#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩০
#নবনী_নীলা
স্পৃহা হাত বাড়িয়ে চকলেট নেওয়ার আগেই তার মা রুমে এলেন। স্পৃহা চোরের মতন হাত দুটো গুটিয়ে কোলে রেখে দিয়ে হাসি মুখে মায়ের দিকে তাকালো। আয়েশা খাতুন এসে স্পৃহার পাশে বসে বললেন,” শোন আমি জিমের সঙ্গে একবার তোর আপুর বাড়িতে যাবো। মেয়েটাকে গিয়ে দেখে আসি নয়তো আমার মন শান্ত হবে না। তোর বাবা অফিস থেকে ফিরলে বলবি যে আমি তোর আপুকে দেখত গেছি। আর আমি চলে যাওয়ার পর যেনো না শুনি তুমি বিছানা থেকে এক পা বাড়িয়েছ! কিছু লাগল ফরিদাকে বলবি।”
স্পৃহা ভদ্র মেয়ের মত মায়ের সব কথায় মাথা নেড়ে গেল। আয়েশা খাতুন তবুও বিশ্বাস করলেন না। ছোট মেয়েটা যে কত দুষ্টু সেটা তার জানা আছে।
গম্ভীর গলায় বললেন শুধু মাথা নাড়লে হবে না। আমি যেন এসে তোমাকে এইখানেই দেখতে পাই বুঝতে পেরেছো?
স্পৃহা কুঁচকে ফেলল তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। সে বুদ্ধি খাটিয়ে মাকে বলল, “তুমি আমাকে ফোনটা দিয়ে যাও, তাহলে তুমি যা বলবে আমি সেটাই করব। ফোন হাতের কাছে না থাকলে আমি তোমাকে কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’
আয়েশা খাতুন ফরিদাকে দিয়ে স্পৃহার কাছে মোবাইল পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তৈরি হয়ে জিমের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়লেন। এতোক্ষণ জিমকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে হয়েছে। স্পৃহা ফোন পেয়ে খুশিতে আত্নহারা। ভাগ্যিস ওই রোবটটা ফোনের কথা মনে করালো নয়তো এই বুদ্ধিটা মাথায় আসতো কি করে।স্পৃহা ফোন অন করতেই দেখলো চার্জ নেই। গাল ফুলিয়ে বিছানার পাশের চার্জারে ফোনটা লাগিয়ে একপাশে রেখে দিয়ে রিমোট হাতে নিয়ে মনের সুখে টিভি দেখতে লাগলো।
___________________
স্নিগ্ধা রুমে চুপচাপ হয়ে বসে আছে। ফাহাদের বলা কথাগুলো সে মাথায় সাজিয়ে উঠতে পারছে না। আরোহী আদিলের বোন আর অভ্র ফাহাদ আর আরোহীর সন্তান। তাহলে আদিল কেনো অভ্রকে নিজের পরিচয়ে বড়ো করছে।কেনো বলছে যে অভ্র তার সন্তান?
ফাহাদকে অপছন্দ করে শুধু এই একটি কারণেই এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। আর ফাহাদই বা কেনো অভ্রকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে না। এই কথাটা ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধার মনে পড়লো ফাহাদের করা প্রশ্নটা যে অভ্র কার সন্তান? হ্যা! শুরুতেই তো ফাহাদ তাকে এই প্রশ্নটা করেছিল। তাহলে কি ফাহাদ জানে না যে অভ্র তারই সন্তান? এর জন্যেই কি আদিল এতো লুকোচুরি করছে অভ্রর পরিচয় নিয়ে, আরোহীর পরিচয় নিয়ে।
স্নিগ্ধার এখন সবচেয়ে বড় কৌতূহল আনোয়ার সাহেবেকে নিয়ে। কোথায় উনি? সেই যে পাহাড়ে গিয়েছেন লোকটার ফেরার নাম নেই। স্নিগ্ধা তাকে নিয়ে এতো খারাপ কল্পনাও করতে পারছে না।
আর আদিল তার কি সবটাই অজানা? ফাহাদের সাথে অন্যায় হয়েছে জেনেও সে ফাহাদকে এতো ঘৃনা করে?কিসের এত জেদ তার? কি আনন্দ পাচ্ছে একটা শিশুকে তার বাবার কাছ থেকে সরিয়ে রেখে। নাকি আদিল ও নিজের বাবার মতন চিন্তা করে। তাহলে তাকে বিয়ে করলো কেনো সে?
