রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব-১৩

0
1031

#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব-১৩ (প্রথমাংশ)

পাশাপাশি ছ’টা চেয়ারে বসে আছে তুরাগ, অভিলাষ, শিলা, স্বরূপা,কৌশিক এবং মৃদুল। সামনে একটা টেবিল। টেবিলের অপজিটে তাদের ঠিক সামনে গোয়েন্দা মুখভঙ্গি নিয়ে পাশাপাশি বসে আছে নিতিন, অধরা। নিতিন সচেতন চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকলেও অধরার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরাসরি গিয়ে পড়ছে তুরাগের উপর। সে স্থির দৃষ্টিতে তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরাগ যখন হেটে আসছিল তখন অধরা অবাক চোখে তুরাগের দিকে তাকিয়ে ছিল। এই মানুষটাকে দেখেই তার একদিন আফসোস হয়েছিল। মনে হয়েছিল এর থেকে অসহায় ব্যাক্তি আর দুটো নেই। অথচ সেই অসহায় ব্যক্তি দু’মুখো সাপ প্রমাণ হল! সে অসহায় ছিল না, সে ছলনাময় ছিল। সেদিনের আফসোসের জন্য আজ আফসোস হচ্ছে অধরার। তুরাগের দিকে তাকাতেই অধরার একটা কথা মাথায় আসছে। একটা মানুষ লোভে পড়ে এতটা নিচে নামতে পারে?

অধরার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল নিতিনের কথায়। নিতিন টেবিলের উপর থেকে প্লাইয়ার্স হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
” ইরানের লার ভ্যালি নামক অঞ্চলে পাওয়া নাট্রিক্স নামক এক ধরনের সাপ। সাপটির বৈশিষ্ট্য কী জানেন? সে কোন শিকারের উপস্থিতি টের পেলে কিংবা আঘাত পাবার সম্ভাবনা দেখলে নিজের নাক, মুখ থেকে রক্ত বের করে তার মুখের পাশে ছড়িয়ে দিতে পারে, যাতে শিকার তাকে মৃত ভেবে ভুল করে। তার মৃত হওয়ার ভান এতটাই নিঁখুত যে সহজে কেউ ধরতে পারে না। সবাই দেখলে বলবে সাপটি নিশ্চিত মৃত। মৃত ভেবে একরাশ আফসোস নিয়ে যখনি শিকার সামনে আসবে, তখনি সাপটি মরণ ছোবল দেয়। তাই এই সাপটাকে অনেকেই ছলনাময় সাপ বা রহস্যময় সাপ বলে থাকে। আপনাদের মাঝে এই সাপের বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। যেন বৈশিষ্টগত দিক দিয়ে একে অপরের কার্বন কপি। কী অভিনয়! বাহ! সত্যিই চমৎকার!”

নিতিন থামল। তারপর সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার প্লাইয়ার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তবে একটা দুঃখের বিষয় কী, জানেন? আপনাদের কেস হ্যান্ডেল করতে করতে আপনাদের কিছু বৈশিষ্ট্য আমার আর ইন্সপেক্টর অধরার মাঝে চলে এসেছে। বিশেষ করে অভিনয়ের গুনটা। ইন্সপেক্টর অধরা তার নিঁখুত অভিনয় দিয়ে ডাঃকৌশিক আর মৃদুলকে পাকড়াও করেছে। আমি আমার অভিনয় গুন দিয়ে মৃদুলের পেট থেকে সত্য বের করেছি। যদিও এরজন্য আমাকেও নাট্রিক্স সাপের মতো অভিনয় করতে হয়েছে। আমি নিজের সততাকে মৃতের ভান করিয়ে শিকারকে বশে এনেছি। বশে আনতেই ছোবল মেরেছি। ”

