#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০৬]
তাড়াতাড়ি নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে আরাভ। আরাভের আজ অনেক তাড়া। কলেজে আসার ইচ্ছে তার ছিলো না। ফাস্ট ইয়ারের একটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস থাকায় কলেজে আসতে হয়েছে তাকে। প্রথমে ভেবেছিল ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটা করেই চলে যাবে।প্রিন্সিপ্যালের কাছে ছুটি চাই সে না করে দেয়। দুদিন পর পর হঠাৎ করে এমন ছুটি তিনি আর দিবেন না। এদিকে আরাভের ফোনে একের পর এক কল এসেই চলেছে। অফিসে বসে নিজের কাজ করছিলো আরাভ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট এর হেড স্যার মনিরুল ইসলাম বসে আরাভের পাশে। আরাভ মনিরুল স্যারের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য মূলক হাসি হাসলো। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। মনিরুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন,
” আপনি কি ব্যাস্ত?”
” হ্যাঁ, এখন একটু ব্যাস্ত আছি।”
মনিরুল ইসলাম ইতস্তত করে উঠতে চেয়েও উঠলেন না। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বললেন,
” আজ ডিনারটা আমাদের সাথে-ই করবেন।”
” ডিনার!”
” আমরা কয়েকজন স্যার মিলে ডিনারের ব্যবস্থা করছি।সেখানে আপনাকেও উপস্থিত থাকতে হবে।”
” চেষ্টা করবো। বাট কথা দিতে পারছি না।”
” আমরা অপেক্ষা করবো।!
উঠে দাঁড়ায় মনিরুল ইসলাম। আরাভের দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসে তারপর প্রস্থান করে। মনিরুল ইসলাম চলে যেতেই আরাভ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকায়। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের হেড এই তরুন স্যারকে তার বেশ লাগে। কেমন মুহূর্তে এই স্যার সবাইকে আপন করে নিতে পারে। এই সম্পর্কে বেশী কিছু জানে না সে। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করে শহরে এসেছে। এর থেকে বেশী কেউ জানে না। লম্বাশ্বাস নিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আরাভ।
ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ির কাছে যায় আরাভ। গাড়ির দরজা খুলে যেইনা গাড়িতে উঠতে যাবে অমনি ভূমির আগমন। ভ্রুদ্বয়ে সমান্য ভাজ পরে আরাভের। আরাভ কিছু বলবে, হাতে মোবাইল থাকায় থেমে গেলো। ” আই উইল কল ইউ লেটার” বলে কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি সেদিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। এতক্ষণ তো ঠিক কথা বলল। যে না ও এসেছে আর ওমনি কল কেটে দিলো। কে কল করেছিল? ওর সামনে কথা বললে কি হতো? আচ্ছা স্যারে জিবনে কি কোন মেয়ে আছে? এমন হ্যান্ডসাম ছেলে তার কোন গার্লফ্রেন্ড থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিষন্নতায় ছেয়েগেল ভূমির মুখ। মাথা নিচু করে নিলো সে। চোখ জ্বালা করছে। ভিষন জ্বালা করছে। কার্নিশে পানিও জমেছে। আরাভ ভুমির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। যখন এলো তখন তো হাসি মুখের ছিলো। এখন আবার হলোটা কি এই মেয়ের। আরাভের কপালের ভাজ আরো গাঢ় হলো। তারপর প্রশ্ন করলো,
” কি হয়েছে? এতক্ষণ তো ঠিক ছিলে? হঠাৎ করে কি হলো?”
মাথা তুলে তাকালো না ভূমি। আর কোন জবাবও দিলো না। আবারও জিগ্যেস করলো আরাভ,
” মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ?
এবারও ভূমির থেকে কোন জবাব পেল না। বিরক্তবোদ করলো আরাভ। বিরক্তিতে চ” উচ্চারণ করে। আশপাশ তাকালো। মনিরুল ইসলাম আর প্রিন্সিপ্যাল স্যার এদিকে আসছে। আরাভ ভূমির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
” গাড়িতে বসো।”
ভূমি দ্বিরুক্তি করলো না। গাড়িতে বসলো। আরাভ ও গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাধতে বাধতে জিগ্যেস করলো,
” কেন এসেছিলে?
