#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব(14+15)
আকাশ জুড়ে অন্ধকার। পূর্নিমা রাত হলে কি ক্ষতি হতো? অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠা রিস্ক। আর রুপা শাড়ী পড়ে ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না। যেকোন মুহূর্তে পরে যেতে পারে। ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করলো তুরান। ছাদে শো শো বাতাস। রুপার চুল গুলো বার বার উড়ে এসে মুখে পরছে। তুরান হেসে বলে,
-‘চুল গুলো এভাবে না কেটে একদম ছেলেদের মত করে কাটলেই তো পারতে।’
-‘কাটবো ছেলেদের মত করে?’
-‘তুমি যদি আর কখনো চুল কাটো আমি তোমার সাথে কথাই বলবো না।’
রুপা হেসে বলে,
-‘আচ্ছা কাটবো না।’
এ পর্যায়ে মুখ ভার করে রুপা বলে,
-‘শাড়ীতে আমায় কেমন লাগে তা তো বললেন না?’
তুরান দুষ্টুমির ছলে গান ধরে বলে,
-‘সব কথা বলে না হৃদয় ,কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।’
হো হো করে হেসে উঠে রুপা।
-‘এই কন্ঠে গান করেন না,লোক জন মনে করবে ছাদে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে ।’
-‘এই তুমি কি মনে করেছো আমি গান করতে পারি না? আমার কন্ঠে অত খারাপ না। অনেক পুরষ্কার পেয়েছি গান করে।’
-‘আপনি তো ঠিক ভাবে কথাই বলতে পারেন না আবার গান!’
হেসে দেয় তুরান।
-‘আমাকে ক্ষ্যাপাতে চাচ্ছো তাই না? অত সোজা নয়। আর আমি তোমার মত অপ্রয়োজনে কথা বলি না।’
কিছুক্ষন চুপ থেকে রুপা বলে,
-‘আচ্ছা আমায় ছাদে আসতে বললেন কেন ?’
থতমথ খেয়ে যায় তুরান। এই প্রশ্নের ফেস করার জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিলো না। এর যুক্তিসংগত কোন উত্তর নেই। রুপার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে তাই আসতে বলেছে। তুরান কে নিরুত্তর দেখে রুপা বলে,
-‘কি হলো চুপ মেরে গেলেন কেন?’
-‘তুমি আমায় ওই দিন রাতে ঘুম থেকে তুলে ছাদে নিয়ে আসলে কেন?’
-‘আমার তো মাথায় সমস্যা তাই যা ইচ্ছা করি। আপনারও কি মাথায় সমস্যা আছে?’
তুরান একটু রেগে বলে,
-‘আচ্ছা তোমার ভালো না লাগলে ছাদ থেকে চলে যাও।’
-‘মেয়ে মানুষের মত কথায় কথায় রাগ করবেন না তো। আমার তো আপনার সাথে থাকতে ভালোই লাগে।যাবো কেন ছাদ থেকে?’
-‘তো এত কথা বলো কেন?’
-‘কবেই কম কথা বলেছি?’
হতাশ হয়ে যায় তুরান । মেয়ে মানুষের সাথে তর্ক করে পারা এত কি সহজ? মুচকি হাসে তুরান। রুপা আজ বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। তুরান কিছুক্ষন রুপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-‘তোমার বাবা-মা কি ছোট বেলা থেকে তোমায় এমন মারে?’
বরাবরের মত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। রুপা বোধ হয় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক না।
-‘এসব কথা না বললে হয় না?’
-‘রুপা আমি তো তোমার বন্ধুর মত। আমার কাছে এসব বললে সমস্যা কি?’
-‘বন্ধুকে তো মানুষ তুই করে বলে। আমি কি আপনায় তুই করে বলি না তাই সমস্যা ।’
কেমন বাচ্চা দের মত লজিক দেখালো রুপা। মনে মনে হাসছে তুরান । রুপার ফুরফুরে মুডটা নষ্ট না করাই ভালো।
-‘আচ্ছা সরি এসব জিজ্ঞেস করবো না আর। তবে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
-‘কি?’
