#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_11
রুপা কে দেখে খানিকক্ষনের জন্য দৃষ্টি আটকে গেলো তুরানের । বিশেষ করে রুপার চুল গুলো । একদম নজড় কাড়া। থুতনিতে কুচ কালো তিলটা সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে সাজানো গুছানো পুতুল যেন।
এভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকা বিষয়টা অস্বস্তিকর। কিন্তু রুপার ক্ষেত্রে মোটেও তা না। তুরানের তাকিয়ে আছে আর ও মিটিমিটিয়ে হাসছে।
এ পর্যায়ে উচ্চস্বরে হেসে দিলো রুপা। তুরানের নাক টেনে বলে,
-‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমায় সুন্দর লাগছে বুঝি?’
থতমত খেয়ে যায় তুরান। বাসার ভেতর থেকে তুরানের মা চেঁচিয়ে বলে,
-‘রুপা কলিং বেল বাজালো কে? কে আসছে?’
তুরানের মায়ের দিকে চোখ বড় করে তাকালো তুরানের বাবা ।
-‘গলা নাকি সাউন্ড বক্স? মেয়ে মানুষ কথা বলবা নরম সুরে ছোট ছোট করে। যাতে কথার স্বর ঘরের বাইরে না যায়। তোমার কথার শব্দে বিল্ডিং কাঁপছে।’
কিঞ্চিৎ লজ্জা পায় তুরানের মা। গলা নিচু করে বলে,
-‘আস্তে ডাকলে কি রুপা শুনতো?’
-‘রুপা কে এখান থেকে মাইক বাজিয়ে ডাকতে হবে কেন? রুপার কাছে যেতে পারো না।’
কথা বাড়ায় না তুরানের মা। স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করার স্বভাব যে একদম নেই তাঁর।
রুমের ভিতর ঢুকে তুরান। আড় চোখে রুপার দিকে তাকাচ্ছে।
-‘দেখলেন তো শাড়ী পড়লে আমায় কত সুন্দর লাগে? এজন্যই তো বলেছি আমায় একটা কালো শাড়ি এনে দিতে। আমিও কালো শাড়িও কালো। ম্যাচিং হবে ভালোই।’
খিলখিলিয়ে হেসে দেয় রুপা। তুরানও না হেসে পারে না।
-‘কে বলেছে তুমি কালো? তোমার গায়ের রংটা শ্যামলা। কবি,সাহিত্যিক রা মাঝে মাঝে শখের বশে শ্যামলা ,টানা টানা চোখের মেয়েদের নিয়ে সাহিত্য রচনা করত না? তুমি সেই সাহিত্য থেকে উঠে আসা রমনী। তুমি জানো…..’
তুরানের কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দেয় রুপা।
-‘উফ! থামেন থামেন। কি সব বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
হতাশ হয়ে তুরান বলে,
-‘এই কথা তোমায় না বলে যদি কোন বুঝবান মেয়ে কে বলতাম খুশিতে গদগদ হয়ে বাঁকা হেসে আমায় ধন্যবাদ দিতো।’
একটু চুপ থেকে রুপা বলে,
-‘আপনি কি জানেন আপনি ইদানিং বেশী কথা বলেন। সেই গম্ভীর গম্ভীর গোবর গনেশ ভাবটা আর নেই।’
চুপ মেরে যায় তুরান । আসলেই কি বাচাল হয়ে যাচ্ছে?
ভাবনার এই পর্যায়ে রেগে যায় তুরান।
-‘এই কি বললে তুমি আমি গোবর গনেশ? গোবর গনেশ হলে কি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারতাম?’
প্রত্তুত্যরে কিছু না বলে হেসে দেয় রুপা। বিড়বিড়িয়ে তুরান বলে,
-‘পেত্নী একটা ।’
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে রুপা। ক্রোধের সাথে বলে,
-‘নিজেকে কি শ্রীমান কার্তিক ভাবেন?’
মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে চুপ হয়ে যায় তুরান।
-‘কি হলো তুই রুপাকে ক্ষ্যাপাচ্ছিস কেন?’
গাল ফুলিয়ে রুপা বলে,
-‘পচা ছেলে যে আপনার। আদব-কায়দার রেশ মাত্র নেই।’
রুপার মুখের ভঙ্গি দেখে না হেসে পারে না তুরান । গেটের সামনে গাড়ির শব্দ পেয়ে অস্থির হয়ে উঠে রুপা ।
-‘আম্মু আসছে বোধ হয়। আমায় রুমে গিয়ে ঘুমের ভান করতে হবে। নয়ত খারাপ হবে।’
সাহেলা বেগম আসলেই রুমে গিয়ে চুপ মেরে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে রুপা। অথচ সারাটা দিন ওর বাসায় এর বাসায়,ছাদে কাটিয়ে দেয়।
তুরানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘আরে আপনি এখান থেকে যাচ্ছেন না কেন? শুনতে পাচ্ছেন না আমি বাসায় যাবো?’
