#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৮
#নবনী_নীলা
কথাটা শুনা মাত্র ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” কি
নাম বললে?”
আরোহী! নামটা কি ঠিক শুনেছে ফাহাদ? নামটা মনে পড়তেই ভিতর থেকে কেমন নড়ে উঠলো সে। নামটা তার জীবনে কতটুকু বিস্তার করে আজও সেটা একমাত্র সে জানে। ফাহাদ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।
ফাহাদের প্রশ্নের উত্তরে স্নিগ্ধা কিছু বললো না। কথার জট খুলতে খুলতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে সে। তার মাথা আর কাজ করছে না। তার ইচ্ছে করছে কোথাও ছুটে পালিয়ে যায়। এই মায়া জালে তার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। তার ভীষন ক্লান্ত লাগছে।
ফাহাদের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বললো,” আপনি আমাকে কেনো এভাবে তুলে এনে বেধে রেখেছেন? আপনি কেনো ক্ষতি করতে চান আমাদের?”
ফাহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো তারপর বললো,” আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি চাই না। আমি চাই শুধু একজনের ক্ষতি। এই নাটকটা যে শুরু করেছে তার শেষ চাই। যার নাটকে তোমারা নিজের অজান্তেই দিনের পর দিন অভিনয় করে যাচ্ছো।”
স্নিগ্ধার মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে সে তাকিয়ে আছে।ফাহাদের বলা কথাগুলো সে শুনছে ঠিকই কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। বাধ্য শ্রোতার মতন শুধু শুনেই যাচ্ছে।
কিন্তু এবার সে আর চুপ থাকতে পারলো না বিষাদময় চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না। আর এটাও বুঝতে পারছি না যে আপনি কেনো আমাকে এভাবে বেধে রেখেছেন। আমার সাথে তো আপনার কোনো বিরোধ নেই।”
ফাহাদ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো তারপর বললো,” তোমার প্রতি সত্যি আমার কোনো রাগ নেই । কারণ আমিও একটা সময় তোমার মতই এমন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। এবং আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতন আমিও প্রেমে পড়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন আমার জীবনে প্রথম প্রেমের ভ্রমর এসেছিলো। তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম নতুন জীবন শুরু করবো বলে।” এইটুকু বলেই ফাহাদ থেমে গেলো।
স্নিগ্ধা এতক্ষণ ফাহাদের প্রতি বিষাদ নিয়ে তাকালেও ফাহাদের এমন কোমল কণ্ঠে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই ফাহাদ ছোটো করে একটা দম ফেলে বললো,” যতোটা খারাপ মানুষ আমি আজ হয়েছি এতোটাই নিষ্ঠাবান আমি একদিন ছিলাম। কিন্তু প্রতি পদে পদে আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমার চরিত্র আমার সততার উপর প্রশ্ন উঠেছে। আর এক সময় আমার ভালোবাসার মানুষটাও আমাকে ভুল বুঝেছে।”
স্নিগ্ধা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে মিথ্যে বলছে। তার চোখে মুখে বিষণ্ণতার এক ছাপ স্পষ্ট। হটাৎ ফাহাদ তাকে এতো কথা বলছে কেনো? আর হটাৎ এতো জঘন্য মানুষ হওয়ার কি প্রয়োজন পড়লো তার? স্নিগ্ধা বিনা বাক্যে তাকিয়ে রইলো উদ্বিগ্ন চোঁখে।
ফাহাদ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,” তোমার নিশ্চই মনে হচ্ছে হটাৎ আমি এতো খারাপ হলাম কি করে? আমি খারাপ হই নি আমাকে খারাপ প্রমাণ করা হয়েছে। আর সেটা কে করেছে জানো?”
