#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-৩
অধরার কথায় বোরহানের চেহারায় ভয়ের মাত্রা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। ভীত ঢোক গিললেন তিনি। উত্তর না দিয়ে কাচুমাচু করতে দেখে অধরা একটা ধমক দিলো,
“চুপ করে আছেন কেনো? চুপ করে থাকলে কিন্তু নিস্তার পাবেন না। তাই তাড়াতাড়ি সত্যটা স্বীকার করুন।”
“ব্বিশশাসস কক্কোররুন ম্মেম্মেড্ডাম আয়াম্মি কক্কিচচ্ছু ক্কররিননি।”
ভীত কন্ঠে তোতলিয়ে বললেন বোরহান। অধরা বলল,
“কিছু না করলে এমন তোতলাচ্ছেন কেনো!”
“ভভয়ে।”
“ভয় পায় দোষীরা। নির্দোষীরা তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। তবে কি আমি ধরে নিবো আপনি দোষী?”ভ্রু কুঁচকে বলল অধরা।
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য হলেও ভয় কাটাতে হবে, এই ভাবনা থেকে ভয় খানিকটা কাটিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বোরহান বলে উঠলেন,
“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি কিছু করিনি। আমি নির্দোষ। ”
এ পর্যায়ে অধরা ধমকে উঠল,
“সত্যটা আপনি বলবেন না কি আমি থানায় নিয়ে যাবো। থানায় নিলে কী পরিস্থিতি আপনার অনুকূলে থাকবে না। ভালোয় ভালোয় সত্যটা স্বীকার করুন। কাল রাতে কে এসেছিলো লাশ নিয়ে? তখন আপনি কী করছিলেন?”
“কাল রাতে বাইরের কেউ আসেনি ম্যাডাম?”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করে উত্তর দিলেন বোরহান। অধরা প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল,
“ভিতরের কেউ এসেছিলো?”
“না, ম্যাডাম। কাল রাত বারোটার পর থেকে ভোর অবধি কারো আসা যাওয়া ছিলো না।”
“কারো যাওয়া আসা না থাকলে লাশ কি হেটে হেটে তুরাগের ফ্ল্যাটের সামনে এসে গেছে?”
বোরহান নিরুত্তর। অধরা রাশভারি গলায় বলল,
“আপনি কি ভালোয় ভালোয় সত্যটা স্বীকার করবেন না কি আমি অন্য উপায় বেছে নিবো?”
বোরহান এবার ঘাবড়ে গেলো। কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন,
“আমি কিছু করিনি, আমি নির্দোষ। ”
অধরা বাঁকা হেসে বলল,
“চোর চুরি করে কখনো বলে, আমি চুরি করেছি? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা না করে বলুন, খুন কিভাবে হলো আর লাশ কে নিয়ে এসেছে?”
“আমি জানি না।”
বোরহানের ভীত স্বরে দৃঢ়তার আভা। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল অধরা। প্রশ্ন করল,
“কাল সারারাত আপনি কোথায় ছিলেন?”
“গেটের কাছেই ছিলাম।”
“ঘুমিয়ে ছিলেন?”
“না, জেগেই ছিলাম। কিন্তু আমি খুনের টের পাইনি।”
” আপনি গেটের কাছে জাগ্রত অবস্থায় সারারাত পাহারা দিয়েছেন, অথচ রাতে কেউ বাইরে থেকে লাশ নিয়ে এসে এক ফ্ল্যাটের সামনে রেখে গেলো, আপনি বলছেন, আপনি টের অবধি পাননি। ব্যাপারটা কেমন হাস্যকর শুনাচ্ছে না? মজা করেন আমাদের সাথে?” গর্জে উঠল অধরা।
অধরার গর্জনে দারোয়ান কেঁপে উঠলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন,
“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি সারারাত গেটের কাছেই ছিলাম। শুধু মাঝে একবার ছাদে গিয়েছিলাম। এ ছাড়া পুরো রাত আমি গেটের কাছেই ছিলাম। কিন্তু কাউকেই বাইরে থেকে আসতে দেখিনি কিংবা কেউ ভিতর থেকে বের হয় নি। ”
অধরা এবার সন্দেহী কন্ঠে বললো,
“কখন গিয়েছিলেন ছাদে, আর কেনো গিয়েছিলেন?”