-‘তোমার লেখাপড়া? ফ্যামিলি? অতীত?’
চোখ ছলছল করে উঠলো রুপার। চাপা কন্ঠে বলে,
-‘ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা তো একই হলো। আচ্ছা এসব বিষয় জানা কি খুব জরুরী? আমি একটা মানুষ সে হিসাবে কি আমার সাথে কথা বলা যায় না? ধরে নেন আমার লেখাপড়া, ফ্যামিলি, অতীত কিছু নেই।’
খুব সিরিয়াস ভাবে কথা গুলো বলছে রুপা। এর আগে কখনো এভাবে কথা বলে নি রুপা। তুরান বুঝতে পারছে না রুপার সমস্যা কোথায়? হয়ত এটা রুপার দুর্বল পয়েন্ট। রুপা এটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু কেন এমন টা?
রুপা আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। দুই হাতে মাথা চেপে রেখেছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পরছে।
ভাবনার জগৎএ ছিলো তুরান । এতক্ষন রুপার দিকে খেয়াল করে নি। রুপাকে এমন অবস্থায় দেখে আতকে উঠে তুরান ।
-‘রুপা এমন করছো কেন? সরি আর কখনো জিজ্ঞেস করবো না। আমি ভয় পাচ্ছি কিন্তু। রুপা স্বাভাবিক হও। কি হয়েছে মাথা ব্যাথা করে?’
এক নাগাড়ে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তুরান । রুপার কাছ থেকে কোন উত্তর পাচ্ছে না। রুপার কান্না ক্রমশ বাড়তেই লাগলো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। বোধ হয় রুপার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে । রুপাকে এসব প্রশ্ন করার দরকার কি ছিলো? মেয়েটা এমনিতেই তো একটু অন্যরকম। নিজের বোকামীর জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে তুরানের।
তুরান রুপার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-‘কি হলো কথা বলছো না কেন? শরীর খারাপ লাগে তোমার? চলো বাসায় দিয়ে আসি।’
রুপার কাঁধে হাত রাখতেই রুপা তুরানের উপর ঢলে পরে। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো তুরানের। ঘামতে ঘামতে শুরু করলো। হঠাৎ এমন কেন হলো? রুপা সেন্স লেস কেন হলো?
তুরান রুপাকে পাজা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। রুপার হুঁশ ফিরবে কিভাবে? ওকে কি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে? তুরান কিছু ভেবে পাচ্ছে না।
ছাদ থেকে নেমে আবার চিন্তায় পরে গেলো। রুপাকে ওর রুমে দিয়ে আসা রিস্ক। তুরানের রুমে নেওয়া কি ঠিক হবে? সকাল বেলা সাহেলা বেগম যদি রুপাকে রুমে না দেখে? বিষয় টা খারাপ হবে খুব।
তুরানের মাথায় আর একটা বুদ্ধি আসলো । রুপার জ্ঞান ফিরার পর সকাল হওয়ার আগেই রুপা যদি ওর রুমে চলে যায় তাহলে বিষয়টা ভালো হবে।
তুরান রুপাকে নিয়ে তুরানের রুমে শুইয়ে দিলো।গ্লাসে করে পানি এনে রুপার মাথায় দিলো । এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাবে? খুব বেশী ভয় হচ্ছে তুরানের, চিন্তার ছাপ মুখে। রুপার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । মুখটা একদম শুকিয়ে গিয়েছে রুপার। মুখের উপর থাকা চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে দিলো তুরান । অদ্ভুধ ভালোবাসা কাজ করছে রুপার প্রতি। ভালোবাসা এমন আজব কেন ভেবে পাচ্ছে না তুরান। তুরান রুপার মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে । রুপার জীবনটা এমন কেন? কিছুই জানে না ওর সম্পর্কে তুরান । রুপা কে ভালোবেসে তো কোন ভুল করে নি? রুপা তো মানসিক ভাবে অসুস্থ । এই অসুস্থার পিছনে কি কোন কারন রয়েছে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কোথায় পাবে তুরান? সাহেলা বেগমের কাছে এসব জিজ্ঞেস করাটা বেমানান!
