#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৮
#নবনী_নীলা
স্পৃহা ইট হাতে নিয়েই বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” ভাগ্যিস দেখে মারতে গিয়েছিলাম। নয়তো সারা জীবন আপনাকে কপাল কাটা জিম নামে বাঁচতে হতো।”
জিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” মানে?”
স্পৃহা বাকা হাসি দিয়ে ইটের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি তো ভেবেছিলাম আজ কপালই ফাটিয়ে দিবো। না দেখে যদি আপনার কপাল ফাটিয়ে দিতাম পরে তো ডাক্তারের কাছে গিয়ে কপাল সেলাই করা লাগতো তারপর সবাই আপনাকে ডাকতো কপাল কাটা জিম। ঐযে নাম শুনেন না আঙ্গুল কাটা জগলু, গাল কাটা জসিম। আপনারটাও তেমন হয়ে যেতো।”
স্পৃহার কথায় জিম রেগে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,” হাতের এইটা ফেলে দাও বলছি।”
স্পৃহা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বললো,” ভয় পেয়েছেন বুঝি? তা রোবট সাহেব আপনি এইখানে কি করছেন শুনি। আমার জন্যে এসেছেন?” একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো সে।
জিম উত্তরে কিছু বললো না এগিয়ে এসে স্পৃহার হাত থেকে টান দিয়ে ইটটা নিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়ে বললো,” তোমার মত মেয়ের পিছু যে কে নেয় তাকে এইবার সত্যি দেখতে ইচ্ছে করছে। তার নিজের জীবনের ভয় নেই মনে হচ্ছে।”
স্পৃহা ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বললো,” ও আচ্ছা। এতো পেচিয়ে কথা বলার কি দরকার বললেই পারেন আপনি আমার জন্যে এসেছেন।”
স্পৃহার এমন হাসিতে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। মেয়েটা এত অদ্ভূত কেনো? জিম দৃষ্টি সরিয়ে আশে পাশে তাকালো। আশে পাশে কেউ নেই বললেই চলে। এই রাস্তায় এবার স্পৃহাকে কে বিরক্ত করতে আসবে?
জিম স্পৃহার পিছু পিছু হাটছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। স্পৃহা কিছুদুর গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম স্পৃহাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। দাড়িয়ে পড়লো কেনো মেয়েটা? জিম এগিয়ে এসে বললো,” হটাৎ দাড়িয়ে পড়লে কেনো? কোনো সমস্যা?”
স্পৃহা চিকন গলায় বললো,” একসাথে হাটি, চলুন।” চ উচ্চারণ করতেই জিম তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” নাহ্। যাও আগে হাটো।”
স্পৃহা ভ্র কুচকে বললো,” আপনি না ভালো কথার মানুষ না।”
জিম ভাবলেশহীন ভাবে বললো,” আমার সাথে ভালো কথা বলতে হবে না তোমায়। তুমি চুপ চাপ হাটো।”
স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। এই লোকটা এমন ভাব করে যেনো, তার সাথে হাঁটলে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আস্ত একটা ঘাউরা কোথাগারের!
স্পৃহা যেতে যেতে খেয়াল করলো হঠাৎ দুটো ছেলে তার দুপাশে এসে একই গতিতে তার সঙ্গে হাঁটা দিয়েছে। স্পৃহা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো এদের মধ্যে একজনই তো রোজ তার পিছু নেয়।
অসভ্যটা আজ আবার আরেকটাকে সঙ্গে করে এনেছে। স্পৃহা বেশ জড়সর হয়ে দাড়িয়ে পড়তেই ছেলে দুটি শব্দ করে হেসে উঠে স্পৃহার সামনে এসে দাড়ালো। স্পৃহা দাতে দাত চিপে ছেলে দুটোর দিকে তাকালো। এদের চুল টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। প্রতিদিন ঠিক এইভাবে তার পিছু পিছু আসে আর উল্টা পাল্টা বকে।
ছেলেগুলো দুষ্ট চোখে স্পৃহার দিকে তাকাতেই স্পৃহার রক্ত টগবগ করে উঠলো। সে শুধু অপেক্ষা করছে কখন জিম এসে এদের আচ্ছা করে দু ঘা লাগিয়ে দিবে। দেখে সে একটু তৃপ্তি পাবে।
জিম ভাবলেশহীন ভাবে পকেটে দুই হাত ভরে স্পৃহার পাশে এসে দাড়ালো। ছেলে দুটো জিমকে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে গেলো। প্রতিদিন এই সময় রাস্তা ফাঁকা থেকে আজ হটাৎ জিমকে দেখে একজন বলে উঠলো,” এ আবার কই থেকে এলো?”