” চারটার দিকে। পাঁচ তলার ভাড়াটে ছেলেটা মানে অভি ফোন দিয়ে বলেছিলো পানির সমস্যা। লাইন চেক করতে। তাই গিয়েছিলাম। আমি লাইন চেক করে দিয়েই চলে এসেছি। এর বাইরে আমি আর কিছুই করিনি।”
দারোয়ানের করুণ কন্ঠে বলা কথা শুনে জিহাদ আর আদাবর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। অধরার দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে জানতো যে দারোয়ান কোন দোষ করেনি। এসবে অন্য কারো হাত আছে। কারণ এত পরিকল্পনা করে খুন করা দারোয়ানের পক্ষে সম্ভব না। তাও দারোয়ানকে ভয় দেখিয়েছে যাতে দারোয়ানের কিছু জানা থাকলে বলে দেয়। অধরা নড়েচড়ে বসলো। তারপর সন্দিহান মুখে বলল,
” আপনি গিয়ে কী দেখলেন? পানির লাইনে কোন সমস্যা ছিলো? আর সেখানে কলদাতা ছিলো?”
” আমি গিয়ে দেখলাম পানির লাইন সব বন্ধ করা। তা দেখে আমি সব চালু করেছিলাম। আমি অভিকে দেখিনি।”
রহস্যবোনা জালের ঘনত্ব যেন বেড়ে গেল। চোখে মুখে কৌতুহলের আভা টেনে অধরা জিজ্ঞেস করল,
” ছাদ থেকে নিচে নামার সময় আপনি তুরাগদের বাসার সামনে কোন বক্স দেখেছেন?”
“না। ”
” আপনি ছাদ থেকে নেমে সোজা গেটে গিয়েছেন? ”
“আমি ছাদ থেকে নেমে আমার রুমে গিয়েছিলাম। তারপর গেটের কাছে গিয়েছি। ”
“কেনো!”
অধরার তড়িৎ প্রশ্নে দারোয়ান কাচুমাচু শুরু করলেন। অধরা ভ্রু কুঁচকে বললো,
” কেনো গিয়েছিলেন?”
“ইয়ে মানে বেশ ছাপ পেয়েছিলো। ”
দারোয়ানের কথা আর কাচুমাচু দেখে বুঝতে পেরে জিহাদ বলল,
“টয়লেটে গিয়েছিলেন?”
লজ্জিত চেহারা নিয়ে মাথা নাড়লেন বোরহান। অধরা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
” ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যখন গেটের কাছে গেলেন তখন কি গেইট খোলা ছিলো?”
“না, আগের মতোই বন্ধ ছিলো।”
তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না অধরা। কপালে হাত চেপে কিছু একটা ভাবল। তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” পাঁচতলার অভি কী করে? মানুষ কেমন?”
” কী করে জানি না, তবে প্রতিদিন সকালে সিগারেট খেতে খেতে বের হয় রাতে সিগারেট খেতে খেতে বাসায় ফিরে। আসা যাওয়ার পথে কখনো আমার সাথে কোন কথা বলেনি। গম্ভীর মানুষ।”
“অভির সাথে প্রতিভা বা তুরাগকে কথা বলতে দেখেছেন কখনো?”
দারোয়ান ভেবে বললেন,
“অভির সাথে প্রতিভা ম্যাডামকে তর্কাতর্কি করতে দেখেছি একবার।”
বোরহানের কথা অধরা চমকে গেলো । তারপর বললো,
“কবে!”
“এই মাসখানেক আগে। একদিন দুজনে সকালে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে তর্কাতর্কি করেছে। খানিক পরে দুইদিকে চলে গেছে। ”
“কী নিয়ে ঝগড়া করছিলো, শুনেছেন কিছু?”
“পুরোপুরি শুনিনি। শুধু এইটুকু শুনেছি প্রতিভা ম্যাডাম বলছিল, ‘দোহাই লাগে আমার জীবনটা শেষ করবেন না! আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন’!”
শিকারের নাগাল পেলে শিকারীর চোখ যেমন চকচক করে উঠে, দারোয়ানের কথায় অধরার চোখ ও তেমনি ঝলঝল করে উঠল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করল,
“পুরো নাম কী ছেলেটার? ”
“পুরো নাম জানি না, শুরু জানি ‘অভিলাষ’ নাম তার।”
“হিন্দু?”
“নাহ,মুসলিম। ”
” একা থাকে?”
“নাহ,মা বাবার সাথে থাকে।”
” আর কখনো অভিলাষকে প্রতিভার সাথে দেখেছেন?”
“না, ম্যাডাম।”
“আচ্ছা যান আপনি। সন্দেহের কিছু দেখলে আমাদের জানাবেন। ঠিক আছে?”