-‘বলেছি না আমায় ওসব জিজ্ঞেস করবেন না।’
রুপার কথায় ভাবনার ছেদ হয় তুরানের । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুরান । এতক্ষনের চিন্তার অবসান হয়।
-‘কি হয়েছিলো তোমায় এমন করলে কেন? আমি কত ভয় পেয়েছি!’
শোয়া থেকে উঠে তুরান কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে রুপা। তুরানের বুকে কিছুক্ষন চুপ-চাপ থেকে রুপা বলে,
-‘কোন কিছু নিয়ে ভাবলে এমন হয় আমার। ভয় পেয়েছেন?’
-‘এমন করলে সবাই ভয় পায় । কি নিয়ে ভাবছিলে এত?’
-‘আপনি যা জিজ্ঞেস করছেন তাই নিয়ে।’
কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় তুরান। রুপা জড়িয়ে ধরে রেখেছে তুরানকে। রুপা কি তুরান কে ভালোবাসে? নাকি এসবও রুপা বেখেয়ালে করছে? মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তুরানের। তুরানও রুপাকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। এর থেকে শান্তি বুঝি পৃথিবীতে হয় না!
চুপ করে আছে দুইজন। এই নিরবতারও বোধ হয় ভাষা আছে। এই নিরবতায় মুখে কথা হয় না,কথা হয় অন্তরে অন্তরে।
নিরবতা ভেঙে রুপা বলে,
-‘আপনার বুকে অনেক শান্তি।’
-‘সারা জীবন থাকবে আমার বুকে?’
কিছুক্ষন চুপ থেকে রুপা বলে,
-‘থাকবো।’
আবেশ জড়ানো কন্ঠে তুরান বলে,
-‘ভালোবাসো আমায়?’
-‘ভালোবাসা টালোবাসা বুঝি না।’
রুপার এমন উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তুরান।
-‘সারা জীবন আমার বুকে থাকবে অথচ ভালোবাসা বুঝো না? ভালোবাসায় হাবুডুবু খাচ্ছো আর বলছো ভালোবাসা বুঝো না?’
কোন কথা না বলে মুচকি হেসে দেয়। অন্য রকম প্রশান্তি পাচ্ছে তুরান। ওভাবে কতক্ষন দুই জন দুই জনকে জড়িয়ে রেখে ছিলো হিসাব নেই।
আজানের ধ্বনিতে হুঁশ ফিরে তুরানের । ভালোবাসার রাত গুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় কেন?
-‘রুপা।’
ঘুম ঘুম চোখে রুপা বলে,
-‘হুম।’
-‘উঠো এখন বাসায় যাও। সকাল হয়ে গিয়েছে।’
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে তুরান কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-‘উঁহু বাইরে এখনো অন্ধকার যাবো না।’
-‘সাহেলা আন্টি যদি তোমায় রুমে না দেখে তাহলে কি হবে জানো না।’
সাহেলা বেগমের কথা শুনতেই দড়পড়িয়ে উঠে বসলো রুপা। চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
-‘আমার হেঁটে যেতে ইচ্ছা করে না,কোলে নিয়ে দিয়ে আসেন।’
-‘যদি কেউ দেখে ফেলে?’
