#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
ভালোবাসার জন্য কাতর এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। একটু চাওয়া, একটু পাওয়াতে যে এত সুখ, এত আনন্দ থাকতে পারে তা বোধ করি দুটো ভালোবাসার মানুষ ব্যতীত আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে দরজার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে বারান্দা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা অর্ষার মুক্ত কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয় আহনাফ। আবেশে বন্ধ দু’চোখের পাতা ভেদ করেও দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অর্ষার।
এক হাতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে রেখে অন্য হাতে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল আহনাফ। লাইট নেভানোর প্রয়োজন হলো না। এর পূর্বেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দও শোনা যাচ্ছে। মৃদু আঁৎকে উঠলেই বাহুর বন্ধন আরো জোড়াল করছে আহনাফ। তার ইচ্ছে করছে অর্ষাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে। সজ্ঞানে এবার সে অসম্ভবপর একটি কাণ্ডও ঘটিয়ে ফেলল। প্রগাঢ় চুম্বনে নিবদ্ধ করে নিল প্রিয়তমার ওষ্ঠদ্বয়। বৃষ্টির রাতকে সাক্ষী রেখে রহস্যময় সুন্দর রজনী কাটে দুজনের। যে প্রহরটি দুজনের জন্যই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত তবে ইচ্ছেময়!
_______
মাটির সোঁদা গন্ধে মুখরিত চারপাশ। তিয়াসকে কোলে নিয়ে বসে আছে অর্ষা। তার চোখে-মুখে খুশির আবরণ। আহনাফ আজ এই বাড়ি থেকেই অফিসে গেছে।
ভাই-ভাবি বাড়িতে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কুসুম আর তিয়াসকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই রুহুল অফিসে চলে গেছে। কুসুম শাড়ি পাল্টে অর্ষার পাশে এসে বসল। আড়দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘মিটিমিটি হাসছিস কেন?’
অর্ষা হকচকিয়ে যায়। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলে,’কই না তো!’
‘রোজা আছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘টুম্পা এসেছিল?’ তিয়াসের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল কুসুম।
অর্ষা এবার লজ্জায় পড়ে যায়। ভাবিকে কী করে সে কথাটি জানাবে বুঝতে পারছে না। উত্তর না পেয়ে কুসুম তাকাল অর্ষার দিকে।
অর্ষা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল,’এসেছিল। কিন্তু পরে চলে গেছে।’
‘চলে গেছে কেন? তোর ভাই না বলে এসেছিল তোর সাথে যেন থাকে।’
অর্ষা ফাঁকা ঢোক গিলে। মনে মনে প্রবোধও গুনে। এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আহনাফ তার স্বামী। সে আসতেই পারে। রাতে থাকতেও পারে। এই সহজ সত্যি কথা বলতে এত কীসের ভীরুতা? কীসেরই বা এত ইতস্ততা?
সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,’থাকার জন্যই এসেছিল। আহনাফ এসেছিল রাতে তাই টুম্পা চলে গেছিল।’
‘কী বলিস! ও আসবে আগে বলবি না? রাতে শাক, ডিম দিয়েই ভাত খাইয়েছিস?’
‘হু। আমিও জানতাম না সে আসবে।’
‘কোথায় এখন?’
‘অফিসে গেছে।’
কুসুম এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ কেয়ার কথা বলল। বোনের জন্য যে হৃদয় পুড়ে সেটা স্পষ্ট। অর্ষা কুসুমকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘তুমি অযথা আর টেনশন কোরো না। আজকে ভাইয়া আসলে আমি কথা বলব।’
দুপুরে গোসল করে নামাজ পড়ে শুয়েছে মাত্র সেই সময়ে আহনাফের ফোন আসে। মুচকি হাসে অর্ষা।
ফোন রিসিভ করে অভিমানীকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’সকালে অফিসে পৌঁছে ফোন করেননি কেন?’
‘সত্যি কথা বলব নাকি মিথ্যা কথা?’