-‘তুমি বাসায় যাবে তো আমি এখান থেকে যাবো কেন?’
তাড়াহুড়া করে রুপা বলে,
-‘আমি কি বাসায় শাড়ী পরে যাবো? শাড়ী কি এখন আপনার সামনে চেঞ্জ করব?’
যথারীতি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো তুরান। মায়ের সামনে কি সব বলল মেয়েটা! আক্কেল নেই। নন সেন্স! তুরান এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে সোজা চলে গেলো।
দ্রুত শাড়ী চেঞ্জ করে বাসায় গিয়ে ঘুমের ভান করে পরে রইল রুপা।
রুপার এমন পাগলামী দেখে না হেসে পারে না তুরানের মা।
-‘মেয়েটা খুব মিষ্টি তাই না? কত বড় চুল! কথা গুলো বেশ লাগে।’
বিরক্তি নিয়ে তুরান বলে,
-‘আমি কি খেয়ে দেখেছি মিষ্টি না টক?’
-‘এভাবে কথা বলছিস কেন? রুপা যদি স্বাভাবিক হত তোর বউ করে নিতাম।’
থ হয়ে যায় তুরান। তুরানের বাবা হেসে বলে,
-‘রতনে রতন চিনে।’
ভ্রু কুঁচকে তুরানের মা বলে,
-‘মানে?’
-‘মানে আবার কি? তুমিও যেমন,রুপাও তেমন । তাইতো তোমার পছন্দ হয়েছে।’
মুখ ভার করে ফেলে তুরানের মা। তুরানের বাবা আবার বলে,
-‘আরে এই অস্বাভাবিক মেয়েও কি তোমার ছেলের কাছে দিবে? আজিজ চৌধুরীর টাকার শেষ নেই।’
মুখ বাঁকিয়ে তুরানের মা বলে,
-‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে আমার। মেয়ের লাইন পরবে দেখো।’
গর্জে উঠে তুরান ।
-‘আরে থামো তোমরা। কি সব নিয়ে আলোচনা করছো? পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি?’
চুপ হয়ে যায় তুরানের বাবা-মা । একটু পরে তুরান আবার বলে,
-‘আজিজ চৌধুরীর মেয়ে না রুপা।’
আগ্রহী কন্ঠে তুরানের মা বলে,
-‘তো?’
-‘সাহেলা আন্টির বোনের মেয়ে।’
-‘উনাদের মা-বাবা ডাকে যে?’
-‘জানি না আমি এতসব। হয়ত উনি নিঃসন্তান তাই রুপারে উনার কাছে রাখে?’
বিস্ময়ের সাথে তুরানের মা বলে,
-‘আজিজ চৌধুরীর ছেলে-মেয়ে নেই?’
-‘না।’
এতক্ষন চুপ হয়ে মা-ছেলের কথা শুনেছিলো তুরানের বাবা।
এ পর্যায়ে সে বলে,
-‘আচ্ছা রুপা কি লেখাপড়া করে না?’
তুরান চিন্তিত হয়ে বলে,
-‘তা তো জানি না।’
রাতে খাবার শেষে শুয়ে পরে তুরান।সেই বিকালে রুপা বাসায় চলে যায়,আর দেখা হয় নি। চোখ বুঁজে রুপার পাগলামী গুলোর কথা ভেবে হাসছে তুরান। মেয়েটা কে নিয়ে ভাবতে না চাইলে কেন জানি ভাবায় খুব।
কালকেই রুপার বিষয়টা জানতে হবে। ওর প্রবলেম কি? ওর জীবন সম্পর্কে জানতে হবে । সময়ের সাথে সাথে রুপাকে নিয়ে জানার আগ্রহ টাও বাড়ছে তুরানের। বার বার চোখে ভেসে আসছে শাড়ী পড়া পুতুল রুপা টা কে। রুপার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানার আগ্রহটাও বাড়ছে।
এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় তুরান।
তুরানের বাবা-মা আজ চলে যাবে। মনটা খারাপ লাগছে তুরানের।
-‘আর কয়টা দিন থাকা যায় না?’