রুপা তুরানের কথা মানতে নারাজ। সে তুরানের কোলে চড়েই রুমে যাবে। এ দিকে প্রায় সকাল হয়ে যাচ্ছে । রুপাকে কোলে নেওয়ার চান্স মিস করতে চাচ্ছে না তুরান। সাত-পাঁচ না ভেবে পাজা কোলে নিলো রুপাকে। তুরানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রুপা।
রুপাকে রুমে দিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো তুরান ।
ভাবতে লাগলো আজকে রাতটা। রুপার ছোঁয়া লেগে আছে তুরানের শরীরে। রুপার শরীরের ঘ্রান লেগে রয়েছে তুরানের শার্টে।
সারা রাত রুপা জড়োসড়ো হয়ে তুরানের বুকে ছিলো। প্রশান্তি,মায়া,ভালোবাসায় ভরা ছিলো রাতটা। রুপার বাচ্চা দের মত কথা বলা অন্য মাত্রা যোগ করে সব সময়।
জীবনের প্রতিটি রাত এমন হলে ক্ষতি কি? হবে কি এমন? রুপাকে নিজের করে পাবে তো? শঙ্কা জাগে তুরানের মনে। এত ভালোবাসা কেন রুপার মাঝে? সারা রাত ঘুম হয়নি। রুপার কথা শুনতে শুনতেই রাত কেটে গিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তুরান ।
সারা রাত সজাগ থেকে চোখ লাল হয়ে রয়েছে তুরানের। চোখ দুটো জ্বলছে খুব। ঘুমিয়ে থাকারও জো নেই টিউশনি,ভার্সিটি। সকালে ঘুম ভাঙতেই রুপার কথা মনে পরলে ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসি ফুঁটে তুরানের । তাড়াহুড়া করে রান্না করছে তুরান। আজকে বোধ হয় টিউশনিতে যেতে পারবে না।
.
সকালে রুমে পায়চারি করছে সাহেলা বেগম । রুপা তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না কখনো। রুপার রুমে যায় সাহেলা বেগম । এখনও ঘুমাচ্ছে রুপা। কালকে ওর আম্মু মারছে ওকে তাই বোধ হয় শরীর খারাপ করেছে সেজন্য ঘুমাচ্ছে।
সাহেলা বেগম রুপার মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। মেয়েটার মুখটা বিশুদ্ধ,স্বচ্ছ একদম। নিঃসন্তান সাহেলা বেগমের মনে রুপার জন্য রয়েছে অগাধ ভালোবাসা । তাইতো রুপার সব পাগলামী সহ্য করে। বুকে একটাই আশা রুপা একদিন সুস্থ হবে। রুপা সুস্থ হলে কি রুপার বাবা-মা রুপাকে সাহেলা বেগমের কাছে রাখবে? নাকি আজিজ চৌধুরীর কথাই সত্যি হবে?
বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে সাহেলা বেগমের ।
আদুরে গলায় ডাকে রুপাকে । বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রুপা। কপালে হাত দিয়ে দেখে সাহেলা বেগম । জ্বর আসছে কি রুপার গায়ে? না শরীরের তাপমাত্রা তো স্বাভাবিক।
রুপার কানের কাছে মুখ নিয়ে সাহেলা বেগম বলে,
-‘রুপা আম্মু উঠো তো। অনেক বেলা হয়েছে।’
অনেকক্ষন ডাকার পর ঘুম ভাঙে রুপার।রুপার ঘুম থেকে উঠতে নারাজ। সাহেলা বেগম রুপাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘুম থেকে উঠালো।
-‘এত বেলা পর্যন্ত ঘুমানো শরীরের জন্য ক্ষতি তো।’
ঘুম ঘুম চোখে রুপা বলে,
-‘উঁহু।’
একটু রাগী গলায় সাহেলা বেগম কথা বলতেই উঠে বলতেই উঠে বসে রুপা। সাহেলা বেগম হেসে বলে,
-‘ভালো কথা তোর কানে যায় না তাই না?’
কোন কথা না বলে হনহনিয়ে বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো রুপা।
.