স্নিগ্ধা অপলকে তাকিয়ে আছে। কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সবকিছু হটাৎ এতো জটিলতায় ভরে উঠেছে যে তার বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই সে শুধু শুনেই যাচ্ছে।
ফাহাদ চুপ করে থেকে চোয়াল শক্ত করে ফেললো তারপর তীব্র ঘৃনা নিয়ে বললো,” আবরার আনোয়ার! মানে যে এখন সম্পর্কে তোমার শ্বশুর।”
এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও স্নিগ্ধা এইবার ভীষন রেগে গেলো তারপর কড়া গলায় বললো,” একদম আজে বাজে কথা বলবেন না। আমি চুপ করে আপনার কথা শুনছি তার মানে এই না আপনার যা খুশি আপনি বলবেন। আসলে কি বলুন তো আপনি নিজে জঘন্য যে তাই আশেপাশের সবাইকে আপনার নিজের মতন মনে হয়।”
ফাহাদ মাথা হেলিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বললো,” মিস স্নিগ্ধা তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো রতনেই কিন্তু রতন চেনে। আশা করি বাংলা এই প্রবাদের অর্থ তোমার জানা আছে। আবরার আনোয়ার যে কেমন মানুষ আগে সেটা জানো, জানবার পর তুমি নিজেই বিচার করে নিও।”
স্নিগ্ধা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করলো। আনোয়ার সাহেবের মতন একজন মানুষকে নিয়ে কি করে এতো কনফিডেন্ট নিয়ে নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছে এই লোকটা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে স্নিগ্ধার।
ফাহাদ আজ ভেবেই এসেছে এতদিন যে সত্য সে নিজে জানতো আজ সেটা এই মেয়েটিকে জানাবে।
ফাহাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” আমি বলেছিলাম না আমার জীবনে প্রেম ভ্রমর এসেছিলো। মেয়েটির নাম আরোহী। আবরার পরিবারের বড় মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যদিও তার এই পরিচয় আমার জানা ছিলো না। আমি শুধু জানতাম আর্ট ক্লাসে একটা মেয়ে খুব সুন্দর ছবি আঁকে নাম আরোহী। প্রায় আর্ট এক্সিবিশনে সবচেয়ে চমৎকার ছবিগুলোর নিচে খুব পেচিয়ে এই নামটাই লেখা থাকতো। মেয়েটিকে দেখার তীব্র ইচ্ছা জাগতো তখন সেই তরুণের মনে। ভাগ্যক্রমে সেই মেয়েটির প্রেমেই তাকে পড়তে হলো। ভার্সিটির পড়া শেষে আরোহীর জন্যে বড় ঘরের প্রস্তাব আসতে শুরু হয়। একজন বেকার প্রেমিকই জানে কতোটা অসহায় সে তখন। আমাকেই মায়ের খেয়াল রাখতে হতো একমাত্র সন্তান আমি। টিউশনের টাকায় আমার আর মায়ের সংসার চলতো।
হটাৎ একদিন আরোহী বেইলি রোডের ফুলের দোকানের সামনে দেখা করে বললো, সে নাকি আজই আমাকে বিয়ে করবে। আজ রাতে নাকি তার বিয়ে ফাইনাল করতে পাত্রপক্ষ আসবে। দুজনেই বিয়ে সেরে ফেললাম কাজী অফিসে গিয়ে। আবরার আনোয়ার ভালোই ঝামেলা করলেন। আমার মতন একটা বেকার ছেলেকে উনি মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে পারলেন না। আমার নামে মামলা টামলা করে আমাকে এক রাত জেল পর্যন্ত খাটালেন। কিন্তু আরোহীর জেদের কাছে তিনি সাময়িক হার মানলেন।লোকটা ঠিক কতটা খারাপ তখনো আমি আন্দাজ করতে পারিনি। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলাম সেখানে তিনমাস পর টাকা চুরির দায়ে আমার উপর মামলা হয়। পড়ে জেনেছি সব নাকি আমার শ্বশুরের চাল। কিন্তু এখানেই থেমে যায় নি সে, আরোহীর সামনে আমাকে একজন প্রতারক হিসাবেও প্রমাণ করেছে।”,
বলতে বলতে কণ্ঠ থেমে এলো ফাহাদের। সে থেমে গিয়ে দাতে দাঁত চিপে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” তোমার আমার মতন মানুষরা কি নিয়ে বাঁচে বলো তো? আত্মসম্মান! সে অপমানে আমার বৃদ্ধ মাও সারাজীবনের জন্যে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি তখনো জেলে, যার হয়ে আমি কাজ করছি সেই মানুষটার জন্যেই সেদিন আমি আমার মায়ের কবরে মাটি দিতে পেরেছিলাম। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আমার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।”
