#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২২
#নবনী_নীলা
জিম স্পৃহার হাত শক্ত করে চেপে বললো,” তুমি কি ভেবেছো? এইসব করে তুমি আরামে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাবে? আমিও দেখি এইগুলো না গুছিয়ে তুমি কি করে এই রুমের বাইরে যাও?”
স্পৃহা রেগে গিয়ে কটমট করে তাকালো তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,” একদম অসভ্যতামি করবেন না হাতটা ছাড়ুন বলছি। নয়তো চিৎকার করে আপনার মান-সম্মান উড়িয়ে দিবো।”
জিম আরো শক্ত করে স্পৃহার হাতটা চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। স্পৃহা হতবাক হয়ে তাকালো। কি আশ্চর্য! আজকে হঠাৎ লোকটা এমন করছে কেনো? স্পৃহা একটা ঢোক গিলল তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” বলেছি তো, আপনি আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। যদি উত্তর দেন তাহলে আমি যা বলবেন তাই করবো আর যদি সেটা না পারেন তবে এই যে বিছানায় ভিজিয়ে দিয়েছি। এর পর আপনার ল্যাপটপ ভাঙবো।”
জিম চুপ করে তাকিয়ে আছে স্পৃহার সাহস দেখে প্রতিবারের মতো এবারও অবাক সে। এই মেয়ের পক্ষে কোন কিছুই অসাধ্য নয়। সত্যি সত্যি না তার ল্যাপটপ ভেঙে দেয়।
জিম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল তারপর গম্ভীর গলায় বলল,” তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর পারবে না তুমি। আমার রুম টা ঠিক করে দিয়ে যাও নয়তো তোমাকে এই রুমেই থাকতে হবে আজকে।
স্পৃহা ভ্রু কুচকে তাকালো লোকটা কি পাগল? তার সাথে এখানে থাকতে হবে মানে? স্পৃহা আড় চোখে তাকিয়ে বলল,” পাগল টাগল হয়ে গেছেন? আমি কেন আপনার সাথে এখানে থাকতে যাবো? ভালো করেই তো জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি ভালোয় ভালোয় বলে দিলে তো আর আপনাকে এইরকম ভিজা বিছানায় ঘুমাতে হতো না। এখন আমার হাতটা ছাড়ুন।”
জিমের দৃষ্টি আগের মতোই রয়েছে। স্পৃহাকে আজ কিছুতেই ছাড়বে না সে। জিম কড়া গলায় বলল,” আমি কখন বললাম যে আমি তোমার সাথে থাকব? তুমি একা থাকবে এই রুমে। এন্ড আই উইল মেক সিওর দ্যাট তুমি এই ভিজা বিছানায় ঘুমাবে।”
স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তারপর নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। পাগল নাকি লোকটা?একাই রুমে থাকতে হবে মানে?
