যদি তুমি জানতে’ পর্ব:২

0
1196

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_2
সকালে উঠে নাস্তা রেডী করছে সাহেলা বেগম। কাজে বেশ তাড়াহুড়া। রান্না সেরে হসপিটালে যেতে হবে। পা টিপে টিপে গিয়ে সাহেলা বেগমের পিছনে দাঁড়ালো রুপা। আচমকা জোরে শব্দ করে উঠল। ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে সাহেলা বেগম বলল,
-‘ডাইনিং রুমে যাও নাস্তা রেডী।’
মুখটা কালো হয়ে যায় রুপার। মন খারাপ করে বলল,
-‘আমি এত কষ্ট করে পা টিপে টিপে এসে জোরে শব্দ করলাম তোমায় ভয় দেখানোর জন্য । তুমি ভয়ই পেলে না আজব!’
মুচকি হেসে সাহেলা বেগম বলল,
-‘আমি তোর উপস্থিতি টের পেয়েছি।’
-‘আচ্ছা তোমাদের এত এত এত টাকা রান্নার জন্য কাজের লোক রাখতে পারো না?’
-‘তোর বাবা আমার হাতের রান্না খেতে পছন্দ করে। হাজবেন্ডের পছন্দের গুরুত্ব মেয়েদের কাছে খুব। বিয়ে হলে বুঝবি।’
রুপা একটু ভেবে বলল,
-‘বিয়ে কি?’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সাহেলা বেগম বলল,
-‘বড় হ তারপর বুঝবি।’
-‘সবাই বলে আমি বড়। অথচ আমি কিছু বুঝি না।’
-‘আস্তে আস্তে সব বুঝবি।’
-‘বাবার এত টাকা তোমার জব করার কি দরকার? একা বাসায় একদম মজা না।’
-‘ছোট বেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়া। আমি সফল হয়েছি। টাকা ব্যাপার না ব্যাপার হলো আমার নিজের তো একটা পরিচয় থাকা চাই। আমার হাজবেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এটা তো আমায় পরিচয় হতে পারে না,আমি ডাক্তার এটা আমার পরিচয়।প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত স্বাবলম্বী হওয়া। হাজবেন্ডের উপর নির্ভর করে থাকা ভুল। জীবনের মোড় কখন ঘুরে যায় তার তো ঠিক নেই।’
একটু থেমে সাহেলা বেগম আবার বলল,
-‘ যেকোন একটা উপলক্ষে তোর বাবা আমায় গিফ্ট দিলো, আমি যদি নিজে উপার্জন না করতাম তাহলে তাঁকে কিভাবে গিফ্ট দিতাম? তাঁর কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে তাঁকে গিফ্ট করা টা বেমানান।’
সাহেলা বেগমের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে রুপা। মন খারাপ করে বলল,
-‘আম্মু আমি তোমার মত এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না কেন? তুমি কত সুন্দর করে কথা বলো।’
-‘পারবি।’
-‘আমি যদি তোমার মত ডাক্তার হতে পারতাম। আচ্ছা ডাক্তার হয় কি ভাবে?’
ক্ষীন নিঃশ্বাস ফেলে সাহেলা বেগম বলল,
-‘তুই আমার থেকে অনেক বড় ডাক্তার হতে পারতি কিন্তু ভাগ্য তোর সঙ্গে ছিলো না।’
সাহেলা বেগমের কথা গুলো বিদঘুটে মনে হয় রুপার কাছে। কি সব বলে কিছুই বুঝে না রুপা।
নাস্তা করে সাহেলা বেগম চলে গেলো হসপিটালে । আর আজিজ চৌধুরী চলে গেলো তাঁর অফিসে। একা রুমে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। একা থাকলেই রুপার মন খুব বেশী খারাপ হয়। অশান্ত হয়ে যায় রুপা।
ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা পারফিউমের বোতল’টা দিয়ে নিজের কপালে কয়েকটা আঘাত করল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে রুপা, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। সব কিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। নিজের হাত কামড়াতে লাগলো। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে রুপার। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কেন কাঁদছে রুপা? তা সে নিজেও জানে না।
কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গেলো। একটু পর ঘুম ভেঙে যায় রুপার। এখন সব কিছু স্বাভাবিক। মেঝে থেকে পারফিউমের বোতল’টা তুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো।
নিজের হাতে দিকে তাকিয়ে আছে রুপা। হাতে অসংখ্য কামড়ে দাগ। হাতে মলম লাগিয়ে ছাদে চলে গেলো।
ছাদে গিয়েই রুপার মন খুশিতে ভরে উঠে তুরানকে দেখে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে। তুরানের সাথে কথা বলতে, তুরানকে ক্ষ্যাপাতে বেশ ভালোই লাগে! কিন্তু তুরান প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। রুপার ভাষ্যমতে ভ্যাবলাকান্ত মশাই! কিছু হলেই শুধু বাবার কাছে বিচার দিবে এই বলে ভয় দেখায়।
রুপাকে দেখে বিরক্ত হয়ে যায় তুরান। আজকে আবার কি কান্ড করবে আল্লাহ্ই জানে। তুরান রুপার দিকে না তাকিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরান ভেবে পায় না রুপা এমন কেন? নিজের পার্সনালিটি,ইগো বলতে কিছু নেই নাকি? তুরান কথা বলতে বিরক্ত বোধ করে এটা কি বুঝে রুপা?