স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” মহাকাশ থেকে এসেছে। কেনো তোদের যেতে ইচ্ছে করছে?”
আরেকজন স্পৃহার কোথায় বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে বললো,” গেলে কি আর একা যাবো? তোকে তো সাথে নিয়েই যাবো।”
বলেই স্পৃহার দিকে এগিয়ে যেতেই জিম সানগ্লাস খুলে হাতে নিলো তারপর এক হাত মেলে বাধা দিয়ে সামনে এসে দাড়ালো। নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি সমস্যা? এভাবে পথ আটকে দাড়িয়ে আছো কেনো? রাস্তা ছেড়ে দাড়াও।”
স্পৃহা জিমের এমন স্বাভাবিক আচরণে ক্ষেপে গিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! ওরা কি আপনার ভাই লাগে নাকি? এভাবে কোমল কণ্ঠে বলার কি আছে? দু চারটে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে পারছেন না?”
ছেলেগুলো হটাৎ স্পৃহার এমন উক্তি শুনে ঘাবড়ে গেল। জিমকে দেখে তাদের সুবিধার মনে হচ্ছে না। জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” এরপর থেকে যেনো এই মেয়ের আশে পাশে না দেখি। নয়তো হাঁটার জন্যে পা থাকবে না। বাকি জীবন হুইচেয়ারে কাটাতে হবে ।” বলেই ছেলে দুটোকে চলে যেতে ঈশারা করতেই ছেলে দুটো বেশ ঘাবড়ে গেলো জিমের এমন গাম্ভীর্যতা দেখে। একজন হুট করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতেই আরেকজন ও ছুটে পালালো।
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” এই আপনাকে ডায়লগ দিতে কে বলেছে? হাত পা নেই মারতে পারলেন না?”
জিম নিজের সানগ্লাস পড়তে পড়তে বললো,” এরা আমার স্ট্যান্ডার্ড না, যে মারামারি করে এদের ভয় দেখাবো। এদের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট।”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” আমি কোথায় ভাবলাম এই দুইটাকে মেরে ভর্তা করে দিবেন তা না..”বলেই নিরাশ চোখে জিমের দিকে তাকালো।
জিম আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” বেশি বড় বড় কথা বলো না। আমাকে তো ইট দিয়ে মারতে এসেছিলে আর এদের বেলায় হাতে তো একটা পাথরও তুললে না। এদের কি ভাড়া করে এনেছো নাকি?”
” ফালতু বলবেন না তো। আমাকে কি বাংলা সিনেমার হিরোইন পেয়েছেন যে টাকা দিয়ে গুন্ডা ভাড়া করবো।”, চটে গিয়ে বললো স্পৃহা।
জিম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” উইল ইউ স্টপ নাও?” স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হাঁটতে লাগলো। কোথায় ভেবেছিলো ছেলেগুলোর মার খাওয়া দেখে মজা নিবে কিন্তু না এই লোকটা কিছুই করলো না। আর এই বদমাইস দুটো এতো ভীতুর ডিম জানা থাকলে সে নিজেই এদের পিটিয়ে লাল করে দিতো। এই লোকের সামান্য কথায় ভয় পেয়ে পালালো।
_________
ফাহাদ রেজওয়ান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আফজাল সাহেব একমাত্র মেয়ের জামাই। আফজাল সাহেবের এই পজিসন টিকিয়ে রাখতে ফাহাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই এই পজিসন এখনও তার দখলে, বয়স কম হলেও ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই তাকে সবাই মান্য করে। বিশাল এই বাড়িটিতে সে বলতে গেলে একাই থাকে। সঙ্গে জিসান মানে তার ডান হাত বলা যেতে পারে, সে থাকে।
জিসান বেশ হন্তদন্ত করে ছাদের পুল সাইডে এলো। জিসান ফাহাদকে সুইমিং করতে দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
মিনিট পাঁচেক পর, ফাহাদ জিসানকে খেয়াল করলো তারপর দুই হাতে সামনের চুলগুলো সরিয়ে বললো,” কি হয়েছে? এতো রাতে এইখানে কি করিস?” বলতে বলতে সুইমিং পুল থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়লো তারপর সাদা তোয়ালে দিয়ে হাতে মুখ মুছে নিলো।
জিসান মাথা তুলে তাকালো তারপর একটা ঢোক গিলে বললো,” বস, রুহুল সাহেব মানে যার কাছ থেকে টাকা পাওনা ছিলো। চিনতে পারছেন? ভদ্র লোকের দুটি মেয়ে আছে।”
ফাহাদ তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বললো,” হুম, চিনতে পেরেছি। কিন্তু কি হয়েছে?”