স্পৃহা জিমের সাথে পেরে উঠছেনা। জিম হাতের বাঁধন ছিল আরো দৃঢ় করতেই স্পৃহা দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে তাকালো। তারপর অগ্নি কন্ঠে বলল,” আপনি হাতটা ছাড়বে না তাই তো? আমি কিন্তু শেষবারের মতো প্রশ্ন করছি।”
জিন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো তারপর বলল,” তুমি আমাকে ঠিক চিনো না। আমি যেটা বলেছি সেটা করেই ছাড়বো ইউ হ্যাভ টু স্টে।”
স্পৃহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তারপর বলল,” আপনিও না আমাকে চেনেন না বুঝেছেন? এত সহজ না…..” বলেই জিমের হাতে মুহূর্তে সজোরে কামড় বসালো স্পৃহা। জিম দাঁতে দাঁত চিপে নিজের হাতের দিকে তাকালো। তারপর হাতটা সরিয়ে আনতেই সে সুযোগে স্পৃহা দৌড়ে পালিয়ে গেল।
জিম রাগে কটমট করে তাকিয়ে রইল কেনো যে মেয়েটা তার পিছনে পড়ে আছে সে বুঝতে পারে না। মানে তার রুমে এসে তার বিছানা পানি দিয়ে ভিজিয়ে তো দিয়েছে এখন আবার কামড় দিয়ে চলে গেল। কি অবস্থা একটা মেয়ে জিম জুবায়েদকে এমন নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে কল্পনাও করেনি সে।
______________
“আচ্ছা অভ্র “, স্নিগ্ধার ডাকে অভ্র একবার তাকালো তার দিকে। পরক্ষনেই তার মনে হলো আজ তো তার নাম জিয়ান। মামনি তাকে অভ্র ডেকেছে, এই ডাকে তার সাড়া দেওয়া ঠিক হয় নি। অভ্র নিজের আঁকিবুকি করাতে মন দিলো। স্নিগ্ধা অভ্রকে আবারো ডাকলো। অভ্র আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার আঁকিবুকি করতে লাগলো। তাকে জিয়ান নামেই ডাকতে হবে।
স্নিগ্ধা জানে না আজ অভ্রর কি নাম। কিভাবেই বা জানবে? অভ্র তো আর গলায় সেই নাম লিখে ঝুলিয়ে রাখে না।নিজের মনে যখন যা আসে তাই করে।
স্নিগ্ধা একটু হাসলো তারপর অভ্রর কোমড়ের পাশে গুতো দিতেই সে আড় চোখে তাকিয়ে বড়দের মতন স্নিগ্ধার হাত সরিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা আরো কয়েকবার এমন করতেই অভ্র হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলো আর বললো,” তুমি আমার সাথে দুষ্টুমি করছো কেনো?” স্নিগ্ধার থেকে বাঁচা এখন তার একমাত্র লক্ষ্য।
অভ্র দুটো বালিশ জড়িয়ে ধরলো দুপাশে যাতে স্নিগ্ধা তাকে সুড়সুড়ি দিতে না পারে।
হাসতে হাসতে অভ্রর ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বললো,” তুমি কি ভেবেছো? আমার হাত থেকে তুমি এত সহজে ছাড় পাবে?”
অভ্র খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,” নাহ্। আমার অনেক হাসি পায়। এমন করো না।”
স্নিগ্ধা হা সূচক মাথা নাড়লো তারপর বললো,” আচ্ছা করবো না। তাহলে আমার কাছে আসো।”
অভ্র না সূচক মাথা নাড়লো তারপর বলল,” না তুমি আবার আমাকে হাসাবে।” সুড়সুড়ি শব্দটার সাথে অভ্রর পরিচয় নেই তাই এইভাবেই সে ভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করছে।
স্নিগ্ধার হেসে উঠে বলল,” না আই প্রমিস আমি করব না। তোমাকে আর হাসাবো না এদিকে আসো।”
অভ্র ছোট ছোট পা ফেলে স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসতেই স্নিগ্ধা অভ্রের হাত খপ করে ধরে একদম নিজের কোলে টেনে নিয়ে এলো তারপর নিজের কোলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা অভ্র তোমার আমাকে কেমন লাগে?” অভ্র আড় চোখে তাকিয়ে বলল,” আগে আমাকে জিয়ান বলো তাহলে বলবো।”
স্নিগ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আচ্ছা ঠিক আছে জিয়ান। এবার হয়েছে? এখন বলো, আমাকে তোমার কেমন লাগে?”
অভ্র ছোট্ট দুটি হাতে স্নিগ্ধার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” অনেক ভালো লাগে তুমি যখন ছিলে না তখন আমি একা একা থাকতাম আমার ভালো লাগত কিন্তু এখন আমার অনেক ভালো লাগে।”
স্নিগ্ধা অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তারপর বলল,” আচ্ছা! আমাকে তোমার ভালো লাগে তাইনা? কতটা ভালো লাগে?”
