# যাত্রাশেষে (পর্ব-৪+৫)
# হালিমা রহমান
মহুয়ার বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেল।রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আগেই বাড়ির পথ ধরেনি সে।এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করেছে।ইদানিং কিছুতেই মন বসাতে পারছে না মহুয়া।কেমন যেন অস্থির লাগে সবসময়।গলা শুকিয়ে আসে।হুটহাট মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়।নতুন কোনো রোগ দেখা দিলো নাকি কে জানে!জানার ইচ্ছে নেই।তাই মহুয়া কোনো ডাক্তারের কাছেও যায়নি।এই বিয়েতে মোটেও রাজি না মহুয়া।তুষারের সাথে বিয়ের কথা-বার্তা যতটুকু এগিয়েছে, তার পিছনে পুরোই মায়ের অবদান।সাবিনা বেগম সবকিছু ঠিকঠাক করে মহুয়াকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।যেদিন তুষারের খালামনি মহুয়াদের বাসায় এসেছিল,সেদিন প্রথম মহুয়া জানতে পারে তার বিয়ের কথা।মহুয়া হতবাক! তার বিয়ে অথচ সে শুরু থেকে কিছুই জানে না!এ নিয়ে আজ বিকেলেও একচোট ঝামেলা হয়েছে বাসায়।মহুয়া তুষারের সাথে দেখা করতে যাবে না।কিছুতেই আরেকটা লোকের সামনে পুতুল হয়ে বসে থাকতে পারবে না সে।সাবিনা বেগম প্রথমে বুঝিয়েছেন,এরপর ধমক দিয়েছেন।কিন্তু,এরপরেও যখন দেখলেন একরোখা মেয়ে কিছুতেই যাবে না; তখন সপাটে দুটো চর মেরেছেন।মায়ের চর খেয়েই মহুয়া আজ তুষারের সাথে দেখা করতে এসেছে।নাহয় কিছুতেই আসতো না।
মহুয়া বাড়ি ফিরলো আটটায়।সে ঘরে ঢুকে দেখলো তার মা রান্না করছে।মহুয়ার মায়ের এই এক স্বভাব,তিনি একবেলার খাবার আরেক বেলায় খেতে পারেন না।তাই,তিন বেলায়ই খাবার রান্না করেন তিনি।মহুয়া ঘরে ঢুকে শব্দ করে ব্যাগ রাখলো।দু-পায়ের দুপাটি জুতো এদিক-সেদিক ছুঁড়ে মারলো।বাড়ি ফিরার পথে ঘরের জন্য দু-কেজি পেয়ারা এনেছিল।শব্দ করে সেগুলো রান্নাঘরে রাখলো।তবুও,সাবিনা বেগম ফিরেও তাকালেন না।যেমন একমনে রান্না করছিলেন,সেরকমই রান্না করতে লাগলেন।মহুয়া বুঝতে পারলো মায়ের রাগ এখনো কমেনি।আশ্চর্য হয়ে যায় মহুয়া।রাগ করার কথা ওর।অথচ রাগ করেছে মা।মহুয়া রান্নাঘরে সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে এলো।এঘর-ওঘর উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বাবাকে খুঁজল।মহুয়ার বাবা মহুয়ার কাছে জাদুকরের মতোন।এই একটা মানুষ যার কাছে সব সমাধান আছে।আফজাল সাহেবকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলো মহুয়া।কোথায় যে গেল বাবা?মহুয়ার পেটের ভিতর কথাগুলো গুড়্গুড় করছে।যতক্ষণ না এগুলো আফজাল সাহেবের সামনে উগরে দিতে পারবে,ততোক্ষণ এই গুড়গুড়ানি থামবে না।মহুয়া নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।বাবা না আসা অবধি একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।সারাদিন অনেক কাজ করেছে সে।সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলে ক্লাস নিয়েছে,বিকেলে সাবিনা বেগমের সাথে ঝামেলা করেছে আর শেষ বিকালে তুষারের সাথে প্যাচাল পেরেছে।কথা বলাও একটা ঝামেলা।কথা বলে মুখ ব্যাথা করার চাইতে চুপ করে থাকা ভালো।মহুয়ার মাথা ব্যাথা করছে খুব।শুধু মাথা না।ঘাড়,গলা, কান, চোখ সব একসাথে ব্যাথা করছে।এতো যন্ত্রণা একসাথে সহ্য করতে পারলো না মহুয়া।গা এলিয়ে দিলো নরম বিছানায়।খুব বেশিক্ষণ চোখ দুটো খুলে রাখতে পারলো না সে।পাড়ি দিলো শান্তির স্বপ্নময় জগতে।