এবার মাথাতুলে তাকালো ভূমি। ভূমির ছলছল কোমল দৃষ্টি দেখে আরাভের বুকের ভিতরটায় চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো। আটকে উঠলো সে। চেয়ে রইলো সেই নরম কোমল দৃষ্টির দিকে। চোখ নামিয়ে নিলো ভূমি। আরাভ সিটবেল্ট রেখে ভূমির এসে আসলো। ভূমির চিবুক ধরে নরম শীতল কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
” কাঁদছ কেন ভূমি? কেউ কিছু বলেছে?
এবার মুখ খুলল ভূমি। আরাভের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” আপনি তখন কার সাথে কথা বলছিলেন।”
হেসে ফেলল আরাভ। মুখ ঘুড়িয়ে ঠোট চেপে হাসলো। তারপর ভূমির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই জন্যে ম্যাডামের মন খারাপ। সন্দেহ করছো আমায়?”
“না সন্দেহ না। আপনি আমায় দেখে কল কেটে দিলেন কেন? কে ছিলো?” শেষ প্রশ্নটা মাথা নিচু করে করলো।
আরাভ ভূমির মুখটা দু-হাতে উচু করে ধরে বলল,
” মব খারাপ করার কিছু নেই। রেদওয়ানের সাথে কথা বলছিলাম।”
মূহুর্তেই ভূমির মনের সব বিষন্নতা কাটিয়ে একটু হাসির রেখে ফুটে উঠলো। আরাভ এবার সেন স্বস্তি পেলো। লম্বা এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভূমির সিল্টবেল লাগিয়ে সোজা হয়ে বসলো। নিজের সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলো,
” এখানে কি করতে এসেছিলে?”
” কফিশপে যাব।”
” এখন।”
” হুম।
আরাভ পড়লো এবার মহামুশকিলে। ভূমিকে এখনি কপিশপে যেতে হবে। এদিকে রেদওয়ান কল দিয়ে তাড়া দিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাভ। ভুমিকে মুখের উপর না করতেও পারছে না। কয়েকদিন পর দেখা তার মেয়েটার সাথে। কাজ আর মানুষিক চাপের কারনে মেয়েটাকে সময়ই দেওয়া হয়না। পরে যা হবার হবে, এবার ভূমির ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিবে আরাভ সিদ্ধান্ত নিলো। ভূমির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
______________________
দিগন্ত ঢাকায় ফিরেছে দু-দিন হলো। দুদিন আর অফিসে যায়নি সে। গতকাল রাতে রফিক মির্জা কল করেছিলে। আজ তাকে অফিসে যেতে হবে। সিলেটের কেইসের হিসট্রি জানতে চান তিনি। তারপর হয়তো দিগন্তের হাতে নতুন কোন কেইস তুলে দিবেন। রাতভর গভীর ঘুমে নিমজ্জিত থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেট হয় দিগন্তের। ফ্রেশ হয়ে অনলাইনে খাবার অর্ডার অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে নেয়। ততক্ষণে খাবার এসে যায়। দিগন্ত নাস্তা করছে এমন সময় দিগন্তের সেলফোন বেজে উঠে। স্কিনে “মা” নামটা দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে দিগন্তের চোখমুখে। কল রিসিভ করে বলে,
” মা, মা বল কেমন আছো তুমি?”
ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠ। কন্ঠে অভীমানের সুর। চাপা কষ্ট। আদরের ছেলে দিগন্ত। যাকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন দিগন্তের মা সৈয়দা লাভলী। সবসময় ছেলেকে আগলে রেখেছেন। কখনো কষ্ট কি বুঝতে দেননি। আজ সেই ছেলে শহরে একা থাকে। ঠিকমতো খেতে পারে কি না জানেনা। কষ্টে, যন্ত্রণায় ছটফট করেন সৈয়দা লাভলী। অভীমানি কন্ঠে বললেন,
” আমার খবর নেওয়ার সময় কি তোর আছে। সারাক্ষণ তো ওই কাজ কাজ কাজ। হ্যারে খোকা। তোর শরীর ভালো আছে তো? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস তো?”
” মা,,, মা,, এত চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি। আমি কিন্তু এখন আর ছোট্ট্ নেই। অনেক বড় হয়েছি।”
” তা তো দেখাতেই পাচ্ছি। তোকে কিছু বলার ছিলো?”
” হ্যাঁ মা বলো কি বলবে?”
