#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_31
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তুরানের বাসার ঠিকানা থাকলে বা পথ চেনা থাকলে বোধ হয় এক্ষুনি চলে যেতো। তুরান এখনো ফিরছে না কেন? কখন ফিরবে? রুপার চোখ আবার ছলছল করছে। কোন কিছুতে মন বসছে না। ইচ্ছা করছে সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে। তুরানের উপর দারুন রাগ হচ্ছে রুপার। তুরান কি জানেনা ওকে ছাড়া রুপার খুব বেশি কষ্ট হয়? একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না? রুপা লুকিয়ে চোখ মুছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
সাহেলা বেগম রান্না করছে তড়িঘড়ি করে। আজ রান্নায় খুব দেরি হয়ে গেছে। রুপার মা সাহেলা বেগমের কাজে সাহায্য করছে। দুই জন মিলে এক রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো।
সাহেলা বেগম মাংস ধুয়ে নিতে নিতে বললো,
-‘তুই কিন্তু বেশ কয়েকদিন থাকবি। এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবি না। আর রুপার আব্বুকেও আসতে বল।’
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ রুপা কে কয়েক দিনের জন্য বাসায় নিয়ে যেতে চাই। ও তো এখন প্রায় সুস্থ শুধু…!’
রুপার মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়ে সাহেলা বেগম বললো,
-‘ তোর বাসার সব কিছুই অপরিচিত রুপার কাছে। ও যদি স্বেচ্ছায় যায় তাহলে যাক। জোর করলে প্রবলেম হতে পারে।’
রুপার মায়ের মুখ টা মূহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চোখে পানি ছলছল করছে। চোখের পলকেই হয়ত পানি ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে।
সাহেলা বেগম আবার বলল,
-‘ মন খারাপ করলি? কি করার বল? আমি যদি না থাকতাম তাহলে তো রুপা কে মেন্টাল হসপিটালে রাখা লাগতো। তোর মন খারাপের কি আছে এখানে? রুপা তো আমার বাসায়ই থাকে। ও কি এখানে অযত্নে থাকে? আর যে কোন হসপিটালে ওর সুস্থ হতে যত সময় লাগতো, এখানে অর্ধেক সময়ই লাগে নি।’
রুপার মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
-‘ আচ্ছা রুপা তো মানসিক ভাবে সুস্থ হলেও তো সম্পূর্ণ সুস্থ না। ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে দরকার হলে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। প্রনয় তো কয়েক মাস বাদে আসছে।’
এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে রান্না শেষ হয় সাহেলা বেগমের। রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সাহেলা বেগম। খাবার সাজানো শেষে যায় রুপার রুমে। রুপা রুমে নেই। সাহেলা বেগম আজকাল রুপার হাবভাব বুঝতে পারছে না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে রুপা। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না । কোন একটা কারনে হয়ত মন খারাপ রুপার।
রুপার মা রুপা কে দেখতে এর আগে যতবার ই এসেছে ততবারই রুপা খারাপ আচরণ করছে। শুধু এই বারই ব্যতিক্রম হচ্ছে। রুপা বোধ হয় ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে, মিউচুয়াল হচ্ছে।
রুপার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে রুপা। এর ভিতর ডাইনিং রুম থেকে আজিজ চৌধুরী ডাক আসলো। সাহেলা বেগম দ্রুত পায় ডাইনিং রুমে যায়।
.
মেয়ের মানসিক উন্নতি দেখে খুশি তে আত্মহারা হয়ে যায় রুপার মা। সাহেলা বেগমের প্রতি কৃতজ্ঞতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দুই জনের ধর্ম আলাদা হলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা কঠোর শক্ত। বোনের চেয়ে কোন অংশেই কম না। এমনকি অনেকে এদের দুই জনকে বোন ভাবে।
রুপার চুল গুলোর কথা ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুপার মা। কত লম্বা চুল ছিল! প্রতিদিন রুপা ঘুমাতে যাওয়ার আগের বেনী গেঁথে দিতো রুপার মা। হঠাৎ একটা এক্সিডেন্টে কি থেকে কি হয়ে গেলো! রুপার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ টা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আচমকা ঝড়ে সব কিছু তছনছ হয়ে গেলো। এসবের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে রুপার মা। প্রতিনিয়ত এই কষ্ট বহন করে চলে। রুপার বাবা, ছোট ভাইটা কারো কষ্টই কম না। রুপা আবার একদম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। সেই প্রত্যাশায় দিন গুনছে সবাই। সবার প্রতিক্ষা রুপা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। আগের রুপা হয়ে যাবে।
.
দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেলো। রুপার মা আসছে তাই আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম কেউই অফিসে যায় নি। তিন জনে বসে বসে খোশগল্প করছে। রুপাও খাটের এক কোনায় বসে আছে। এই আড্ডার আসরে কোন রকম মন নেই রুপার। রুপা শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছে কখন তুরান আসবে? রুপার এমন উদাসীন ভাব ভাবাচ্ছে সাহেলা বেগম কে।
-‘ রুপা আমার সাথে বাসায় যাবে আম্মু? তোমার বাবা যেতে বলেছে। তোমার সব পছন্দের খাবার খাওয়াবো। নারকেল এর নারু বানিয়েছি অনেক তোমার জন্য।’
রুপার মা একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। রুপা শুধু দায়সারা ভাবে হ্যাঁ, হুঁ বলে যাচ্ছে বা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিচ্ছে। রুপা কিছুতেই রুপার মায়ের সাথে যাবে না। তুরান কে ছেড়ে কোথায়ও যাবে না। তাই এখান থেকে কোথায় যাওয়ার কথা প্রশ্নেই আসে না।
তুরান দেশের বাড়ি গেলো দুই দিন হয়ে গেলো এখানো আসছে না। রুপার পাগল প্রায় অবস্থা। মুখে কোন কথা নেই, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করছে না। রুপা রুপার মায়ের উপর বিরক্ত হচ্ছে খুব। মহিলা টা এখনো যাচ্ছে না কেন? আগে আসলে একটু থেকে চলে যেত। আর এবার ঘাপটি মেরে রয়েছে। কোথাকার কি সব গল্প জুড়ে দেয় রুপা বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে ফেলে। রুপার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কাউকে সহ্য হচ্ছে না। এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় যায় রুপা। গেটের দিকে তাকাতেই দেখে তুরান এসেছে। রুপা আনন্দে চিৎকার করে উঠে। রুপার আনন্দ ধ্বনি তুরানের কানে গিয়ে পৌঁছলো। তুরান বারান্দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দেয়। তুরানের মা-বাবা দুজনেই এসেছে। তুরান ওর অসুস্থ বাবাকে ধরে বাসার দিকে নিয়ে আসছে। রুপা দৌড়ে সেখানে গেলো।
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না কারন তুরানের বাবা-মার কারণে। রুপা কে দেখেই হেসে দেয় তুরানের মা। রুপাকে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলো তুরানের মায়ের কারন এর আগে যখন রুপা কে দেখেছে তখন রুপার চুল গুলো হাঁটু অব্দি ছিলো।
তুরানের মা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-‘ রুপা না তুমি? চুল গুলোর এই অবস্থা কেন? ইস কত বড় চুল গুলোর এই অবস্থা হলো কিভাবে!’
তুরানের মা রুপার চুল নিয়ে রিতিমত আফসোস শুরু করলো। তুরানের মা’কে রুপার বেশ লাগে। সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে তুরানের মা। রুপা উনাদের সাথে বাসা অব্দি গেলো। দুই জন দুই জনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে কিন্তু তেমন কিছু বলতে পারছে না। এমন অবস্থায় রুপার দাম বন্ধ হয়ে আসছে। তুরান শুধু বললো,
-‘ কেমন আছো রুপা?’
রুপা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো। তুরান ভালো করেই বুঝতে পারছে রুপার এই দুই দিনে কষ্ট হয়েছে বেশ। চোখ গুলো ফুলে আছে রুপার। চেহেরায়ও বিষাদের ছাপ। রুপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তুরানের মা রুপা কে বসতে বললো । রুপা বাধ্য মেয়ের মত বসলো।
খানিক বাদেই তুরান আবার বাসা থেকে বের হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য তুরানের বাবাকে নিয়ে। রুপার সাথে একান্তে আর কথা হলোনা। রুপার একাকিত্বের গল্পও শোনা হলো না। তুরানের মা একা বাসায় রইলো।
রুপার নিরুপায় হয়ে বসে বসে তুরানের মায়ের সাথে গল্প করছে। উনার সাথে গল্প করতেও মন্দ লাগছে না রুপার। কিন্তু মনে মনে তুরানের উপর চাপা অভিমান হচ্ছে। কিন্তু তুরানের বা কি করার? অনেক সময় সব বুঝে শুনেও আমরা প্রিয় মানুষটার উপর রাগ করি। এটাই বুঝি প্রেম?
রুপার বেশিক্ষণ গল্প করতে পারলো না। সাহেলা বেগম ডেকে পাঠিয়েছেন রুপা কে। রুপা চরম বিরক্ত হয়ে হনহন করে চলে গেলো।
রুপার মা আর সাহেলা বেগম বসে আছে সোফায়। রুপা কে দেখেই রুপার মা রাগি গলায় বলললো,
-‘ কোথায় গিয়েছিলে?’
রুপা নাকমুখ কুঁচকে বললো,
-‘ যেখানে ইচ্ছা গিয়েছিলাম।’
রুপার মা আর কথা বাড়ায়নি । কথা বাড়ালেও তাতে বিশেষ কোন লাভ হবে না।রুপা এমন উল্টাপাল্টা জবাবই দিবে।
রুপা রুমে চলে গেলো। রুপা রুমে চলে যাওয়ার পর সাহেলা বেগম বললো,
-‘ তুরান দের বাসায় গিয়েছিলো বোধ হয়। তুরানের বাবা-মা এসেছে।’
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ তুরান কে?’
-‘ এখানে ভাড়া থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারে পড়ে ছেলেটা। খুবই ভালো ছেলে।’
-‘ রুপা কে একটু চোখে চোখে রাখিস। ওই বাসায় যেন বেশি না যায়। যত যাই হোক একটা ছেলের প্রতি একটা মেয়ের বা একটা মেয়ের প্রতি একটা ছেলের আকর্ষণ হতে কতক্ষন।’
সাহেলা বেগমের এসব নিয়ে ভাবা হয়নি তেমন। বিষয়টা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের সন্তান নেই বলে বোধ হয় এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে নি।
চলবে..