***
রুবিনা বেগম বিছানায় বসে আছেন।তার সামনে মৃত্তিকা বসা।তুষার তাকে একগাদা খেলনা এনে দিয়েছে সেদিন।বল,গাড়ি, প্লেন,হাড়ি,পুতুল এরকম আরো অনেক কিছু।এর মধ্যে অর্ধেক আছাড়-টাছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছে মৃত্তিকা।বাকি অর্ধেক ভাঙার পায়তারা করছে।কখনো দাঁত দিয়ে কামড়ে দেয় আবার কখনো খেলনাগুলোকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেয়।এরপরেও যদি না ভাঙে তবে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই অবাক হয়ে যান রুবিনা বেগম।মেয়েটা এতো দুষ্টু! কার মতো হয়েছে ও।তুষার তো এতো দুষ্টু নয়।
রুবিনা বেগম ইদানিং তুষারকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন।এই বিয়ে তুষার বাধ্য হয়ে করছে।তাই,তার কাজ- কর্মগুলোও কেমন যেন ঝিমধরা।বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই,ইচ্ছে নেই,আগ্রহ নেই।বিয়ের পর সুখী হবে তো তুষার?মহুয়া ভালো হবে নাকি আর দশটা সৎমায়ের মতো হবে?যদি মৃত্তিকার সাথে খারাপ ব্যবহার করে?যদি এই পুতুলটাকে আপন করে না নেয়, তবে? কী হবে তখন?
ভাবতে পারেন না রুবিনা বেগম।সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বুঝা মুশকিল।তিনি কি থেকে কি করবেন তা কেউ আগেই বুঝতে পারে না।রুবিনা বেগম শত শত চিন্তাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন।তিনি ধৈর্য্য ধরে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে সময়ের অপেক্ষা করেন।এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।
তুষারে ফিরতে রাত হলো।প্রায় দশটা বেজে গেছে।সে যতোক্ষণে রুবিনা বেগমের বাসায় পা রেখেছে,ততোক্ষণে মৃত্তিকা ঘুমিয়ে গেছে।তুষার ঘরে ঢুকে দেখলো মৃত্তিকাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন রুবিনা বেগম।তুষার আস্তে আস্তে দরজায় আওয়াজ করলো।মৃদু আওয়াজে বললঃ” খালামনি,ঘুমিয়েছ?”
—” কে তুষার?ভিতরে আয়।”
তুষার ঘরে ঢুকে খাটের এককোনে বসল।মৃত্তিকাকে ইশারায় দেখিয়ে বললঃ” কখন ঘুমিয়েছে?”
—” একঘন্টা আগে।”
—” সারাদিন তোমাকে বিরক্ত করেছে খুব,তাই না?”
—” তোকে না দেখলে তো ও একটু বিরক্ত করেই। ওসব বাদ দে।এখন বল,মেয়ে কেমন দেখলি? পছন্দ হয়েছে?”
—” খারাপ না।”
রুবিনা বেগম বিরক্ত হলেন।কথার কি ধরন! মুখ ভোঁতা করে বললেনঃ”মেয়েটা খুব সুন্দর। ব্যবহারও খুব ভালো।তুই এভাবে বললি কেন?”
—” কিভাবে বললাম?”
—“খারাপ না আবার কেমন কথা।তুই বলবি,মেয়েটা খুব সুন্দর।আমার পছন্দ হয়েছে।আমি জিজ্ঞেস করেছি,মেয়ে পছন্দি হয়েছে কিনা।আর তুই বলিস খারাপ না।হারামজাদা কোথাকার।কোথায় পেয়েছিস এসব কথা?”
তুষার হাসে।খালামনি পারলে আজকেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিত।সে বালিশ ছাড়াই বিছানায় মাথা রেখে শুয়ে পরলো।
—” খালামনি বিয়ের তারিখ কি ঠিক করেছ?”