রুপা এসে তুরানের কাছে দাঁড়ালো।
-‘আমি আসলাম অথচ আপনি আমার দিকে একটুও তাকালেন না কেন?’
চায়ের কাপে চমুক দিতে দিতে তুরান বলল,
-‘তোমার দিকে তাকাতে হবে কেন?’
-‘জানেন না আমি বাসায় একদম একা থাকি। একা ভালো লাগে না একদম। একটু আসি আপনার সাথে কথা বলতে তা আপনি আমায় সহ্যই করতে পারেন না।’
-‘রুপা আমার পড়ায় ডিস্টার্ব হচ্ছে, এখান থেকে যাও।’
-‘আপনি তো চা খাচ্ছেন। পড়তেছেন না তো।’
তুরান কোন উত্তর দেয় না। চায়ের কাপে একটু চমুক দিচ্ছে, আবার বইয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
তুরানের পাশে আরেক টা চেয়ায় টেনে বসলো রুপা। আচমকা তুরানের হাত থেকে চায়ের কাপটা টান দিয়ে নিয়ে বলে,
-‘যে টুকু আছে আমি খাবো।’
তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কোন লেবেলের পাগল এটা? আধ খাওয়া চায়ের কাপটা এভাবে নিয়ে গেলো!
চায়ের কাপটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে চমুক দিয়ে রুপা বলল,
-‘অনেক মজা!’
খুব তৃপ্তি সহকারে চা খাচ্ছে রুপা। প্রতিটি চমুকে রয়েছে তৃপ্তির ছাপ। রুপা আবার বলল,
-‘এভাবে চায়ের কাপটা নিয়েছি কেন জানেন? আমায় রেখে একা একা খাচ্ছেন, সৌজন্যমূলক সাধলেনও না। মিনিমাম ফর্মালিটি টুকু আপনার নেই।’
-‘তোমার খুব ফর্মালিটি তাই না? অন্যের চায়ের কাপ হাত থেকে নিয়ে যাও।’
-‘অন্যে যদি আমায় রেখে একা একা খায় আমি কি করব?’
অবাক হওয়ার সুরে তুরান বলল,
-‘তুমি মানুষ না এলিয়েন আমি বুঝতে পারছি না।’
রুপা আপতত তুরানের কথায় কান দিচ্ছে না। যত্নসহকারে চা টুকু খাচ্ছে। তুরান রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আগে কখনো চা খাও নি?’
মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। অনেকক্ষন ভেবে বলল,
-‘না।’
-‘না মানে?’
-‘না মানে আগে খাই নি।’
উদাস হয়ে যায় রুপা। আগে কি কখনো চা খেয়েছে? নাকি খায় নি? ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়। এত ভাবতে পারছে না মাথায় ভেতর অশান্তি লাগছে। আবার উত্তাল হয়ে যাচ্ছে রুপা। চোখ বুঁজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চায়ের কাপ’টা হাত থেকে ফেলে দুই হাতে মাথা চেপে নাক-মুখ কুঁচকে রাখে।
আতকে যায় তুরান। কি হলো রুপার? রুপার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
-‘রুপা কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?’
যথারীতি ভয় পেয়ে যায় তুরান। কেমন অদ্ভুধ দেখাচ্ছে রুপাকে। ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-‘রুপা কি হয়েছে বলবা তো? মাথা ব্যাথা করে তোমার?’
কোন কথা বলছে না রুপা। তুরান ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ কি এমন হলো?
