#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৩
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
সময় মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। পরিবর্তন করে তোলে মানুষকে। কখনো কখনো দূরত্ব বাড়তে থাকা মানুষটির গুরুত্বও বুঝিয়ে দেয়। কাউকে বা শিখিয়ে দেয় পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে। প্রসঙ্গ যদি হয় গুরুত্বের তাহলে আহনাফের শূন্যতাকে ইঙ্গিত করা যায়। কাছে থাকতে যেই মানুষটির গুরুত্ব কিংবা সঙ্গ সে উপলব্ধি করেনি বরঞ্চ উপেক্ষা করে গেছে; দূরে যেতেই সে ধীরে ধীরে গুরুত্ব বুঝতে শিখে গেছে। কিন্তু ঐযে স্বভাবসুলভ সমস্যা তার! চাপা স্বভাব, গম্ভীরতার কারণে মুখ ফুটে বলতেও পারছে না, ‘আমি তোমাকে সত্যিই খুব মিস করি।’ পাছে মেয়েটা কী না কী ভেবে বসে। হাসবে বোধ হয় খুব! তবে হ্যাঁ, সে নানা আকার-ইঙ্গিতে হোক, গানের ভাষায় হোক নিজের অবস্থান বোঝানোর জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে। কিন্তু হায়! মেয়েটা বোঝে নাকি বোঝে না কে জানে!
অপরদিকে পরিস্থিতির সাথে, সময়ের সাথে নিজেকেও মানিয়ে নিয়েছে অর্ষা। বন্ধুদের সঙ্গ, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গ, মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি যাওয়া এসব কিছুর মাঝেই অর্ষা আটকে আছে। অন্যকিছু ভাবার সময়ই হয়ে ওঠে না। তাতেই বা কী আসে যায়? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেও মনকে সে মানিয়ে নিতে পারেনি। পারেনি কোনো রকম বুঝ দিতে। অবাধ্য মন বারবার ছুটে যেতে চায় সে গম্ভীর, রাশভারী মানুষটির কাছে। ইচ্ছে করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের তেষ্টা মেটাতে। কত যে আকুলতা মানুষটিকে একবার জড়িয়ে ধরার জন্য তা যদি সে জানত, তৎক্ষণাৎ ছুটে আসতো সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে। সে না কখনো মানুষটিকে মুখ ফুটে এসব কথা জানাতে পারবে, আর না সেই মানুষটা কখনো জানতে পারবে! সময় শুধু শিখিয়ে, বুঝিয়েই দেয় না; মাঝে মাঝে প্রবল আফসোস ও দীর্ঘশ্বাসের কারণও হয়।
দুপুর তিনটা পার হয়েছে। ঘড়ির বড়ো কাঁটাটি এখন দশের দিকে। রেণু মিল্কশেক বানিয়ে এনেছে। গ্লাসটি টেবিলের ওপর রেখে বলল,
‘আপা খাইয়া লন। গরমের মইধ্যে ভালো লাগব।’
অর্ষা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,’উঁহু! আমার একটুও ভালো লাগে না। বমি চলে আসে।’
‘তাও খাইতে হইব। খালার আদেশ।’
শাশুড়ি মায়ের আদেশ অমান্য করার মতো সাহস বা কলিজা অর্ষার নেই। মা যখন বলেছে খেতে, তখন সে অবশ্যই খাবে। গ্লাসটি হাতে নিয়ে সে রেণুকে জিজ্ঞেস করল,
‘ফ্রিজে আইস কিউব আছে রেণু আপু?’
‘হ, আছে তো।’
‘এনে দেবেন?’
রেণু হেসে ফেলে। হেসে হেসেই বলে,’আপনে যে কেমন বাচ্চাগো মতো মুখটা করেন না! আনতাছি আমি।’
রেণু গিয়ে চার টুকরা আইস কিউব এনে গ্লাসে দিয়ে দেয়। মিল্কশেকে বরফ কুচি কিংবা আইস কিউব মিশিয়ে দিলে খেতে মন্দ লাগে না। অর্ষা গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বলল,
‘রেণু আপু, কাজ না থাকলে একটু বসেন।’
রেণু বসল। কয়েক চুমুকে গ্লাস খালি করে হাতের উল্টোপিঠে মুখ মুছে নিল অর্ষা। ওড়নায় হাত মুছে বলল,’মা কী করেন?’
‘শুইছে মনে হয়।’
‘আহিল বাসায় নেই?’
‘না। ভাইজান তো খালুর লগে অফিসে গেছে।’
‘আহিল ভালোই দায়িত্ব বুঝে নিতে শিখে গেছে।’
‘হ। এই বাড়ির দুই ছেলেই ব্যাপক ভালো আপা। তয় রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না।’
‘কেন? কিছু হয়েছে নাকি?’