” রুমিকে তো চিনিস। তোর বাবা বলছিলো রুমির সাথে তোর বি,,,য়ে,,,,
” মা প্লিজ। তুমি তো সবটা তাহলে কেন এসব কথা বলছো।”
” যে হাড়িয়ে গেছে তাকে কি খুঁজে পাবি বল। এভাবে নিজের জিবনটা নষ্ট করিস না খোকা।”
” তার ঠিকানা আমি পেয়ে গেছি মা। এবার খুব তাড়াতাড়ি তোমার বৌমাকে ঘরে তুলবো।”
” হ্যারে সত্যি বলছিস তো খোকা।”
” হুম। সত্যি বলছি। এবার রাখছি বুঝলে মা। আমাকে অফিসে যেতে হবে।”
” হুম রাখ। আর শোন সাবধানে থাকবি, নিজের খেয়াল রাখবি। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি। আর একদম রাত জাগবি না।”
” ঠিক আছে এবার রাখি।”
” হুম রাখ।
কল কেটে স্মিত হাসলো দিগন্ত। ওর মা-টা না কি যে ভাবে। দিগন্তকে এখনো সেই ছোট্টটি ভাবে। আসলে ছেলেমেয়েরা যতই বড় হোকনা কেন? বাবা মায়ের কাছে তারা সবসময় ছোটই থাকে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে খাবার খেতে শুরু করে দিগন্ত।
রফিক মির্জার সাথে আলোচনা শেষ করে বিকালের দিকে অফিস থেকে বের হয় দিগন্ত। গন্তব্য এখন তার প্রিয় মানুষটার ঠিকানায়। একটা রিক্সা ডেকে সেটায় উঠে বসে। রিক্সা চলছে তার নিদিষ্ট গতিতে। দিগন্তের চোখ রাস্তার চারিপাশে বিচরণ করছে। মনে মনে নানা কল্পনা আটছে তার প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে। কেমন দেখতে হবে তার প্রিয় মানুষটা। তার সাথে প্রথমে কি ভাবে কথা বলবে? দিগন্ত খেয়াল করলো ওর গলা কাপছে। হার্ট দ্রুত বিট করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছোট্ট পুতুল। দিগন্তের এখনো মনে আছে প্রথম যেদিন তার ছোট্ট পুতুলের সাথে দেখা হয়েছিলো তখন দিগন্ত সবে ফোরে পড়ে। ছোট্ট ভাই মা বাবা আর দাদুকে গিয়ে এসেছিলো তাদের ছোট্ট গ্রামে। যেটা এখন শহর হিসাবে গড়ে উঠেছে। লাল ফ্রক পড়া ছোট্ট সেই মেয়েটির মাথায় ঋুটি করা ছিলো। যেটা দেখে দিগন্ত প্রথম যেটা বলেছিলো সেটা হলো, পুতুলের মাথায় তালগাছ গজিয়েছে। মাথায় তালগাছ গজিয়েছে বলে পুতুল অনেক কাঁদছিল যার কারনে দিগন্তকে মার খেয়ে হয়েছিল ওর মায়ের হাতে।
হেসে ফেলল দিগন্ত। ছোট বেলার সেই মধুর স্মৃতি আজো ওর বুকে ধারন করে রেখেছে। এই স্মৃতিগুলো নিয়েই তো বেচে আছে সে। একদিন সে তার পুতুলকে কাছে পাবে তাকে আপন করে পাবে এই স্বপ্নই তো সে দেখেছে।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রোজিনা হোসাইন দরজা খুলে দেন। দরজার ওপাশে লম্বা সুশীল এক যুবককে দেখে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকান। রোজিনা হোসাইনকে দেখেই যুবকটার মুখে চোওড়া হাসি ফুটে উঠলো। রোজিনা হোসাইন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ড্রয়িংরুম বসে মোবাইলে লুডু লেখছে ভূমি আর তন্ময়। রোজিনা হোসাইনকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুমি প্রশ্ন করলো,
” কে এসেছে, মা?”
কন্ঠটা শুনে বুকটা ছেদ করে উঠলো যুবকটার। বুকের ভিতরটা উঠানামা করছে। সে দ্রুত শ্বাস নিতে থাকলো। এই কন্ঠটা, হ্যা এই কন্ঠটাই তো সে শুনতে চেয়েছে এতদিন।
চলবে,,,,,,,,
Mahfuza Afrin Shikha.