—” না, কেন?তোর খুব পছন্দ হয়েছে মহুয়াকে? এই সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করি?”
খুব উৎফুল্ল শোনায় রুবিনা বেগমের কন্ঠস্বর।তুষার কিছুক্ষণ ভেবে বলেঃ”না,খালামনি।বিয়ের তারিখ এতো তাড়াতাড়ি ঠিক করো না।একমাস পিছনের একটা তারিখ ফেলো।আমার একমাস সময় লাগবে।”
—” একমাস!”
—” হুম।”
—” একমাস সময় নিয়ে কি করবি তুই?”
—” নয়া পল্টনের ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি শেষ করতে আরো একমাস সময় লাগবে।আমি চাইছি,বিয়ের পর ওদেরকে নিয়ে ওখানেই উঠতে।দোকানে আসা- যাওয়া করতে সুবিধা হবে।”
একটু মিথ্যা বলল তুষার।ফ্ল্যাট প্রায় শেষ হওয়ার পথেই।বড়জোর দু-সপ্তাহ লাগবে। তুষার বিয়ের তারিখ পিছিয়েছে মহুয়ার জন্য।মেয়েটাকে আজ ভালোও লাগেনি আবার খারাপও লাগেনি।আর কয়েকটা দিন তার সাথে মিশতে চায় তুষার।মহুয়াকে বিশ্বাস নয় বুঝতে চায়।একমাসে কি একটা মানুষকে পুরোপুরি বুঝে ফেলা যায়?কে জানে!মহুয়াকে একটু হলেও বুঝে নিতে চায় তুষার।না বুঝে মানুষকে বিশ্বাস করলে সেখানে বিশ্বাসের মূল্য থাকে না।এ সত্য তুষারের চাইতে আর কে বেশি জানে??
***
মহুয়া ঘুমিয়ে আছে।তবে বেঘোরে নয়।মহুয়ার ঘুম পাতলা।ঘুমের মধ্যে একটু আওয়াজ কানে এলেই ঘুম ভেঙে যায়।মহুয়ার মনে হচ্ছে কেউ ওর চুলে আঙুল চালাচ্ছে।নরম আঙুলে চুলগুলো টেনে দিচ্ছে কেউ।আহ! কি আরাম।চুলের ভিতর যেন কেউ আদর ঢেলে দিচ্ছে।কে করছে এরকম?এমন মহান মানুষটাকে দেখার উদ্দেশ্যেই চোখ খুললো মহুয়া।চোখ খুলে আর কাউকে নয় বাবাকেই পেল।মাথার কাছে বসে বসে চুল টেনে দিচ্ছেন আফজাল সাহেব।মহুয়া মৃদু হাসে।মহুয়া যেদিন খুব ক্লান্ত থাকে সেদিন বাবা এরকম করে।কি করে যেন বুঝে
যায় বাবা।
—” মহু মা,শরীর কি বেশি খারাপ লাগে?”
—” না, বাবা।”
মহুয়া নিজের মাথাটাকে বাবার কোলে আরো গুজে দেয়।পরম শান্তিতে চোখ বুজে নেয়।
—” কোথায় ছিলা তুমি,বাবা?”
—” মসজিদে গেছিলাম।তারপর সেখান থেকে তালিমে।তাই আসতে দেরি হলো।তুই কখন এসেছিস?”
—” আটটায়।”
—” তোর মায়ের সাথে কথা বলেছিস?”
—” না।সাহস হয়নি।”
আফজাল সাহেব হাসেন।হাসতে হাসতে বলেনঃ” এতো কম সাহস নিয়ে তোর মায়ের সাথে বিদ্রোহ করতে যাস কেন?যা বলে তা মেনে নিলেই পারিস।”
মহুয়া চুপ করে রইলো।মনে মনে বললঃ” সব কি চাইলেই মেনে নেওয়া যায়?”
আফজাল সাহেব মেয়ের কোনো হোলদোল না দেখে বললেনঃ” কীরে,আবারো ঘুমিয়ে গেছিস?”
—” উঁহু। ”
—” তুষারকে দেখেছিস আজকে?কেমন লাগলো?”
—-” খুব স্বার্থপর একজন মানুষ, বাবা।”
—“স্বার্থপর!”