বলে মৃদুলের রক্তমাখা হাতের দিকে ইশারা করল। তারপর বলল,
“বিশ্বাস না হলে নিজেরাই দেখুন। ছোবল মারার পিছনে অবশ্য আরেকটা দোষ ছিল। তা হলো, সে আমাদের হাত করে মামলা দফারফা করতে চেয়েছিল। যা একবারেই আমার পছন্দ নয়। অপছন্দনীয় কাজের শাস্তি অবশ্যক। মৃদুলের শাস্তির কথা বলার মানে হচ্ছে আপনাদের সতর্ক করা। দেখুন, আপনারা আবার ভুল করেও দফারফার কথা মুখে আনবেন না। সেটা সম্ভব নয়। যদিও আপনাদের শাস্তি দিতে আমার বেশ মজা লাগবে। প্রচুর ক্ষোভ আপনাদের উপর। ক্ষোভের পরিমান এত বেশি যে এই প্লাইয়ার্স দিয়ে আপনাদের পুরো শরীরের চামড়া টেনে তুলে ফেললেও ক্ষোভের পরিমাণ কমবে না। হয়তো আরো বাড়বে। সুতারাং, আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না। ভালোয় ভালোয় এ টু জেড সব সত্য বলুন। না হলে এই প্লাইয়ার্স তো আছেই।”

নিতিন বাঁকা হাসল। নিতিনের কথা, ভাবভঙ্গি দেখে তুরাগ ছাড়া বাকি সবার চেহারায় ভয়ের আভাস দেখা গেল। তারা বারবার মৃদুলের ব্যাথিত চেহারা আর রক্তমাখা হাতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলছে। মৃদুলের ব্যাথিত চেহারার নিরব আর্তনাদ যেন তাদের ভয়কে ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে নিতিনের প্লাইয়ার্স ঘুরানো তাদের আত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তবে তুরাগের চেহারায় ভয়ের তেমন আভাস নেই। সে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় সে নিতিনের কথা শুনেই নি। তুরাগের ভয়হীন চেহারা পরখ করে অধরা ভ্রু কুঁচকাল। এখনো কি এই অপরাধীর ভয় লাগছে না! আরো অভিনয় করা বাকি আছে?

অধরা তুরাগকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মি.তুরাগ, এখন কি আপনি আবার কোন স্ক্রিপ্ট মনে করছেন, যা আমাদের শুনাবেন? যদি তাই হয় তবে সে খেয়াল মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন।”

অধরার কথায় তুরাগের ভাবভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। এখনো আগের মতোই ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। যা নিতিনের পছন্দ হলো না। নিতিন হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে তুরাগের কাছে গেল। এবং দড়ি দিয়ে চেয়ারের হাতলের সাথে বাধা ডান হাতের অনামিকা আঙুলের ডগা প্লাইয়ার্সের ভিতর ঢুকিয়ে সব শক্তি দিয়ে একটা চাপ দিল। এতে তুরাগের নখটা ভেঙে গেলো। কাঁচা নখে আঘাত লাগায় রক্ত ঝরা শুরু হলো। সেই সাথে অসহনীয় ব্যাথা। সেকেন্ড বিশের মাঝে কাজ শেষ করে নিতিন নিজের জায়গায় এসে বসল। আকস্মিক নিতিনের কাজ কেউই যেন বুঝে উঠতে পারল না। ব্যাথায় তুরাগের মুখ থেকে আর্তনাদ বের হল। সে চটপট করতে লাগল। কিন্তু শক্ত করে বাধা থাকায় হাত নাড়াতে পারছে না। তুরাগের আর্তনাদ কানে যেতেই সবাই চিৎকার দিল। এবং তুরাগের হাতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। এবার ভয়টা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। তারা বেশ বুঝতে পেরেছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর বাঁচার কোন উপায় নেই।

নিতিন সবার ভীত চেহারার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
“এবার একদম পারফেক্ট লুকে আছেন সবাই। বিশেষ করে তুরাগ। এত বড় অপরাধ করে পুলিশ, সি আই ডি কর্মকর্তার সামনে নির্বিঘ্নচিত্তে বসে থাকা শোভা পায় না। চেহারায় ভয় থাকা বাধ্যতামূলক। আমার আবার আসামীদের ভীত চেহারা দেখতে ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা থেকেই এত আয়োজন। তবে আপনারা চিন্তা করবেন না। সুযোগ বুঝে সবাই পাবেন এই উপহার। আপনারা প্রতিভাকে ধোকা দিয়েছেন আমি না হয় আপনাদের প্লাইয়ার্স দিয়ে একটু কষ্টই দিলাম! মন্দ কি? অবশ্য প্লাইয়ার্সের আঘাতের চেয়ে ধোঁঁকার আঘাতে কষ্ট বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি এখন ধোঁকা দিতে পারব না আপনাদের। তাই প্লাইয়ার্স দিয়েই একটু আধটু আসামীপরায়ান করব। কী বলেন, ইন্সপেক্টর অধরা? বেশ হবে না?”

