যেদিন তুমি এসেছিলে সূচনা_পর্ব

0
8419

‘ছেঁড়া শাড়ি পরে বিয়েতে এসেছ কেন?’

কথাটি শুনে অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায় অর্ষার। সে কাচুমুচু ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফের দিকে। অর্ষাকে নিরব দেখে আহনাফ একই প্রশ্ন করল,

‘কী হলো? ছেঁড়া শাড়ি পরে এসেছ কেন?’

অর্ষা নিশ্চুপ। আহনাফ এবার বিরক্ত হয়ে বলল,’কথা বলতে পারো না তুমি? বিয়ে বাড়িতে তুমি কোন সেন্সে এমন ছেঁড়া শাড়ি পরে এসেছ?’

অর্ষা কাচুমুচু ভঙ্গিতে বলল,’ছেঁড়া শাড়ি পরে আসিনি। আসার সময়ে রিকশার সাথে লেগে ছিঁড়ে গেছে।’

অর্ষার ভয়,শুধু এখানেই স্থির নয় বরঞ্চ সে বাড়িতে গিয়ে ভাবিকে কী জবাব দেবে সেটাও ভাবছে। অনেক অনুনয়বিনয় করে সে ভাবির থেকে শাড়িটা ধার নিয়েছিল। অসাবধানতায় শাড়িটা ছিঁড়েও গেল। বাড়িতে গেলে যে কয়েক ঘা পিঠে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আহনাফ বলল,’তো শাড়িটা পালটে আসা যায়নি? বাই দ্য ওয়ে, তুমি কে?’

‘আহিলের বান্ধবী।’

‘আহিলের বান্ধবী? আমার ভাই আহিলের?’

‘জি।’

‘ওহ। আচ্ছা আমি আহিলকে ডেকে দিচ্ছি। তুমি ওর থেকে একটা শাড়ি নিয়ে এটা পালটে নাও।’

অর্ষা কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে আহিলও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ ব্যস্ত ও।

ব্যস্ততার সাথেই বলল,’কিরে কী হয়েছে?’

‘কী হবে?’

‘ভাইয়া আমাকে পাঠাল। তোর নাকি কী লাগবে?’

‘শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে।’

‘ওমা! ছিঁড়ল কীভাবে?’

অর্ষার ইচ্ছে করছিল আরেকবার ছিঁড়ে দেখাতে। সে কোনোরকম রাগ কন্ট্রোল করে বলল,

‘তোদের বড়লোকের বিয়েটিয়েতে আসার মতো যোগ্যতা আমার নেই। এজন্যই আমি আসতে চাইনি। ভাবির থেকে অনেক অনুরোধ করে শাড়িটা নিয়েছিলাম। ছিঁড়েও ফেললাম। বাড়িতে গিয়ে কপালে দুঃখ তো আছেই, আবার তোর ভাই ও তার বন্ধুদের সামনে অপমানিতও হলাম।’

‘ভাইয়া তোকে কথা শুনিয়েছে?’

‘না, তেমন কিছু নয়। আহিল শোন, আমি বরং বাড়িতে চলে যাই?’

‘অসম্ভব। আমার বোনের বিয়ে আর তুই থাকবি না তা কি হয়? তুই আমার সাথে চল। আমি তোকে মায়ের একটা শাড়ি দিচ্ছি।’

আহিল অর্ষার কোনো কথা না শুনে ওকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। অর্ষা আর আহিলের বন্ধুত্বের বয়স খুব বেশি নয়। ইন্টার প্রথম বর্ষ থেকে দুজনের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। এইতো কিছুদিন বাদেই দুজনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। ওদের বন্ধুত্ব এতটাই প্রগাঢ় যে, কেউ কেউ তো ভেবে বসে দুজনের মাঝে হয়তো ভালোবাসাও রয়েছে। তবে এসবকিছু আহিল কিংবা অর্ষা কেউই ধার ধারে না। কারণ তারা জানে, তাদের মাঝে সত্যিকারের বন্ধুত্ব ব্যতীত অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।

আহিলের মা আমেনা বেগম অর্ষাকে লাল রঙের জামদানি একটা শাড়ি দিয়েছেন। অর্ষা শাড়িটা পরে বাইরে আসতেই ওর বাকি বন্ধু ও বান্ধবীদের দেখতে পায়। অর্ষা গাল ফুলিয়ে চাপাস্বরে বলে,

‘তোরা এত দেরি করলি কেন আসতে? জানিস একা একা আমার কত খারাপ লাগছিল!’