‘অবশ্যই সত্যি কথা বলবেন।’
‘আমার না! আমার না খুব লজ্জা লাগছিল।’
আহনাফের কথার ধরণ শুনে অর্ষা খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর হাসির শব্দ ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে নিরব হয়ে শোনে আহনাফ। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যে রকম অনুভূতির সঞ্চার দুটি হৃদয়ে বহমান থাকে এই দুটো মানুষের অবস্থানও ঠিক সেরকম।
আহনাফের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অর্ষার হাসি মিলিয়ে যায়। লাইনে আছে নাকি কেটে দিয়েছে শিওর হওয়ার জন্য কান থেকে ফোন সরিয়ে নিয়ে দেখল একবার। লাইনে তো ঠিকই আছে। সে পূণরায় ফোন কানে নিয়ে বলল,
‘হ্যালো।’
ওপাশ থেকে ফিরতি উত্তর এলো,’শুনছি।’
‘চুপ করে আছেন কেন?’
‘বললাম তো, শুনছি।’
‘আমি তো এতক্ষণ কিছু বলিইনি। আপনি কী করে শুনলেন?’
‘সবসময় শুধু কথাই শুনতে হবে?’
‘তবে?’
‘হাসির শব্দ শুনছিলাম।’
অর্ষা থমকে যায়। কণ্ঠ খাদে ফেলে বলে,’ধুর! এখন থেকে তো আপনার সামনে হাসতে গেলেও আমার দশ বার ভাবতে হবে। কেমন না কেমনভাবে হাসি আমি আল্লাহ্ ভালো জানে।’
‘তিনি তো সবকিছুই জানেন। সত্য জানেন। আমিও তোমার হাসির ব্যাপারে জানি।’
‘কী জানেন?’
‘এইযে, তোমার হাসি সুন্দর। হাসির শব্দও সুন্দর।’
‘চাপা!’
‘শোনো, আমি কোনো মেয়ে পটাচ্ছি না যে চা’পা’বা’জি করতে যাব। আর এসব মেয়ে পটানো-ফটানো আমার ধাতে নেই। আমি আমার বিয়ে করা বউয়ের হাসির প্রসংশা করছি। তার হাসি কার কাছে কেমন সেসব জেনে তো আমার কোনো কাজ নেই। আমার বউ আমার কাছে সেরা। তার হাসি আমার কাছে বিশ্বের সব মেয়ের হাসির থেকে সুন্দর। তোমার কোনো দ্বিমত আছে?’
‘দ্বিমত থাকলেও কি মানবেন?’
‘তা অবশ্য মানব না।’
‘যাই বলেন, আমি কিন্তু পটে গেছি।’
‘পটলেও তুমি আমার। না পটলেও তুমি আমার। তোমার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। ইউ আর পার্মানেন্ট মাইন।অনলি মাইন।’
অর্ষা মুচকি হাসে। যতটা ধৈর্য ধারণ সে করেছিল তার ফল বোধ হয় এখন পাচ্ছে। অন্যপাশ ফিরে শুয়ে বলল,
‘আপনি কি একটা কথা জানেন?’
‘কী?’
‘আপনি যে অনেক রোমান্টিক? অবশ্য আমি কখনো ভাবিওনি আপনি এত রোমান্টিক। আমি তো ভাবতাম আপনার মধ্যে রসকষ কিচ্ছু নেই।’
আহনাফ শব্দ করে হেসে ওঠে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বলে,’আমিও জানতাম না। জানব কী করে বলো? আগে তো আর বউ ছিল না।’
‘ওহ আচ্ছা আপনি যে রোমান্টিক তা শুধু আমাকেই জানাচ্ছেন?’
‘অবশ্যই। তুমি কি চাচ্ছ আমি পুরো বিশ্ববাসীকে জানাই?’
অর্ষা হেসে বলল,’না।’
‘দেখো তুমি যদি চাও, আমি পুরো বিশ্বকে জানাতে রাজি আছি আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি। তবে আমি কতটা রোমান্টিক, আমার মাঝে কতটুকু প্রেম রয়েছে তা শুধু একমাত্র তুমিই জানবে। তুমিই এই প্রেমের, এই ভালোবাসার হকের দাবিদার।’
‘আমি চাই আপনি আমায় কতটা ভালোবাসেন এটা শুধু আমিই জানি, আমিই বুঝি। আমার বড্ড ভয় হয়। যদি এই ভালোবাসায় কারো নজর লেগে যায়?’
‘লাগবে না। তুমি আমি আমরা সারাজীবন একসাথে থাকব। একসাথে বাঁচব।’
‘আপনি অন্যদের সামনে যেমন গম্ভীর, রাশভারী ছিলেন তেমনই থাকবেন ঠিক আছে?’