অভ্র নিজের দুই হাত মেলে দেখালো এতটা। স্নিগ্ধা একটু থমকে গেল মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগছে। সে ঘাড়টা একটু কাত করে অভ্রর দিকে তাকালো। তারপর বলল,” তোমার আম্মুর থেকেও বেশি ভালো লাগে?”
প্রশ্নটা করে যেনো নিজেই থমকে গেল সে।
যদি উত্তরে অভ্র বলল না। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই নয়? নিজেকে নিজে কেন এত কষ্ট দিতে চাইছে সে? আদিলের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষকে অভ্র সব চাইতে বেশি ভালবাসবে এটাই তো সত্য।
কিন্তু স্নিগ্ধাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে অভ্র বলল,” হ্যাঁ!” স্নিগ্ধার ঘোর কাটলো চোখের পাতা ফেলে তাকালো তারপর বললো,” মানে আমাকে তোমার আম্মুর থেকেও বেশি ভালো লাগে?”
অভ্র মন খারাপ করে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। স্নিগ্ধা দুইহাতে অভ্রর গাল দুটি আদর করে ধরে বলল,” কেন?”
একটু মায়া হচ্ছে তার। আচ্ছা এই আরোহী সে কি বেঁচে নেই? বেচে থাকলে কি করে পারলে এমন ফুটফুটে একটি বাচ্চাকে ফেলে যেতে মায়া হয়নি তার? অভ্র গাল ফুলিয়ে বলল,” আম্মুর তো শুধু ছবি দেখেছি। আম্মু তো কখনো আমার কাছে আসেনি। আদর ও করেনি। কিন্তু দাদু বলেছে আম্মু নাকি এঞ্জেল। তাই আমি দেখতে পাই না।”
স্নিগ্ধা নিজের কোলে অভ্র কে জড়িয়ে ধরলো। কথাগুলো শুনে তার ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো।
আদিলের উপর গতকাল রাতে তার অনেক অভিমান হয়েছিল শুধু অভিমান হয় রাগ হয়েছিলো। রাগ অভিমান হলে সে সেটা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু এখন অভিমানের রেশটা যেনো একটু কেটে গেছে।
__________
আদিল প্রায় আধ ঘণ্টা আগে এসে বসে আছে। জিমকে পাশের টেবিলে বসতে বলেছে সে যাতে দূর থেকে পুরো বিষয়টা জিম তদারকি করতে পারে। মূলত ফাইভ স্টার হোটেলের এই পুরো ফ্লোরটা বুক করা হয়েছে প্রাইভেসির জন্য।
তবুও আদিল এদেরকে বলে রেখেছে পাঁচ থেকে ছয় জন মানুষকে ভিতরে আসার পারমিশন দিতে কারন জিমকে একা বসে থাকতে দেখলে সুনেয়রা সন্দেহ করতে পারে। রাত আটটায় ডিনারের জন্য ইনভাইট করা হয়েছে সুনেয়রাকে। আটটা বেজে সাত মিনিটে তার গাড়ি হোটেলের সামনে এসে থামলো।
ব্যাকলেস রেড রঙের একটি শর্ট গাউন পড়ে বেরিয়ে এলো সে। সঙ্গে সিলভার রঙের হাই হিল আর চুলগুলো পনি টেইল করে বাঁধা। কম সুন্দরী সে নয় তার মা ছিলেন আমেরিকান একজন নারী তাই বলাই বাহুল্য সৌন্দর্যের দিক থেকে তার কোনো কমতি নেই।
সুনেয়রা আদিলকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো তারপর পাশের চেয়ারে বসতে বসতে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,” সরি!বেশি দেরী করে ফেললাম নাকি মিস্টার আবরার ফাইয়াজ?”