জুঁই ঠেস মেরে বলে,’কেন? আহিল তো ছিল।’

‘থাকলেই বা কী? ওর বোনের বিয়ে। ওর একটা দায়িত্ব আছে না?’

‘আচ্ছা যা হোক, তোকে কিন্তু সুন্দর লাগছে। শাড়িটাও খুব সুন্দর।’

‘আহিলের মা দিলো।’

আশিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’শাড়ি? কেন দিলো?’

‘আমার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। দয়া করে এখন এটা জিজ্ঞেস করিস না যে, কীভাবে ছিঁড়েছে। বিস্তারিত বলার মতো মুড নেই এখন।’

ওদের কথার মাঝে আহিলও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তাড়া দিয়ে বলে,’আয় আগে খেয়ে নিবি তোরা।’

খাওয়ার সময়ে একবার আহনাফের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় অর্ষার। আহনাফকে দেখলেই ওর কিছু মুহূর্তের আগের কথা মনে পড়ে যায়। তখন লজ্জায় ইচ্ছে করে মাটির সাথে মিশে যেতে। সে অস্বস্তিতে ঠিকমতো খেতেও পারছে না। বিষয়টা খেয়াল করে আহনাফ সেখান থেকে সরে যায়।

খেতে খেতে রেশমি বলে,’আহিল তোর ভাইয়াটা দেখতে যা জোশ! উফ! চোখগুলো মারাত্মক।’

আহিল কিছু বলল না। খেতে খেতে হাসল শুধু। লামিয়া বলল,’আরে, ওর ভাইয়াকে ছবির চেয়েও বাস্তবে আরো বেশি সুন্দর লাগে। আমি তো এখন সিদা থেকে ফিদা হয়ে গেছি।’

জুঁই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’তুই ছবি কোথায় পেলি?’

লামিয়া বলল,’কেন? আহিল ফোনে দেখিয়েছিল না আমাদের? তাছাড়া ফেসবুকে তো প্রায়ই দেখি।’

‘তোর লিস্টেও আছে?’

লামিয়া এবার দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলল,’না রে! রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম অনেক আগে। কিন্তু এক্সেপ্ট করেনি।’

আহিল এবার হেসে বলে,’করবেও না। ভাইয়ার ফ্রেন্ডলিস্টে আননোন কাউকে রাখে না।’

‘বাঃ রে! আমি আননোন হলাম কীভাবে? আমি তো তোর বান্ধবী। তাছাড়া বিদেশিনীদের তো ঠিকই রাখে লিস্টে। আমি কমেন্ট দেখেছি।’

আহিল এবারও হেসে বলল,’তুই আমার বান্ধবী কিন্তু ভাইয়ার তো আর না। আর বিদেশিনীরা ভাইয়ার ক্লাসমেট। তো ওরা পরিচিত তাই লিস্টে আছে।’

‘হুহ! ঢং।’

জুঁই হেসে বলে,’আহারে, বেচারি! কতশত যুবককে ঝুলিয়ে রেখে, এখন নিজেকেই ঝুলে থাকতে হচ্ছে।’

‘তাতে তোর কী হয়েছে? তুই চুপ থাক।’

জুঁই বলল,’এই দেখ, দেখ! ওদিকে তাকা। ইশ! কী সুন্দর করে হাসে। আল্লাহ্! হাসলে চোখ দুটো কেমন ছোটো ছোটো হয়ে যায়। মরেই যাব এবার আমি।’

রেশমি হুঙ্কার দিয়ে বলে,’খবরদার! নজর দিবি না বলে দিলাম।’

খাওয়ার পুরো সময়টাতে অর্ষা, দিদার আর আশিক চুপ ছিল। এবার আশিক বিরক্ত হয়ে বলল,’কী শুরু করেছিস তোরা? মেয়ে হয়েও ছেলেদের প্রতি এত ছুঁকছুকানি কেন হ্যাঁ?’

অর্ষা দুম করে আশিকের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলে,’এগুলা আবার কী শব্দ ব্যবহার করিস?’

‘দেখছিস না, এগুলায় কী শুরু করছে।’

লামিয়া ক্ষেপে বলে,’তোর কী? তোর মন চাইলে তুইও কর। তোকে কেউ পাত্তা দেয় না বলে, তোর খুব জ্বলে তাই না?’

‘ফালতু কথা বলবি না একদম।’

অর্ষা ওদের থামিয়ে নিচুস্বরে বলে,’কী শুরু করেছিস? বিয়ে বাড়ি এটা। থাম প্লিজ!’

সবাই থেমে যায় এবার। অর্ষার খাওয়া শেষ তাই সে বেসিনে যায় হাত ধুতে। যাওয়ার সময় আবারও সে ভুলবশত একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। এঁটো হাত গিয়ে লাগে আহনাফের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটিতে। সঙ্গে সঙ্গে হলুদ দাগ যেন চোখ মেলে সাদা পাঞ্জাবির ওপর বসে পড়েছে। এমন বিচ্ছিরি ঘটনার জন্য এবার সত্যি সত্যিই অর্ষার ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর লুকিয়ে যেতে।

আহনাফ রাগে, ক্ষোভে কথা বলতেই ভুলে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে নিজের রাগকে সে কন্ট্রোলে এনে ফেলে। চাপাস্বরে রাগের সঙ্গে বলে,’পাগল তুমি? দেখে চলতে পারো না?’

অর্ষা থতমত খেয়ে বলে,’স…স্যরি..’
অর্ষার পুরো কথা শোনার আগেই আহনাফ সেখান থেকে চলে যায়। একরাশ দীর্ঘশ্বাস আর নিজের প্রতি বিরক্তি নিয়ে সে কিছুক্ষণ আহনাফের যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত অনেক গভীর হয়ে গেছে। অর্ষার বাকি বন্ধুদের বাড়ি এক দিকে। আর উলটো পথে হচ্ছে অর্ষার বাড়ি। কথা ছিল, বিয়ে শেষে আহিল ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আহিলের অবস্থাই তো এখন নাজেহাল। আহনাফ এবং আহিলের একমাত্র বোন হচ্ছে আফরিন। সবার বড়ো আহনাফ, তারপর আফরিন এবং সবার ছোটো আহিল। আফরিনের এক বছরের ছোটো আহিল। পিঠাপিঠি হওয়াতে দুজনের ঝগড়াঝাঁটি যেমন সবচেয়ে বেশি হতো, তেমনই দুজনের মাঝে সখ্যতা এবং ভালোবাসাও বেশি ছিল। তাই আদরের বোনকে বিদায় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই সে শেষ। হাত-পা ছড়িয়ে এখনো কেঁদেই চলেছে। ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বাবা-মা’ও কাঁদছে। এমতাবস্থায় অর্ষাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার-স্যাপার।

অসহায়ভাবে অর্ষাকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশিক বলল,’চল আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘না রে। তুই কেন শুধু শুধু উলটো পথে যাবি? রাত অনেক হয়েছে। আসার সময়ে গাড়িও পাবি না।’ বলল অর্ষা।

‘তাহলে তুই একা যাবি কীভাবে? আহিল তো যেতে পারবে না।’

পাশ থেকে ওদের কথোপকথন আহনাফ শুনছিল। তাই ওদের কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’সমস্যা নেই। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। তোমরা কি একা যেতে পারবে?’

জুঁই বলল,’জি ভাইয়া। আমাদের বাসা কাছেই। আর আমরা সবাই এক এলাকায় থাকি। আপনি একটু অর্ষাকে পৌঁছে দিন।’

‘ঠিক আছে। চিন্তা কোরো না। তোমরা সাবধানে যেও।’

আহনাফের সঙ্গে যেতে হবে ভেবেই ভয়ে গাট হয়ে রয়েছে অর্ষা। আল্লাহ্ মালুম! আবার কোনো ভুল না করে বসে। সে আড়চোখে একটু তাকিয়ে দেখে আহনাফ সাদা পাঞ্জাবি পালটে কালো পাঞ্জাবি পরেছে। অবশ্য এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছিল। সে তার বাকি বান্ধবীদের মতো করছে বলে মনে মনে নিজেকে একচোট ধিক্কার জানাল।

নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সবাই চলে যাওয়ার পর অর্ষা বলল,’আমি শাড়িটা পালটে আসছি।’

‘কেন? এই শাড়িতে কী সমস্যা?’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল আহনাফ।

‘এটা তো আমার নয়। আপনার মায়ের।’

‘ফেরত দিতে হবে না। তুমি রেখে দাও। আর হ্যাঁ, তোমার শাড়িটা নিয়ে নাও।’

‘আমার নয়, ভাবির শাড়ি।’

‘যাই হোক।’

অর্ষা শাড়ি নিয়ে এসে দেখে আহিল তখনো কাঁদছে। ওর থেকে বিদায় নেওয়ার কিছু নেই আপাতত। তাই ও আহনাফের সাথে গিয়ে গাড়িতে বসে। পুরো রাস্তায় শুধু বাড়ির ঠিকানা জানতে চাওয়া ছাড়া আর কোনো কথা বলেনি আহনাফ। অর্ষা নিজেও নিশ্চুপ ছিল।

বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামে। অর্ষা তড়িঘড়ি করে নেমে যায়। একই তো ভাবির শাড়ি ছিঁড়েছে, তারমধ্যে এত রাত করে বাড়ি ফিরেছে! ভয়ে তার অবস্থা খারাপ। আতঙ্কের চোটে ভদ্রতার খাতিরে আহনাফকে বাড়িতে আসতে বলা তো দূরে থাক, বাই পর্যন্ত বলেনি। অর্ষার এমন ব্যবহারে আহনাফ একটু অবাক হলেও পরক্ষণে আবার নিজেকে সামলে নিল। গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করে নিজের বাড়ির দিকে।

বাড়ির দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দেয় বড়ো ভাই রুহুল আমিন। অর্ষাকে দেখে রাগে ফেঁটে পড়ে মারতে উদ্যত হবে তখন ভাবি এসে আটকায়। ভাই মারতে না পারলেও ইচ্ছেমতো বকাবকি আর গালাগালি করে নিজের ঘরে চলে যায়।

অর্ষার গায়ে নতুন শাড়ি দেখে ভাবি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’এই শাড়ি কার? আমার শাড়ি কোথায়?’

অর্ষা ভয়ে ভয়ে বলে,’তোমার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে ভাবি।’

ব্যস, এবার ভাবিরও আসল রূপ বের হয়ে যায়। ঘরে ভাইয়ের ছোটো ছেলে তিয়াস ঘুমাচ্ছে বলে অর্ষার চুলের মুঠি ধরে উঠানে নিয়ে আসে ভাবি। ইচ্ছেমতো গালে, পিঠে থাপ্পড় দিতে দিতে বলে,

‘তুই আমার এত শখের শাড়িটা ছিঁড়ে ফেললি? তোকে তো আমি এখন খু*ন-ই করে ফেলব। বাড়িতে রেখে খাওয়াই-পরাই কি আমার জিনিস নষ্ট করার জন্য?’

ভাবির মারের সাথে সাথে মুখও চলছে। বিশ্রি সব ভাষায় গালাগাল দিয়ে নিজের রাগ উপশম করার চেষ্টা করছেন। সেই মুহূর্তে বাড়ির মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায় আহনাফ। তার হাতে অর্ষার পার্স। ভুলবশত গাড়িতে ফেলে এসেছিল বলে, গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরত দিতে এসেছে। আর এসে এমন ঘটনা দেখে সে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। এভাবে এত বড়ো মেয়েকে কেউ মারে? এ দৃশ্য দেখার পর, আহনাফ নিজের রগচটা স্বভাব, রাগ কোনোটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

চলবে?

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। কেমন লেগেছে জানাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here