#যাত্রাশেষে (পর্ব-৬+৭)
#হালিমা রহমান
মহুয়া বাস বা মাইক্রোবাসে যাতায়াত করে খুব বেশি একটা আরাম পায় না।এগুলোতে উঠলেই ওর ঘুম চলে আসে।সে রিকশা দিয়েই চলাচল করে আনন্দ পায়।নয়া পল্টনে পৌঁছানোর আগেই মহুয়া ঘুমিয়ে পরলো।কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল তা নিজেই জানে না।আবরারদের বাড়ির সামনে পৌঁছে যখন মহুয়াকে ডাক দেওয়া হলো, তখন সে সহসা কয়েক মিনিট আশপাশের কোনোকিছু ঠাওর করতে পারলো না।এ নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করতে ছাড়েনি কেউ।একগাদা মানুষজন ঠেলে,হাজারটা নিয়মকানুন পালন করে মহুয়া যখন আবরারের ঘরে বসেছে ; তখন ঘড়িতে প্রায় দশটা বেজে গেছে।পৌষ মাসের শীতেও অসহ্য গরম লাগছে মহুয়ার।গরমে,ঘামে মাথার ছোট চুলগুলো কপালের দু-দিকে লেপ্টে আছে।কানের দুল,টিকলি,চুড়ি,হার, শাড়ি —সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে একটা ভারী বস্তার মতো লাগছে।আহ!বিয়েতে এতো কষ্ট কেন?বিয়ে একটা রহমত-বরকতের অনুষ্ঠান।অথচ,এই শান্তির অনুষ্ঠানটাকেই হাজারটা নিয়ম-কানুনে বন্দি করে ঝামেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।গায়ে হলুদ,মেহেদী,বিয়ের সাজ,বৌ-ভাত—এতোকিছুর দরকার আছে?এর চাইতে কাজির সামনে তিনবার কবুল বলে ফেললেই তো হয়।ব্যাস,ঝামেলা শেষ।সাজানো বিছানার এককোনে বসে এসব কথাই ভাবছিলো মহুয়া।সেই গায়ে হলুদের আগের রাত থেকে সে ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি।মাথা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।ক্ষিদেও পেয়েছে খুব।দুপুরে ভালোমতো খেতে পারেনি।কিভাবে খাবে?এই চুড়ি-শাড়ির জন্য শান্তিতে খাওয়া যায়?মহুয়া নিজের হাত ছাড়া আরেকজনের হাতে খেতে পারে না।কেমন যেন লাগে।তাই,দুপুরে ছোট চাচি খাইয়ে দেওয়ার পরেও পেটভরে খেতে পারেনি।মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখলো।মাঝারি আকারের একটা ঘর।ঘরের দুটো জানালার একটা খুলে রাখা। খুলে রাখা জানালার সাথেই লাগোয়া বিছানা।তার পাশে একটা টেবিল।এককোনে একটা আলমারি,একটা ড্রেসিং টেবিল।আরেকপাশের দেয়ালজুরে একটা বড় বুক-সেলফ।মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝারা দিল।বিশাল বিছানাটা রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো।দূর্ভাগ্যবশত, এই দুটো ফুলের একটাও পছন্দ না মহুয়ার।সে একদম সহ্যই করতে পারে না এই দুটো ফুল।মহুয়া এগিয়ে যেয়ে বইগুলো দেখলো। বেশিরভাগ কবিতার বই।মহুয়া নাক ছিটকে ফেললো।কবিতা সে পছন্দ করে না।পছন্দ করে না বললে ভুল হবে,আসলে কবিতা ও বুঝতেই পারেনা।মহুয়ার পছন্দ উপন্যাসের বই।মোটা মোটা বইগুলো পড়ার সময় অন্য এক জগতে চলে যায় মহুয়া।পড়তে পড়তে আনমনে প্রায়ই ভাবে—” আহা,জীবনটা যদি উপন্যাসের মতো হতো!”
মহুয়া ঘরের উত্তর দিকের জানালাটা খুলে দিল।দো-তলার এই ঘর থেকে নিচে তাকালে একটা ছোট্ট গলি দেখা যায়।মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে দেখলো।জানালার ওপাশে এক-দেড়হাত দূরেই একটা বহুতল ভবন চোখে পরে।অন্ধকারেও বুঝতে পারলো, এখানে এখনো কেউ থাকে না।বাড়িটা নতুন করছে।মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।ভাগ্য ভালো পাশের বাড়িটা খালি।নাহয়,জানালাটা খোলাও যেত না।
খট করে খুলে গেল দরজা।মহুয়া ভেবেছিলো হয়তো আবরার এসেছে।কিন্তু,না। পিছু ফিরে দেখলো বিলকিস বেগম এসেছেন। তার সাথে আরেকটা মেয়ে।বয়সে আবরারের বড়ই হবে।মহুয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল।শত হলেও সে নতুন বউ।এভাবে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করলে নিশ্চয়ই কেউ ভালো চোখে দেখবে না।মহুয়া একটু দ্রুতপায়ে এসে বিছানায় বসে পরলো।বিলকিস বেগম ও তার সাথে আসা মেয়েটি শব্দ করেই হেসে ফেললো।মহুয়া বুঝতে পারে না,এ বাড়ির সবাই অকারণে এতো হাসে কেন।বিলকিস বেগম এসে খাটের কোনে বসলেন।একদম মায়েদের মতো আদুরে স্বরে বললেনঃ”তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে,মা?”