‘এখন কিছু হয় নাই। আপনে যহন বিদেশ গেছিলেন গা তহন আহিল ভাইজান খুব রাগ করছিল। তার একটাই কথা ক্যান তারে না জানাইয়া আপনেরে একা পাঠাইছে।’
অর্ষা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ওর মতো ফ্রেন্ড পাওয়া আসলেই খুব ভাগ্যের ব্যাপার। আর নিঃসন্দেহে আমি সেই ভাগ্যবতী।’
‘দোয়া করি, আপনে সারাজীবন এমন সুখে থাকেন আপা।’
‘জানেন রেণু আপু, আমার জীবনে মানুষের আনাগোনা খুব বেশি নয়। বিয়ের পর মানুষের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। বাবা-মা, আপনি, সুইজারল্যান্ডে লিলিয়া আন্টি আর স্মিথ। আপনারা এত বেশি আপন হয়ে গেছেন যে, মাঝে মাঝে যদি কখনো ভাবি এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাহলে দম আটকে আসে আমার।’
‘ধুর আপা! আপনে যে উল্টাপাল্টা কী ভাবেন। আমরা সবসময়ই থাকমু। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা কই?’
‘বলেন।’
‘বিয়ের পর সবার কথাই তো কইলেন। বড়ো ভাইজানের কথা কইলেন না ক্যান?’
অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই প্রশ্নের উত্তর তো তার জানা নেই। সে মানুষটির কথা কেন বলল না? দ্বিধার জন্য? প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘তার কথা আর কী বলব! সে তো ব্যস্ত মানুষ। তার থাকা না থাকা একই কথা।’
‘আপনে কি আবার বিদেশে চলে যাইবেন?’
‘জানিনা। তবে ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে খুব মিস করি। বিড়ালদুটো তিয়াসের মতো আমার নেউটা ছিল।’
‘হ জানি। ভিডিয়োতে দেখছিলাম।’
অর্ষা বিস্মিত হয়। সে তো কখনো ভিডিয়ো করেনি। পাঠায়ওনি। তাহলে? অবাক হয়ে জানতে চাইল,’কীসের ভিডিয়ো?’
‘বড়ো ভাইজান খালার মোবাইলে পাডাইছিল। তহন দেখছিলাম।’
অবাক হওয়ার পাশাপাশি মনে মনে একটু খুশিও হয় অর্ষা। লুকিয়ে লুকিয়ে সে তাহলে ভিডিয়ো-ও করত!
মনে মনে হেসে ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে তিনটার বেশি বাজে। গল্প করে অনেকটা সময়ই কেটেছে। অর্ষা উঠে গেল। ওয়ারড্রব থেকে বোরকা বের করে রেডি হতে হতে বলল,
‘আমি একটু আমাদের বাড়িতে যাব। তিয়াসকে দেখতে। মা ঘুম থেকে উঠলে বলে দিয়েন। আর আহিল যদি আমার আসার আগেই চলে আসে তাহলে বলে দিয়েন আমায় নিয়ে আসতে। রাত হওয়ার আগে যদি আমি চলে আসি তাহলে তো আসলামই।’
‘আইচ্ছা। সাবধানে যাইয়েন।’
.
.
অর্ষা যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছায় তিয়াস তখন উঠানে পাটির ওপর বসে খেলছিল। অর্ষাকে দেখতে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে এমনভাবে দৌঁড়ে ছুটে যায়। অর্ষা তিয়াসকে কোলে নিয়ে চুমু খায়।
কুসুম বারান্দায় বসে রান্না করছিল। অর্ষা বারান্দার দিকে যায়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো ভাবি?’
কুসুম বসার জন্য একটা বেতের মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল,’ভালো আছি। বোস।’
তিয়াসকে কোলে নিয়েই অর্ষা বসল। অর্ষার আনা চকোলেট খাওয়ায় ব্যস্ত তিয়াস।
‘ভাইয়া কখন আসবে?’ জানতে চাইল অর্ষা।
কুসুম তরকারি কাটতে কাটতে বলল,’সাতটায় ছুটি হবে। আসতে আসতে সাড়ে সাতটা বাজবে। চা বানিয়ে দেবো?’
‘উঁহু। চা খাব না এখন।’
‘তাহলে শরবত বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘কিছুই লাগবে না ভাবি। তুমি বসো।’
কুসুম শুনল না। সে ঘরে গিয়ে চিনির বয়াম আর ফ্রিজ থেকে লেবু এবং ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো। তরকারি কাটা বাদ দিয়ে শরবত বানাচ্ছে আগে। অর্ষা অভিভূত হয়। ভাবির মধ্যেও কত পরিবর্তন এসেছে! যেই ভাবি আগে অর্ষাকে দূর দূর করত সেই ভাবিই এখন অর্ষাকে আপ্যায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
শরবত বানিয়ে কুসুম আবার তরকারি কাটছে। অর্ষা শরবতের গ্লাসে এক চুমুক দিতেই তিয়াস বলল,’আমিও ছলবত কাব।’
অর্ষা আর খেল না। কুসুম খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল,’কেয়ার সাথে কি তোর কথা হয়?’
অর্ষা তাকিয়ে থাকে। উত্তর দেওয়ার আগেই কুসুম ফের বলে,’আমায় মিথ্যা বলবি না খবরদার! সত্যিটা বল।’
‘না। রেজাল্টের দিন ফোন দিয়েছিল শুধু।’
কুসুম অবাক হয়ে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,’কেন? কী বলেছে?’