-‘আর কয়টা দিন কিভাবে থাকবো বল? ওদের বাসায় রেখে আসছি তোর দাদির কাছে । মেয়ে তিন টাকে নিয়ে সব সময় চিন্তা হয়।’
শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে তুরান বলে,
-‘আমি আজ ভার্সিটি তে যাবো না,টিউশনেও না। এখন একটু বাইরে বের হবো। ওঁদের জন্য কিছু কেনা কাটা করবো।’
উদগ্রীব হয়ে তুরানের মা বলে,
-‘না,না ওঁদের জন্য কিছু কেনার দরকার নেই। ওঁদের যা লাগে তা তো তোর বাবাই দেয় ।’
-‘বাবার দেওয়া আর আমার দেওয়া এক হলো মা?’
বাসা থেকে বেরিয়ে পরে তুরান। তুরান কে দেখেই ডাক দেয় রুপা।
-‘আজকে ভার্সিটি তে যাবেন না?’ বই টই কিছু নেন নি যে।’
-‘না,না আজ বাইরে বের হবো একটু কেনাকাটা করবো।’
-‘কার জন্য কেনাকাটা করবেন?’
-‘আমার বোন দের জন্য ।’
-‘আমায় নিবেন? আম্মু বাসায় নেই। বাসা থেকে বের হই না অনেক দিন হলো।’
অনিচ্ছুক ভাব প্রকাশ করলো তুরান।
জোড় গলায় অনুরোধ করে রুপা বলে,
-‘আপনার সাথে গেলে কি হবে? প্রমিস কিছু চাইবো।’
রুপার অনুরোধে আর না করতে পারে না তুরান। তুরান হ্যাঁ বলার সাথেই সাথেই দুই মিনিটে জটপট রেডী হয়ে আসলো রুপা।
-‘তোমার আম্মু কিছু বলবে না আমার সাথে গেলে।’
ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি টেনে রুপা বলে,
-‘আম্মু জানলে তো।’
রিক্সা ডাকলো তুরান । রুপার রিক্সাওয়ালা পছন্দ হচ্ছে না। মহা বিপদে পরলো তুরান।
-‘আচ্ছা তোমার কেমন রিক্সাওয়ালা চাই বলো তো?’
-‘আপনার মত নাদুস নুদুস।’
-‘ফাজলামি পেয়েছো? আমার মত রিক্সাওয়ালা কোথায় পাবে তুমি? যাও তুমি বাসায় যাও তোমার যেতে হবে না।’
বাসায় যাওয়ার কথা শুনে চুপ হয়ে যায় রুপা। মনে মনে হাসছে তুরান। পাগলামী টা বন্ধ হলো অন্তত।
সংকীর্ন রিক্সার সিট। রুপা তুরানের গা ঘেঁষেই বসে আছে।বোধ হয় ওর ভিতর কোন সংকোচ নেই। তুরান যত জড়োসড়ো হয়ে বসছে রুপা তত তুরানের দিকে আগাচ্ছে।
আর একটু হলে রিক্সা থেকে পরে যাবে।
-‘তুমি কি আমায় রিক্সা থেকে ফালানোর ফন্দি করছো?’
হেসে দেয় রুপা। মাথা ঝেঁকে বলে,
-‘হুম।’
রেগে যায় তুরান। রুপা এবার ঠিক হয়ে বসে। তুরান এবার সিরিয়াস হয়ে বলে,
-‘তোমার বাসায় কে কে আছে? তোমার বাবা কি করে? তোমার সম্পর্কে কিছু বলো। লেখাপড়া করো নি কেন?’
মুহূর্তের হাস্যজ্জ্বল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার ।
-‘কি হলো কিছু বলছো না কেন?’
-‘জানি,না আমি কিছু জানি না। এসব নিয়ে আমায় কিছু বললে রিক্সা থেকে ঝাঁপ দিবো।’
আর কথা বাড়ায় না তুরান । উদাস ভঙ্গিতে গম্ভীর হয়ে বসে রইল রুপা। রিক্সার ঝাঁকুনি তে চুলে খোঁপা খুলে গেলো। লম্বা চুল। রিক্সার চাক্কার সাথে পেঁচানোর আশঙ্ক্ষা রয়েছে।
ওদিকে খেয়াল নেই রুপার। চুল গুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
-‘আচ্ছা ওসব আর জিজ্ঞেস করবো না । চুল বাধোঁ।’
-‘না।’
-‘কি না? চুল বাধোঁ। চুল পেঁচাবে নয়ত।’
জেদ ধরে বসে থাকে রুপা। রুপার এনে চুল গুলো বার বার তুরানের মুখের উপর পরছে। চুলের ঘ্রান এত সুন্দর কেন? রুপার চুল গুলো খোলা থাকলে মন্দ হয় না।
চলবে…