মহুয়া এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়।
বিলকিস বেগম আবারো জিজ্ঞেস করলেনঃ”ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? ”
মহুয়া কিছু না বলে চুপ করে রইলো।তার সত্যি ক্ষিদে পেয়েছে।চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ।বিলকিস বেগম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ” আফিয়া যা তো,ভাতের প্লেটটা নিয়ে আয়।”
আফিয়া চলে গেলে বিলকিস বেগম বললেনঃ”ও তোমার ননাস হয়।আমার বড় মেয়ে।ওকে তুমি আপা বলেই ডেকো।”
মহুয়া বুঝলো এটাই আবরারের সেই পালক বোন।যার কথা মা বলেছিল।ভাত নিয়ে আসার পর বিলকিস বেগম নিজের হাতে খাইয়ে দিতে চাইলে,হতাশ হলো মহুয়া।এইবার নিজের হাতে খেতে না পারলে বোধহয় ও মরেই যাবে।মহুয়া তাই সাহস নিয়ে মিনমিন করে বলেই ফেললোঃ” আমি নিজের হাতেই খাই।”
—” নিজের হাতে খেতে পারবে?”
—” জ্বি।আমি নিজের হাত ছাড়া অন্যকারো হাতে খেতে পারি না।”
—” আচ্ছা,খাও।”
পেটভরে শান্তিতে খাওয়ার পর আফিয়ার সাথে পরিচিত হলো মহুয়া।আফিয়াকে বেশ মনে ধরলো মহুয়ার।হাসি-খুশি উচ্ছল একটা মেয়ে।কথা বলার সময় হাসি লেগেই থাকে মুখে।আফিয়া অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিলো মহুয়াকে।বিলকিস বেগমের পছন্দ-অপছন্দ,আবরারের স্বভাব,বাড়ির নিয়ম- কানুন।আবরারের নাকি অনেক রাগ।রাগলে মাথা ঠিক থাকে না।রাগের মাথায় কাকে কি বলে বসে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না।এসব কথা শুনে মহুয়া মনে মনে হাসে।রাগ দেখাবে মহুয়ার সাথে? হুহ! এতো সাহস! আবরারের আর কিইবা মেজাজ।মহুয়া রাগ দেখালে সামলাতে পারবে তো? ছোটবেলা থেকেই মহুয়া হুটহাট রেগে যায়।রাগ তার নাকের ডগায় থাকে।আর রেগে গেলে চিল্লাচিল্লি করে ঘর-দোর উল্টে -পাল্টে ফেলে না।চোখ-মুখ ফুলিয়ে চুপ করে থাকে।তারপর হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে।এভাবে, সাবিনা বেগমের কতো কাঁচের জিনিস যে ভেঙে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই।বিনিময়ে মায়ের হাতের চর- থাপ্পড়ও কম খায়নি।কিন্তু,তবুও এই বদ অভ্যাস যায়নি।দিনদিন যেন এ স্বভাব বেড়েই চলছে।
আফিয়া চলে যাওয়ার পর মহুয়া বিছানায় হাত- পা ছড়িয়ে বসলো।আফিয়া যাওয়ার আগে একটা পাতলা সুতির শাড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে।শাড়ি পরতে মহুয়ার ভালোই লাগে।সে ঠিক করে রেখেছে,এখন থেকে শাড়িই পরবে।শাড়ি না পরলে বউ বউ লাগে নাকি?আচ্ছা,এ বাড়ির মানুষ কেমন হবে? ভালো নাকি খারাপ? নাটক- সিনেমায় যেমন দেখায় শ্বাশুড়ি বউদের উপর অত্যাচার করে,দিন-রাত ঝগরা করে, স্বামী অত্যাচার করে—এমন হবে? মহুয়ার কপালে ভাঁজ পরে।হুহ! এমন হলে মহুয়া সেই সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো কখনোই মুখ বুজে সহ্য করবে না।সংসারের কপালে ঝাড়ু মেরে চলে যাবে।মহুয়া কি মধ্যযুগীয় মেয়ে নাকি?সে আধুনিক মেয়ে।ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।সে মানিয়ে নেওয়া নয় সমঝোতায় বিশ্বাস করে।কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এসব ছাড়াছাড়ি চিন্তা মাথায় আসায় নিজেকেই মনে মনে আবার ধমক দিলো মহুয়া।