স্নিগ্ধা থমকে তাকিয়ে আছে। তার পুরো শরীর শিউরে উঠেছে। হটাৎ নিজের মধ্যে প্রচন্ড রাগ অনুভব করছে সে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো।
ফাহাদ চোখ বন্ধ করে চেয়ারের পিছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। তারপর চোখ মেলে মাথা সোজা করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” এখন হয়তো এই কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হবে না। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু তোমাকে সতর্ক করে দিলাম। আবরার আনোয়ার প্রয়োজনে তোমাকে আজ ব্যাবহার করছে কাল ছুড়ে ফেলে দিতেও তার সময় লাগবে না। আদিলের কাছেও তখন তুমি আর ভালোবাসার কেউ থাকবে না। কারণ আদিল তার বাবাকে অন্ধের মতন বিশ্বাস করে। যার ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছো সে উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে শেষ করবার জন্যে।”
স্নিগ্ধা সব কথা শুনলো। তার হার্ট বিট প্রচন্ড বেড়ে গেছে। রীতিমতন ঘামতে শুরু করেছে সে। তবুও নিজেকে শান্ত করে কাপা কাপা গলায় বললো,” আরোহীর কি হয়েছিলো?”
ফাহাদ চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার কণ্ঠে নেই। ফাহাদ ব্যাথিত হয়ে তাকালো তারপর বললো,” বাকিটা না হয় আদিলকেই জিজ্ঞেস করো। অবশ্য তোমাকে বলবে কিনা জানি না। আরোহী বলতো ওর ভাইটা বড্ড জেদী। তার প্রমাণ তুমি আমি দুজনেই পাচ্ছি।” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ফাহাদ।
স্নিগ্ধা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ফাহাদ বললো,” কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার লোকেশন ওরা পেয়ে যাবে। ততক্ষন তোমাকেই এই বন্ধি অবস্থায় থাকতে হবে। আর হ্যা তোমার চোখে অনেক প্রস্ন কিন্তু এর উত্তর আমি দিবো না। তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে।”
স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে গলা উচিয়ে ফাহাদকে থামতে বললো কিন্তু ফাহাদ একবারো পিছনে তাকালো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বেড়িয়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে আবারো রুমটায় বন্ধ করে দিলো। স্নিগ্ধা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। দড়ির শক্ত বাঁধনে তার হাত বার বার ঘর্ষণে হাতে ক্ষত হয়ে যাচ্ছে তবুও সে থামছে না। বার বার চেষ্টা করতে করতে হটাৎ মাথাটা কেমন করে উঠলো।চারিপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেলো।
_______________
স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ মেললো। তার শরীরটা ভীষন দুর্বল লাগছে। সম্পূর্ন চোখ খুলতেই মনে হলো সে নরম কোথাও শুয়ে আছে।চোখ মেলে একটু তাকাতেই চারপাশ দেখতে পেলো স্নিগ্ধা। জায়গাটা চিনতে প্রথমে একটু কষ্ট হলো কিন্তু ভালো করে তাকাতেই খেয়াল করলো সে আদিলের রুমে। প্রথমে বিশ্বাস হলো না তার। স্বপ্ন ভেবে হুড়মুড়িয়ে উঠতে গিয়ে তার শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো। আদিল পাশেই ছিলো ব্যাস্ত হয়ে সে হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধাকে বসালো। স্নিগ্ধার মাথাটা এখনো ধরে আছে।ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যাওয়ার ভয়ে আদিলের হাত শক্ত করে ধরলো তারপর দ্রুত নিশ্বাস নিতে লাগলো। হটাৎ হার্ট বিট বেড়ে গেছে তার।
আদিল স্নিগ্ধার এই অবস্থা দেখে একহাতে স্নিগ্ধার গাল স্পর্শ করে অস্থির কণ্ঠে বললো,” কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? শান্ত হও, কোনো ভয় নেই। আমি আছি তোমার কাছে।”
[ #চলবে ]