“জ্বি ম্যাডাম।” সায় জানিয়ে বিদায় নিল বোরহান।
দারোয়ান চলে যেতেই অধরা বললো,
” পানির পাইপ বন্ধ থাকা, দারোয়ানকে কল করা এবং ছাদে যাওয়া সবটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। অভিলাষ দারোয়ানকে বাহানা দিয়ে ছাদে নেয়। দারোয়ান গেট ছেড়ে ছাদে যেতেই গেইটের আশেপাশে লাশ নিয়ে প্রস্তুত থাকা কেউ একজন বা দু’জন গেইট খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। লাশ ভরতি ব্যাগ বিল্ডিংয়ের ভিতরে কোন এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। দারোয়ান যখন ছাদ থেকে নিচে নামে, তখন অভিলাষ অগত ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিদ্বয়ের রেখে যাওয়া বক্স তুরাগের ফ্ল্যাটের সামনে রেখে কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ফুটেজ ডিলিট করে নিজ বাসায় চলে যায়। আমি যদি ভুল না হই, এমনটাই হয়েছে। তবে, এখানে আরো রহস্য আছে। এখন কোন পদক্ষেপ নিলে মূল রাঘব বোয়ালকে ধরা যাবে না। তাই প্রমাণসহ এগুতে হবে। ”
আনমনে কথাগুলো বলে থামল। তারপর জিহাদকে আদেশের সুরে বলল,
“জিহাদ, অভিলাষের মানচিত্র বের করো।”
“আচ্ছা, ম্যাডাম।”
” এই মামলার মতো এত জটিল মামলা আমি কখনো দেখিনি। সকালে একজনকে খুনী মনে হয়, বিকেলে মনে হয় সে নির্দোষ, অন্যকাউকে খুনী মনে হয়। রাতে তাকে নির্দোষ মনে হয়,আরেকজনকে খুনী মনে হয়। মূল খুনী কে সেটাই ধোঁয়াশা। ”
বিরক্তিঘন স্বরে বলল আদাবর। অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদাবরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি আমার সাথে আসুন। তুরাগের বাসা আরেকবার তল্লাশি করে দেখি, কিছু পাই কি না।
“জ্বি ম্যাডাম।”
*
অধরা এবং আদাবর ভুঁইয়া বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি দরজার দিকে। দরজায় নেমপ্লেট টানানো। যাতে লেখা,
‘Turag Ahmed
&
Protiva Mirza’
দরজায় চোখ বুলিয়ে আদাবর ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল। অধরা দুই হাত প্যান্টের পকেটে রেখে চমৎকার ভঙ্গিতে হেটে ভেতরে প্রবেশ করল। চারদিক চোখ বুলিয়ে আদাবর থেকে গ্লাভস নিয়ে হাতে পরে নিল।
ড্রয়িং,ডাইনিং,এক্সট্রা তিনটা বেড, কিচেনের সমন্বয়ে বিশাল ফ্ল্যাট। তুরাগ প্রতিভার শোবার ঘর বাদে বাকিসব রুম তল্লাশি করে তেমন কিছু ফেলো না সে। সব শেষে তুরাগ প্রতিভার শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল অধরা। শোবার ঘরে যেতে যেতে ডাঃ লিপিকাকে কল দিলো।
কথা বলার ফাঁকে ভ্রুণের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই লিপিকা জানালো প্রতিভার গর্ভে বেড়ে উঠা ভ্রুণের সাথে তুরাগের ডি এন এ ম্যাচ করেছে। অর্থ্যাৎ বাচ্চাটা তুরাগের। দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হওয়ায় খানিক স্বস্তি ফেল অধরা।
ফোন রেখে অধরা আবার তার কাজে মন দিল।চারদিক চোখ বুলাতে গিয়ে শোবার ঘরের দেয়ালে অধরার চোখ আটকালো। রুমের চার দেয়াল জুড়ে আছে চারটা বড় বড় ফটোফ্রেম। তুরাগ- প্রতিভা দম্পতির আনন্দময় কিছু মুহুর্ত ফ্রেমে বাধানো হয়েছে। প্রতিটা ছবিতেই দুজনকে অতি সুখী দেখাচ্ছে। প্রাণখুলে হাসছে দুজন। দেখলেই প্রাণ জুড়ে আসে। এক দেখাতেই মন্তব্য করা যায়, খুব সুন্দর আর সুখী একটা জুটি। পুরো রুমটা যেন ভালোবাসায় বাধানো। রুমের প্রতিটা কোণা অতি যত্নের সাথে কেউ সাজিয়েছে।
রুমের এক কোণে জানালার পাশে দেয়ালে একটা বোর্ড ঝুলানো। তাতে হরেক রঙের শ’খানেক ছোট ছোট চিরকুট আটকানো। বোর্ডের মাঝে বর্ডার দেয়া। একপাশে শিরোনামের মত করে প্রতিভার নাম লেখা,অন্যপাশে তুরাগের নাম লেখা। প্রতিভার নামের নিচে সবকটা চিরকুট তুরাগকে উদ্দেশ্য করে লেখা,যা প্রতিভা লিখেছে। আর তুরাগের নামের নিচে থাকা সবকটা চিরকুট প্রতিভাকে উদ্দেশ্য করে লেখা,যা তুরাগ লিখেছে। প্রতিভা তুরাগ একজনের প্রতি অন্যজনের নিত্যকার অনুভুতি প্রকাশ করেছে চিরকুটে। বুঝাই যাচ্ছে এরা চিরকুট আদান প্রধান করতো সবসময়। অধরা মনোযোগ দিয়ে সবগুলো চিরকুট পড়ল। প্রতিটা চিরকুট ভালোবাসায় গাঁথা। একের অনুপস্থিতিতে অন্যজনে চিরকুট লিখেছে। চিরকুট আদান-প্রদানের ব্যাপারটা অধরার বেশ লাগলো। একটা কথা স্পষ্ট যে এদের মাঝে ভাবটা বেশ ছিল।
আরো খানিকক্ষণ পুরো রুম তল্লাশী করলো। একটা নীল মলাটের ডায়েরি ছাড়া আর তেমন কিছুই পেলো না। অধরা ডায়েরিটা সাথে নিলো। যদি এর থেকে কিছু জানা যায়!