ছিঃ! বিয়ের প্রথম দিনেই কে এসব ভাবে।মহুয়া ঘড়ির দিকে তাকালো।এগারোটা বেজে গেছে। আবরারের আসার নাম-গন্ধ নেই।মহুয়ার রাগ জমলো আবরারের উপর।আশ্চর্য মানুষ তো! মহুয়াকে এভাবে জাগিয়ে রাখার মানে কি? আরো দুবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এককোনে শুয়ে পরলো মহুয়া।দিন-দুনিয়া ভেঙে ঘুম আসছে।কারো জন্য অপেক্ষা করে ঘুমকে অবহেলা করতে পারবে না মহুয়া।ঘুম এসেছে,এখন সে ঘুমাবে।বাকি সবাই জাহান্নামে যাক।
***
বিয়ের পর দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেছে।কিন্তু,স্বামী নামক প্রাণীর সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি মহুয়া।সহজ হওয়া তো দূরের কথা, খুব বেশি কথাই হয়না দুজনের মাঝে।এই পাঁচদিনে আবরারের সাথে মহুয়ার কথা হয়েছে দশবারের কম।বিয়ের দিন রাতে আবরার কখন ঘরে এসেছে,কখন ঘুমিয়েছে এসবের কিছুই জানে না মহুয়া।সকালে ঘুম ভেঙেছিলো বেশ বেলা করে।প্রায় নয়টার দিকে চোখ খুলে মহুয়া আবিষ্কার করে সে এখনো ঘরে একা।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পরে।শুক্রবার ছাড়া এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস নেই।মহুয়া তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকে।প্রথমদিনই এতো দেরি করে ঘুম থেকা উঠা মোটেও ঠিক হয়নি।ভাগ্যিস এখানে মা নেই।মা থাকলে নিশ্চিত এখন দু-চারটে চর লাগিয়ে দিত।
সকাল থেকেই একটু বেশি গরম পরেছে।শীতে গরম পরবে কেন? গরমদের জায়গা শুধু গ্রীষ্মে।মহুয়া সকাল সকাল উঠেই গোসল করে ফেললো।ছোট্ট বাথরুমে শাড়ি পাল্টাতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে।হালকা মেরুন রঙের শাড়ির অর্ধেকটা ভিজিয়ে ফেললো পরতে যেয়ে।আগের দিনের ব্যবহার করা শাড়ি ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলো মহুয়া।আবরারের বারান্দাটাও মোটামুটি বড়ই।এককোনে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে।মহুয়ার নজর কাড়লো পাশের বাড়ির বারান্দাটা।বেশ বড় সেটা।অনেকগুলো গাছ লাগানো যাবে।মহুয়া চুল থেকে গামছা খুলে চুল ঝারতে ঝারতে ঘরে ঢুকলো।ঢুকেই আবরারকে দেখলো।বিছানার উপর বসে আছে পা তুলে।বিয়ের দিনের পর এই প্রথম মুখোমুখি দেখা।মহুয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।গামছা পাশের চেয়ারের উপর রেখে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে ঘোমটা দিলো।মহুয়াই বোধহয় একমাত্র মেয়ে,যার সাথে বিয়ের রাতে স্বামীর দেখা তো দূর কথাই হয়নি।আবরার মহুয়ার দিকে একবার নজর দিয়ে বললঃ” আপনি কি সবসময়ই দেরি করে উঠেন?”
—” জ্বি, না।ক্লান্ত থাকার কারণে আজ উঠতে দেরি হয়ে গেছে।আমি দুঃখিত।”
—” ঠিক আছে।মা আপনাকে খাওয়ার জন্য ডাকছে।আপনার তৈরি হতে কি আরো সময় লাগবে?”
—” জ্বি,না।”
—“আমি তাহলে আপাকে পাঠাচ্ছি।ওর সাথেই চলে আসুন।”
উঠে চলে যায় আবরার।দুপুরের আগ পর্যন্ত আর কোনো কথা হয়না দুজনের মাঝে।সারাদিন অনেক মানুষের আনাগোনার ভীড়েও একটা কথা মহুয়া কিছুতেই মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে পারে না।আবরার কি এমনই চুপচাপ থাকে? নাকি মহুয়াকে দেখলেই চুপচাপ হয়ে যায়?আবরার কি বিয়েতে রাজি ছিলো না?