—” হুম।”
—” কি করে বুঝলি?”
উঠে বসলো মহুয়া।আফজাল সাহেবের মুখোমুখি বসে ওরনা ঠিক করতে করতে বললঃ” আমাকে বিয়ের প্রস্তাব কি করে দিলো জানো? বলে কি– আমি মেয়ের জন্য বিয়ে করছি।আমি যাওয়ার পর জিজ্ঞেসও করেনি আমার যেতে কোনো সমস্যা হয়েছে কী না।তাহলেই চিন্তা করো।”
আফজাল সাহেব পা গুটিয়ে বসলেন।
—” তুই কয়টা বাজে গেছিলি সেখানে?”
—” সাড়ে পাঁচটায় মনে হয়।”
—” তার মানে তুই তাকে আধঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলি।আধঘন্টা সময় মানে বুঝিস? অনেক সময়।আমি তুষারের জায়গায় থাকলে কখনোই অচেনা একটা মেয়ের জন্য এতোক্ষণ অপেক্ষা করতাম না।চলে যেতাম।অথচ,সে কিন্তু এটা করেনি।এ থেকে বোঝা যায়,তুষার খুব ভদ্র।”
অবাক হয়ে যায় মহুয়া।ও কি বলল আর বাবা কি বলল!অধৈর্য্য গলায় বললঃ” আরে বাবা, তুমি সময় দেখছো কেন? লোকটার কথা তো শুনলে ।তোমার তাকে স্বার্থপর মনে হয়নি?”
—” মোটেও না।তুই যেমন একটা দুর্ঘটনার শিকার,তেমনি সেও একটা বিশ্রি দুর্ঘটনার শিকার।তাই তার কাছ থেকে বিয়ে সম্পর্কে সাধারণ কথা-বার্তা আশা করা বোকামি।তুই একটা চরম বোকা মহুয়া।”
মহুয়া গাল ফুলালো।বাবাও কেন বিরোধিতা করছে আজ? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললঃ” বিয়েটা না করলে হয় না, বাবা?”
—” হবে না কেন,অবশ্যই হয়।”
—” তবে তোমরা এতো পাগল হয়ে যাচ্ছ কেন? আরো যাক না কয়েকটা বছর।”
আফজাল সাহেব মেয়ের মাথা টেনে কোলের উপর রাখেন।মেয়েকে কোলের উপর শুয়ে পরতে ইশারা করেন।মহুয়াও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরে।আফজাল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেনঃ” তোর মা আর আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,মা।আমরা সারাদিন যাই করিনা কেন ভিতরে ভিতরে চিন্তায় মরে যাই।তোর ভবিষ্যৎ কী,আমাদের কিছু হলে তোর কি হবে,বাইরে মানুষ তোকে বাজে কথা শুনাচ্ছে নাকি, এসব ভেবে ভেবে দম বন্ধ হয়ে আসে আমাদের। এসব চিন্তার অনেক জ্বালা মা।তাই, চিন্তামুক্ত হতেই তোকে এখন বিয়ে দিচ্ছি।”
—” আমি তোমাদের দুঃশ্চিন্তা?”
—” অবশ্যই।শুধু তুই কেন,সব সন্তানই বাবা- মার কাছে চিন্তার বিষয়।এখন তুই বুঝবি না।কিন্তু,যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি।”
আচমকা মহুয়ার চোখের উপর ভেসে উঠে মৃত্তিকার মুখ।একদম তুলতুলে একটা পুতুল।মহুয়া মৃদু হাসে।
—” কিন্তু, আমার যে ভয় করে বাবা।যদি আগের মতো হয়? যদি আবারো আমি একটা দুর্ঘটনার শিকার হই, তবে?”