*
পরদিন তুরাগ,স্বরূপা,প্রভাত মির্জা,তিহানা জাহানকে থানায় ডাকা হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তুরাগের জবানবন্দি অতিব জুরুরি বিধায় খানিক অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তাকে থানায় ডাকা হয়েছে। অধরা আলাদা আলাদা ভাবে সবার জবানবন্দি নিলো। যাতে কোন গুপ্তরহস্য থাকলে বেরিয়ে আসে। স্বরূপা, প্রভাত মির্জা আর শিলার জবানবন্দিতে তেমন কোন সূত্র পাওয়া যায় নি। তিনজনই প্রতিভা-তুরাগের ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করেছে। নেতিবাচক কোন কিছু তাদের চোখে পড়েনি বিধায় তারা বলেনি। তবে তুরাগ ও তিহানা জাহানের জবানবন্দিতে বেশ কিছু সত্য বেরিয়ে এসেছে। যা সত্যিই বিস্ময়কর। অধরা যখন প্রতিভার প্রেগন্যান্সির কথা তিহানা জাহানকে জিজ্ঞেস করে তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলেন,
” আমি প্রতিভার প্রেগন্যান্সির কথা জানতাম। ”
“কবে জানলেন ?”
” দেড়মাস আগে। টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট হাতে পেয়ে প্রতিভা আমাকে বলেছিলো। ”
“তুরাগ জানতো?”
“না।”
“কেনো!”
“প্রতিভা তুরাগকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো তাই জানায়নি। প্রতিভা চেয়েছিলো তুরাগের জন্মদিনে তাকে সন্তানের আসার সংবাদ দিয়ে সারপ্রাইজ দিবে। সেই সাথে সবাইকে জানাবে। এমন পরিকল্পনা থেকেই প্রতিভা তার প্রেগন্যান্সির কথা শুধু আমাকেই বলেছে আর কাউকে বলেনি।”
প্রেগন্যান্সির রহস্যটা উদঘাটন হওয়ায় অধরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারমানে প্রতিভা তুরাগ না জানানোর কারণ এটাই! যাক একটা ধোঁয়াশা কেটে গেল। অধরা এবার বলল,
” তুরাগের জন্মদিনে প্রতিভার কী পপরিকল্পনা ছিলো?”
“পরিকল্পনা ছিলো, প্রতিভা নিজ হাতে কেক বানিয়ে ঘর সাজিয়ে রাত বারোটা এক মিনিটে তুরাগকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে, সেই সাথে উপহার হিসেবে নতুন অতিথি আগমনের বার্তা দিবে।”
অধরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কিন্তু তুরাগের জন্মদিনের আগের দিন তো প্রতিভার বাবার বাসায় থাকার কথা ছিলো।”
মধ্যবয়সী ফর্সা দেহী তিহানা জাহান দৃঢ়তার সাথে বললেন,
” এমন কোন কথাই ছিলো না। প্রতিভা আমাদের বাসায় গিয়ে তার বাবাকে দেখে চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। প্রতিভা খুব তাড়ায় ছিলো বাসায় ফিরে তুরাগকে সারপ্রাইজ দিবে, সব রেড়ি করতে হবে। আমাদের জোরাজোরিতে ডিনার করলো। ডিনার করে সাথে সাথে বেরিয়ে পড়েছে।”
“যাবার সময় কিছু বলেছিলো? ”
“বলেছিলো সোজা বাসায় যাবে তারপর তুরাগকে সারপ্রাইজ দিবে। কেক কাটার সময় যেন আমরা ভিডিও কলে থাকি। ”
“আচ্ছা, প্রতিভার সাথে কারো কোন শত্রুতা ছিলো? বা প্রতিভাকে কেউ বিরক্ত করতো? কোন ছেলে?”