এরকম দূরে দূরে থেকেই পাঁচদিন কেটে গেছে।বিয়ে উপলক্ষে আবরার ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছিলো মাত্র তিনদিন।বড় করে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান হয়নি।এ নিয়ে অবশ্য অভিযোগ করেনি মহুয়া।এমনিতেও এসব অনুষ্ঠানকে ঝামেলা মনে হয় ওর কাছে। দু-দিন যেয়ে থেকে এসেছে বাড়িতে।বাড়িতে আত্মীয়ের দল কমে এসেছে।পুরো বাড়িতে সারাদিন একা একা থাকে মহুয়া।বিলকিস বেগম বিয়ের ঝামেলায় একটু অসুস্থ হয়ে গেছেন।অসুস্থ থাকলেও মহুয়াকে কোনো কাজ করতে দেন না।নতুন বউ থাকুক একটু আরামে।শ্বাশুড়ির এই আহ্লাদে বেশ সন্তুষ্ট মহুয়া।সারাদিন শুয়ে- বসে থাকতে কার না ভালো লাগে?তবে,আবরারকে এখনো বুঝতে পারে না মহুয়া।সারাদিনের মাঝে কথা হয়না বললেই চলে।রাতে বাড়ি ফিরার পর মহুয়া লক্ষ্মী বউয়ের মতো আবরারের সব পোশাক গুছিয়ে রাখে।মহুয়া তার মাকে সবসময় দেখত বাবার জন্য লেবুর শরবত করে রাখতে।আফজাল সাহেব বাজারে গেলেও সাবিনা বেগম আগে আগেই একগ্লাস লেবুর শরবত তৈরি করে রাখতেন।বাজার থেকে ফিরার পর এই শরবতটাই যেন আফজাল সাহেবের পুরো ক্লান্তি দূর করে দিত।মায়ের এই ছোট-খাটো যত্ন দারুন লাগতো মহুয়ার। তাই,আবরারের ক্ষেত্রেও মহুয়া একই ধরনের চেষ্টা করে।অফিস থেকে ফিরার পরেই একগ্লাস শরবত এগিয়ে দেয় আবরারের দিকে।হাত-মুখ ধোয়ার পর ঘরে পরার পোশাক এগিয়ে দেয়।কখন কি দরকার পরে, আবরারের পছন্দের খাবার কি, পছন্দের রঙ কি —এসব আগ্রহ নিয়ে জানার চেষ্টা করে।কিন্তু,কিছুদিনের মধ্যেই একটা জিনিস চোখে পরে মহুয়ার।ও যতটুকু আগ্রহ নিয়ে ভাব জমাতে চায়, ততোটা আগ্রহ আবরারের মাঝে দেখা যায় না।আবরার যেন ঘরের বাইরেই ভালো থাকে।ঘরের বাইরে থাকলেই আবরারকে হাসি-খুশি দেখা যায়।মহুয়ার সাথে না পারতে কথা বলে না।যতক্ষন কথা বলে ততোক্ষণ কপাল কুঁচকে রাখে।মহুয়া খুব সুন্দর করে কথা বললেও বিনিময়ে সামান্য ভালো কথা আসে না আবরারের থেকে।
মহুয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে।আবরারের কি বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিলো?আবরারের আচরণ যেন স্পষ্ট জানান দেয়,সে মহুয়াকে নিয়ে খুশি নয়।মহুয়ার সাথে সে সহজ হতে চায় না।আবরার আড়ালেই থাকতে চায়।সবার থেকে নয়।শুধুমাত্র মহুয়ার থেকে।মহুয়ার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
#(পর্ব-৭)
বিলকিস বেগম আরাম করে খাটের এককোনে বসে আছেন।তার দু-হাত সামনেই আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে মহুয়া।বিলকিস বেগমের প্রতি তার ভয় নয়,শ্রদ্ধা কাজ করে।সাবিনা বেগমের চাইতেও বেশ স্নেহপরায়ণ তিনি।কিন্তু,সমস্যা একটাই।বিলকিস বেগম কথা কম বলেন।তাই মহুয়া তার সাথে কথা বলতে একটু অপ্রস্তুত বোধ করে।বিলকিস বেগম মহুয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেনঃ”তোমার কি এখানে কোনো সমস্যা হয় মহুয়া?”
—” জ্বি,না আম্মা।”
—” সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলো, কেমন?আমি তো তোমার মায়ের মতোই।”
মহুয়া মাথা নিচু করে রাখে।বিলকিস বেগম আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেনঃ” তুমি কি রাঁধতে জানো?”
