#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৭
#নবনী_নীলা
আদিল স্নিগ্ধার হাতে ক্রিমটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,” আমাকে আর সুযোগ দিতে না চাইলে চুপচাপ ক্রিমটা লাগিয়ে নাও। নয়তো তোমাকে এক্ষুনি, তুলে অন্য রুমে নিয়ে যাবো। তারপর তোমার সাথে যা যা হবে,সেটার দায় ভার সম্পূর্ন তোমার।” শেষের কথাটা বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো আদিল। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। মুখে যা আসে তাই বলতে হবে এই ছেলেকে। মানে নিজের লজ্জা না হয় নাই বা থাকবে তাই বলে অন্য কারোর নেই। স্নিগ্ধা কটমট করে তাকিয়ে আদিলের হাত থেকে ছো মেরে ক্রিমটা নিয়ে নিলো।
আদিল মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” তোমাকে ক্রিম হাতে নিয়ে বসে থাকতে বলিনি। আমি কিন্তু একটু পর চেক করবো।”
স্নিগ্ধা দাতে দাত চেপে বললো,” ব্যাথা দিয়ে এখন আবার হুকুম চালাচ্ছে। একদম ওনার সব কথা মেনে চলতে হবে আমায়।” বেশ ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বললো সে।
আদিল কথাটা শুনে ফেললো তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে বললো,” অবশ্যই মেনে চলবে। তুমি সবটুকুই তো এখন আমার। আমাকেই তো খেয়াল রাখতে হবে, তাই না?” বলেই ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে এক পলক স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।
স্নিগ্ধা মূর্তির মতন বসে আছে। কথাগুলো সে শুনেছে ঠিকই কিন্তু না শোনার ভান করে নিশ্চুপে বসে আছে। আদিলের এমন কথায় তার বুকের ভিতরটায় মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণে চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এই ছেলে এমন মারাত্মক আগে বুঝতে পারলে বিয়েই করতো না সে। তাহলে এমন বিপদে পড়তে হতো না।
আদিল ফ্রেশ হওয়ার জন্যে ওয়াশরুমে যেতেই স্নিগ্ধা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো। চুপচাপ মেয়ে হয়েও সে পড়েছে মুশকিলে এই ছেলের সব কথা তাকে চুপ করে হজম করতে হচ্ছে। স্পৃহা হলে ঠিকই দু চারটে কথা শুনিয়ে দিতে পারতো। তারা দুজনেই আপন বোন অথচ কতো অমিল দুজনের মধ্যে। আচ্ছা সে কেনো এমন হলো? ভেবেই এখন নিজের উপর রাগ লাগছে।
আদিল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো শুধু একটা ট্রাউজার পড়ে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পড়েছে । গৌড় বর্নের গা বেয়ে মুক্তর মতন পানি গড়িয়ে পড়ছে।
স্নিগ্ধা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এইটা বুঝাতে যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আর কিছু পারুক বা নাই বা পারুক এইটা অনেক ভালো করেই পারে। ছোটবেলায় মা বাবার ঝগড়া হলে কেউ কারোর সাথে কথা বলতো না। তখন স্পৃহা হয় নি তাই তাকে ম্যাসেঞ্জার মানে বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করতে হতো। শেষে বিরক্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে থাকতো। তখন উপায় না পেয়ে রেগে গিয়ে হলেও তারা দুজনে কথা বলতেন।
আদিল ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলো। তারপর এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধাকে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আদিল একটু অবাক হলো। মেয়েটা মাত্র পাঁচ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়লো। কীভাবে সম্ভব? আদিল একটু ঝুঁকে এসে কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। নাহ্ মনে তো হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাহ্ তার হাত থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। ক্রিমটা লাগিয়েছে কিনা কিভাবে জানবে সে? এই মেয়েকে ধরার উপায়ও নেই। ধরলেই তো কেপে উঠে, ঘুমের মাঝেও কেপে উঠবে। নাহ্ দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙ্গা ঠিক হবে না।
কিছুক্ষণ পর আদিল লাইট নিভিয়ে অভ্রর পাশে শুয়ে পড়তেই স্নিগ্ধা চোখ মেলে তাকালো। তারপর মুখ ভরে নিশ্বাস নিলো। যাক এই যাত্রায় বেঁচে গেছে।
______
আদিল নিজের অফিসে বসে আছে। স্নিগ্ধার ফোনের কল রেকর্ডিং একটু আগে শুনছে সে। তাই নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টায়, চেয়ারের হ্যান্ডেলে হাত ভাজ করে রেখে দুই আঙ্গুলে কপালের প্রান্ত ভাগ ধরে বসে আছে সে।
জিম ব্যাস্ত হয়ে রুমে এলো। পায়ের শব্দে আদিল চোখ খুলে তাকালো। তারপর কপাল থেকে হাত নামিয়ে দুই হাত টেবিলে রেখে মুষ্টিবদ্ধ করলো। আদিল চোয়াল শক্ত করে বললো,” খবর পেয়েছো?”