“কয়েকটা ছেলে প্রতিভাকে বিয়ের আগে খুব বিরক্ত করতো। বিয়ের প্রস্তাব ও পাঠিয়েছিলো দুই একজন। কিন্তু প্রতিভার আপত্তি জেনে কারো প্রস্তাব গ্রহণ করিনি আমরা। প্রতিভার পছন্দ অনুযায়ী তুরাগের সাথেই বিয়ে দিয়েছি। ”
“কারা বিরক্ত করতো? নাম বলুন।”
তিহানা জাহান তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। পরনে তার এলোমেলো করে পরা হলদেটে শাড়ি। শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে সরে গিয়েছে। আঁচল কাধে জড়াতে জড়াতে ভাবনায় মত্ত হলেন। মিনিট খানেক ভেবে বললেন,
” সাজিদ, মাহির, কিরণ আর অভিলাষ এই চারজন বিরক্ত করতো। তারমধ্যে অভিলাষের বিরক্তির মাত্রা বেশি ছিলো। ”
‘অভিলাষ’ নামটা শুনে অধরা চমকে উঠলো। স্প্রিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা ছিল সে। অভিলাষের নাম শুনে তড়িৎ সোজা হয়ে বসে বলল,
“অভিলাষ কে? বিস্তারিত বলুন।”
” অভিলাষ আর প্রতিভা একই স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছে। অভিলাষ প্রতিভার কয়েক ব্যাচ সিনিয়র ছিলো। স্কুল জীবন থেকে প্রতিভাকে পছন্দ করতো অভিলাষ। ছেলেটা অনেকটা উগ্র আর বখাটে ধরনের ছিলো বিধায় প্রতিভা অভিলাষকে পছন্দ করতো না। সবসময় এড়িয়ে যেতো। বেশ কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বিয়ের আগ অবধি অভিলাষ প্রতিভাকে বিরক্ত করতো। নেশা করে বাসায় এসে হাঙামা করতো। বাসায় গিফট পাঠাতো। প্রতিভাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করার হুমকি দিতো। এসবের জন্য বছরখানেক আগে অভিলাষকে জেলেও দিয়েছি আমরা। চারমাস জেলে ছিলো। জেলে থাকাকালীন সময়েই তুরাগ প্রতিভার বিয়ে হয়ে যায়। ”
” জেল থেকে বের হয়ে অভিলাষ যখন শুনলো প্রতিভার বিয়ে হয়ে গেছে তখন ঝামেলা করেনি?”
“না। জেল থেকে বের হয়ে অভিলাষ আর কখনো প্রতিভাকে কোন প্রকার বিরক্ত করেনি।।”
“অভিলাষ যে প্রতিভাদের বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় থাকে তা আপনি জানেন না?”
সন্দেহী কন্ঠে বললো অধরা। অধরার কথায় তিহানা জাহান স্বভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“জানি। ”
“একি বিল্ডিংয়ে থাকার সুবাধে তাদের তো দেখা হওয়ার কথা। চোখের সামনে পেয়েও প্রতিভার কোন ক্ষতি করেনি?”
“আমার জানামতে করেনি। প্রতিভা আমাকে তেমন কিছুই বলেনি। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রতিবারই বলেছে অভিলাষ শোধরে গেছে, এখন তাকে আর বিরক্ত করে না। নিজের মত থাকে।”
“প্রতিভা নিজের দুঃখ কষ্টের কথা কার সাথে শেয়ার করতো?”
” প্রতিভা নিজের সুখের কথা সবার সাথে শেয়ার করলেও দুঃখ কষ্টের কথা কখনো কারো সাথে শেয়ার করতো না। আমি, তুরাগ কিংবা স্বরূপার সাথেও না। তবে সব কথা ডায়েরিতে লিখতো।”
” প্রতিভার ডায়েরিটা কোথায় এখন?”
” তুরাগের ফ্ল্যাটে আছে।”
“আচ্ছা আপনি এখন আসুন। পরে ডাকলে আবার আসবেন।”
“আচ্ছা।”
বলে তিহানা জাহান উঠে চলে গেলেন বাইরে। অধরা আনমনে বললো,
‘তুরাগকে বার্থডে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে প্রতিভা নিজেই লাশ হয়ে সবাইকে সারপ্রাইজ করলো। সারপ্রাইজের উপর সারপ্রাইজ! তাও এতটা রহস্যময়। সত্যিই এটা রহস্যময় সারপ্রাইজ। এক সারপ্রাইজের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে আরেক রহস্য তৈরি হচ্ছে।
তিহানা জাহানের পর ডাকা হলো তুরাগকে।
*
“মি.তুরাগ আপনি কি জানেন আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট ছিলো?”