মহুয়া ঢোক গিলে।মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করে।যা ভয় পেয়েছিলো ঠিক তাই।আজ থেকেই বোধহয় রান্নাঘরে যেতে হবে।আহ! যন্ত্রণা। ভালো লাগে না এসব।
—“মহুয়া,মহুয়া।”
—“জ্বি,আম্মা।”
—” কী ভাবছো?”
—” না,আম্মা। কিছু না।”
বিলকিস বেগম মহুয়ার নীরবতা হয়তো বুঝতে পারেন।তিনি মৃদু হেসে মাথার নিচে বালিশ রেখে শুয়ে পরেন।নরম গলায় বলেনঃ” তুমি কোনো রান্নাবান্না জানো না,তাইনা?”
মহুয়া মাথা নিচু করে বলেঃ”শুধু পানি গরম করতে জানি।তাছাড়া আর কিছু জানি না।”
—” কেন? শিখতে ইচ্ছে হয়নি কখনো?”
—” উঁহু।আমি আগুন খুব ভয় পাই।তাছাড়া,পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম বলে বাবা-মা জোর করে চুলার কাছে পাঠায়নি।”
বিলকিস বেগম একটু চিন্তিত হয়ে পরেন।সবাই আশা করে তার ঘরের বউ কাজে পটু হবে।কিন্তু,মহুয়া যে ঘরের কাজে একদম অপদার্থ তা বুঝতে বাকি থাকে না।মেয়েটা আবার খুব অলস নয় তো? অলস মানুষ নিয়ে ঝামেলা।অপদার্থ, বোকা দিয়ে কাজ করানো যায়।কিন্তু অলস মানুষ দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও কাজ করানো যায় না।এরা সবসময় নিজের গা বাঁচিয়ে চলতে চেষ্টা করে।এরকম মানুষ দিয়ে আর যাই চলুক সংসার চলে না।
—” আম্মা,আপনি শিখিয়ে দিলে আমি কাজ করতে পারব।”
মহুয়ার কথায় ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন বিলকিস বেগম।গভীর ভাবনায় থাকার কারণে সহসা মহুয়ার কথা বুঝতে পারেন নি।তাই আবার প্রশ্ন করেনঃ” কি বললে?”
—” আপনি যদি শিখিয়ে দেন, তবে আমি সব কাজ করতে পারব।একটু সময় লাগবে শুধু।”
—“তাহলে এখন থেকে আমি যখন রান্না করব,তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকো।কয়েকদিন দেখলেই শিখে যাবে।রান্নাবান্না এতো কঠিন কিছু নয়।”
মহুয়া চুপ করে থাকে।শ্রদ্ধেয় শ্বাশুড়ি মা তো বলে দিলেন,রান্না কঠিন কিছু না।কিন্তু,আসলে এটা যে কি ঝামেলার কাজ তা তো বললেন না।
মহুয়ার চিন্তিত মুখ দেখে মৃদু হাসেন বিলকিস বেগম।মহুয়াকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বলেনঃ” এতো চিন্তা করো না।আমি কিন্তু শ্বাশুড়ি হিসেবে খুব খারাপ না।কাজ না করলে খুব বেশি বকাবকি করব না।আস্তে ধীরে শিখে নিয়ো।আমি আর কয়দিন।আমার পরে তো তুমিই সংসারটাকে আগলে রাখবে।যত তাড়াতাড়ি শিখবে, ততোই তোমার লাভ।”
মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।এই বাড়িতে এই মানুষটাকে অসাধারণ লাগে মহুয়ার কাছে।বিলকিস বেগমের আচরণ, স্নেহ দেখে শ্বশুড়বাড়ি সংক্রান্ত অনেক ভয়-ভীতি কেটে গেছে মহুয়ার।বিলকিস বেগম না থাকলে একা বাড়িতে আবরারের সাথে সে বোধহয় দুই দিনও থাকতে পারতো না।মহুয়া যখন একা থাকে তখন প্রায়ই মনে মনে ভাবে- আবরারও কি বিলকিস বেগমের কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে নাকি?নাহয় মা-ছেলের মাঝে এতো অমিল কি করে হয়?
***
দিনগুলো নিজেদের মতো করে কেটে যাচ্ছে।আবরার আগের থেকে এখন একটু বেশি কথা বলে।খুব বেশি না কিন্তু।সামান্য পরিবর্তন হয়েছে তার।বিয়ের পর কয়েকটাদিন মহুয়া খুব ভাব জমাতে চাইতো আবরারের সাথে।সেধে সেধে কথা বলতো।কিন্তু যখন দেখলো আবরার এসব কাজে খুব বিরক্ত হচ্ছে, তখন মহুয়া নিজেই আবার সরে আসলো।আবরারের আচরণ তার সম্মানে আঘাত করেছিলো। মহুয়া খুব আত্মমর্যাদা রক্ষা করে চলতে জানে।আবরারের অনবরত এড়িয়ে যাওয়া দেখে প্রথমেই মহুয়ার মাথায় যেই কথাটা এলো,তা হলো— মহুয়া কি ফেলনা কিছু?নাকি মর্যাদাহীন নির্লজ্জ মেয়ে?না, এমন কিছুই নয় সে।তবে কেন মর্যাদা বিকিয়ে কথা বলবে সে?সম্পর্ক সহজ করার দায়-দায়িত্ব কি একা মহুয়ার?