শেষে কথাটা অধরার দিকে তাকিয়ে বলল নিতিন। অধরা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল,
” পাহাড় সম কষ্টের বিনিময়ে মুঠোভরতি কষ্ট নিতান্তই নগন্য। তবে একবারেই খালি হাতে ফেরানোর চেয়ে মুঠোভরতি কষ্ট উত্তম। বেশ হবে। ”

নিতিন এবার অভিলাষ আর আর্তনাদরত তুরাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এস আই ভির লিডার যেহেতু অভিলাষ আর তুরাগ। তাই ঘটনার মূল প্রেক্ষাপট তাদের থেকেই শুনি। তো মি. কুঞ্জন ওরফে তুরাগ, মি. চঞ্চল বিশ্বাস ওরফে অভিলাষ, নাটক না করে বাধ্য ছেলের মতো ঘটনার শুরু থেকে বলুন তো। কে বলবেন? দুজনের একজন বলুন তাড়াতাড়ি। ”

নিতিনের কথায় তুরাগ অভিলাষ দুজনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ইশারায় কথা সেরে নিরবতায় গা ঢাকল। নিতিনের কথার উত্তর দিল না। নিতিন প্লাইয়ার্স হাতে অভিলাষের কাছে গেল। অভিলাষের আঙুলে প্লাইয়ার্স তাক করল। তা দেখে নিজ ব্যাথা ভুলে তুরাগ চেঁচিয়ে উঠল।
“আমি বলছি। ওকে ছেড়ে দিন।”
অভিলাষকে বাঁচাতে দেখে নিতিন অধরা অবাক হল। বিস্ময় কাটিয়ে নিতিন বলল,
“বাবা মেয়ের খুন মোটেও সম্পত্তির জন্য ছিল না। প্রতিশোধমুলক খুন ছিল, তাই না?”