হুইলচেয়ারে বসা শুভ্র বর্ণের সুদর্শন যুবকের উদ্দেশ্যে প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়লো অধরা। অধরার কথায় অধরার বিপরীত পাশে হুইলচেয়ারে বসা সুদর্শন যুবকের চেহারার রঙ পালটে গেলো। বিমর্ষ চেহারায় একরাশ বিস্ময় উঁকি দিলো। যেন সে কোন চমকপ্রদ তথ্য জেনেছে। যা সে ইতিপূর্বে জানতো না।
তুরাগের কানে শুধু ‘আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট’কথাটাই গিয়েছে। তিনটা শব্দই তুরাগের কানে বাজছে বারবার। এই তিনটা শব্দই তুরাগকে মুহুর্তের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখী মুহুর্তে নিয়ে গেলো। এই তিনটা শব্দ তুরাগকে ভুলিয়ে দিলো যে তার স্ত্রী এখন মৃত। সে তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। এই তিনটা শব্দই তুরাগকে সেকেন্ডের জন্য বধির করে দিলো। তাই তো সে অধরার বলা বাক্যের শেষ ‘ছিলো’ শব্দটা শুনতে পায় নি। তুরাগের চোখে মুখে একমুঠো সুখ উঁকি দিলো। আনন্দে চোখ চিকচিক করছে। চোখের সামনে নানান দৃশ্য ভেসে উঠছে। দৃশ্যের পালাবদলে চোখের সামনে ছোট্ট একটা রাজকন্যার অবয়ব ভেসে উঠতেই ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে দেখে দিলো। নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বললো,
“আমার প্রিন্সেস আসছে? আমার প্রিন্সেস! আমি বাবা হবো! ”
প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদটা অধিকতর সুন্দর আর প্রশান্তিকর হয়। সংবাদটায় জুড়ে থাকে একরাশ স্বস্তি,আনন্দ আর সুখ। তুরাগের বিমর্ষ চেহারার মাঝে উঁকি দেয়া আনন্দটা যেন তার বিমর্ষতা দূর করে দিয়েছে। বিমর্ষতার বিনিময়ে একমুঠো সুখ উপহার দিয়েছে যেন।
অধরা তুরাগের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তুরাগের এত খুশির কারণ। এখন তুরাগের চেহারা দেখলে যে কেউ বলবে এই মুহুর্তে তুরাগ খুব সুখীবোধ করছে। অনাগত সন্তানের কথা শুনে তুরাগের কষ্ট দিগুন হওয়ার কথা। কারণ সে স্ত্রীর সাথে সন্তানকেও হারিয়েছে। তবে কষ্টের সময়টায় তুরাগ খুশি হচ্ছে কেনো! অধরা ভ্রু কুঁচকে উচ্চকন্ঠে বলল,
” প্রতিভার মৃত্যুর আগে আপনি প্রতিভার কনসিভ করার কথা জানতেন?”
“মৃত্যু” শব্দটা বজ্রপাতের মতো ভয়ংকর শব্দে তুরাগের কানে বাজলো। তুরাগের বধিরতা কাটার জন্য এই একটা শব্দই যথেষ্ট ছিলো। তুরাগের স্তব্ধতা, উৎফুল্লতা, সুখী অনুভূতির তাঁরটা যেন মুহুর্তেই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। খানিক আগে ঘুরে বেড়ানো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর মুহুর্ত থেকে টেনে হিঁচড়ে বাস্তবতার কাটাযুক্ত পথে নামিয়ে দিলো তুরাগকে। মনে করিয়ে দিলো মৃত্যু’নামক কঠিন,নির্মম এবং ভয়ংকর শব্দটা তার কাছে থেকে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। গ্রাস করেছে তার অনাগত সন্তানকেও। বাবা হওয়ার খবর জানার আগেই তার সন্তান পরপারে চলে গেছে। সন্তান আগমনের খবরটা খানিক আগে তাকে যতটা সুখ উপহার দিয়েছিলো এখন তার চেয়ে দশগুন বেশি কষ্ট উপহার দিচ্ছে। ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। স্ত্রী সন্তান হারানোর কষ্টটা ভয়ংকর ভাবে ঘিরে ধরেছে তুরাগকে। কেনো হলো এমনটা! ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে সে সুখীই তো ছিলো। তার সুখকে দিগুন করতে তার সন্তান আসছিলো কিন্তু তার দিগুন সুখী হওয়া হলো না। দিগুন তো দূরে থাকে ভাগের খানিক সুখটাও চলে গেলো। প্রতি কেনো হলো এমনটা? কে আমার সুখকে কেড়ে নিলো বলো! কার এত বড় ক্ষতি করেছি আমি? অসহনীয় কষ্টের ভীড়ে তুরাগের গলা পাকিয়ে কান্নার ধলা বেরিয়ে এলো। সে শব্দ করে কেঁদে দিলো। কান্নামাখনো গলায় বললো,
“কেনো হলো এমনটা? বাবা হওয়ার কথা জানার আগেই নিঃস্ব হলাম। একেবারে নিঃস্ব হলাম আমি। প্রতি, আমাকে জানালে না কেনো! একটা সন্তানের জন্য দুজনে কত মুখিয়ে ছিলাম তবে আমাকে না জানিয়ে নিজেই সন্তানকে নিয়ে পরপারে চলে গেলে কেনো? আমি কী নিয়ে বাঁচবো বলো? আমার কষ্টটা যে দিগুন হয়ে গেলো।”