জিম মাথা নেড়ে বললো,” হুম, মিস সুনেয়রা নেক্সট উইকে দেশে ফিরছেন।”
আদিল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” আমি এইবার নিজেই গিয়ে দেখা করবো। তুমি সব ব্যাবস্থা করে রাখো।”
জিম চিন্তিত স্বরে বলল,” সরাসরি আপনার গিয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হবে? আমরা তো ছদ্মনামে চেষ্টা করছি।”
আদিল না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” আমার অপেক্ষা করার সময় নেই। ফাহাদ স্নিগ্ধা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, ওকে আমার বিরুদ্ধে তুলতে চাইছে। এরপর ও স্নিগ্ধার ফ্যামিলিকে টার্গেট করবে। আমার লাইফে আবার আসার আগেই ওকে আমি সরিয়ে ফেলতে চাই। তাই সবটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে। আর আবরার ফাইয়াজের ইনভাইটেশন বলে কথা, যে কেউ আসতে বাধ্য।”
জিম নিচু গলায় বললো,” স্যার, এইটা সেফ না। রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হবে?”
আদিল বাকা হেসে বলল,” ডোন্ট ওরি, আমার কিছু হবে না। ওদের অতো ক্ষমতা হয় নি।” বলেই আদিল নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুইটার কাছে এসে থেমেছে। আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” জিম তুমি আজ স্পৃহার কলেজে যাও নি? কারা ডিস্টার্ব করছে খুঁজে পেয়েছো?”
জিম নিশব্দে নিশ্বাস ফেললো তারপর বললো,” জ্বি, না। আমি গিয়েছিলাম কিন্তু কাউকে পাই নি! আমার ধারণা এই সবগুলোই স্পৃহার বানানো।”
আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” যেদিন তুমি রাত জেগে থাকো, সেদিন কি চোর চুরি করতে আসে? আসে না, সুযোগ বুঝে তবেই আসে। যারা ওকে ডিস্টার্ব করছে তারাও নিশ্চই সুযোগের অপেক্ষা করছে। জিম, ওরা যেনো সুযোগটা না পায়, দায়িত্বটা কিন্তু তোমায় দিয়েছি।”
জিম হতাশ চোখে তাকালো। আবার এই মেয়ের সাথে দেখা করতে হবে। চুপ চাপ শান্ত মেয়ে হলে কোনো কথা ছিলো না। এই মেয়ে তো কথা বলে বলে তার মাথা খারাপ করে দেয়। জিম নিরবে হতাশ হয়ে আদিলের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। এই মেয়েটা তাকে যে আর কত হয়রানি করবে কে জানে?
_______
স্নিগ্ধা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেই এই রহস্যের উন্মোচন করবে। এদের জিজ্ঞেস করে করে দাত পরে যাবে তবুও এরা তাকে কিছুই বলবে না সেটা তার বোঝা হয়ে গেছে। আদিলের বাবা এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি বেশির ভাগ সময়ই পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় তার এক বন্ধু আছেন। তাদের দুইজনেরই ঘুরে বেড়ানোর শখ।
স্নিগ্ধা সুযোগ বুঝে আনোয়ার সাহেবের ঘরে এলো। আদিলের রুমে এই কয়দিনে সে কম তল্লাশি চালায় নি। কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় নি। আনোয়ার সাহেবের রূমের নিশ্চয়ই ফ্যামিলি ফটো থাকবে। এভাবে রুমে আসতে তার বেশ অপরাধবোধ হচ্ছে কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই।
খুব সাধারণ ভাবে সাজানো রুমটা। ছোট একটা বিছানা যার দুপাশে দুটো মাঝারি সাইজের টেবিল ল্যাম্প। একপাশে বিশাল এক বুকসেলফ, পুরোটাই বইয়ে ভর্তি। তার পাশে একটা টেবিল। একপাশে একটা ইজি চেয়ার। ব্যাস এইটুকুই।
স্নিগ্ধা দেওয়ালে ভালো করে দেখলো। খুব সুন্দর কিছু পেইন্টিং। এই বাড়িতে একই চিত্র শিল্পীর অনেকগুলো পেইন্টিং রয়েছে। নামটা পেঁচিয়ে লেখার কারণে স্নিগ্ধা ঠিক পড়তে পারেনি।
