যদি তুমি জানতে’পর্ব-১৩

0
770

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_13
জানালার কপাট গুলো আস্তে আস্তে ফাঁক করে রুমের দিকে উঁকি দেয় তুরান। শরীর কাঁপছে তুরানে। এভাবে উঁকিঝুকি দেওয়ার অভ্যাস কোন জনমেই ছিলো না। একে তো আজ রুপা ওর জন্য মার খেলো। কেউ যদি আবার এখন দেখে তাহলে খারাপ হবে। এত রিস্কের মাঝেও কৌতূহলি মনকে দমাতে পারছে না তুরান। জানালার পর্দা সরালেই রুমের ভিতরে রুপা আছে নাকি দেখা যাবে। তুরান তাই করলো। খাটের উপর বালিশ হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে রুপা। রুপার চুলের দিকে তাকালেই তুরানের মন খারাপ হয়। রুপার মুখ জুড়ে বিষন্নতা। চুল গুলো উস্কখুস্ক। চোখ ফুলে রয়েছে। মায়া হচ্ছে বড্ড তুরানের। একা একা বসে বসে ফুঁসছে রুপা। রুপার হাতে ব্লেডের কাটা দাগের অভাব নেই। কি বাজে অভ্যাস মেয়েটার! কিছু হলেই হাত-পা কাটে। ইভেন চুল গুলো কেটে ফেললো। কবে যে নিজের গলা কেটে ফেলে কে জানে! এটাও ওর কাছে অসম্ভব কিছুই না।
তুরান চাপা কন্ঠে ডাক দিলো,
-‘রুপা।’
ধ্যানে বসেছে বুঝি রুপা। ডাকছে সেদিকেও খেয়াল নেই। তুরান আগের বারের তুলনায় একটু জোরে বলে,
-‘রুপা।’
কোন দিকে খেয়াল নেই তাঁর । হলো টা কি? এই মেয়ে কে যাদুঘরে রেখে আসলেও মন্দ হয় না।
তুরান পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাগজের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো রুপার দিকে । কাগজের টুকরো টা রুপার মাথায় উপর পরলো। এবার রুপা আশেপাশে তাকালো। এক পর্যায়ে জানালার কাছে তুরান কে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে দিলো তুরান। রুপা দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে তুরানের কাছে গেলো । আচমকা জড়িয়ে ধরলো তুরানকে। কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,
-‘উনারা কত মেরেছে আমায়। আপনার জন্য ওয়েট করতে ছিলাম,কোথা থেকে উনারা এসে আমায় গুলো বাসায় নিয়ে আসলো।’
কেঁদে ফেলে রুপা। এই মেয়েটা হয়ত বেখেয়ালি মনে তুরান কে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু তুরানের পুরো শরীর জুড়ে শীতল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে । অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে । এর আগেও তো রুপা একদিন জড়িয়ে ধরেছিলো তুরান কে,তখন তো এমন অনুভূতি হয় নি। রুপা এত শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে ছাড়ানোরও উপায় নেই। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেই চলেছে। মনের মাঝে শান্তি অনুভব করছে তুরান,কাঙ্ক্ষিত অনুভূতি হচ্ছে । থাক না রুপা এভাবে জড়িয়ে ধরে,কি হবে এমন? আবেশ জড়ানো কন্ঠে তুরান বলে,
-‘কেঁদো না পাগলী। সরি আমার জন্য মার খেতে হলো । মাফ করে দেও আমায়।’
তুরানের বুক থেকে মুখ তুলে রুপা বলে,
-‘আপনার কি দোষ? আমিই তো আপনার সাথে যেতে চেয়েছি। কি এমন হয়েছে যে তাতে আমায় মারতে হবে?’
রুপার চোখের পানি স্ব-যত্নে মুছিয়ে দিলো তুরান ।
-‘মা-বাবা সন্তান কে মারতেই পারে । তুমি চুল গুলো কাটলে কেন? তোমার চুল গুলো কত সুন্দর ছিলো সে তুমি জানো?’