মহুয়া কিছুদিনের মধ্যেই আবরারকে নিজের চিন্তা থেকে বাদ দিয়ে দিলো।আবরারকে বাদ দিয়ে বিলকিস বেগম ও ঘরটাকেই আপন করে নিলো।মহুয়ার দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কেটে যায় এখন।সারাদিন খুব বেশি কাজ থাকে না।বিলকিস বেগম যখন রান্না করেন তখন দাঁড়িয়ে থাকে।মাঝে মাঝে নিজে নিজেও চেষ্টা করে।এই তো সেদিন, একা একা ভাতের মাড় ফেলতে যেয়ে ডানহাত পুড়িয়ে ফেললো।হাত পুড়িয়ে সে কি চিৎকার তার।লাফিয়ে লাফিয়ে কেঁদেছে।বাবা-মায়ের স্নেহের চাদরে বড় হওয়া মহুয়ার জন্য এসব যন্ত্রণা বেশ নতুন।তাই ছেলেমানুষীও তার মাঝে বেশিই দেখা যায়।মহুয়ার পোড়াহাত দেখতে যেয়ে বেশ উভয় সংকটে পড়ে যান বিলকিস বেগম।একদিকে মেয়েটা ব্যাথায় কাঁদছে আবার ঔষধও লাগাতে দিচ্ছে না।শেষে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর শান্ত হয় মহুয়া।দুপুরে শ্বাশুড়ির হাতে ভাত খেয়েছে।ব্যাথার তীব্রতায় বিকালের দিকেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে মহুয়ার।আবরার বাড়ি ফিরার আগ পর্যন্ত বিলকিস বেগম মহুয়ার পাশেই বসা ছিলেন।আবরার ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে দেখে মহুয়ার এই অবস্থা।সে জামা-কাপড় পাল্টে মহুয়ার পাশে বসে।বিলকিস বেগমকে ঘরে চলে যেতে বলে নিজ হাতে প্লেটে ভাত নেয়।জ্বরে কাঁপতে থাকা মহুয়ার গায়ে আলগোছে হাত বুলিয়ে বলেঃ” তোমার কি খুব খারাপ লাগছে মহুয়া?ডাক্তারের কাছে যাবে?”
একটু যত্ন।আবরারের কথায় কিছু একটা মেশানো ছিলো যা মহুয়ার কানে খট করে বাজে।ক্ষনিকের জন্য জ্বরে নয় ঘোরে কেঁপে উঠে মহুয়ার শরীর।আবরার স্বাভাবিকভাবে কথা বলল?মহুয়া মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করে তাদের বিয়ের বয়স।বিয়ের বয়স বোধহয় একমাস হয়েছে।এই একমাসে এই প্রথম আবরার নিজ থেকে একটু ভালোভাবে কথা বলল।এর আগে যতবারই কথা বলেছে ততোবারই মহুয়ার কথার প্রেক্ষিতে কথা বলেছে।সচরাচর নিজ থেকে কথা বলতো না সে।আজ কি হলো?এতো পরিবর্তন যে?
—“মহুয়া,তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো?মহুয়া?”
—” না,ঘুমাইনি।”
মহুয়া আবরারের দিকে মুখ করে শোয়।আবরারের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ে সুন্দর একটা ক্লান্ত মুখ।আবরারের চেহারাটা খুব সুন্দর।এতোদিন ভালোভাবে দেখেনি মহুয়া।তাই হয়তো চোখে পড়েনি।আজ অসুস্থ শরীরে আবরারকে দু-চোখ ভরে দেখে মহুয়া।অর্ধেক খুলে রাখা চোখে এদিক-ওদিক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে।সুন্দর,বলিষ্ঠ একটা পুরুষ তার স্বামী –এই কথাটা মাথায় আসতেই আনন্দে ভরে যায় মহুয়ার মন।
আবরার চোখ ছোট ছোট করে মহুয়াকে দেখে।এই মেয়ের সমস্যা কী?এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?কখনো চোখ খুলে তাকিয়ে আছে আবার কখনো অর্ধেক চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।কি এতো দেখছে সে?আবরার আরো একবার মহুয়াকে ডাক দেয়—-” মহুয়া।”
—” হুম?”
—” ভাত খেয়েছো?”