আহনাফ হেসে বলল,’ঠিক আছে। আর তুমিও যেমন চুপচাপ, ভীতু আর বোকা স্বভাবের ছিলে তেমনই থাকবে। তোমার চঞ্চলতা, তোমার চোখে আমার জন্য অস্থিরতা শুধু আমিই দেখতে চাই।’
চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির হাসি হাসে অর্ষা। ফোনের অপর প্রান্তে প্রাণ জুড়ানো হাসিতে মনকে তৃপ্ত করে আহনাফ নিজেও।
.
.
সকালের মেজাজ ভীষণ খারাপ। কাদা-পানি পেরিয়ে সে খুব সাবধানে পা ফেলে হাঁটছে। মেজাজ খারাপের কারণ তার ভাই মাহিত। গতকাল রাতে বলল,
‘সকাল তুই রেডি থাকিস। আমি তোকে স্কুলে দিয়ে আসব।’
সকালও তাই ওর বান্ধবীদের বলে দিয়েছে স্কুলে চলে যেতে। রেডি হয়ে বের হবে তখন সেলিনা বেগম জানালেন জরুরী কাজে মাহিত আরো আগেই অফিসে চলে গেছে।
এ কথা শোনার পর মিষ্টি মেয়ে সকালের সকালটাই খারাপ হয়ে গেল। মেজাজ খারাপ নিয়ে সে কী পরীক্ষা দেবে কে জানে।
বাম সাইডের রাস্তা থেকে রিকশার টুংটাং শব্দ শুনে সকাল দাঁড়িয়ে যায়। বৃষ্টিবাদলের দিনে রিকশা পাওয়া মানে খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ভাড়া যদিও তখন প্রায় আকাশচুম্বী, তবে উপায় নেই। কাদার মধ্যে হাঁটার চেয়ে একটু বেশি ভাড়া দিয়ে স্কুলে পৌঁছানোটা জরুরী।
রিকশা থামানোর জন্য হাত বাড়াতে গিয়েও নামিয়ে ফেলে সে। ফাঁকা রিকশা নয়। মানুষ রয়েছে। রিকশাটি তবুও তার সামনে এসে থামল। পেছনে বসে থাকা প্যাসেঞ্জারটি অন্য কেউ নয়। যার জন্য সে পাগল, সেই ছেলে। আহিল। হুড তুলে রাখায় বুঝতে পারেনি তখন।
আহিল আগাগোড়া পরখ করে সকালকে। সাদা সালোয়ার আর সাদা জুতায় অনেকখানি কাদার ছিঁটে লেগে আছে। কামিজের এক কোণায় কাদার ছোপছোপ দাগ। সে এবার সকালের মুখের দিকে তাকাল।
আহিলকে এমনভাবে তাকাতে দেখে লজ্জায় পরে গেল সকাল। সে জানে তার বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। এই সময়েই কি তার আহিলের সঙ্গে দেখা হতে হলো? কী দরকার ছিল? সে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অথচ তার স্কুলে পৌঁছানো খুব প্রয়োজন। পা চলছে না। স্তব্ধ হয়ে দৃষ্টি রেখেছে রাস্তার অন্য পাশে।
‘পরীক্ষা তোমার?’ থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল আহিল।
সকাল মুখে কিছু বলল না। শুধু উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল।
‘তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন এখানে?’
‘রিকশার জন্য।’
‘উঠে আসো।’
‘জি?’
‘বললাম রিকশায় উঠে আসো।’
সকাল কী যেন একটু ভাবল। বলল,’না, থাক। আমি যেতে পারব।’
‘যেতে পারবে সেটা আমিও জানি। পরীক্ষার সময় মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত। এভাবে রিকশা না পেয়ে বিরক্ত হলে মাথা আর ঠান্ডা থাকবে না।’
‘অন্য রিকশা নিয়ে নেব।’
‘আরে বাহ্! তুমি কি আমায় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছ?’