স্নিগ্ধা নিশ্চই তার কাঙ্ক্ষিত মেয়েটি নয় কারণ তার থেকেও অনেক রুপবতী আর গুণবতী মেয়েকে সে অনায়াসে বিয়ে করতে পারতো। তাহলে এতো কিছু করে তাকেই কেনো বিয়ে করলো সে?
যদি সত্যিই ভালোবাসতো তাহলে তো তাকে সবটা জানাতো। এইটুকু বিশ্বাস কি তাকে করা যেতো না? নাকি সেদিনের মিডিয়ার প্রচার করা সেই মিথ্যে কথাটাকে সত্যি প্রমাণ করতে এইসব করেছে সে।
অভ্রর সত্যিটা আড়াল করতেই কি তাকে বিয়ে করেছে আদিল? হয়তো সেটাই। কারণ তার মতন এমন সাধারণ মেয়েকে আবরার ফাইয়াজ কেনো বিয়ে করতে যাবে? আবরার ফাইয়াজের জীবনে হয়তো অন্য কেউ আছে। থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়?
এইসব চিন্তার মাঝেই আদিল একটা ট্রে হাতে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। স্নিগ্ধা নিশ্চুপে চেয়ে রইলো। ট্রে টা স্নিগ্ধার পাশে রেখে আদিল বললো,” তোমার শরীর এখন দুর্বল তাই তোমাকে ঘন ঘন খাবার খেতে হবে। তাই চটজলদি খাবারটা শেষ করো।”
স্নিগ্ধা খাপছাড়া ভাবে বললো,” আমি খেলেই বা কি এমন হবে?”
স্নিগ্ধার কথা আদিল ঠিক ধরতে পারলো না। তার কপালে হালকা ভাজ পড়লো। তারপর কিছু একটা ভেবে স্নিগ্ধার পাশে বসে বললো,” না খেলে সুস্থ হবে কি করে।”
স্নিগ্ধা কাঠ গলায় বললো,” আমাকে নিয়ে আপনি না হয় আর নাই বা ভাবলেন।” স্নিগ্ধার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ধনুকের মতন আদিলের হৃদয়ে বিধলো।
আদিল বুঝতে পারছে ফাহাদ স্নিগ্ধাকে কিছু তো বলেছে। নিশ্চই স্নিগ্ধা জেনে গেছে অভ্র তার বোনের সন্তান। আরো কি কি বলেছে ফাহাদ সেসব বেশ আন্দাজ করতে পারছে সে। স্নিগ্ধার রাগ হওয়াটা তাই স্বাভাবিক কিন্তু এতে করে তাদের মাঝে আরো দুরত্ব বারুক সেটা সে চায় না।
আদিল শান্ত গলায় বললো,” তোমার ভুল হচ্ছে তোমাকে নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি আমাকেই নিয়ে ভাবছি কারণ তোমার সুস্থ হয়ে উঠাটা আমার জন্যে প্রয়োজন। আমাকে ভালো থাকতে হলে তো তোমাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে।”
সুপের বাটি ট্রে থেকে হাতে নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে এক পলক তাকালো আদিল।
আদিলের কথাগুলো এবার আর স্নিগ্ধা নিজের মন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিলো না। মন থেকে তার দূরত্ব আরো বেড়ে গেছে। স্নিগ্ধা অভিমানী নয়নে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধার এই চোখের ভাষা পড়তে একটুও কষ্ট হলো না আদিলের সে জানে স্নিগ্ধা কি শুনতে চায়। তবুও সেই কথাগুলো বলার সময় এখনও আসেনি। আদিল বুঝেও চোখ নামিয়ে ফেললো তারপর চামচে করে ফু দিয়ে ঠান্ডা করে সুপটা স্নিগ্ধার মুখের কাছে নিতেই অভিমানী মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখের ভাষা কঠিন।
আদিল হাল ছাড়লো না কোমল গলায় বললো,” আমার ভালো থাকার কথা নাই বা ভাবলে। তোমার মা তোমাকে দেখতে আসছে তার কথাটা তো ভাবো।তোমাকে এমন দেখতে কি তার ভালো লাগবে?”