চোখ বন্ধ করে হাতের অসহনীয় ব্যাথা হজম করল তুরাগ। তারপর ধীর গলায় বলা শুরু করল,
” হ্যাঁ, এটা প্রতিশোধমূলক খুন। ঘটনা শুরু আজ থেকে প্রায় ষোলো বছর আগে৷ তখন আমার বয়স ছিল দশবছর, চঞ্চলের ছিল আট বছর। আমরা দুজনই ছিলাম এতিম। আমাদের দুজনের বাস রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলার দুর্লভপুর এতিমখানায়। ওই এতিমখানার একজন শিক্ষক ছিলেন নাম সাদাব বিশ্বাস। অত্যন্ত সৎ ও ন্যায়বান মানুষ ছিলেন তিনি। এতিমখানার সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখতেন। তবে সবার চেয়ে আমাদের দু’জনের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল একটু বেশিই। আমাদের দুজনকেই ডাস্টবিনের ময়লার থলে থেকে তুলে এতিমখানায় এনে নিজ সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন। সন্তান না থাকায়। আমাদেরই সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন তার পরিচয়ে যেন আমরা মানুষ হই তাই আমার নাম রাখলেন কুঞ্জন বিশ্বাস। অভিলাষের নাম রাখলেন চঞ্চল বিশ্বাস। তার স্ত্রী শতরূপা মেহেক বীনা ও আমাদের সন্তানের চোখে দেখতেন। বুঝ হওয়ার পর থেকে আমরা দুজন তাদের বাবা মা হিসেবে জানতাম। আমরা তাদের বাবা মায়ের মতোই ট্রিট করতাম। আমাদের আন্তরিকতায় তিনি মুগ্ধ হতেন বলেই হয়তো আমাদের বেশি আদর করতেন। অভিলাষকে যখন বাবা কুড়িয়ে আনেন তখন আমার বয়স দুই কি আড়াই বছর। বাবা ওকে কুড়িয়ে এনে আমার কোলে দিয়ে বলেছিলেন এটা তোমার ভাই। ছোট ছিলাম এত কিছু বুঝতাম না, তাই মেনে নিয়েছিলাম। ওকেই আমার সঙ্গী করলাম। সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম ওকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার। চঞ্চল বড় হতে লাগল। ওর চোখে আমি হয়ে গেলাম বড় ভাই। দু’ভাই মিলে বেশ ভালোই হেসেখেলে দিন পার করতাম। এর বেশ কয়েক বছর পর একদিন হুট করেই বাবা মা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেদিন ছিলো শুক্রবার। বাবা আগেরদিন রাতে দীঘাপতিয়ায় নিজ বাড়িতে গিয়েছিলেন। সব ঠিকঠাকই ছিলো। হুট করে বাবা মায়ের মৃত্যু মানতে পারলাম না। কেনো জানি মনে হচ্ছিলো এটা আতহত্যা নয় এটা মার্ডার। বাবা মা এভাবে মরতে পারে না। তাছাড়া তারা খুব সুখে ছিল। ছোট হলেও আমার মানুষিক পরিপক্ক ছিল প্রবল। তাই খটকাটা বেশি লাগছিল। থানা পুলিশ হল। সবকিছু মিটমাট করলেন বাবার ভাই মানে চাচা পলাশ বিশ্বাস। আমি পিতৃশোকে কাতর তখন। শোক কাটিয়ে উঠে একদিন চাচার কাছে গেলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম বাবা মা আত্মহত্যা করেন নি। তাদের খুন করা হয়েছে। এমনভাবে খুন করা হয়েছে যেন মার্ডান হিসেবে বুঝা যায় না। আত্মহত্যা হিসেবে ঢাকা পড়ে। কে খুন করেছে জিজ্ঞেস করলে চাচা জানায়,বাবার সাথে বেশ কিছুদিন যাবত নাকি এক শিল্পপতি ঝগড়া চলছে। বাবা নাকি শিল্পপতির ইয়াবা প্রাচারের কথা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা ন্যায়বান মানুষ ছিলেন, অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াতেন। নিজ জেলায় ওই শিল্পপতির ইয়াবা প্রাচার দেখে প্রথমে নিষেধ করেন, তাও না মানলে বাবা কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশকে দিয়ে দেন। প্রমাণ হাতে পেয়ে পুলিশ তাকে ধরতে গেলে তিনি পুলিশকে টাকার বিনিময়ে নিজের দলে নিয়ে নেন। যাতে পুলিশরাও তার কথামতো কাজ করে। থানায় প্রমাণ জমা দেয়ার দিন দুয়েক বাদেই বাবা মায়ের মৃত্যু হয়। এতেই বুঝা যায় বাবা মাকে খুন করে ওই শিল্পপতি প্রতিশোধ নিয়েছে। কারণ এর আগেই শিল্পপতি বাবাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলো। ”

“ওই শিল্পপতি কে ছিলো?”
কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল নিতিন। তুরাগ চোয়াল শক্ত করে কঠিন কন্ঠে বলল,
“প্রভাত মির্জা, প্রভাত মির্জাই সেই কালপ্রিট যে আমাদের বাবা মাকে মেরেছে।”
“আর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই আপনি প্রভাত মির্জাকে খুন করলেন, তাই তো?”
অধরা গম্ভীরমুখে বলল। তুরাগ সায় জানিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এর জন্যই। আমাদের তিনজনের জীবন তছনছ করে তিনি সুখে থাকবেন! তা হতে দিই কি করে আমরা? তাই প্রতিশোধ নিয়েছি। আমার বাবা মায়ের খুনিকে শাস্তি দিয়েছি।”