বলে কাঁদতে লেগে গেলো তুরাগ। ‘প্রতি’ শব্দটা ‘প্রতিভা’ নামের অংশবিশেষ। যা ভালোবাসা প্রকাশ পূর্বক ব্যবহৃত হয়েছে। তুরাগ নিজ স্ত্রীকে ভালোবেসে ‘প্রতি’ বলে ডাকতো। এমনটা আন্দাজ করছে অধরা। সে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তুরাগের হাবভাব লক্ষ্য করছে। এতক্ষণে অধরা তুরাগের হাসি কান্নার অর্থ খুঁজে ফেলো। তারমানে তুরাগ সত্যিই স্ত্রীর প্রেগন্যান্সির কথা জানতো না। তার আন্দাজ এবং তিহানা জাহানের কথা ঠিক হলো।প্রতিভা কাউকে জানায় নি। তুরাগের কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে সন্তানের আগমনের জন্য দুজনেই অপেক্ষায় ছিলো। অধরা তুরাগকে এই খুশির খবরটা এমনি এমনি দিতে চায় নি বলেই তুরাগের জন্মদিন অবধি অপেক্ষা করেছিলো হয়তো। তুরাগের জন্য খারাপ লাগলো অধরার।ভালোবাসার মানুষের বিচ্ছিনতার কষ্ট সত্যিই অসহনীয়। অধরা শান্ত কন্ঠে বললো,
“শান্ত হোন। মৃত্যু অবধারিত। সবাইকে একদিন না একদিন এর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। কান্নাকাটিতে কোন কিছুর সমাধান হবে না। কষ্ট থেকেই যাবে। আপনাকে যারা নিঃস্ব করেছে তারা শাস্তি ফেলে আপনার কষ্ট কিছুটা লাঘব পাবে। তাই আমাদের সাহায্য করুন। আমরা খুনীদের পাকড়াও করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিবো। আপনি শান্ত হন। ঠান্ডা মাথায় বলুন, মূলত সেদিন রাতে কী হয়েছিলো?”
মিনিট তিনেক সময় নিয়ে তুরাগ নিজেকে শান্ত করলো। কষ্ট গুলোকে চোখের পানিতে না ঝরিয়ে সবগুলো এক করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসে গেলে দিলেন। কষ্ট ঝরানোর নিরব উপায় হয়তো এটাই। নিজেকে শান্ত করে মাথা নিচু করে তুরাগ বলা আরম্ভ করল,
“সারাদিন নিত্যকার রুটিনেই কেটেছিলো। প্রতিভা তার দিনের বেশির ভাগ সময় আমার সেবায় ব্যয় করেছিলো। আমার খাওয়া,গোসল সব সে তার নিজ হাতে করাতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সব ঠিকঠাক ছিলো। সন্ধ্যায় প্রতিভা রান্নাঘরে ছিলো। গোপন কোন রেসিপি করবে বললো। আমি জিজ্ঞেস করলে আমাকেও জানায় নি। শিলাকে ও ড্রয়িংরুমে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আমি শোবার ঘরে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ প্রতিভা রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে রেডি হতে লাগলো। আমি কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে জানালো,বাবার বাসায় যাচ্ছে,বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় নিয়ে এসেছে বিধায় বাবাকে দেখতে যাচ্ছে। এক্সিডেন্টের কথা শুনে আমিও যাবো বললাম। কিন্তু ও আমার অসুস্থতার কথা ভেবে আমাকে সাথে নিতে রাজি হলো না। একা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। আমি অনুরোধ করলাম একা না যেতে। আমাকে না নিলে অন্তত শিলাকে নিয়ে যেতে।
কিন্তু ও বলল,
‘শিলাকে নিয়ে গেলে তোমার খেয়াল কে রাখবে? তুমি যদি পড়ে টড়ে যাও তবে? আমি তোমাকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না। শিলা থাকুক তোমার কাছে। তোমার আবার কখন কী লাগে। আর আমি সুস্থ সবল মানুষ, একা চলে যেতে পারব। বাবাইকে দেখেই ডিনারের আগে ফিরে আসবো।তুমি চিন্তা করো না।’
তবুও আমি কোনভাবেই ওকে একা ছাড়ছিলাম না। মূলত আমার মনে কু ডাকছিলো। আমার কথা রাখতে এক পার্যায়ে প্রতিভা বলল, ‘আমার একা গেলেই সমস্যা তো? তবে আমি একা যাবো না রক্সিকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। আর গাড়িতে যাবো গাড়িতে আসবো। খানিক পর পর তোমাকে আর শিলাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিবো। তাও টেনশন করো না। দুই ঘন্টারই তো ব্যাপার। এখন বাজে সাতটা দুই। আমি রক্সিকে নিয়ে সাড়ে ন’টার আগে ফিরবো। খুশি?’