স্নিগ্ধার মন নরম হলো না। সে অন্যদিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। আজ আর তাকে ভোলানো সম্ভব নয়। যতদিন না আদিল তাকে সবটা বলছে সে কোনো কথা শুনবে না।
____________________
স্পৃহা ফোন হাতে নিয়ে অবাক একটা নাম্বার থেকে এতোগুলো কল এসেছে তার ফোনে? বাপরে! কার এতো মনে পড়ছিল তাকে? স্পৃহা ফোনটা চার্জার থেকে খুলে সেই নাম্বারে কল করলো।
জিম সবে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে। চোখ বন্ধ করে সোফায় গা হেলিয়ে দিতেই তার ফোন বেজে উঠলো। জিম বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো তারপর রিসিভ করে বললো,” হেলো! কে?”
স্পৃহা জিমের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছে যে এটা সেই রোবোটিক মানুষ। কি আশ্চর্য! তার নাম্বার লোকটা মোবাইলে সেভ করেনি? স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” হেলো কে? এইটা কেমন কথা? আপনি নিজে আমাকে এতোগুলো কল দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছেন হেলো কে?”
এমন খিটখিটে কণ্ঠস্বর শুনে জিমের বুঝতে বাকি রইলো না ফোনের ওপাশে কে। জিম তপ্ত নিশ্বাস ফেললো তারপর চুপ করে রইলো।
স্পৃহা জিমকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,” আমাকে এতোগুলো কল দিয়ে এখন মুখে তালা মেরে বসে আছেন কেনো? কি জন্যে এতো কল করেছেন বলুন।”
জিম বেশ বিব্রত হয়ে ফোনের দিকে তাকালো। কি বলবে সেটা মনে মনে গুছাতে চেষ্টা করলো কিন্তু ঠিক পেরে উঠলো না। আমতা আমতা করে বললো,” অভ্রর জন্যে কল করেছিলাম। তোমাদের বাড়িতে ছিলো সে কারণেই চিন্তা হচ্ছিলো।” বলেই নিরবে একটা নিশ্বাস ফেললো সে।
” ও আচ্ছা? শুধু এই জন্যেই কল করেছিলেন বুঝি?” সন্দেহের কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো স্পৃহা।
জিম চুপ করে রইলো। হটাৎ কেনো জানি ভীষন নার্ভাস লাগছে তার। ফোন হাতে সে দাড়িয়ে পড়লো তারপর দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষে বলল,” ঠিক তা না!”
স্পৃহা জিমের কণ্ঠ শুনে বেশ মজা পেলো। লোকটা কি ঘাবড়ে গেছে নাকি? স্পৃহা আরো ভয় দেখতে বললো,” ঠিক তা না তো, ঠিক কি?”
জিম অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে গেলো। স্পৃহার খোঁজ নিতেই সে ফোন করেছিলো কিন্তু এই সত্যিটা সে কেনো জানি মুখে বলতে পারছে না। নিজেকে কেমন যুক্তিহীন মনে হচ্ছে। একটা মেয়েকে সে কেনো এতবার কল করলো। শুধু সে কেমন আছে একবার জানার জন্যে? কথাগুলো ভেবে জিম নিজেই অবাক। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কল কেটে দিয়ে পুনরায় সোফায় গা হেলিয়ে বসলো সে। দুহাতে কপালের অগ্রভাগ ধরে চিন্তা করতে লাগলো সে।
স্পৃহা হটাৎ জিমের এমন কাণ্ডে বেশ ক্ষিপ্ত হলো। আশ্চর্য! এইভাবে একটা মেয়ের মুখের উপর কল কেটে দিলো লোকটা? কতো বড় অপমান!
[ #চলবে ]