“তিনজন? তিনজন কে কে? আপনি আর অভিলাষ ছাড়াও আরো কেউ ছিল?”
অধরা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। অধরার কথা শুনে তুরাগের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। যেন সে নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গিয়েছে। এমন কথা সে বলতে চায় নি। তুরাগ একবার তার পাশে তাকাল। দেখলো দুটো অশ্রুভরা চোখ অসহায় দৃষ্টিত তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে তুরাগের চেহারায় ভেসে থাকা অসহায়ত্ব এবার অপরাধবোধে পরিনত হলো। তুরাগ চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। কোন উত্তর দিলো না। নিতিন তুরাগের দিকে সচেতন চোখে তাকিয়ে বলল,
” আমি যদি ভুল না হই তবে তৃতীয় ব্যক্তি স্বরূপা। তাই না?”

নিতিনের কথায় চমকে গিয়ে মাথা তুলে তাকাল তুরাগ। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
“না বর্ণা এসবে নেই। ওকে জড়াবেন না এসবে?”

অধরা স্বরূপার দিক অন্তর্ভেদী চাহনি দিল। বাদামী দেহে গ্রে কালার টপস, সাথে নীল ডেনিম প্যান্ট। কালার করা চুল পোনিটেল করে বাধা। শ্যামবর্ণের মায়াবী চোয়াল, কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। সব শেষে অধরার চোখ গেল স্বরূপার সিঁথিতে। চুলের মাথা সরু লাল রেখা আঁকা। সিঁদুর ওটা! বোধহয়। অধরা হাতে নজর দিল, নাহ, শাখাপলা নেই। অধরা আবার সিঁদুরের দিকে তাকাল, বাঁকা হাসল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

“আচ্ছা, জড়াব না। স্বরূপার সিঁথিতে আপনার নামের সিঁদুর দেখেও কিছু বলব না। তবে আমার কৌতুহ মন স্বরূপার সাথে আপনার পরিচয়, পরিণয় এবং প্রণয় কাহিনী শুনতে চাইছে। বলে ফেলুন ।”

অধরার কথায় তুরাগ স্বরূপার সিথিতে নজর দিল। স্বরূপা তুরাগের ব্যাথিত হাত থেকে দৃষ্টিতে তুলে অধরার দিকে তাকাল। এতক্ষণ সে স্থির দৃষ্টিতে তুরাগের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে পানি টলমল করছিল। চেহারা ভরা ব্যাথার আভাস। যেন ব্যাথা তুরাগ নয় সে পাচ্ছে। ব্যাথিত চোখে খানিকটা বিস্ময় মাখিয়ে নিতিনের দিকে তাকাল সে। যার অর্থ,আপনারা জেনে গেছেন!
নিতিন থেকে চোখ সরিয়ে তুরাগের দিকে তাকাল একবার। তুরাগের ও দৃষ্টি তখনো স্বরূপার দিকে। তুরাগের চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। স্বরূপার চোখের পানি তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। নাহ, সে কোন ভাবেইবেই এই মানুষটার চোখে পানি দেখতে পারবে না। তাই চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর কী যেন ভাবল। ভাবনার মাঝেই তুরাগের চেহারায় দৃঢ়তার ঢেউ খেলে গেল। হয়তো সে প্রতিজ্ঞা করেছে, নিজের যত দোষই হোক মেনে নিবে। কিন্তু প্রিয়তমাকে শাস্তি পেতে দিবে না। কখনো না। দুজনের এই বদলানো চেহারার ভাষা খুব সহজেই ধরে ফেলল নিতিন। বাঁকা হেসে বলল,
“মি.কুঞ্জন বিশ্বাস আপনি আপনার পরিচয় পরিণয়ের ব্যাপারে মুখ খুলবেন না তাই তো? যদি ও আমি সবটাই জানি। তাও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি। নাহলে আমাকে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে।”

চোখে মুখে দৃঢ়তার রেখা টেনে দৃঢ় কন্ঠে তুরাগ বলল,
” প্রতিভা ছাড়া আমার কোন পরিণয় প্রণয়ের ঘটনা নেই। আমি জানি না আপনারা কী শুনেছেন তবে যাই শুনেছেন তা মিথ্যা।”