গাল ফুলিয়ে রুপা বলে,
-‘কই একদিনও তো বলেন নি আমার চুল সুন্দর ।’
হেসে দেয় তুরান। মানুষ আসতে পারে। এভাবে দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে তুরান। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুপা।
-‘আপনার বুকে অনেক শান্তি। ছাড়বো না।’
রুপার বলা কথা গুলো তীরের মত আঘাত করে তুরানের বুকে । প্রেমের তীর যেন।
-‘তোমার জন্য কালো শাড়ী এনেছি।’
বিস্ময়ের মুখ হাঁ করে ফেলে রুপা।
-‘ এভাবে মুখ হাঁ করো না ডেঙ্গু মশা ঢুকবে মুখে।’
তুরান কে ছেড়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠে রুপা। খুশিতে আটখানা দিয়ে গিয়েছে রুপা। রুপার এই আনন্দিত মুখটাই দেখতে চেয়েছিলো তুরান । উৎকন্ঠিত হয়ে রুপা বলে,
-‘কোথায় শাড়ী? কখন কিনলেন?’
-‘তোমায় ওখানে ওয়েট করতে বলে শাড়ী কিনতে গিয়েছিলাম।’
তর সইছে না রুপার।
-‘দেন,শাড়ী দেন তাড়াতাড়ি।’
-‘শাড়ী তো রুমে ,তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।’
রুপাও তুরানের পিছনে পিছনে রুমে গেলো। শাড়ী পেয়ে রুপার খুশি আর দেখে কে! হঠাৎ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার।
-‘কি হয়েছে মুখটা হুতুম পেঁচার মত হয়ে গেলো কেন?’
-‘আংকেল-আন্টি চলে গিয়েছে?’
-‘তোমার বাসায় তো তখন হরতাল চলে তাই বলে যেতে পারে নি। আম্মু তোমার চুল গুলোর জন্য রাগ করেছে খুব।’
মাথা নিচু করে ফেলে রুপা।
-‘আমি কি ইচ্ছা করে চুল কেটেছি। রাগ হলে তো সব ভুলে যাই।’
তুরান রুপার একটু কাছে গিয়ে বলে,
-‘শাড়ী পছন্দ হয়েছে তো রাগিনী?’
-‘খুব।’
-‘আর কখনো চুল কাটবে না,হাত,পা কাটবে না।’
ঘাড় বাঁকিয়ে রুপা বলে,
-‘আচ্ছা ।’
একটু পরে রুপা আবার বলে,
-‘শাড়ী পড়িয়ে দিবেন? শাড়ী পড়তে পারি না তো আমি।’
রুপার কথা শুনে জিহ্বায় কামড় দেয় রুপার। কি ব্রেকলেস কথা বলে? তুরান রুপাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলে,
-‘না, না আমি ও পারি না। তুমি এখন বাসায় চলে যাও। আমার রুমে তোমায় কেউ দেখলে বাজে ভাব্বে।’
-‘আপনি শাড়ী এনে দিয়েছেন আপনায় পড়ে দেখাবো না?’
-‘এখন পড়ে দেখাতে হবে না। তুমি সাহেলা আন্টির কাছ থেকে শিখে নিও। আর রাতে সবাই ঘুমানোর পর শাড়ী পড়ে ছাদে এসো সেদিনের মত গল্প করবো ।’
বিস্ময়ের সুরে রুপা বলে,
-‘সত্যি!’
-‘হ্যাঁ।’
খানিকক্ষন কি যেন ভেবে রুপা বলে,
-‘আন্টির কাছে শাড়ী পড়া শিখবো? আন্টি যদি জিজ্ঞেস করে শাড়ী কোথায় পেয়েছি? আমার পা ভেঙে রুমে বসিয়ে রাখবে।’
চোখ কপালে উঠে গেল তুরানের।
-‘তাই তো। মাথায় ছিলো না একদম। তুমি যেভাবে পারো পেঁচিয়ে পড়ো। ভুলেও সাহেলা আন্টির কাছে যেয়ো না। শাড়ীর কথা সে যেন না জানে।’
.