জিসান পুনরায় মাথা নিচু করে ফেলে বললো,” স্যার, উনি আত্মহত্যা করেছেন। এই মাত্র খবর পেয়েছি। ”
ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ জিসানের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর পাশেই মদ্যপানের একটি বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে হাতে নিয়ে নিশ্চুপে বসে রইলো। তারপর এক চুমুক দিতেই জিসান বললো,” বস্, এইবার কি করে টাকা আদায় হবে। রুহুল সাহেবের স্ত্রীকে চাপ দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।”
ফাহাদ গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,” নাহ্, ওনার স্ত্রী কে চাপ দেওয়ার দরকার নেই। রুহুল সাহেবের বড় ভাই শুনেছি বিশাল ব্যাবসা করে। দরকার পড়লে অনেক চাপ দাও নয়তো ছেলে মেয়েকে তুলে আনো। যে করেই হোক আগামীকালের মধ্যে টাকা আমি চাই। তার জন্যে যা করা লাগে করো।”
জিসান হা সূচক মাথা তারপরও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলার আছে তার কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। জিসান চিকন গলায় বললো,” বস্ , সুনেয়রা ম্যাডাম শুনছি দেশে ফিরছেন। যদিও তিনি কিছু জানান নি আমাদের তবে আমি খবর পেয়েছি।”
ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে একটা ভ্রু তুলে বললো,” মানে? আমাকে না জানিয়ে দেশে ফিরছে?।” বলেই চুপ করে গেলো তারপর জিসানকে হাতের ঈশারায় চলে যেতে বললো।
গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্নটা শেষ করে গ্লাসটা এক পাশে রেখে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কয়েকবার কল করলো কিন্তু সুনেয়রা ফোন তুললো না। কয়েকবার কল করেই ফাহাদ ভীষন রেগে গেলো দাতে দাত চেপে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো। মেঝেতে পড়তেই ফোনটি চূর্নবিচূর্ণ হয়ে গেলো। রাগে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে তার। সুনেয়রা সবটাই ইচ্ছে করেই করছে বুঝতে বাকি রইলো না তার।
_______
এতো রাতে স্পৃহার কল পেয়ে স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। এই মেয়ের তো এই বেলায় ফোন দেওয়ার কথা না। স্নিগ্ধা তার পাশের টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর ফোন কানে ধরতেই স্পৃহা ভয়ার্ত গলায় বললো,” আপু জানিস। রুহুল সাহেব আছেন না। উনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হয় বাঁচবেন না।”
স্নিগ্ধা অভ্রর পাশে বসেছিলো। মৃত্যুর কথা শুনে স্নিগ্ধা ফট করে দাড়িয়ে পড়লো। বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো তার। স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” মানে? কি আজে বাজে বলছিস। এভাবে বলে নাকি?”
স্পৃহার কণ্ঠ আরো কাতর হয়ে উঠলো সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,” আপু এই গলিতে কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত ভেসে আসছে। বাবা মা মিতু আর নিতুর বাড়িতে গেছে। আমার না ভীষন ভয় লাগছে। তুই আয় না আপু।” বলেই অঝোরে কাদতেঁ লাগলো স্পৃহা।
[ #চলবে ]