—” এই যদি শব্দটাকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয় মা।এই একটা শব্দ আমাদেরকে ভয় দেখায়। জুজুবুড়ির ভয়।যতদিন না তুই এই ভয়কে জীবন থেকে ঝেরে ফেলে দিতে পারবি,ততোদিন তুই কিছুতেই সুখী হতে পারবি না।”
মহুয়া হঠাৎ করেই খুব অসহায়ের মতো করে উঠলো।বিধ্বস্তের মতো বললঃ” চাইলেই কি বাদ দেওয়া যায়?স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট অনেক, বাবা।”
—” হয়তো তোর কথাই ঠিক।চাইলেই সব বাদ দেওয়া যায় না।কিন্তু,আমার মেয়ের উপর আমার বিশ্বাস আছে।সে খুব সাহসী।সৃষ্টিকর্তা যদি পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চান,তবে আমরা কেউ তা ঠেকাতে পারব না।কিন্তু,মুখোমুখি নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারব।সেই সাহস ও ধৈর্য্য আমার মেয়ের আছে।তাছাড়া, এতো চিন্তা করছিস কেন মা? ইনশাআল্লাহ, এবার যা হবে ভালোই হবে।”
মহুয়া নিশ্চুপে চোখ বন্ধ করে।মনে মনে প্রার্থনা করে, এবার যাতে সে সৌভাগ্যের মুখ দেখে।দূর্ভাগ্যরা যেন দূরে থাকে।দুঃখরা তাকে এবং তার পরিবারকে যেন স্পর্শও না করতে পারে।।
#(পর্ব-৫)
আজ আবারো মহুয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তুষার।ঢাকা শহরে পার্কের অভাব নেই।সেরকমই একটা পার্কে বসে বসে আশপাশে নজর বুলাচ্ছে সে।এইদিকটায় মানুষের আনাগোনা কম।তাছাড়া,বেলাও খুব বেশি হয়নি।সবে তিনটা দশ বাজে।তুষার এখানে এসেছে পৌনে তিনটায়।প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে বসে আছে সে।আজকেও মহুয়া দেরি করছে।মহুয়া বলেছিল তিনটার মধ্যেই সে পার্কে থাকবে।একটা বিরক্তিযুক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো তুষার।এই মেয়ের কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই?নাকি সে ভেবে নিয়েছে, তুষারের কোনো কাজ-কর্ম নেই।তুষার ভেবে পায় না,একজন মানুষ কি করে সবজায়গায় দেরি করতে পারে।সেদিনও দেরি করলো, আজকেও দেরি করছে।উফ! অসহ্য।
প্রায় তিনটা বিশের দিকে পার্কে ঢুকলো মহুয়া।আজ সে ইচ্ছে করে দেরি করেনি।স্কুল ছুটি হয় একটায়।মহুয়ার শেষ ক্লাস ছিল সাড়ে বারোটায়।সে ভেবেছিল ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবে।তারপর খেয়েদেয়ে আস্তে ধীরে বের হবে।কিন্তু,বিধি বাম!স্কুল ছুটির পর একটা মিটিং শুরু হলো।সেই মিটিংয়ে আটকে গেল মহুয়া।বাসায়ও ফিরতে দেরি হলো ফলস্বরূপ এখানেও আসতে দেরি।মহুয়া এই চাকরিটার উপর খুব বিরক্ত।সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল নতুন একটা চাকরি পেলে এই চাকরিটা ছেড়ে দিবে।এখন মনে হচ্ছে শীঘ্রই নতুন একটা কাজ খুঁজতে হবে।স্কুল কর্তৃপক্ষ হুটহাট মিটিং ডাকে।এটা একদমই সহ্য হয় না মহুয়ার।পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ে উত্তর দিকের একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ। গাছের নিচে একটা রংচটা স্টিলের বেঞ্চ পেতে রাখা।তার উপরেই বসে আছে তুষার।হেলান দিয়ে বসে বসে মোবাইল টিপছে।মহুয়ার আজকে নিজেকে একটু অপরাধী মনে হচ্ছে।ওর জন্য প্রতিবার এই মানুষটার সময় নষ্ট হয়।মহুয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তুষারের দিকে।
—” আসসালামু আলাইকুম, তুষার সাহেব।আপনি নিশ্চয়ই অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।আমি আসলে খুবই দুঃখিত।অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনায় আটকে গিয়েছিলাম।তাই,দেরি হলো।আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি।”
তুষার মৃদু হাসলো।হেসে বেঞ্চের একদিকে চেপে বসলো।অন্যদিক খালি করে দিল মহুয়াকে।মোবাইলটাকে পকেটে রাখতে রাখতে বললঃ” ঠিক আছে কিছু মনে করলাম না।বসুন।”
মহুয়া বসার পর তুষার বেঞ্চের উপর এক-পা তুলে বসলো।তারপর মুখে বললঃ” আপনার আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
—” নাহ।কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন আপনি?”