সন্ধ্যা বেলায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আফজাল সাহেব। হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে রুমে আসলো সাহেলা বেগম। বেলের শরবত আজিজ চৌধুরীর পছন্দের।
আড়মোড়া হয়ে উঠে বসলো আজিজ চৌধুরী । শরবত খেয়ে গ্লাস টা বেড সাইডে রাখলো।
-‘আজকে রুপার বাবা-মা কি কান্ডটা করলো? রুপার যে মেন্টালিটি অবস্থা । ও প্রেম ভালোবাসার কি বুঝে বলো?ও যা করে খামখেয়ালির বশে করে।’
রুপার বাবা-মা কে নিয়ে আজিজ চৌধুরীর কাছে বড় গলা করার উপায় নেই সাহেলা বেগমের। ঠান্ডা গলায় বলে,
-‘সবার জ্ঞান তো এক না। আমরা নিঃসন্তান তাই রুপার প্রতি আমাদের ভালোবাসা টা বেশী, আমরা অন্যায়টাকেও পজেটিভ সেন্সে দেখি। কারন সন্তানের মোহে আমরা অন্ধ।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আজিজ চৌধুরীর ।
-‘তোমার লজিকাল কথা-বার্তা শুনে না হেসে পারি না। আর একটা কথা কি জানো?’
কৌতূহলি চোখে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সাহেলা বেগম বলে,
-‘কি?’
-‘পর কখনো আপন হয় না। যতই তুমি বোন বোন ডাকো বান্ধবী কখনো বোন হয় না । তোমার বোনের মেয়েকে তুমি জোর খাটিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবে,রুপা কে যদি কিছু বলো তাহলে ওর বাবা-মা বাজে রিয়েক্ট করবে ।’
মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় সাহেলা বেগমের,
-‘বাদ দেও ওসব।’
-‘ওটা ওঁদের ধর্মের দোষ ।’
চোখ লাল করে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকায় সাহেলা বেগম,
-‘ফালতু কথা না বললে হয় না তোমার?’
আবার হেসে দেয় আজিজ চৌধুরী।
-‘নিজেদের সুবিধার জন্য রুপাকে তোমার কাছে রেখেছে। রুপা সুস্থ হলে তোমার আর খোঁজ নিবে না। এই যে দেখো ভাইদের আমি কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখালাম,চাকুরী পেয়ে এক এক জন আমার প্রতি বিমুখ। একবার লসে পড়েছিলাম আত্মীয়-স্বজনের ভাবটা দেখছো তখন? পৃথিবী টা বড়ই স্বার্থপর সাহেলা ।’
আজিজ চৌধুরীর কথা গুলো তিক্ত মনে হচ্ছে সাহেলা বেগমের কাছে। কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরলো।
বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজে আছে তুরান। পড়ায় মন বসছে না। কখন রুপা ছাদে আসবে মন সেদিকে। এমন ছটফট ভাব কখনো হয়নি তুরানের । আজ হচ্ছে ।
হঠাৎ চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তুরান। রুপার সম্পর্কে কিছুই জানে না। ও কি লেখাপড়া করে? ওর অতীত? ওর ফ্যামিলি?
এভাবে হুট করে মায়ায় জড়িয়ে গেলো। মায়া তো আর বলে আসে না। জেনে জড়ানোর টাইম কোথায়?
হঠাৎ টোকা পড়লো তুরানের দরজায়। রুপা এসেছে? দরজা খুলে দেয় তুরান।
সামনে একটা পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গেলো তুরান। লম্বা চুলে রুপা কে যেমন সুন্দর লাগতো,ছোট চুলেও তেমন সুন্দর লাগছে। শাড়ীটা কোন রকম পেঁচিয়ে পরা। গুছিয়ে পরলে হয়ত এত সুন্দর লাগতো না। পছন্দের মানুষটা সব অবস্থা তেই সুন্দর, তাই বোধ হয় এমন হচ্ছে ।
বিস্ময় কাটিয়ে তুরান বলে,
-‘ছাদে যাবে না?’
মুচকি হেসে দেয় রুপা।
-‘যাবো তো।’
দুইজন পা বাড়ায় ছাদের দিকে । রুপা তুরানের হাত ধরে হাঁটছে।
-‘আপনায় আমার খুব ভালোলাগে।’
রুপার কথার উত্তরে কি বলা উচিত জানে না তুরান। একটু চুপ থেকে তুরান বলে,
-‘সাহেলা আন্টি ঘুমিয়েছে তো?’
-‘হ্যাঁ ঘুমিয়েছে তো। আপনি সাহেলা আন্টি কে এত ভয় পান কেন বলেন তো?’
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here