“প্রভাত মির্জার লাশ যেদিন পেলাম সেদিন আমি আপনার ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখেছি। প্রতিটা জিনিস সুক্ষ্ম চোখে পরখ করেছি। তেমনি তল্লাশি চালাতে চালাতে আপনার বেডরুমে যাই। আপনার বেডরুমের দেয়ালে চোখ বুলাতে গিয়ে একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। ছবিটা ছিল আপনার প্রথম ভ্রমণের। স্থান, ইন্দোনেশিয়ার বালি। আপনার গায়ে ছিলো লাল টি-শার্ট, ব্রাউন ডেনিম প্যান্ট। চোখে নীল সানগ্লাস। ছবির বাকিসব জিনিস থেকে আপনার ব্লু সানগ্লাসটা আমার অধিক নজর কেড়েছে। কারণ কি জানেন? ”
প্রশ্ন ছুঁড়ল নিতিন। তুরাগ ধরতে পারল না। কৌতুহলী চোখে তাকাল কেবল মাত্র। ভ্রু কুঁচকানো তার। স্বরূপা উৎসুকভাবে প্রশ্ন করল,
“কী?”

নিতিনের টেবিলের উপর ডান হাতের চার আঙুল দিয়ে হারমোনিয়াম বাজানোর মতো করে আঙুল নাচালো। সেই সাথে বলল,
“আপনার সানগ্লাসেই ছিল এক নারীর অবয়ব। খানিক দূরেই ছিল সে নারী। রেড এন্ড হোয়াইট কম্বিনেশনের স্লিভলেস হাটু অব্দি ফ্রকে শ্যামবর্ণের এক অপরূপা নারী। তার পোশাক তার মূল চরিত্র ডেকে দিয়েছিল। তাই আমার চিনতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখার পর সেই নারীকে আমার পরিচিত লাগল। কোথায় দেখেছি একে? কোথায়? হুট করেই মনে পড়ল আরে এ তো প্রতিভার বান্ধবী স্বরূপা! ওই মেয়ে ওখানে কী করছে! তুরাগের সাথে তো প্রতিভার থাকার কথা। তারপর আমার চোখে পড়ে ফটো ট্যাগ কার্ডে। যার সারমর্ম ছিল, প্রতিভাকে ছাড়া আপনার প্রথম ফরেন ট্রিপ ছিল সেটা। ওই ট্যাগ দেখে আমি আবারো ফটোফ্রেমে চোখ বুলাই। তারপর খেয়াল হয় আপনাদের দুজনের ড্রেস কালার একি। কাপল ড্রেস! তারমানে এরা… হাহ, তারপরই সব ঘটনা বুঝে আসে আমার। সব কাজ নিঁখুত করে বেড রুমে ওই ছবি না রাখলে ও পারতেন। সবাই তো আর প্রতিভার মতো বোকা না যে চোখে পড়বে না।”

নিতিনের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। নিতিনের কথায় তুরাগের কুঁচকানো ভ্রু সোজা হয়ে গেল। কপালে দেখা গেল বিস্ময়ের রেখা। সেই সাথে চোখে মুখে রাগের আভাস ফুটে ওঠেছে। সেই রাগটা হয়তো নিজের উপর। কেনো সে এই ভুলটা করতে গেল! ছবিটা বেডরুমে না রাখলে তো বর্ণা ফেঁসে যেতো না। রাগে নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে পারছে না। নাহ, এত তাড়াতাড়ি হার মানলে চলবে না। নিজের জন্য না হলেও বর্ণার জন্য হলেও লড়তে হবে। এ ভেবেই দৃঢ়তার সাথে বলল,
” আপনারা ভুল ভাবছেন এমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। বালিতে বর্ণা যায় নি। আমিই গিয়েছিলাম৷ আপনারা যাকে দেখেছেন সে বর্ণা নয়। অন্য মেয়ে। ”

“আপনি মুখ খুলবেন না তাই তো?” রাগত কন্ঠে বলল অধরা। তুরাগ এবারও দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই আমার৷ অন্য যেকোনো ব্যপারে প্রশ্ন করুন। আমি বলব। বর্ণার সাথে আমার কিছু নেই। ওকে জড়াবেন না।”