‘ভালো রেজাল্ট করার জন্য শুভকামনা জানিয়েছে।’
‘আর কিছু বলেনি?’
‘না। ফোনই যায়নি আর। ব্লক করে দিয়েছে নাকি হোয়াটসএপ একাউন্টই ডিলিট করে ফেলেছে বলতে পারি না।’
কুসুম চুপ হয়ে যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে তরকারি কাটলেও মন বলছে, সে অন্য কিছু ভাবছে। অর্ষা তাকে ঘাটায় না। নিরব থেকে তিয়াসকে শরবত খাইয়ে দিচ্ছে।
মৌনতা কাটিয়ে কুসুম নিজেই বলল,’কেয়ার সাথে আমার মাঝে মাঝেই কথা হয়।’
অর্ষা বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চায়,’সত্যিই? কোথায় আছে এখন আপু?’
‘সিলেটে আছে।’
‘কেন সেদিন চলে গেছিল জিজ্ঞেস করোনি?’
‘করেছি। ওর সম্পর্ক ছিল একটা। তার সাথেই পালিয়েছে।’
‘তাহলে বিয়েতে কেন রাজি হয়েছিল?’
কুসুম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আমার প্রেশারের জন্য। কিন্তু কে জানত বিয়ের দিনই এমন অঘটন ঘটাবে? আসলে কী বলত, ভাগ্যে বিয়ে ছিল তোর সাথেই। তাই এমন হয়েছে।’
‘আপু আসে না কেন তাহলে?’
‘তোর ভাইয়ার জন্য। কেয়া ফোন করেছিল বলেছিলাম বলেই যা তা শুনিয়েছে আমায়। তাই আমিই আসতে বারণ করেছি। যার হাত ধরে পালিয়েছে তার সাথেই থাকুক। আমাদের কাছে আসার আর কী দরকার?’
‘তাই বলে এমন দূরে রাখবে? মাফ করে দিলেই তো পারো।’
‘ও যা চেয়েছে তাই করেছে। এখন আর মাফ করে কী হবে?’
‘কোন নাম্বার চালায় এখন? আছে তোমার কাছে?’
‘আমার ফোনে সেভ করা আছে দেখ। ফোন ঘরে ওয়ারড্রবের ওপর রাখা।’
তিয়াসকে কোল থেকে নামিয়ে অর্ষা ঘরে যায়। ফোন থেকে কেয়ার নাম্বারটি নিজের নাম্বারে টুকে নেয়। এতদিন যত অভিমান, রাগ ছিল এখন আর সেসব নেই। কতগুলো মাস পার হয়েছে দুজনের দেখা হয় না!
নাম্বার নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আহনাফের কল আসে। মুচকি হাসি ফুটে ওঠে অর্ষার ঠোঁটের কোণে। বাইরে না গিয়ে ঘরেই বসে। ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়।
আহনাফ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,’কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তোমাদের বাসায় এখন?’
‘হুম। আপনাকে কে বলল?’
‘মাকে ফোন করেছিলাম। বাসায় যাবে কখন?’
‘ভাইয়া আসলে দেখা করে যাব।’
একটু থেমে নিজেই বলল,’একটা কথা বলি?’
‘হু।’
‘আপনি আসবেন কবে?’
‘কেন? মিস করছ?’
অর্ষা থতমত খেয়ে বলল,’তেমন কিছু নয়। সবাই জিজ্ঞেস করে তাই জানতে চাইলাম।’
‘ও তুমি নিজে থেকে জানতে চাওনি তাহলে! জানিনা শিওর কবে যাব। ঈদের কিছুদিন আগে হয়তো। নয়তো ঈদের পর।’
‘না আসলেই হয়। কোথায় এখন?’
‘বাইরে। রেস্টুরেন্টে আছি। আমি হেলেন আর গ্লোরিয়া।’
গ্লোরিয়ার নাম শুনে মেজাজ গরম হয়ে যায় অর্ষার। কোনো রকম নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,’ঠিক আছে রাখছি এখন।’
‘কেন? ব্যস্ত তুমি?’
অর্ষার হোয়াটসএপের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে তখন। চেক করে দেখে গ্রুপে রেশমির ম্যাসেজ,’তোরা কোথায় কে আছিস রে! তাড়াতাড়ি কলে আয়। স’র্ব’না’শ হয়ে গেল রে!’
ম্যাসেজ দেখে অর্ষা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ওর আবার কী হলো! এদিকে অর্ষাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আহনাফ বলল,’কী হলো?’
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অর্ষা বলল,’অ্যা? না, কিছু না। আমাদের বাসায় আছি তো। পরে কথা বলব।’
‘আচ্ছা।’
‘রাখছি। আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘অর্ষা, শোনো?’
‘জি।’
কিছুক্ষণ দু’পাশেই নিরবতা চলে। আহনাফ ক্ষীণস্বরে বলে,’মিস ইউ!’
চলবে…