‘একদম না। আপনি ভুল ভাবছেন। তাছাড়া আপনিই তো বলেছিলেন, আমি যেন আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি।’
‘তা ঠিক। কিন্তু এখন তো তোমার রিকশাটা প্রয়োজন। ঠিক আছে আমি নেমে যাচ্ছি। তুমি যাও এই রিকশায়।’
‘আপনি কেন নামবেন? আপনি যান। সমস্যা নেই তো।’
আহিল রিকশা থেকে নেমে বলল,’রাস্তার ঐ পাড়েই আমার বন্ধুর বাসা। এটুকু আমি হেঁটেই যেতে পারব। তুমি যাও।’
‘সত্যি বলছেন? মিথ্যে হলে নামার প্রয়োজন নেই। আমরা রিকশা শেয়ার করতে পারব।’
‘সত্যিই। এবার যাও তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে না?’
সকাল হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে থাকলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে।
সে রিকশার কাছে গিয়ে বলল,’যাই তবে।’
‘সাবধানে যেও। মন দিয়ে পরীক্ষা দিও।’
‘দোয়া করবেন।’
‘অবশ্যই। বাই দ্য ওয়ে, কী পরীক্ষা এখন?’
‘সাময়িক।’
‘আচ্ছা। সাবধানে যেও।’
আহিল রিকশাওয়ালাকে বলে দিল,’মামা স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়েন।’
এরপর ভাড়াটাও সে মিটিয়ে দিল। সকাল অবশ্য বাধা দিয়েছিল কয়েকবার। রিকশা চলতে শুরু করার পর আহিলও হাঁটতে শুরু করে। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে সে রিকশা খুঁজছে। সকালকে রিকশাটা দেওয়ার জন্যই কিছুক্ষণ পূর্বে সে মিথ্যে বলেছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল বিধায় বাইক নিয়ে আজ বের হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুপথ এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশাও পাওয়া গেল।
আহিল এসে পৌঁছিয়েছে অফিসে। আহনাফ এখন প্রায়ই অফিসে আসে বলে,সে একটু ঢিলেমি করছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছিল তাই আর সকাল সকাল অফিসে আসেনি।
.
দু’দিন পরেই অর্ষাকে বাসায় নিয়ে আসে আহনাফ। ভালোবাসা আদান-প্রদান হওয়ার পর থেকে দূরত্ব রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। একটু পরপরই প্রিয় মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। যাচ্ছে তাই অবস্থা!
রুহুলের সাথে অর্ষার কথা হয়েছে। কেয়ার নাম শুনেই মুখটা প্রথমদিকে গম্ভীর করে ফেলেছিল। অর্ষা সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে রুহুলের মন গলিয়ে ফেলেছে। কুসুম তখন কিছুই বলেনি। বোনের জন্য কোনো রকম সাফাইও গায়নি। কারণ সে খুব ভালো করেই জানত, আর যাই হোক না কেন রুহুল অর্ষার কথা ফেলবে না। কেননা সময় যে বদলিয়েছে। অর্ষার নিরব দাপট রয়েছে এই বাড়িতে, ভাইয়ের কাছে। তবে এ কথাও সত্য অর্ষা পূর্বে যেমন ছিল,
বর্তমানেও তেমনই আছে। ওর মধ্যে দাপুটে কোনো ভাব কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। বোধ করি কখনো হবেও না। মেয়েটার মনটা যে ভীষণ নরম!
কেয়াকে মেনে নিতে রাজি তো হয়েছে রুহুল। তবে একটা শর্তও মাঝখানে জুড়ে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ির সবাইকে এমনকি আহনাফকেও তার নিজের মানাতে হবে। তাহলেই কেয়াকে ক্ষমা করে দেবে। শ্বশুরবাড়ির বাকিদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ম্যানেজ করা যাবে। তার ভয় তো শুধু আহনাফকে নিয়েই। না জানি সে বিষয়টা কেমন ভাবে নেয়। অথবা কেয়ার নাম শুনলেই আবার রেগে যায় কিনা।
সন্ধ্যায় ইফতারের পর ভয়ে ভয়ে সে আহনাফকে বলল,’একটা কথা বলতাম।’
আহনাফ নামাজ পড়ে এসে শুয়েছে মাত্র। ক্লান্তস্বরে বলল,’বলো।’
‘রাগ করবেন না বলেন?’