অধরা টেবিল থেকে প্লাইয়ার্স নিয়ে রাগত কন্ঠে বলল,
“দিনের পর দিন প্রতিভার সাথে বিশ্বাসঘাতক করেছেন। তাকে বিয়ে করে তার অলক্ষ্যে সব পাপ করে গেছেন। এখন বলতে পারছেন না কেনো! আমি ও দেখি আপনি কিভাবে মুখ না খুলেন। মি.নিতিন আপনার নখ ভেঙেছে আমি আপনার ভাঙা নখ আঙুল সহ ছিঁড়ে ফেলব। তারপর দেখি, আপনি কতটা শক্ত থাকতে পারেন।”

অধরা উঠে দাঁড়াল। তারপর এক পা বাড়াতেই নিতিন থামিয়ে দিল।
“এক মিনিট, মিস অধরা।”

অধরা দাঁড়িয়ে কপাক কুঁচকে নিতিনের দিকে তাকাল। যার অর্থ, থামালেন কেনো! নিতিন তা বুঝতে পেরে বলল,
“অপেক্ষা করুন, বলছি। ”
বলে নিতিন তার প্যান্টের পকেট থেকে সাদা কাগজে আবৃত একটা স্প্রে বোতল বের করল। স্প্রেটার উপরে ছাই রঙের ক্যাপ। বাকিটা কাগজে ঢাকা। নিতিন স্প্রেটা দেখিয়ে বলল,
“এটা কি জানেন? এটা একটা মরনব্যাধি স্প্রে। এই স্প্রে শরীরের কোন অংশে দিলে সাথে সাথে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় এবং খানিক পরেই সেই স্থান অকাজো হয়ে যায়। যেমন, প্যারালাইজড। প্লাইয়ার্স দিকে নখ টেনে তুলতে বেশ শক্তি খরচ হয়। ওতো শক্তি প্রয়োগ না করে তুরাগের আঙুলে এই স্প্রে ছিটালে ঘন্টাখানেক গলা কাটা মুরগির মতো চটপট করবে। ব্যাথায় অসহ্য হয়ে মরতে চাইবে। কিন্তু পারবে না। তারপর ঘন্টাখানেক পরে হাত নিস্তেজ হয়ে যাবে। এটাতে আমাদের শ্রম কম যাবে, ওরা ভালো শাস্তি ও পাবে। আপনি বরং এটা ট্রাই করুন।”

বলে অধরার দিকে স্প্রেটা বাড়িয়ে দিল। অধরা স্প্রেটা নিতেই নিতিন অধরাকে ইশারায় কিছু একটা বলল। অধরা ইশারা বুঝে ইশারাতেই সায় জানাল। তারপর স্প্রে হাতে নিয়ে প্লাইয়ার্স নিতিনকে দিয়ে তুরাগের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে বলল,
“আপনার উপর আমার ভীষণ রাগ। আজ সব রাগ এই স্প্রে পুষ করে পুষাবো।”
বলে স্প্রে বোতলের ঢাকনা খুলে একবার ঝাকি দিল। এদিকে নিতিন হাতে প্লাইয়ার্স ঘুরিয়ে বলল,
“আমি বেকার বসে না থেকে কিছু কাজ করি। কারো নখ তুলি। হাত নিশপিশ করছে। কার তুলবো? ”
বলে মাথা চুলকাল নিতিন। তারপর বলল,
“পেয়েছি। স্বরূপার নখ তুলি। সে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর মুখ ও খুলছে না। তাই একটা নখ তুলে মুখ খোলার ব্যবস্থা করি। ” বলে বাঁকা হেসে স্বরূপার দিকে এগিয়ে গেল।

নিতিন স্বরূপার ডান হাতের অনামিকা আঙুলের নখের দিকে তাক করল প্লাইয়ার্সটা। অধরা ও স্প্রে নিয়ে তুরাগের হাতের উপর ধরল।
‘রেডি-ওয়ান, ঠু, থ্রি’ বলে নিতিন অধরা তাদের কাজ শুরু করার আগ মুহুর্তেই সমস্বরে এক জোড়া কন্ঠ বলে উঠলো,
“ওকে কিছু করবেন না। আমি বলছি। যা করার আমাকে করুন। ”