—” উঁহু।”
—” তাহলে,উঠো ভাত খাবা।”
—” আমার ডান হাত পুড়ে গেছে।হাত নাড়তেই পারছি না।ভাত খাব কি করে?”
—” উঠো, আমি খাইয়ে দেই।তাড়াতাড়ি উঠো।তোমাকে খাওয়ানোর পর আমি খাব।সকাল সকাল ব্যাংকে যেতে হবে আমাকে।তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে।উঠেছো?”
ঐ ঘটনার পর থেকে এখন প্রায়ই মহুয়ার সাথে কথা বলে আবরার।আগের মতো একদম চুপ করে থাকে না।কখনো কখনো অফিসে যাওয়ার আগে মহুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করে—” এই মহুয়া,তোমার কিছু লাগবে?কি আনব আসার পথে?”
আবার ছুটির দিনে মহুয়া যখন কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে ব্যস্ত হাতে রান্না করে তখন প্রায়ই আবরার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে।আগে তো সে ছুটির দিনে বাড়িতেই থাকতো না।কাজের দোহাই দিয়ে বাইরে চলে যেত।আবরারকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগে মহুয়ার।নাকের পাটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।কান গরম হয়ে যায়।লোকটার নজর খুবই খারাপ।এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে?আশ্চর্য! মহুয়ার কি লজ্জা লাগে না?নাকি অসভ্য লোক ধরেই নিয়েছে মহুয়ার কোনো লজ্জা-টজ্জা নেই।
রান্নাঘরের কাজগুলো শিখতে খুব বেশি সময় লাগেনি মহুয়ার।রান্না করা খুবই সহজ।চুলার উপর হাঁড়ি-পাতিল তুলে চামচ দিয়ে দু-তিনবার নাড়াচাড়া করলেই রান্না শেষ হয়ে যায়।মহুয়ার রান্না এখন খুব মজা হয়।বিলকিস বেগম যখন আঙুল চেটে খায় আর মহুয়ার প্রশংসা করে তখন আনন্দে তার মুখে চওড়া হাসি ফুটে।আবরারের কন্ঠে খুব বেশি একটা প্রশংসা শোনা যায় না।সে নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে উঠে যায়।তার ভাবটা যেন এই, একরকম রান্না হলেই চলবে।মহুয়া মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়।দু-একদিন একটু প্রশংসা করলে কি হয়?বিয়ের এতোদিন পার হয়ে গেলেও সে এখনো পুরোপুরি আবরারকে বুঝতে পারে না।মাঝে মাঝে আবরারের আচরণ দেখলে মনে হয়, সে মহুয়ার প্রতি আকৃষ্ট।আবার মাঝে মাঝেই আবরারের অবহেলা দেখলে মনে হয়, মহুয়ার চিন্তা-ভাবনা ভুল।আবরার মহুয়ার প্রতি কোনোভাবেই আকৃষ্ট নয়।
বিয়ের দেড় মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো মহুয়া আবরারের রাগ দেখলো।সেদিন বোধহয় শনিবার ছিল।আগেরদিন,আবরারের অনেকগুলো শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছিলো মহুয়া।একটা শার্টের পকেটে কি একটা কাগজ ছিলো।মহুয়ার নজরে আসেনি তা।ভুলে ওটাসহ জামা-কাপড় ধুয়ে ফেলে।সকালে অফিসে যাওয়ার আগে তন্ন তন্ন করে কাগজটা খুঁজেছে আবরার।শেষে পেয়েও যায় অবশ্য।ভিজে কাগজটা আধভেজা হয়ে একদলা হয়ে আছে।কাগজের লেখাগুলো কিছুতেই বুঝা যাচ্ছে না।দরকারি জিনিসের এই অবস্থা দেখে সে কি রাগ আবরারের।ভীষণ চোটপাট করেছে মহুয়ার সাথে।সকালে নাস্তা অবধি খায়নি।পুরোটা সময় মহুয়া চুপ করে ছিলো।শত হলেও দোষটা তারই।মহুয়া যতবার শুকনো মুখে ভুল স্বীকার করতে গেছে, ততোবার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে আবরার।সেদিন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছে মহুয়ার।সব ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে।বিলকিস বেগমও বাড়ি ছিলেন না সেদিন।দিন কয়েকের জন্য আফিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন।মহুয়াকে বাড়িতে একা পেয়ে যেন নিজের সব রাগ উগরে দিয়েছে আবরার।আবরার চলে যাওয়ার পর মহুয়া একা একা অনেক্ষণ চিন্তা করেছে।অনেকদিন হয়েছে বাড়িতে যাওয়া হয়না।