‘তার মানে তুমি রাগ করার মতোই কোনো কথা বলবে। আচ্ছা তাও রাগ করব না বলো।’
কেয়ার বিষয়টা শুরু থেকে সব বিস্তারিত বলল অর্ষা। আহনাফ নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেছে। মাঝখানে কোনো কথা বলেনি। অর্ষার বলা শেষ হলে সে বলল,
‘বুঝলাম। বেশ ভালো। অতীতে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল, আমার রাগে
-ক্ষোভও ছিল ঠিক। সুইজারল্যান্ডে তোমায় আমি একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?’
‘কী?’
‘সময় অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। আজও আমি এই কথাটাই বলছি। সে তোমার বেয়াইন। বড়ো বোনের মতো। সেই পরিচয়টাই এখন থেকে বহাল থাকবে। অতীতে কী হয়েছিল না হয়েছিল সেসব আমি আরো আগেই মন থেকে মুছে ফেলেছি। তোমরাও ভুলে যাও আর তাকেও ভুলে যেতে বলে দিও।’
অর্ষার ওষ্ঠদ্বয়ে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। আহনাফ চোখ বন্ধ করে বলল,’আর কিছু?’
‘না।’
সে অর্ষার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে কাছে এনে বলল,’এবার একটু জড়িয়ে ধরো।’
হাতে টান পড়ায় সে আহনাফের অনেকটাই কাছে চলে গেছে। তার আর জড়িয়ে ধরতে হলো না। অর্ষাকে শুইয়ে আহনাফ নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
______
বন্ধুদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না অনেকদিন। সময়ের সাথে সাথে গ্যাঞ্জাম পার্টির গ্যাং-ও কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটি গ্যাং এর কোনো সদস্যরই ভালো লাগছে না। ভীষণ খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে সেই আগের সময়টিতে চলে যেতে। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সকলে একত্রে গ্রুপ কলে আসে।
আশিকের মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। লামিয়া তাই বলল,’কিরে আজ যে এখনো কোনো কবিতা বললি না?’
আশিক দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে। একটু নড়েচড়ে বলল,’সারাদিন তোদের মতো গিলি না। আমি রোজা রেখেছি। এখন মুখ দিয়ে কথা বের করতেই কষ্ট হচ্ছে। আর তুই আছিস কবিতা নিয়ে।’
জুঁই ‘চ’ এর মতো শব্দ করে বলল,’আহারে! বেচারা।’
‘কিছু বললাম আজ জুঁই। যা ইচ্ছে আজ কর তুই।’
রেশমি বলল,’আচ্ছা শোন, তোদেরকে একটা কথা বলার আছে।’
দিদার ফ্রুুটোর বোতলে চুমুক দিয়ে বলল,’নখরামি না করে বলে ফেল।’
‘মাহিত তোদের সবাইকে একটা ট্রিট দেবে বলেছে ইফতারের পর। কোনদিন যাবি বল?’
দিদার হড়বড় করে বলা শুরু করে,’এটা তুই আগে বলবি না? চল যাই এখনই।’
আহিল মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’মাথা ঠিক আছে? রাত বাজে ১১টা। আর এখন যাবি রেস্টুরেন্টে খেতে? সারাটা জীবন খাই খাই করে গেলি।’
‘জীবনে খাওয়া ছাড়া আর কী আছে বন্ধু? যাই হোক, ডেট তাহলে আগে আগেই ফিক্সড কর। খাওয়ার বেলায় বেশি দেরি করতে নেই।’
সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল আগামী পরশু সবাই মিলে দেখা করবে। আর ট্রিট তো অবশ্যই দেবে মাহিত।
সকাল সাতটার দিকে জহির চৌধুরী, আহনাফ আর আহিল অফিসে চলে গেছে। বাসায় এখন আমেনা বেগম, অর্ষা আর রেণু। আজকে আফরিনের আসার কথা। তাই আমেনা বেগম ভীষণ অস্থির হয়ে আছেন। এতদিন বাদে মেয়ে আসবে এটা কি কম খুশির খবর নাকি। যদিও প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়। ফোনে কথা হওয়া আর সামনে থেকে মেয়েকে কাছে পাওয়া, আদর করার মাঝে বিস্তর তফাৎ রয়েছে।
তিনি রেণুকে রান্নার বন্দবস্ত করতে বলছেন। কী কী জোগার করবে তারই ফরমায়েশ করছেন। শাশুড়ির চোখে-মুখে ছড়িয়ে থাকা আনন্দটুকু দূর থেকে লক্ষ্য করে অর্ষা। এখন কেন জানি অর্ষার কাছে মনে হচ্ছে, আমেনা বেগমের বয়স অনেক কমে গেছে। কেন এমনটা মনে হচ্ছে? হঠাৎ-ই তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। ওপাড়ে কেমন আছে মা? ভালো আছে কি? দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে সে আমেনা বেগমের কাছে এসে বসে। আমেনা বেগম একবার অর্ষার দিকে তাকিয়ে আবার রেণুর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কথা শেষ হলে তিনি অর্ষাকে জিজ্ঞেস করেন,’কী? কিছু বলবে?’
অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়ল।
‘শরীর খারাপ করছে?’
‘না। আমি ঠিক আছি। আপু কখন আসবে?’
‘গাড়িতে উঠেছে। বেশি সময় লাগবে না।’
‘রান্নাবান্না কি এখনই করবেন?’
‘হ্যাঁ। আফরিন এসে খাবে তো।’
অর্ষা জানতে পারে প্রতি মাসে মেয়েদের এক সপ্তাহের যেই ছুটিটা পাওয়া হয়, আফরিনও এখন তাই পেয়েছে। এজন্য সে রোজা নেই। রেণুর সাথে রান্না করছিলেন আমেনা বেগম। অর্ষাকে আসতে দেননি। আফরিনের জন্য আহনাফ আর আহিলও বেশিক্ষণ অফিসে থাকেনি। একটু আগেই চলে এসেছে। আফরিনও প্রায় এলো বলে। অর্ষা সোফায় চুপ করে বসে আছে। আহনাফের কাছেও যায়নি আসার পর থেকে। আজ তার মনটা ভীষণ খারাপ। কোনোভাবেই মনটাকে সহজ করতে পারছে না। খুব করে মাকে মনে পড়ছে। আহনাফ এসে একবার ডেকে গেল। প্রচণ্ড অনিহা নিয়ে সে রুমে যায়।
অর্ষাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে আহনাফ জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে? মন খারাপ?’
‘উঁহু! এমনিই ভালো লাগছে না।’
‘খারাপ লাগলে রেস্ট করো।’
অর্ষা কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ‘আসছি’ বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
রান্নাঘরে গিয়ে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল,’মা, জড়িয়ে ধরলে কি রোজা হালকা হয়ে যায়?’
আমেনা বেগম ব্যস্ত হাতে তরকারি নাড়ছিলেন। রেণু হা করে তাকিয়ে আছে। অর্ষার এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন আমেনা বেগম। যদিচ তিনি জানেন, অর্ষা নেহাৎ-ই প্রয়োজনের তুলনায়ও অধিক সহজ-সরল; তথাপি এমন প্রশ্নও করতে পারে ভেবে অপ্রস্তুত হোন বটে! কথাটা তো আহনাফকে জিজ্ঞেস করলেই পারত। নাকি এখনো দুজনের ঝগড়া চলে?
অর্ষা শাশুড়ির মুখের দিকে উত্তরের জন্য তাকিয়ে ছিল। তাকে নিশ্চুপ দেখে বিমর্ষ হয়ে বলে,’যদি হালকা না হয়, তাহলে আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতাম। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে!’
চোখের পাতা ভিজে ওঠে আমেনা বেগমের। অর্ষা তাকেই জড়িয়ে ধরার জন্য প্রশ্নটি করেছিল; আর সে কিনা ভেবেছে আহনাফকে জড়িয়ে ধরবে তাই এই প্রশ্ন করেছে!
তিনি এবারও অর্ষার কথার উত্তর দিলেন না। শুধু হাত টেনে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’তুই অনেক পাগলি রে মা, জানিস?’
অর্ষা কিছু বলে না। সে কাঁদছে। আনন্দের কান্না বোধ হয়! আমেনা বেগমের শরীরে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ আছে। অর্ষা তো পাচ্ছে। আচ্ছা এটাই কি মা মা ঘ্রাণ?