আদিল না সূচক মাথা নাড়ল তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি আগেই চলে এসেছি তাই সরি বলার কোন প্রয়োজন নেই আই গেস আপনার এখানে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি।”
সুনেয়রা আবরারকে দেখে এত অভিভূত হয়েছে যে চোখ সরাতে পারছে না। এতদিন পেপারে নিউজ আবরারকে দেখেছে সে কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি।
সুনেয়রা হেসে বলল,” দেশের বাইরে ছিলাম তার মানে এই না যে কিছুই চিনি না। যদিও আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে এই রেস্টুরেন্টটা অনেক দূরে কিন্তু আপনার সাথে দেখা করতে এতদুর আসাটাও তেমন বড় কিছু না।”
সুনেয়রা নিজের পার্সটা টেবিলের পাশে রেখে বলল,” ফাহাদ রেজওয়ান আই মিন আমার হাজব্যান্ড সেই ব্যাপারেই তো আপনি আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন যদি আমি ভুল না করি।”
আদিল সহজ ভাবে তাকিয়ে থাকলেও সুনেয়রার এসেই প্রথমে এই প্রশ্নটা করায়, তাকে একটু ভাবিয়ে তুলছে। সহজেই বিশ্বাস করা যাবে না। ফাহানের ব্যাপারে কোন কিছুই এখন বলা যাবেনা। আগে তো দেখতে হবে মেয়েটা কতটা বিশ্বস্ত।কারণ আদিল নিশ্চিত ফাহাদ যদি কোনো ভাবে জানতে পারে অভ্র তার সন্তান তাহলে। তাহলে অভ্রর মারাত্বক ক্ষতি করতেও পিছ পা হবে না। তাই আরোহীর মৃত্যুর কথাটা সবকিছুই তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
আদিল একটু হাসলো তারপর বলল,”সবে তো পরিচয় হয়েছে এইসব টক্সিক কথাবার্তায় আমারা না হয় একটু পরেই গেলাম।
আদিলের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে আজকে সে সুনায়রার সব প্রশ্নই এড়িয়ে গেছে। কারণ এতো সহজে মেয়েটাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারলে গেমটা একভাবে খেলতে হবে, আর অবিশ্বাস করলে গেমটা খেলতে হবে আরেক উপায়ে। তাই অবিশ্বাস করে এগিয়ে যাওয়াটাই শ্রেও।
কথা শেষ হতে হতে প্রায় রাত অনেক হলো। আজকের প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে সুনেয়রা বেরিয়ে গেল। যদিও সে আরো কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আদিলের ছোট্ট একটা মিথ্যা কথা যার কারণে আদিলের প্রতি নিজের কন্সার্ন দেখিয়ে সে চলে গেলো।
সুনেয়রা চলে যেতেই আদিল টেবিলের দুই হাত একত্রে মুষ্টিবদ্ধ করলো । জিম বেশ চিন্তিত মুখে উঠে দাড়াল তারপর আদিলের পাশের চেয়ারে বসলো। ক্ষীনস্বরে বলল,” তেমন কিছুই তো হলো না যেমনটা আপনি চেয়েছেন। কিছু জিজ্ঞেস করলে না কেনো?”
আদিল কঠিন স্বরে বললো,” ফাহাদ আর সুনেয়রার এই সম্পর্কটা একটা চুক্তি। নিজেদের স্বার্থেই এই নাটককে মেতে আছে ওরা। আমি তো ভেবেছিলাম আমার বোনকে ও ঠকিয়েছে অন্য কাউকে ভালোবেসে কিন্তু না ক্ষমতার লোভে সে আমার বোনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।” বলেই সজোরে টেবিলে আঘাত করতেই কাচের গ্লাস গুলো পরে গিয়ে চুর্ন বিচূর্ণ হয়ে গেছে। রক্ত বর্ন চোখে তীব্র রাগ সে বললো,” ফাহাদ রেজওয়ানের এমন অবস্থা করবো আমি। ও নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলবে।”
[ #চলবে ]