রান্না করে খেতে খেতে একটা টিউশনির সময় ওভার হয়ে গেলো। বাসা থেকে বের হলো তুরান। বার বার রুপার রুমের দিকে তাকাচ্ছে। সকাল বেলা রুপার মুখটা না দেখে বেরুতে ইচ্ছা করছে না।
দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা কাগজের টুকরোর কি যেন লিখে রুপার রুমের দিকে ছুঁড়ে মারলো তুরান।
কাগজের টুকরো দেখেই তাড়াহুড়া করে কুড়িয়ে হাতে নিলো রুপা। তুরান ছাড়া এ আর কার কাজ? আম্মু যদি দেখে ফেলে তাহলে খারাপ হবে।
‘রুপা বাবু চিঠি পড়তে জানো তো তুমি? না জানলেও সমস্যা নেই। এটা নিয়ে ভেবে আবার অজ্ঞান হয়ে যেয়ো না। ভার্সিটি তে যাচ্ছি আমি হুম? রুম থেকে বের হয়ো না।কোন পাগলামী করো না।’
মুচকি হেসে দেয় রুপা। তুরান কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘শুধু চিঠি না,মানুষের মন পড়তেও জানি আমি।’
এক বুক প্রশান্তি নিয়ে বাসা থেকে বের হয় তুরান ।
তুরানের কথা মত রুপা সারা দিনেও রুপ থেকে বের হয় নি। কোন ভাংচুরও করে নি। রুপা এখন হাত ,পা কাটে না। রুমে বসে তুরানের চিঠিটা নিয়েই দুপুর টা কাটিয়ে দিলো। তুরান কখন বাসায় ফিরবে সেই অপেক্ষা শুধু।
রুপার এমন স্বাভাবিক আচরন দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সাহেলা বেগম । ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে আজিজ চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘দেখো রুপা এখন প্রায় স্বাভাবিক।’
-‘সব স্বাভাবিক কোথায়? ওর অতীত…’
আজিজ চৌধুরীর কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দিলো সাহেলা বেগম। থমথমে মুখে বলে,
-‘ওটা অত জরুরী না।’
একটু থেমে আবার বলে,
-‘রুপা আগে কি করতো মনে নেই তোমার? ওর বাসায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো, ওর ছোট ভাই কে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। এমন কি পাগলামী আছে ও করে নি? ওর বাবা-মা এসবে তিক্ত হয়ে মারতো ওকে। সেজন্যই বাবা-মার কথা শুনতে পারে না। সে তুলনায় এখন অনেক গুন ভালো।’
আনন্দিত মনে আজিজ চৌধুরীর সাথে বসে বসে কথা বলছে সাহেলা বেগম । কথা বলার মেইন টপিক রুপা। রুপার জন্য সাহেলা বেগমের এত ভালোবাসা দেখে আফসোস হচ্ছে আজিজ চৌধুরীর । রুপাকে যখন ওর বাবা-মা নিয়ে যাবে তখন কি সহ্য করতে পারবে সাহেলা বেগম?
গোসল সেরে হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছে রুপা। সাহেলা বেগম রুপার রুমে আসতেই রুপা হেসে বলে,
-‘ আগে কত বড় চুল ছিলো,শুকাতে অনেক সময় লাগতো। আর এখন কম সময় লাগে। ভালো হয়েছে তাই না?’
বলেই হেসে দেয় রুপা। সাহেলা বেগমের ইচ্ছা করছে রুপার গালের উপর একটা থাপ্পর দিতে। রাগ সংযত করে সাহেলা বেগম বলে,
-‘খেতে আসো ।’
খাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই রুপার চোখ পরে তুরানের দিকে । বাসায় ফিরেছে তুরান!
এখন সাহেলা বেগম বাসায় তাই তুরানের কাছে যেতে পারলো না। অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো কখন সাহেলা বেগম বের হবে বাসা থেকে ।
সাহেলা বেগম বাসা থেকে বের হতেই দৌঁড়ে ছাদে চলে যায় রুপা।
চেয়ারে বসা তুরান । রুপা কে দেখেই হেসে দেয়।
-‘এতক্ষন আসার সময় হলো বুঝি?’
হাঁপিয়ে গিয়েছে রুপা। কথা বলতে পারছে না। তুরান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
রুপাকে চেয়ারে বসিয়ে বলে,
-‘হেঁটে আসলেই তে পারতে। এভাবে দৌঁড়ে আসতে বলেছে কে?’
রুপা এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,
-‘খেয়েছেন তো?’
এই টুকু কথার ভিতরও ভালোবাসা খুঁজে পায় তুরান ।
-‘হ্যাঁ খেয়েছি তো।তুমি খেয়েছো?’
মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয় রুপা।
-‘মাঝে মাঝে চিঠি লিখতে পারবেন? ভালো লাগে আমার।’
-‘পারবো।যদি তুমি চিঠি উত্তর দেও।’
রুপা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
-‘চিঠি লিখতে পারি আমি ।’
তুরান হেসে বলে,
-‘আমি কি বলেছি তুমি পারো না?’
তুরান আবার বলে,
-‘ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’
উৎসাহিত কন্ঠে রুপা বলে,
-‘কি?’
-‘চোখ বুঁজো আগে তারপর।’
-‘বুঁজলাম চোখ।’
-‘যতক্ষন না বলব আমি ততক্ষন চোখ খুলবে না।’
রুপাও বাধ্য মেয়ের মত তাই করলো।
তুরান পকেট থেকে পায়েল বের করে রুপার পায়ে পরিয়ে দিলো। রুপার চোখে আঁকাবাঁকা করে লেপ্টিয়ে কাজল দিয়ে দিলো। একটা কালো টিপ রুপার কপালে পড়িয়ে দিলো। সবুজ এক মুঠ চুড়ি রুপার হাতে পড়িয়ে দিলো।
-‘চোখ খোলো এবার ।’
রুপা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে রয়েছে। তুরান রুপার সামনে হাঁটু ঘেঁষে বসে বলে,
‘শোনো, আধুনিকতা একদম পছন্দ না আমার। তুমি আমার রানী হয়ে থাকবে। যাঁর চোখে থাকবে গাঢ়,মোটা কাজল। হাত ভর্তি চুড়ির আওয়াজ বাজবে সারাক্ষন। কপালে থাকবে বাঁকা টিপ,টিপ ঠিক করার ছলে মাঝে মাঝে কপালে হাত ছুঁয়ে দিবো। যত্ন করে পায়ে পড়িয়ে দিবো পায়েল। কাউকে কাজল পড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস আমার একদম নেই। তাই তো আঁকাবাঁকা হয়েছে।’
রুপার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। অতি আনন্দের জল।রুপা তুরানের হাত ধরে বলে,
-‘অনেকদিন হলো কেউ আমায় ভালোবাসে না । আপনি একদম ব্যতিক্রম।’
-‘ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে তাহলে সবাই ভালোবাসবে।’
আজিজ চৌধুরীর কন্ঠে শুনে তুরানের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রুপা। নিচ তলা থেকে ডাকছে আজিজ চৌধুরী।
তুরান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘আংকেল বাসায়?’
-‘বাবার শরীর ভালো না তাই যায় নি অফিসে। বাবা বাসায় থাকলে ভয় হয় না। কারন সে সারাক্ষন রুমে বই নিয়ে বসে থাকে । দুনিয়ার অন্য কোন বিষয়ে তাঁর খেয়াল নেই।’
এই বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলো রুপা। আজিজ চৌধুরী তো কখনো ডাকে না এই সময় আজ কেন ডাকছে?
তুরান হতাশ ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে রইল। এমন সময় কেউ ডিস্টার্ব করে? হায়! অদৃষ্ট।
.
একটু পরে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসলো রুপা।
-‘কি হলো রাগে গজগজ করছো কেন?’
-‘মেজাজ খারাপ হচ্ছে ।’
-‘কেন ,কেন?’
-‘আরে আমি চিনি না জানি না কোথা থেকে কে ফোন দিয়ে আলাপ দেয়।’
-‘কে ফোন দিয়েছে?’
-‘প্রনয় রায়।’
তুরান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘আংকেলের ফোনে কল দিয়েছে ছেলেটা?’
-‘হুম।’
-‘কি বলেছে তোমায় ?’
-‘জানে কে আজাইরা কথা । বাদ দেন।’
চিন্তায় পড়ে যায় তুরান। আজিজ চৌধুরীর ফোনে কল দিয়েছে নিশ্চয় রুপার পরিচিত কেউ । তুরান ভয় পাচ্ছে অন্য কারনে। পরক্ষনে মনে পরলো প্রনয় রায় ছেলেটা হিন্দু ! ভয় কেটে গেলো তুরানের!
চলবে…