অর্ষা কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্য আহনাফও পিছু পিছু বেরিয়ে ছিল। যখন রান্নাঘরের বাইরে এসে এই দৃশ্য দেখল, তখন তার একই সাথে ভালো যেমন লাগল; তেমন আবার অর্ষার জন্য কষ্টও লাগল। প্রিয় মানুষের কোনো কষ্টই যেন সহ্য করা যায় না। সে বেশিক্ষণ সেখানে থাকল না। পাছে আবার বউ বা মা কেউ দেখে ফেলে। রেণুর চোখ ছলছল করছিল। সে পেয়াজ কাটতে কাটতে একটু কেঁদেও নিল। পেয়াজ কাটার এই হলো সুযোগ। পেয়াজের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করছিল বলে চোখ থেকে পানি বেরিয়েছে এমন অজুহাত দেওয়া যায়।
আমেনা বেগম রেণুর ফোঁপানোর শব্দ শুনে বুঝতে পারেন। অন্য হাতে রেণুকে টেনে জড়িয়ে ধরে বলেন,’আমার মেয়েগুলা সব আহ্লাদী।’
রেণু এবার খুশিতে শব্দ করেই কেঁদে ফেলে। চোখের পানি মুছে বলে,’আপনি মেলা ভালা মানুষ খালাম্মা। আপনে অনেক বছর বাঁইচা থাহেন আমি দোয়া করি।’
অর্ষাও চোখের পানি মুছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এখন তার কেমন যেন লজ্জা লাগছে। আবদারটা বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে না? আমেনা বেগম হেসে ফেলেন। অর্ষার গালে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলেন,’যা ঘরে যা।’
অর্ষা একছুটে রুমে চলে আসে। এতক্ষণে তার কলিজা ঠান্ডা হয়েছে। অস্থির অস্থির ভাবটা এখন আর নেই। আহনাফ একটা বই নিয়ে বসে ছিল। অর্ষাকে দেখতে পেয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
‘আচ্ছা রোজা রেখে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলে কি রোজা হালকা হয়? না মানে, যদি হালকা না হয় তাহলে বউটা যেন আমায় একটু জড়িয়ে ধরে।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ-১ অনেকের কাছেই সকাল চরিত্রটা ভালো লাগছে না। কেন ভালো লাগছে না তাও জানিনা। কয়েকজন যেই রিজন দেখিয়েছে সেটাও আমার কাছে ভিত্তিহীন মনে হয়েছে। গল্পের একদম শেষ প্রান্তে এসে আমায় নিশ্চয়ই এটাও বলে দিতে হবে না যে, আহিল গল্পের সাইড মেল ক্যারেক্টার। অর্থাৎ আহনাফের পাশাপাশি সেও একজন নায়ক। এখানে সে কোনো থার্ড পার্সন নয়। সূতরাং তার নায়িকা থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। আর আমি এই গল্পটিতে বন্ধুত্বকে শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জায়গাতেই রাখতে চেয়েছি এবং আমার সিদ্ধান্তে আমি বহালও থেকেছি। নতুবা ওদের সার্কেলে কোনো না কোনো একটা জুটি অবশ্যই থাকত। অনেকে গল্পের শুরুতে আহিল এবং অর্ষাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব ব্যতীত অন্য কোনো অনুভূতি যে নেই এটাও আমায় গল্পের মাঝে বারবার বোঝাতে হয়েছে। কাজেই সকাল ক্যারেক্টার কেন এনেছি, সেটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত। যারা আহিলকে পছন্দ করেন বলে মজা করে সকালকে স’তী’ন বলেন, এজন্য সহ্য হয় না বলেন তাদের বিষয়টা ভিন্ন। কিন্তু যাদের কাছে সিরিয়াসলি সকালকে এবং ওর চঞ্চলতা পছন্দ হচ্ছে না আমি তাদেরকে সাজেস্ট করছি, আপনারা ওর ঘটনাটুকু পারলে স্কিপ করে যাবেন। এতে সুবিধা এতটুকুই যে, আপনারা গল্পটা ঠিকমতো ইনজয় করতে পারবেন।
বিঃদ্রঃ-২ গল্পের আর মাত্র ৩টা পর্ব বাকি আছে। এই তিনটা পর্ব আমি একটু সময় নিয়ে লিখতে চাই। তাই প্রতিদিন গল্প চেয়ে চেয়ে কেউ প্রেশার দেবেন না প্লিজ! শেষের দিকে কোনো জগাখিচুড়ি হোক গল্পে সেটা আমি চাই না। কম তো অপেক্ষা করেননি। শেষেও একটু অপেক্ষা করুন, বেস্ট দেওয়ার চেষ্টা করব ইন-শা-আল্লাহ্।]