—“প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট।আজকে খুব রাগ হয়েছিল আপনার উপর।ভেবেছিলাম আপনি আসলে মাথায় তুলে দু-একটা আছাড় মারব।কিন্তু,এসে যেভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন তাই আর কিছু বললাম না।আমার আবার খুব দয়ার শরীর।”
হেসে ফেললো মহুয়া।
—” আপনার সাহস তো কম নয়।বিয়ের আগেই আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।আমি কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ লুতুপুতু মেয়েদের মতো না।আমাকে অকারণে ধমক দিলে একেবারে খুন করে ফেলব।আমি মহুয়া,হুহ!”
তুষার জবাবে কিছু বলার আগেই কল এলো মোবাইলে।দোকানের কর্মচারী ফোন দিয়েছে।তুষার উঠে একটু দূরে চলে গেল কথা বলার জন্য।মহুয়া একা বসে একমনে তুষারের দিকে চেয়ে রইলো।আজকে এখানে দেখা করার সিদ্ধান্ত তুষারের।কি জন্য তুষার দেখা করতে চেয়েছে তা এখনো অজানা মহুয়ার।তুষার দু-দিন আগে ফোন করে অনুরোধ করেছিল মহুয়াকে যেন আজকে দেখা করে।না করতে পারেনি মহুয়া।লোকটা একটু কেমন যেন।সহজেই মিশে যায়।কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করে না।যারা নিজেদের সীমারেখা বজায় রাখে তাদেরকে আর যাই হোক খারাপ বলা যায় না।তাই,তুষারকেও মহুয়া খারাপ বলতে পারছে না।তুষারকে মাঝে মাঝেই খুব সহজ-সরল মনে হয়।আবার মাঝে মাঝে স্বার্থপর।মহুয়ার কাছে বর্তমানে তুষার একটা মস্ত ধাধা।
—” মহুয়া কি ভাবছেন?”
—” না,কিছু না।”– তুষারের কন্ঠে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে মহুয়া।
—” আচ্ছা,মৃত্তিকা কেমন আছে?”
—” ভালো।”
—” ও আপনাকে না দেখলে কাঁদে না?”
—” অনেক্ষণ না দেখলে কাঁদে।কিন্ত সমস্যা হয় না খালামনি ওকে সামলে নেয়।ও ওর দাদির খুব ভক্ত।”
—” ভাত খেয়েছেন দুপুরে?”
—” হুম।আপনি খেয়েছেন?”
মহুয়া মাথা নাড়ে।যার অর্থ সে খেয়েছে।মহুয়া এদিক- ওদিক নজর বুলিয়ে বললঃ” আজ এখানে ডাকলেন যে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন নাকি?”
—” বলব না, শুনব।”
—” কি শুনবেন?”
তুষার হেলান দিয়ে বসে বললঃ” ওইদিন মাঝ পথে কথা থামিয়ে চলে গিয়েছিলেন,মনে আছে?এরপর কি হয়েছিল তা তো আর বললেন না।সেই পুরো ঘটনাটাই আজ শুনব।আজ কিন্তু অর্ধেক বলে চলে যেতে পারবেন না।পুরোটা শেষ করতে হবে।”
মহুয়া অবাক হয়ে গেল।বিস্মিত স্বরে বললঃ”আমার আগের বিয়ের ঘটনা শোনার জন্য আজ এই জরুরি তলব!আপনার আজ কোনো কাজ নেই? অন্য একদিন শুনে নিলেই তো হয়।অনেক সময় লাগবে তো বলতে।”
তুষার বেশ আয়েশ করে বসে বললঃ” লাগুক।আজকে সব কাজ কর্মচারীদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।খালামনিকেও বলে এসেছি আজকে আমার ফিরতে দেরি হবে।আপনি রিল্যাক্সে বলুন।আজ আমার সারাদিন আপনার নামে লিখে দিলাম।আমার কোনো তাড়া নেই আজ।”
মহুয়া চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।তার মাথায় নড়চড় করছে অতীতের কিছু পোকা।সে একটা বড়সড় দম নিলো। তারপর সামনের দিকে চেয়ে বললঃ” কোথায় যেন ছিলাম?”