আবরারের আজকের আচরণের পর মহুয়া সহজে তার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবে না। মহুয়ার সময় লাগবে।তাই মহুয়া সিদ্ধান্ত নিলো আজ আবরার বাড়ি ফিরলেই, সে আজিমপুর যাওয়ার অনুমতি নেবে।কাল বিকালের দিকে বিলকিস বেগম চলে আসবেন।মহুয়া সকাল সকাল রান্না শেষ করে রাখবে।তাহলেই আর কোনো সমস্যা হবে না।মহুয়া ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। হাঁপিয়ে গেছে সে।কিছুদিন বিশ্রাম না করলে নিশ্চিত মরে যাবে মহুয়া।আবরারের উগ্র আচরণ আজ খুব চোখে লেগেছে।একটু ভুল নাহয় করেই ফেলেছে।তাই বলে এতো খারাপ ব্যবহার!এতোটা কি কাম্য ছিলো? রাতের বেলা একা বাড়িতে খুব ভয় লাগে মহুয়ার।আবরারদের বাড়ির নিচ তলায় ভাড়াটিয়া আছে।দো-তলায় কেবল আবরাররাই থাকে।দরজা-জানালা বন্ধ করে শোবার ঘরে খাটের এককোনে বসে থাকে মহুয়া।মহুয়ার মুখোমখি আয়না রাখা।মহুয়া খাটে বসেই নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে।আবরার কেন আকৃষ্ট হয় না তার প্রতি? মহুয়া কি যথেষ্ট সুন্দরী নয়?
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে।সে নিশ্চিত বিয়ের আগে আবরারের একটা সম্পর্ক ছিলো।এখনো আছে কি না তা জানে না মহুয়া।আবরার নিশ্চয়ই আগের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।তাই হয়তো এখনো স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারছে না মহুয়ার সাথে।মহুয়ার ইচ্ছা করে বিষয়টা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে।কিন্তু,ইচ্ছা পূরণের কোনো রাস্তা নেই।আফজাল সাহেব মহুয়ার প্রতি খুবই দূর্বল।মহুয়ার মানসিক অশান্তির কথা তার কাছে খুলে বলা মানেই বাবাকে চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া।এই কাজ কিছুতেই করতে পারবে না মহুয়া।ভাগ্যের উপর ভর করে দেখাই যাক,সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেটা কি।
ভাবতে ভাবতে একসময় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মহুয়া।ঘুম ভাঙে আবরার আসলে।আবরার রাত দশটার দিকেই বাড়ি চলে আসে।মহুয়া আজ আগ বাড়িয়েই কথা বলে না।এমনকি আবরারের জামা-কাপড় এগিয়ে দেয় না,শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় না।তাকায়ই না আবরারের চেহারার দিকে।হয়তো মহুয়ার এই ভিন্ন আচরণ আবরারের চোখে পড়ে।রাতে ভাত না খেয়েই বিছানায় চলে আসতে চায় মহুয়া।তবে আসতে পারে না।পিছন থেকে হাত টেনে ধরে আবরার।নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায় মহুয়াকে।দু-হাতের আজলায় তুলে নেয় মহুয়ার মুখ।নরম গলায় প্রশ্ন করেঃ”ভাত খাওনি কেন?”
—” ইচ্ছে করছে না।”
—” রাগ করে আছো?”
—” না।হাত সরান। আমার ঘুম পেয়েছে,আমি ঘুমাব।”
আবরার হাসে।মুখ ছেড়ে দু-হাতে আলগোছে জড়িয়ে ধরে মহুয়াকে।মহুয়া অবাকের চূড়ান্তে।আবরার কি অসুস্থ?এরকম বিকারগ্রস্থের মতো আচরণ করার মানে কি?
—” মহুয়া তুমি কবিতা পছন্দ করো?”
—” না।আমি কবিতা বুঝি না।আপনি এভাবে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।”
মহুয়ার কথার ধারে কাছেও যায় না আবরার।নিজের মতো করেই বলেঃ”আমার সবচেয়ে পছন্দ জীবনানন্দ দাশের কবিতা।ওনার একটা কবিতা আছে, বনলতা সেন নামে।পড়েছ?”
—” উঁহু, নাম শুনেছি।”
আবরার হঠাৎ করেই গভীর পুরুষালি গলায় জীবনবাবুর কবিতার দুটো লাইন আবৃত্তি করে।কবিতার চরণে ঢেলে দেয় গলার সব আবেগ।
“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”
“মহুয়া আমি পৃথিবীর এক ক্লান্ত যাত্রী।আমাকে দু-দন্ড শান্তি দিবে,প্লিজ।আজকে থেকে আমার বনলতা সেন হবে?আমার একান্ত ব্যক্তিগত বনলতা সেন??”
চলবে….
(বি.দ্রঃভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)