সমস্বরে বলা কথা কানে যেতেই থেমে গেল নিতিন আর অধরা। বাঁকা হাসি ফুটল দুজনের ঠোঁটেই। তারা সমস্বরে উচ্চারিত বাক্যের কথক তুরাগ আর স্বরূপার দিকে তাকাল। দুজনেই একে অপরের দিকে মাথা তাক করে মুখ খিচে চোখ বন্ধ করে আছে। দুজনের কারোরই নিজের ব্যাথা পাওয়ার দিকে খেয়াল নেই। দুজনেই অপরের ব্যাথায় ব্যাথিত। দুজনের এক কথা, যা কষ্ট দেয়ার আমাকে দিন, আমি সয়ে যাব। কিন্তু ওকে কোন কষ্ট দিবেন না আমি সইতে পারবো না।

তুরাগ চোখ মুখ খিচে বলল,
“প্লিজ! বর্ণার নখ তুলবেন না। যত কষ্ট দেয়ার আমাকে দিন। আমার হাত পায়ের সব নখ তুলে নিন, তাও ওকে কিছু করবেন না। ও ব্যাথা পাবে, আমি সইতে পারব না।”

তখনি স্বরূপা চিৎকার করে বলল,
“আমি ব্যাথা পাব না। প্লাইয়ার্স আর স্প্রে আমার হাতে করুন। তাও ওকে কিছু করবেন না। আপনাদের যা জানার জিজ্ঞেস করুন, আমি বলছি সব। কুঞ্জনকে ছেড়ে দিন। এই কেসের মেইন কালপ্রিট আমি। ওকে ছেড়ে দিন। প্লিজ!”
বলে কেঁদে দিল স্বরূপা। তার কান্নায় ব্যাথিত না হয়ে হেসে দিল অধরা আর নিতিন। তাও আবার সমস্বরে। অধরা হেসে বলল,
“যাক, কাজ হয়েছে। প্রমাণ হল এবার যে আপনাদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক আছে। তাও গভীর সম্পর্ক! সত্যটা যেহেতু সামনে এসেছে এবার বলেই ফেলুন। বাবার মৃত্যুর পর কী হলো? এবং আপনাদের পরিচয় কিভাবে হলো তা বলুন।নাহলে শাস্তি দুজনেই পাবেন।”

“কে বলবে? তুরাগ না স্বরূপা? এ টু জেড সব শুনতে চাই। কিছু বাদ গেলে দুজনের একটা নখও হাতে থাকবে না। একজন বলা শুরু করুন।”
চেয়ারে আয়েশ করে বসে প্লাইয়ার্স ঘুরাতে ঘুরাতে বলল নিতিন। প্রায় সাথে সাথেই স্বরূপা বলল,
“আমি বলছি, সব বলছি। তাও কুঞ্জনকে কিছু করবেন না। ও এমনিতেই ব্যাথায় কাতরাচ্ছে।”

“তুমি চুপ থাকো। আমি বলছি। তুমি সব জানো না। উল্টাপাল্টা কী না কী বলে আবার শাস্তি পাবে। তারচেয়ে বরং আমি বলি সবটা। আমি ফিট আছি একদম।”

ধমকে বলল তুরাগ। দুজনের ভালোবাসা দেখে নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে ভ্রু নাচাল নিতিন। তারপর সচেতন চোখে তাকিয়ে বলল,
” আপনাদের নাটকীয়তা শেষ হলে বলা শুরু করুন। তুরাগ, আপনি বলুন। স্বরূপার ক্লাস পরে নিচ্ছি।”

তুরাগ বলা শুরু করলো।

চলবে…

এই পর্বটা প্রায় ৫,০০০শব্দের পর্বের ছিল। এক পর্বে দেয়া সম্ভব নয়। তাই দুই পর্ব করতে হলো। বাকি অংশ শীঘ্রই দেয়া হবে।
গত পর্বে আপনাদের রেসপন্স আমাকে হতাশ করেছে। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকুন। গল্পের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ টুকু ধৈর্য্য ধরে পড়ুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here