—” ঐ যে আবরার না কী যেন একটা নাম, ওর সাথে দেখা…
—” ওহ, মনে পরেছে।আচ্ছা,শুনুন তাহলে।”
***
আবরারের মায়ের নাম বিলকিস বেগম।মহুয়াকে তার পছন্দ হয়েছে খুব।তিনি কিছুদিন ধরেই ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন।সেদিন আজিমপুরে মূলত মেয়ে দেখতেই গিয়েছিলেন।কিন্তু,মাঝপথেই দূর্ঘটনার শিকার হন।মহুয়াকে দেখার পর থেকে আর কোনো মেয়ে মনে ধরছে না।আজিমপুর থেকে ফিরেও দুটো মেয়ে দেখেছেন।কিন্তু,তাদের সবকিছুই কেমন যেন মেকি মনে হয়েছে।মনে হয়েছে এরা একজনও স্বাভাবিক আচরণ করছে না।বিলকিস বেগম অনেক ভেবেচিন্তে মহুয়াদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠালেন।তার একটাই ছেলে।একটা সোনার টুকরা মেয়ে না ঠিক করলে চলবে কেন?
মহুয়া রাতের বেলা বসে বসে ছবি দেখছিল।পরীক্ষার পর থেকে দিনের বেলা ব্যস্ত থাকলেও রাতের বেলা অলসের মতো পরে থাকে মহুয়া।হাতে কোনো কাজ নেই।ঘরের কাজে আগ্রহ নেই।মহুয়া জীবনে রান্নাঘরে কতবার গেছে তা হাতে গুনে বলতে পারব।রান্নাবান্নার কাজে সে প্রচন্ড অলস।পানি গরম ছাড়া আর কিছুই পারে না।ওকে এক প্রকার অপদার্থই বলা যায়।তবে,এতোটা অলস হওয়ার পিছনে আফজাল সাহেবের অবদান কম নয়।সাবিনা বেগম বারবার মেয়ের অদক্ষতা প্রচার করে বকাবকি শুরু করলেই তাকে থামিয়ে দিতেন আফজাল সাহেব।মুখে বলতেনঃ” আহ,সাবিনা থামো তো।রান্না করার সময় আসলে মেয়ে এমনিতেই শিখে যাবে।মায়ের কাছে থাকলে মেয়েরা একটু অলস হয়ই। নিজের ঘাড়ে পরলেই সব কিছু শিখে যাবে।দেখে নিও।”
মহুয়া যখন বসে বসে একটা হলিউড মুভি দেখছিল,তখনই ঘরে আসেন সাবিনা বেগম।মহুয়া একনজর মায়ের দিকে তাকালো।আজকে কেন যেন মাকে একটু বেশিই খুশি খুশি দেখাচ্ছে।সে ল্যাপটপে নজর রেখেই বললঃ” কী ব্যাপার মা? তোমাকে এতো খুশি খুশি লাগছে কেন?”
—” একটা ঘটনা ঘটেছেরে মহুয়া।”
মহুয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে সাবিনা বেগমের দিকে ঘুরে বসে।মুখে বলেঃ” কি ঘটলো আবার?”
—” ওইদিন একটা মহিলাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলি না,ওই যে….
—” মনে আছে আমার।কি হয়েছে ওনার?”
—” তার ছেলের জন্য তোকে চেয়েছেন উনি।ছেলেটা কি সুন্দর, তাই না? আর অনেক ভদ্র,মা ভক্ত ছেলে একদম।ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।সংসারে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই।মা- ছেলে এই দুজন নিয়েই পরিবার।ছেলের একটা পালক বোন আছে।বিয়ে হয়ে গেছে তার।আবরারের বাবা মারা গেছে অনেক আগে,তারপর…..