স্বাভাবিকই তো ছিলো রুপা।
অনেকক্ষন মাথায় হাত চেপে রেখে বসে থাকে রুপা। চায়ের কাপটা পা দিয়ে ভেঙে লাল চোখে তুরানের দিকে তাকাতে তাকাতে ছাদ থেকে চলে যায়।
তুরান হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপটা ভেঙে ফেলল এভাবে? কক্সবাজার থেকে কত শখ করে কাপটা এনেছে!
না আর সহ্য করতে পারছে না তুরান। অসভ্য মেয়ে একটা! পেয়েছে টা কি?
তুরান যতই রুপা কে ইগনোর করবে রুপা ততই তুরানের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে। আর মেয়েটা এমন অদ্ভুধ প্রকৃতির! ভাবতেই পারছে না তুরান।
সেদিন নতুন শার্ট’টা নষ্ট করছে,আজকে আবার শখের কাপ’টা ভেঙে ফেলল।
আজিজ চৌধুরীর কাছে এবার বিচার দিবেই তুরান। হনহনিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো আজিজ চৌধুরীর ফ্লাটে। দরজা খোলা কিন্তু বাসায় কাউকে দেখছে না। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ আসলো তুরানে কানে। পাশের রুম থেকে আসছে আওয়াজটা। কন্ঠটা পরিচিত তুরানের। রুপা কাঁদছে। তুরান আস্তে আস্তে রুপার রুমের দিকে গেলো। ফ্লোরে শুয়ে কাঁদছে রুপা। চোখ কপালে উঠে যায় তুরানের । হাতে একটা ব্লেড রুপায়। ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কাটছে! এলোপাথরি ভাবে হাতে ব্লেড দিয়ে আঘাত করছে। রক্তে ফ্লোর লাল হয়ে যাচ্ছে । এমন করছে কেন মেয়েটা? রক্ত দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে তুরানের।
তুরান দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে রুপার হাত থেকে ব্লেডটা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
লম্বা চুল গুলো ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে আছে । নিস্তেজ হয়ে গেছে রুপা। তুরান বুঝতে পারলো রুপা সেন্সলেস হয়ে গেছে। পাজাকোলে নিয়ে রুপাকে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে শুইয়ে দিলো।
রুপার ঠোঁটের নিচে তিল টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুরান। বাহ্! মেয়ে টা বেশ মায়াবতী। আগে কখনো খেয়াল করে নি তুরান।
রুপার কি কোন মেন্টালিটি প্রবলেম আছে? আর ওর মা-বাবা এমন কেন? ওকে একা বাসায় রেখে কেন যায়।
রুপার হাতের রক্ত তুলা দিয়ে মুছে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিলো । ঘেমে একাকার হয়ে গেছে রুপা। ফ্যানটা অন করে দিলো তুরান।
অদ্ভুধ মায়া হচ্ছে রুপার প্রতি। অসহায় মনে হচ্ছে রুপাকে।
সাহেলা বেগম বাসায় ফিরলো। এসে দেখে রুপা ঘুমাচ্ছে। হাতে ব্যান্ডেজ । সাহেলা বেগম কে বাসায় আসতে দেখে তুরান সাহেলা বেগমের কাছে আসলো। সব টা বলল সাহেলা বেগমের কাছে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
-‘আন্টি আপনার মেয়ের কি কোন মেন্টালিটি প্রবলেম আছে? প্লীজ কিছু মনে করবেন না।’
-‘না বাবা । রুপা একটু জেদি। রাগ বেশী। ছোট বেলা থেকেই অকারনে কান্না করে, তাছাড়া স্বাভাবিক।’
তুরান আর কথা বাড়ালো না।
-‘ওকে একা বাসায় রেখে যাওয়া বোধ হয় ঠিক না।
‘এই বলে চলে যায় তুরান।
পিছন থেকে তুরান কে ডাক দেয় সাহেলা বেগম। বলল,
-‘তুমি একটা চায়ের মগ ক্ষতিপূরন হিসেবে নিয়ে যাও বাবা। ও যদি তোমার কিছু নষ্ট করে আমায় বলো,ক্ষতিপূরন দিয়ে দিবো।’
ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে তুরান বলল,
-‘না,না আন্টি দরকার নেই মগের।’
তুরান এই বাসায় এসেছে দেড় মাস হলো। সবাই খুব ভালো জানে তুরান কে। ছেলে হিসেবে বেশ ভদ্রই তুরান।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here