলজি শিখালো কে তোমায়? আচ্ছা তোমার রহস্য টা কি বলো তো? মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা,আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি সবজান্তা সমসের।’
ভাবুক কন্ঠে রুপা বলে,
-‘আমি কি তা তো আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।’
এই বলেই আবার হেসে দেয় রুপা। আবার বলে,
-‘কোন কিছু সম্পর্কে আমায় বেশী প্রশ্ন করবেন না। তাহলে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই যে জিজ্ঞেস করলেন সাইকোলজি কি? এখন তো আমি নিজেই সাইকোলজি ভুলে গেলাম।’
-‘রুপা সিরিয়াস একটা কথা বলি তুমি ব্রেনের ডাক্তার দেখাও।’
রুপার কথার তালে পরে সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তুরান । সেই কখন আসছে এখনও বাসায় যায় নি। বাবা-মা যদি দেখে এখানে এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে তাহলে আবার শুরু হবে।
তুরান রুপার হাতে আইসক্রীম দিয়ে বলে,
-‘এই তোমার আইসক্রীম ।’
খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে রুপা। সামান্য আইসক্রীম পেয়ে কেউ এত খুশি হয়?
আনন্দে উৎকন্ঠিত হয়ে রুপা বলে,
-‘আপনার হাতে ওগুলো কি?’
-‘মায়ের জন্য শাড়ি এনেছি,আর বাবার শার্ট।’
উঁকি মেরে শাড়িটা দেখে রুপা বলে,
-‘বাহ্! এত সুন্দর। এই আমায় একটা কালো শাড়ী এনে দিবেন?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তুরান। কি আজব আবদার করে এগুলো? রুপার প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে তুরান তা শুনার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে রুপা।
রুপা কে একবার যদি বলে শাড়ী এনে দিবে ,তা এনে দিতে হবেই।
-‘তুমি তোমার আম্মুকে বলো শাড়ী এনে দিতে।’
মুখ ফ্যাকাশে করে মাথা নিচু করে ফেলে রুপা। ওড়ানা দিয়ে আইসক্রীম লুকিয়ে রুমে চলে যায় রুপা। সাহেলা বেগম দেখলে বকবে রুপাকে। আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে ঢুকে আইসক্রীম খেয়ে বের হলো রুপা।
সাহেলা বেগম অনেকক্ষন ধরে রুপার রুমে বসে রইল । প্রায় আধা ঘন্টা পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো রুপা।
-‘এতক্ষন ওয়াশরুমে কি করছিলে?’
থতমত খেয়ে রুপা বলে ,
-‘হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়েছি।’
-‘মিথ্যা বলা খারাপ। তোমার হাত মুখ তো ভেজা না । কি করছিলে ওয়াশরুমে?’
-‘হাত মুখ তো অনেক আগে ধুয়েছি। ভালো লাগছিলো না তাই ওয়াশরুমে বসে ছিলাম।’
-‘ওয়াশরুম বসে থাকার জায়গা? দুপুরে ওষুধ খেয়েছো? তোমার আম্মু আসছে কালকে। যদি তাঁদের দেখে কোন পাগলামী করো তাহলে খারাপ হবে।’
মুখ গম্ভীর করে রুপা বলে,
-‘খেয়েছি ওষুধ। কচুর আম্মু। বিরক্তকর মানুষজন।’
রাগান্বিত কন্ঠে সাহেলা বেগম বলে,
-‘মাকে কেউ এসব বলে?’
হাতের একটা কালো দাগ সাহেলা বেগম কে দেখিয়ে রুপা বলে,
-‘দেখো আমায় কিভাবে মেরেছে উনারা।’
-‘পাগলামী করলে সবাই ই মারে।’
-‘কই তুমি তো মারো না?’
-‘আমার দায়িত্ব তোমাকে মারা না। তোমাকে বুঝানো।’
সাহেলা বেগম রুম থেকে চলে যাবার পর উদাস মনে জানালা গ্রিলে ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইল রুপা। মেজাজ চটে আছে রুপার।
গাল বেয়ে নোনা জল পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো রুপা ।
.
ছাদে আজিজ চৌধুরী কে দেখে ,না দেখার ভান করে চলে আসলো তুরান। বাসায় ছেড়ে যাবে বলে আজিজ চৌধুরীর কাছে গিয়েছিলো। রুপার অনুরোধে আর বাসা ছাড়া হয় নি। সেই থেকে আর আজিজ চৌধুরীর সামনে পরে না তুরান। যদি আজিজ চৌধুরী সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে?
ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ছাদে আসে রুপা। তুরান কে দেখেও না দেখার ভান করে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে।
রুপার এমন ব্যবহারে অবাক হয়ে যাচ্ছে তুরান । জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিষয়টা তুরানকে ভাবাচ্ছে । রুপাকে এমন চুপ-চাপ কখনো দেখে নি।
তুরান রুপার করছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-‘কি ব্যাপার মন খারাপ কেন?’
কোন জবাব দেয় না রুপা। শাড়ী এনে দিবে না বলেছে বলে কি রুপার মন খারাপ?
-‘রুপা কি হলো?’
ক্ষীন স্বরে রুপা বলে,
-‘এমনি।’
-‘এমনি কারো মন খারাপ হয়? সত্যি করে বলো ।’
রুপার চোখ ছলছল করে উঠে।
আবার বলে,
-‘এমনি।’
-‘শাড়ী এনে দিবো না বলে মন খারাপ?’
রুপা মাথা ঝেঁকে বলে,
-‘না।’
অনেকক্ষন ধরে মন খারাপের কারন খুঁজে যাচ্ছে তুরান। রুপা তেমন কিছুই বলছে না। চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ গুলো হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে বিষয়টা সবাইকেই ভাবায়।
-‘রুপা আম্মু তোমায় যেতে বলেছে।’
এবার হেসে দেয় রুপা।
-‘চলুন তাহলে।’
-‘তোমায় যেতে বলেছে আমায় না।’
রুপা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তুরান । মেয়েটার মুড হয়ত কোন কারন ছাড়াই চেঞ্জ হয়। মা ওকে সত্যিই যেতে বলেছে। রুপার সাথে তুরান কে দেখলে বাবা-মা খোঁচা মারতে ছাড়বো না। তাই যায় নি তুরান।
একটু পরে বাসায় যায় তুরান। কলিং বেল বাজাতেই রুপা দরজা খুলে দেয়।
মায়ের জন্য আনা শাড়ীটা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। তুরান অবাক দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে…