#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
সকালের প্রস্ফুটিত কুসুম রাঙা ভোর দেখে মন শান্ত হয়ে যায় অর্ষার। ফজরের নামাজ পড়ার পর আর ঘুম আসেনি। তাই বই হাতে জানালার কাছে বসে ছিল। পড়া অবশ্য হয়নি। সে ভোরের শুরু হওয়া, আলোর বিচরণ ছড়ানো দেখেছে। একটু বাদেই তাকে রেডি হতে হবে। লামিয়ার কড়া আদেশ, আজ ওর সব বান্ধবীদের নীল শাড়ি পরতে হবে। এজন্য সে আকদে তিন বান্ধবীর জন্য তিনটা নীল শাড়ি আর তিন বন্ধুর জন্য তিনটা নীল পাঞ্জাবি কিনে আগেই দিয়ে দিয়েছে।
ঘরোয়াভাবে লামিয়ার আকদের অনুষ্ঠান করা হলেও মেহমান যে নেহাৎ-ই কম হবে না সেটা বন্ধুমহলের সকলেরই জানা আছে। অর্ষার সমস্যাটা এখানেই। তার বোকা বোকা স্বভাব, কথা, আচরণ এসব সম্পর্কে বন্ধুরা অবগত। ওদের সামনে নিজেকে সে অন্যরকম প্রমাণ করার প্রয়াস কখনোই করেনি। তবে বাকিদের সামনে যেন একদম মিইয়ে যায়। যথাতথা চেষ্টা করে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার। তার একটু মন খারাপও লাগছে। পরীক্ষার পর কে কোথায় চলে যাবো তা ওরা কেউ-ই এখনো জানে না। সম্ভবত এক ভার্সিটিতে পড়াও হবে না। তখন কি বন্ধুত্বে ভাঙন ধরবে? দূরত্ব সৃষ্টি হবে? অর্ষার তো বেঁচে থাকার অন্যতম স্পন্দন হচ্ছে ওদের গ্যাঞ্জাম পার্টি। যেখানে সে মুক্ত পাখির মতো। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। এই পার্টির একটা সদস্য ব্যতীতও সে নিজেকে কল্পনা করতে পারে না। পরীক্ষার পরই লামিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। তখন কি আর লামিয়া আগের মতো থাকবে? থাকতে চাইলেও সেটা কি আদৌ সম্ভব হয়ে উঠবে কখনো? তখন ওর নিজের একটা সংসার হবে, আলাদা পরিবার হবে। নিজের মানুষটাকে সময় দিতে হবে। আরো কত কী! এসব ভাবতে ভাবতেই মন প্রায় অসাড় হয়ে আসে তার। মস্তিষ্ক অযথা চিন্তা করাও বাদ দিয়ে দেয়। আর কত প্রেশারই বা নেবে?
‘অর্ষা? এই অর্ষা? উঠেছিস?’
বাইরে থেকে আহিলের গলার স্বর শুনে সম্বিৎ ফিরে পায় অর্ষা। প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। অর্ষাকে দেখে আহিল বিস্মিত হলো। যদিও ওর বিস্ময়ের কারণ সম্পর্কে অর্ষা একদমই অবগত নয়।
সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আহিল বলল,’তুই এখনো রেডি হোসনি? লামিয়া ফোন দিতে দিতে আমায় পাগল করে ফেলতেছে।’
অর্ষা মনমরা হয়ে বলল,’হব এখন।’
অর্ষার মনঃকল্পিত ক্লেশ বোধ হয় আহিল কিছুটা আন্দাজ করতে পারল। শীতলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে?’
‘কিছু না। তুইও গিয়ে রেডি হয়ে নে।’ আহিলের দিকে না তাকিয়েই মাথা নত করে বলল অর্ষা।
আহিল তার জায়গা থেকে নড়ল না। অর্ষার গাল আলতো করে চেপে ধরে মুখ সোজা করল। গম্ভীর হওয়ার মেকি অভিনয় করে বলল,’বলবি না?’
‘কী বলব?’
‘তোর কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি বললাম তো।’
‘তাহলে মন খারাপ কেন?’
‘এমনি।’
‘কথা লুকাতে শিখে গেছিস দেখছি।’
‘তোর কাছে আমি কিছু লুকাই?’
‘এখন লুকাচ্ছিস। বলবি কিনা বল?’
‘তেমন কিছু না রে। লামিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। একে একে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এসব ভেবে একটু খারাপ লাগছিল।’
আহিল মুচকি হাসল। অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’মন খারাপ করিস না। যে যেখানেই থাকুক, আমাদের সবার বন্ধুত্ব আজীবন থাকবে।’
আহিলের কথায় ভরসা খুঁজে পায় অর্ষা। ঠোঁটের কোণে ফুঁটে ওঠে এক চিলতে মৃদু হাসির রেখা; যা সূর্যের কিরণের মতো জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছিল। অন্তত আহিলের কাছে তো এমনটাই লাগল।
আহিল চলে যাওয়ার পর অর্ষাও গোসলে যায়। সে নিজেই শাড়ি পরতে পারে বলে অন্য কারো সাহায্যের দরকার হয় না। গাঢ় নীল শাড়িটা অর্ষার শ্যামবর্ণ অঙ্গে নীল গগনের মতো লাগছে। রঙ-টাই বোধ হয় এমন! শাড়ি পরা শেষে সামান্য প্রসাধনী ব্যবহার করে সে। সেই সময়ে আহিল আসে।
সে দরজার বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করল,’আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘এইতো হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিট।’ বলল অর্ষা।
‘আমি নিচে আছি। তুই চলে আসিস।’
‘আচ্ছা।’
অর্ষা সম্পূর্ণ রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হয়। রেণু দেখে হেসে বলে,’আপনেরে সেই লাগতাছে আফা।’
অর্ষা সলজ্জিত হেসে আমেনা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। ঐ সময়ে আহনাফও বের হচ্ছিল। গত চারদিনে সে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই চারদিনে বাইরেও বের হয়নি। আজও বের হতো না; তবে জরুরী একটা কাজ থাকায় তাকে বের হতে হচ্ছে। অর্ষার পায়ে হাই-হিল। সে শাড়ির কুচিগুলো ধরে সন্তর্পণে আস্তে আস্তে একটা একটা করে সিঁড়ি পাড়ি দিচ্ছে। আহনাফ যে ওর পিছেই আছে সেটাও সে শাড়ি সামলানোর চক্করে খেয়াল করেনি।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে অর্ষার শাড়ির আঁচল সিঁড়ির ওপর টাচ করছিল; যার দরুণ ভুলবশত যেকোনো সময়ে আঁচলে পা লাগলে অর্ষা তৎক্ষণাৎ পড়ে যেতে পারে। আহনাফ নিঃশব্দে এগিয়ে এসে শাড়ির আঁচলটা হাতে তুলে নেয়। তখনো পর্যন্ত অর্ষা কিচ্ছুটি টের পায়নি। আহনাফও ওর মতো গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল।
সবগুলো সিঁড়ি যখন পার হয়ে এলো তখন আহনাফ কেঁশে গলা পরিষ্কার করে। উদ্দেশ্য অর্ষার দৃষ্টি আকর্ষণ। অর্ষা তো হঠাৎ ভয়ে চমকে ওঠে। ঘুরে তাকায় পেছনে। আহনাফকে দেখে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। তবুও ভয়ে বুকের ভেতরটা এখনো ধুকপুক আওয়াজ তুলছে।
আহনাফ ওর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল না। ধরে রাখা আঁচলের দিকে ইশারা করে আঁচলটি ছেড়ে দিলো। ডান হাতের তর্জনী দ্বারা কপালের মাঝখানটায় চুলকাতে চুলকাতে বলল,’এরপর থেকে আঁচলটা আরেকটু ছোটো রাখবে।’
এরপর সে উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে অর্ষাকে পাশ কাটিয়ে গ্যারেজে চলে যায়। অপরদিকে লজ্জায় মরিমরি অবস্থা অর্ষার। হঠাৎ আসা সমীরণে সে স্তম্ভিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। সাতপাঁচ না ভেবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। মেইন গেইটের বাইরেই বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিল আহিল।
অর্ষাকে দেখে আহিল বলে,’এতক্ষণ লাগে?’
অর্ষা নিরুত্তর রইল। আহিল বলল,’ওঠ।’
অর্ষা বাইকে উঠে বসার সময় আহনাফ ওর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শুধু অর্ষা। লামিয়াদের বাসায় পৌঁছিয়ে দেখল ওরা বাদে বাকিরা চলে এসেছে।
লামিয়ার ঘরে ঢোকা মাত্রই তেড়েমেড়ে এগিয়ে আসে লামিয়া। দুজনের সামনে কোমরে হাত রেখে রাগীকণ্ঠে বলে,’তোদের এতক্ষণে আসার সময় হলো বুঝি? দুটিতে কি আবার ঘুরতে গিয়েছিলি নাকি?’
আশিক কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’আহা লামিয়া, কী হবে আর কান্দিয়া? ওরা তো পড়েছে আসিয়া।’
ওর অযাচিত কবিতা শুনে লামিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। এতেই আশিকের ভষ্ম হওয়ার জোগার। সে যথাসম্ভব দু’পাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,’হেহে মজা করলাম। আমি তো তোর পক্ষেই।’
‘তোর কারো পক্ষে থাকা লাগবে না। তুই শুধু তোর ফাল’তু কবিতা বলা বন্ধ কর।’
আশিক চুপসে যায়। আজকে অন্তত লামিয়াকে আর রাগাবে না বলে মনস্থির করে ফেলে। এদিকে আহিল এবং অর্ষা পড়ে গেছে বিপাকে। খুব বেশি যে দেরি হয়েছে তাও তো নয়। তবে হ্যাঁ, লামিয়ার ঠিক করে দেওয়া নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট পর এসে ওরা পৌঁছিয়েছে। আর এতেই যত সমস্যা, অনাসৃষ্টি চক্ষের পলকে তৈরি হয়ে গেছে।
দিশা খুঁজে না পেয়ে অর্ষা আচমকা লামিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আদুরেকণ্ঠে বলে,’স্যরি রে। আর এমন হবে না।’
লামিয়া কটমট করে বলে,’আর এমন হবে না মানে কী? আমার আকদ কি আরো দশবার হবে পরে?’
লামিয়ার রাগ কমাতে গ্যাঞ্জাম পার্টিকে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধাতে হলো। যে যেভাবে পারল ও’কে হাসানোর চেষ্টা করল। এজন্য উলটা-পালটা কবিতার পাশাপাশি, ফানি গান, উরাধুরা নাচও বাদ গেল না। এতে অবশ্য মেয়েদের সাজের বারোটা বেজে গেল। বরপক্ষ আসার পূর্বে ওরা যতটা পারল সাজসজ্জা ঠিক করে নেয়।
বরপক্ষ এলো দুপুরের কিছু আগে। আজ নিহালের সঙ্গে তার বেশ কয়েকজন বন্ধুও এসেছে। এরাও গ্যাঞ্জাম পার্টির চেয়ে কম নয়। এটা তখনই সকলে উপলব্ধি করতে পারল যখন সন্ধ্যায় শুধুমাত্র ওরা একটা রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এর মাঝে অবশ্য আরো একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। নিহালের বন্ধু সুবাসের দৃষ্টিতে আটকে যায় জুঁই। সরল স্বভাবের সুবাসের দৃষ্টি সবার আগে খেয়াল করে আহিল। সে বসেও ছিল জুঁইয়ের পাশে।
অনেকক্ষণ যাবৎ সুবাসের অমন দৃষ্টি দেখে আহিল জুঁইকে ফিসফিস করে বলে,’কিছু কি লক্ষ্য করেছিস?’
আনন্দে মেতে থাকায় এবং নিহালের বন্ধুদের সাথে ঝগড়ায়, আমোদে আমোদিত থাকার দরুণ আহিলের কথাগুলো জুঁই শুনল না।
আহিল এবার জুঁইয়ের হাতে চিমটি কেটে কথাগুলো পূণরায় বলল। জুঁই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে একবার সুবাসের দিকে তাকায়। আহিলের কথাই সত্য। ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনের চোখে চোখ আটকাতেই সুবাস সরল হাসে।
জুঁইও এবার ফিসফিস করে আহিলকে বলল,’ঘটনা তো সত্য দোস্ত। এই পোলায় তাইলে আমার প্রেমে পড়ছে?’
‘তাই তো মনে হয়।’
‘কিন্তু দোস্ত! পোলাডা সুন্দর আছে…কিন্তু একটু হাদা টাইপের। অর্ষার সঙ্গে মানাইত। দুজনই সহজ-সরল, বোকা।’
আহিল চোখ পাকিয়ে তাকাতেই জুঁই দাঁত বের করে হেসে বলল,’ধুর! মজা করছি আমি। তুই সিরিয়াসলি নিলি?’
‘না।’
‘আচ্ছা শোন, আমরা যে বুঝতে পারছি এটা ঐ ছেলেকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।’
‘হ, তুইও একটু ভাবে থাক।’
‘ওকে, ওকে।’
জুঁইয়ের ভাব নেওয়া অবশ্য বেশিক্ষণ টিকল না। আড্ডার এক পর্যায়ে সুবাস সকলকে চমকে দিয়ে জুঁইকে অনুরোধ করল একটা গান গাইতে। জুঁইয়ের গানের গলা ভালো। যে কেউ ওর গান শুনলে অন্তত গানের জন্য হলেও মুগ্ধ হবে, ইম্প্রেস হবে। আর বরপক্ষের সামনে এই সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করলে চলবে না। তাই সে খালি গলাতেও গান ধরল। উপস্থিত সকলেই অভিভূত হয়। এমনকি খুশি হয়ে সুবাস ও’কে পাঁচশো টাকার নতুন কচকচে একটা নোট উপহার দিলো। এতে এবার বাকিরাও যা বোঝার বুঝে নিল।
রাতে বরপক্ষের বয়োজ্যেষ্ঠরা খাওয়ার পরে লামিয়া ও নিহালের বন্ধুরা সবাই খেতে বসেছে। সুবাস বসেছে জুঁইয়ের পাশে। ছেলেটা সহজ-সরল হলে কী হবে, কথা বলে দারুণ! ওর কথার মোহোতেই জুঁই আইসক্রিমের মতো একটু একটু করে গলতে শুরু করে। গলা শেষ হয় ফেসবুকে এড হয়ে, ফোন নাম্বার নিয়ে।
দিদার সব লক্ষ্য করে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলে,’সো ফাস্ট!’
আশিকও হেসে বলে,’জুঁই তো অবশ্যই করবে কুঁইকুঁই।’
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে যে যার বাড়ি চলে আসে। অর্ষা আর আহিলেরও বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা পার হয়ে যায়। এত যে দেরি হবে সেটা ওরা ভাবেনি।
__________
রাত ১২টা বাজতে চলল। আজ শো-রুম থেকে বের হতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কেয়া ব্যস্ত পায়ে বাস স্টপেজের দিকে এগোচ্ছিল। পথিমধ্যে চায়ের দোকান থেকে বের হওয়া এক যুবকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। দাঁতমুখ খিঁচে কিছু বলতে যাবে তখন লোকটি অনবরত স্যরি বলা শুরু করে।
মুখোমুখি হয়ে দুজনেই বেশ অবাক হয়। আহনাফ মৃদু হেসে বলে,’আরে আপনি!’
হেসে ফেলে কেয়াও। রাগ গিলে হাসিমুখে বলে,’হ্যাঁ, বাসায় যাচ্ছি। কিন্তু আপনি এখানে কেন?’
‘একটা কাজে বের হয়েছিলাম। অনেকক্ষণ হয়েছে পেটে চা-কফি কিছু পড়েনি। আমার আবার ঘনঘন চা-কফি খাওয়ার বাতিক রয়েছে। তাই আর থাকতে না পেরে গাড়ি থামিয়ে এই দোকানে চা খেতে এসেছিলাম।’
‘খেলেন?’
‘হ্যাঁ, তবে তৃপ্তি পাইনি। প্রথমে পানসে লাগল। পরে বললাম আরেকটু চিনি দিন। চিনি নেওয়ার পর মনে হলো শরবত। উলটো মুখ নষ্ট হলো।’
কেয়া হেসে বলল,’একদিন সময় করে টিএসসিতে যান। ওখানকার যা দারুণ।’
‘যাব। আপনার দেরি হচ্ছে না?’
‘তা একটু হচ্ছে বৈ কি!’
‘কীসে যাবেন?’
‘বাসে।’
‘এত রাতে বাসে?’
‘কিছু করার নেই।’
‘আপনাদের বাড়ি হয়েই যাব। সমস্যা না থাকলে আমি পৌঁছে দিতে পারি।’
‘পরিচিত মানুষের সঙ্গে যেতে সমস্যা কোথায়?’
‘মাই প্লেসার!’
দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। কেয়া আহনাফের এক্সিডেন্টের গল্প শোনে। অর্ষার খোঁজ-খবর নেয়। গল্পের মাঝেই ওরা বাড়িতে পৌঁছে যায়। কেয়া অনেকবার পীড়াপীড়ি করেছে আহনাফকে ভেতরে আসার জন্য। তবে আহনাফ রাজি হয়নি। কেয়াকে নামিয়ে দিয়ে সে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে।
কেয়া ভেতরে গিয়ে দেখে রুহুল আমিন মাত্রই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছে। ও’কে দেখে সে বলল,’অপেক্ষা করব?’
কেয়া নিজের রুমে যেতে যেতে বলল,’না, দুলাভাই। আপনি খাওয়া শুরু করেন।
রুহুলের সামনে গম্ভীরমুখে বসে রয়েছে কুসুম। মুখে তার অমাবস্যাতিথি। প্লেটে ভাত দিতে দিতে সে বলে,’তোমার মতিগতি তো আমি কিছু বুঝি না। তুমি কোন আক্কেলে অর্ষাকে ঐ বাড়িতে ঢ্যাং ঢ্যাং করে পাঠালে? তিয়াসকে নিয়ে বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না করতে কত কষ্ট হয় আমার জানো?’
রুহুল উত্তর করল না। সে নিশ্চুপে খেয়ে যাচ্ছে। কেয়া ঘর থেকে সবই শুনেছে। ফ্রেশ হয়ে সেও চুপচাপ খেতে বসে।
কুসুম কেয়ার প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে রুহুলকে কড়া করে বলল,’আমি অতশত বুঝি না। তুমি কালই অর্ষাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে।’
এ কথার প্রত্যুত্তর রুহুল করার পূর্বেই কেয়া করল। সে জিজ্ঞেস করল,’কেন?’
কুসুম মৃদু চিৎকারের সহিত বলল,’কেন মানে? সারাদিন তো থাকিস বাইরে। তুই কীভাবে জানবি বাড়িতে কাজকর্ম করতে আমার কত কষ্ট হয়!’
‘বাইরে আমি আমোদ করে বেরাই না আপু! কাজ করতেই যাই।’ ব্যঙ্গ করে হেসে বলল কেয়া।
‘সে যাই করিস, আমার কষ্ট তো আর বুঝিস না? ঐ মেয়েকে খাওয়াই, পড়াই আমরা। আমাদের সাহায্য না করে অন্যের বাড়িতে পড়ে থাকবে?’
‘এতে যদি ওর ভালো হয়, তো থাকুক না কিছুদিন। সমস্যা কোথায়?’
‘ও। তুই ওর ভালোটা দেখছিস। আর আমার ভালো তোর সহ্য হয় না?’
‘এখানে ভালো-খারাপ চাওয়ার কিছু নেই। তুমি তো প্রায় প্রতিদিনই বলতে অর্ষাকে বিদায় করতে। এতে নাকি তোমার আপদও বিদায় হবে। তাহলে মাত্র এ ক’টা দিনেই অর্ষাকে ছাড়া এমন হাঁপিয়ে উঠলে?’
কুসুম দাঁতমুখ খিঁচে স্বামীর উদ্দশ্যে বলে,’দেখেছ দেখেছ? নিজের বোন হয়ে আমাকে কথা শোনাচ্ছে। ঘরশত্রু বিভীষণ!’
রুহুল কিছু বলার আগেই কেয়া উঠে পড়ে। না খেয়েই চলে যায় রুমে। রুহুল চাপাস্বরে বলে,’সারাদিন কাজ করে বাড়িতে এসে এসব ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না কুসুম। সব ভালো তো আর তুমি একা বোঝো না। আমায়ও না হয় একটু ভালোটা বুঝতে দাও? এখন সাময়িক কষ্ট হচ্ছে তোমার। পরে সুখে থাকবে। ধৈর্য ধরো।’
কুসুম জানে না, স্বামী তার কীসের জন্য এত ধৈর্যধারণ করতে বলছে। তবে তার এত ধৈর্য নেই। সে রাগে দু’চারটে কথা শোনাতে গিয়েও চুপ করে রইল।
.
.
এক ঘণ্টার মতো ঘুমিয়ে অর্ষা পড়তে বসেছে। দিনের তুলনায় রাতে তার পড়া ভালো হয়। পড়তে পড়তে পানি পিপাসা পায় তার। কিন্তু উঠতে মন চাচ্ছে না। তার রুম ব্যতীত সবার রুমের লাইট বন্ধ। এমনকি ড্রয়িংরুমের লাইটটাও বন্ধ করে রাখা। থাইগ্লাস ভেদ করে অল্পবিস্তর আলো ড্রয়িংরুমে হাতছানি দিলেও অর্ষার ভয় অতটুকু আলোর কাছে নস্যি।
হ্যাঁ,শুনতে হাসির কথা মনে হলেও অর্ষার ভূতে ভয় রয়েছে। যদিও সে জানে, পৃথিবীতে ভূত বলতে আসলে কিছুই নেই। আছে শুধু জ্বীন আর পরী। সে ছোটোবেলায় নানুর কাছে গল্প শুনেছে অনেক। পরীরা নাকি শুধু ছেলেদের পছন্দ করে। তার এজন্য খুব রাগ হতো। কেন শুধু পরীরা ছেলেদেরই পছন্দ করে? মেয়েদের কেন নয়? তাহলে সেও পরীর সঙ্গে পরীর দেশে গিয়ে ঘুরত, খেত। বেশ মজা হত! কিন্তু এমন তো হবে না। তাছাড়া সে আহামরী সুন্দরীও নয় যে পরীরা তাকে খামোখা পছন্দ করতে যাবে। তবে জ্বীন! নামটাই তো কেমন ভয়ংকর। পরী নামটা শুনলে চোখের দৃশ্যপটে যেমন সুন্দরী মেয়ের মুখশ্রী ভেসে ওঠে; জ্বীনের বেলায় তেমনটা হয় না। জ্বীনের কথা ভাবলেই চোখের পাতায় ভয়ংকর ভয়ংকর সব মুখ ভেসে ওঠে। ভয়ে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ছোটো থেকেই সে ভীতু গোছের মেয়ে ছিল। এখনো তার সেই ভয় কাটেনি। ওদের নিজেদের বাড়িতে টয়লেট বাইরে। রাতে প্রাকৃতিক ডাক পড়লে ভয়ে একা বের হতো না। কেয়াকে সাথে নিয়ে যেত।
এই বাড়িতে অবশ্য টয়লেটের ভয়টা নেই। রুমের ভেতরেই সব। তবুও একলা রুমে হঠাৎ হঠাৎ একটুখানি ভয় জেঁকে ধরলেও পড়ার তালে আবার ভুলে যায়। কিন্তু এখন যে পানি পিপাসা পেল? পিপাসা তো ভোলার বদলে আরো বেশি বাড়ছে। প্রতিদিন ওয়াটার বোতলে পানি থাকে। আজ ঘুমের তালে পানি ভরতে মনে ছিল না। এক মনে ভাবল ওয়াশরুম থেকে পানি আনবে কিনা! পরক্ষণে গা আবার কেমন ঘিনঘিন করে উঠল। যতই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোক; ওয়াশরুম তো ওয়াশরুমই!
সে সকল ভয়কে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে মনে সাহস সঞ্চয় করল। চোখ বন্ধ করে বার দুয়েক বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে পানির বোতল হাতে নিলো। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একবার আগায় তো একবার পেছায়। হুট করে তার মনে হলো ড্রয়িংরুমে লাইট জ্বলছিল। তাহলে এখন নেই কেন? মনের ভুল হবে হয়তো। সে পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে আগায়। আরে! রান্নাঘর থেকে ঘুটুর-মুটুর শব্দ আসছে। ইঁদুর নাকি? এতক্ষণ তার রুমের অল্প আলোটুকু ঠিকরে এদিকে আসছিল বলেই তো মনে হচ্ছিল, তাহলে এখন এমন অন্ধকার মনে হচ্ছে কেন? সে ঘুরে পিছে তাকায়। একি! তার রুমের লাইটও তো বন্ধ। এবার রান্নাঘরের শব্দ জোড়ালো হয় সেই সাথে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ বের হয়। সে তাকানোর সাহস না পেলেও তার অবচেতন মন রান্নাঘরে তাকানোর সায় দেয়। সে থমকে তাকায়। অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে এতক্ষণে। লম্বা দীর্ঘকায় আবছা কিছু রান্নাঘরের দরজায় দেখেই সে জোরে চিৎকার দেয়। ওর চিৎকারে বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙে যায়।
আবছা জিনিসটা ক্রমেই অর্ষার দিকে এগিয়ে আসছিল আর অর্ষার চিৎকারের শব্দও বাড়ছিল। এবার জিনিসটি কাছে এসে অর্ষার মুখ চেপে ধরে বলে,’শাট আপ! আমি আহনাফ।’
অর্ষার ভয় কাটেনি। সে মুখবন্ধ অবস্থায় চিৎকার করার চেষ্টা করে। কারেন্ট না থাকায় বাড়ির সকলে ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে আসতেছে। আলো এসে ততক্ষণে ওদের ওপরেও পড়েছে। কিচেনের সাথেই রেণুর রুম। তাই সবার আগে রেণু এসে পৌঁছায়। সে ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে বলে,’হায় আল্লাহ্! বড়ো ভাইজান, আপনে আফার মুখে কী করতাছেন?’
রেণুর এ কথার অর্থ যে দু’রকম হয় সেটা এই বোকা রেণুকে কে বোঝাবে? বাড়ির মানুষ কি শুনেছে? আহনাফের এখন জ্ঞাতশূন্য অবস্থা। সে অর্ষার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]