—” থামো মা”— সাবিনা বেগমকে থামিয়ে দেয় মহুয়া।আরেক ছেলে নাড়ি-নক্ষত্র শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না তার।এরকম বিয়ের প্রস্তাব বহুবার এসেছে মহুয়ার জন্য।প্রত্যেকবার পড়ালেখার দোহাই দিয়ে আটকে দিয়েছে মহুয়া।কিন্তু এবার কি করবে? এবার তো বিয়ে আটকানোর মতো কোনো অজুহাত নেই মহুয়ার কাছে।কি যে করবে মহুয়া।বেশ চিন্তায় পরে যায় সে।কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমাকে ওই ছেলের মা একদিন দেখেছে।এতেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলো! খোঁজ খবর নিয়েছে আমার সম্পর্কে? ”
—” তা কি আর না নিয়েছে।নিশ্চয়ই আড়ালে আবডালে নিয়েছে।তোর বাবাও নয়া পল্টনে ছেলেদের এলাকায় যেয়ে খবর নিয়ে এসেছে।ছেলের কোনো খারাপ রেকর্ড নেই।”
অবাকের আতিশয্যে সোজা হয়ে বসে মহুয়া।গলায় অবাকের রেশ ছড়িয়ে বলেঃ” তোমরা চুপিচুপি এতোকিছু করে ফেলেছো?এখন বলতে এসেছ কেন? বিয়ের তারিখ ঠিক করে একেবারে বিয়ের দিনই বলতে।আমি তৈরি থাকতাম।”
সাবিনা বেগম মুখ বাকিয়ে ঝাঝালো স্বরে বললেনঃ” খোচা মেরে কথা বলবি না ফাজিল মেয়ে।ছেলেটা ভালো।এইখানে বিয়ে হলে ভালো থাকবি তুই।তোর বাবা- চাচারা সবাই ছেলে দেখেছে।তাদের খুব পছন্দ।ছেলের পক্ষের কোনো চাহিদা নেই।এরকম ছেলে আজকাল পাওয়াই যায় না।তোর কোনো কথাও এবার শুনব না।আল্লাহ যদি চায় তবে এখানেই বিয়ে হবে তোর।”
সাবিনা বেগম উঠে চলে গেলেন।মহুয়া থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তাহলে কি বিয়েটা করতেই হবে? ব্যক্তিগতভাবে মহুয়ার কোনো পছন্দ নেই।বাবা- মায়ের উপর তার অগাধ বিশ্বাস। তারা যা করবে তাই সৌভাগ্য বয়ে আনবে– এই কথাটাই বিশ্বাস করে মহুয়া।কিন্তু,তবুও বিয়ে নিয়ে খুব ভয় মহুয়ার।বিয়ের পর নিশ্চয়ই রান্নাঘরে যেতে হবে।হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে।কাপর কাঁচতে হবে,ঘর ঝাড়ু দিতে হবে,বিছানা গোছাতে হবে— কতকাজ।উফ! অসহ্য! কোলবালিশ জড়িয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে মহুয়া।কি হয় বিয়ে না করলে।মা কি জানে না তার মেয়েটা কত অলস? সে কি এসব কাজ করতে পারবে?
অবশেষে আবরারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েই গেল মহুয়ার।বিয়ের আগে ট্রেনিং সেন্টারের কাজটা ছেড়ে দিলো মহুয়া।নয়া পল্টন থেকে প্রতিদিন এসে কাজ করা সম্ভব না ওর পক্ষে।বিয়ের পরে ভালো কোনো চাকরি পেলে বরং ওটাই করবে।আবরারের সাথে বিয়ের আগে একবার মাত্র দেখা হয়েছে মহুয়ার।তাও আংটি পরানোর দিন।মহুয়া ঘোমটার আড়াল থেকে একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখেছিল।কেমন গম্ভীর একটা মুখ আবরারের।মহুয়া ভেবেছিল মানুষটাই বুঝি এরকম গম্ভীর।কিন্তু,কে জানতো ওর ভাবনাটাই ভুল ছিল!আবরারের গম্ভীর চেহারার পিছনেই অন্যকিছু লুকিয়ে ছিল।
অবশেষে সেই পৌষ মাসের মাঝামাঝিতে আবরারের সাথে মহুয়ার বিয়েটা হয়েই যায়।এক পাতাঝরা রিক্ত বিকেলে বাবার হাত ছেড়ে মহুয়া আঁকড়ে ধরে আবরারের হাত।যাত্রা করে এক নতুন ঠিকানায়।সাথে পুঁজি করে নিয়ে যায় একচোখ স্বপ্ন,কিছটা লজ্জা,একটু ভয়-সংকোচ আর এক আকাশ মন খারাপ।।
চলবে…