কিন্তু এই রুমে একটা অন্য রকম পেইন্টিং নজরে পড়লো তার। মাঝে ছোট্ট একটা বাচ্চা, বাচ্চাটা অবিকল অভ্রর মতন। অবয়বটা দেখতে অনেকটা এক রকম লাগছে তার কাছে। একপাশে এক বৃদ্ধ হাতে লাঠি নিয়ে হাসি মুখে বসে আছে পরণে সাদা পাঞ্জাবি অন্যপাশে অভ্রকে পিছনে থেকে জড়িয়ে ঝুকে দাড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী এক যুবক। বৃদ্ধা আর যুবকটি নিশ্চই আনোয়ার সাহেব আর আদিল। কিন্তু পাশে মুচকি হেসে একটি রূপবতী মেয়ে দাড়িয়ে কোমল চোখে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটির অবয়বটা অন্যরকম পরণে গাঢ় নীল রঙের পাতলা একটা শাড়ি, কৃষ্ণ কালো চুলে কাঠ গোলাপের খোঁপা। পিছনে কৃষ্ণচূড়ার গাছটি যেনো এই ছবিটাকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
স্নিগ্ধা খেয়াল করলো এই পেইন্টিং ও একই চিত্র শিল্পীর। তার মানে এই চিত্র শিল্পী এদের সবাইকে খুব ভালো করে চিনে। কিন্তু কে সে? স্নিগ্ধা নিজের মোবাইলে ছবি তুলে নিলো। তারপর সময় নষ্ট না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। কোনো স্টাফ এইদিকে আসার আগেই তাকে বেড়িয়ে যেতে হবে। কারণ এই রুমে তাকে আবার আসতে হবে, তাই কেউ দেখে ফেললে সমস্যা। পরে দেখা যাবে এই রুমেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
______
স্পৃহা কলেজের থেকে বের হতে না হতেই তার মোবাইল বেজে উঠলো। স্পৃহা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো স্নিগ্ধার কল। হটাৎ এমন সময়ে মহারানীর কেনো তাকে মনে পড়লো? স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরে বললো,” হটাৎ এমন ভর দুপুরে ফোন করেছিস কেনো?”
স্নিগ্ধা নিচু স্বরে বললো,” শোন, আমার তোর হেল্প লাগবে। তুই তো পেইন্টিং করিস তাই না?”
স্পৃহা রেগে বললো,” এই তুই কি নতুন জন্মেছিস এই পৃথিবীতে। আশ্চর্য! আমার বোন হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, তুই তো পেইন্টিং করিস তাই না?”
স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” আচ্ছা। সরি, ভুল হয়ে গেছে। ভুলে বলে ফেলেছি। রাগ করিস না বোন। আমার কথা শোন।”
স্পৃহা ঠোঁট উল্টে বললো,” আচ্ছা, বল।”
স্নিগ্ধা আসল ঘটনা কিছু বললো না। স্পৃহাকে শুধু ওই পেইন্টারের ঠিকানা বের করে দিতে বললো। স্পৃহা মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল হটাৎ তার কাধে কেউ একজন হাত দিয়ে ডাকতেই। স্পৃহা পিছনে না তাকিয়ে হাত দিয়ে তাকে ইশারায় থামতে বললো।
ওপাশ থেকে স্নিগ্ধা বললো,” শুন, তুই আমাকে ডিটেইলস সবটা জানা, আমি ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে তোকে সবটা বলবো।”
স্পৃহা উত্তরে কিছু বলার আগে আবার তার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকলো কেউ। স্পৃহা প্রচন্ড রেগে গিয়ে স্নিগ্ধাকে বললো,” আচ্ছা, তোর সাথে পরে কথা বলছি।” তারপর ফোন কেটে দিলো।
ফোন কেটে দিয়ে, সামনে পড়ে থাকা ইটের টুকরা হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর ক্রোধ নিয়ে পিছনে ফিরে ইট ছুড়ে মারতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলো সে। তার পিছনের জিম দাড়িয়ে আছে। ভাগ্যিস দেখে মারতে গিয়েছিলো নয়তো আজ মাথাই ফাটিয়ে ফেলতো এই রোবটের। স্পৃহার এমন আচরণে জিম বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এই মেয়ে তো মারাত্মক!
[ #চলবে ]