আমার মন তখনো আনচান করছিলো। কিন্তু প্রতিভাকে আটকানোর উপায় ও ছিলো না। অনুমতি দিলাম। অগত্যা সে রক্সিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। গাড়ির স্টার্ট না হওয়ায় লোকাল গাড়িতেই চলে গেলো। যা আমাকে পরে জানিয়েছে। ”
“রক্সি কে!”
তুরাগের কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বললো অধরা।
তুরাগ উত্তর দিল,
“রক্সি একটা বিড়াল। প্রতির খুব পছন্দের বিড়াল ছিলো । মানুষের মতো কথা না বলতে পারলে ও সব বুঝতো। রক্সি প্রতির কাছে নিজের বাচ্চার মতো ছিলো। খুব আদর করতো। যেখানে যেতো রক্সিকে নিয়ে যেতো। বিয়ের আগে রক্সি ওর সাথে বাবার বাসায় থাকতো বিয়ের পর প্রতির সাথে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসে। তারপর থেকে আমাদের সাথেই থাকতো।”
“রক্সি এখন কোথায়? প্রতিভার লাশের সাথে কি তাকে পেয়েছিলেন? ”
“রক্সি নিখোঁজ। প্রতির সাথে বাবার বাসায় গিয়ে ফেরার পথে প্রতির সাথেই নিখোঁজ হয়েছে। তারপর আর সন্ধান পাওয়া যায় নি।”
“আচ্ছা। আপনাদের দাম্পত্যজীবন কেমন ছিলো? কোন ঝগড়া বিবাদ ছিলো?”
“আমার আর প্রতির দুই বছরের সম্পর্ক ছিলো। দু’বছরের সম্পর্কের পর সাত মাস আগে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। এই দুই বছর সাত মাসে আমাদের মাঝে কখনো মান অভিমান ও জায়গা পায়নি। সেখানে ঝগড়া ত অনেক দূরের কথা। আমরা খুব সুখে ছিলাম। আমাদের সম্পর্কটা পরশু অবধি তেমনি ভালোবাসার ছিলো যেমনটা সম্পর্কের প্রথম দিকে ছিলো। কিন্তু কারো আমাদের সুখ সহ্য হলো না। সব কেড়ে নিলো। আমি হারালাম আমার সুখ, আমার ভালোবাসাকে। ”
তুরাগের গলা ধরে এলো। অধরা বলল,
“আচ্ছা, আপনার বা প্রতিভার কোন শত্রু ছিলো? কারো সাথে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিলো? স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য আপনার কেউ কে সন্দেহ হয়?”
একটা ঢোক গিলে ধরা গলাটাকে স্বাভাবিক করলো তুরাগ। তারপর বললো,
” প্রতিভা বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলো। ঝগড়া ঝাটি পছন্দ করতো না। কাউকে পছন্দ না হলে এড়িয়ে যেতো কিন্তু ঝগড়া করতো না। আমার জানামতে প্রতিভার তেমন কোন শত্রু নেই। আমারো নেই কোন শত্রু।”
অধরা সুযোগ বুঝে চট করে প্রশ্ন করলো,
” আচ্ছা, পাঁচতলার অভিলাষকে আপনি চিনেন?”
অভিলাষেরর কথা শুনতেই তুরাগের চেহারায় কাঠিন্যতা দেখা দিলো। অধরা পরখ করলো সেটা। সে বললো,
“চিনেন তাকে?”
“জ্বি।”
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো তুরাগ। অধরা বললো,
“কিভাবে?”
” আমার প্রতিবেশি হিসেবে চিনি। আর..
“আর?”
“ইভ-টিজার হিসেবে। অভিলাষ প্রতিভাকে উত্যক্ত করতো বিয়ের আগে। ”
“বিয়ের পর করতো?”
“নাহ। জেল থেকে ফিরে আর বিরক্ত করেনি কখনো। ততদিনে আমাদের বিয়ে ও হয়ে গিয়েছিলো। তখন আর কিই বা করার ছিলো। ”
” অভিলাষের সাথে আপনার কখনো কথা বা ঝগড়া হয়েছে?”
“নাহ।”
“আপনি এখন আসুন।”
তুরাগ যাওয়ার পর অধরা মনে মনে বললো,
“আমি যদি ভুল না হই তবে বিয়ের পর ও অভিলাষ প্রতিভাকে বিরক্ত করতো। এত সহজে প্রতিভাকে ছাড়ার কথা না অভিলাষের। অভিলাষের অত্যাচারের কথা প্রতিভা কাউকেই বলতো না। অভিলাষের জেলে যাবার জন্য অভিলাষ প্রতিভাকে কোন না কোন ভাবে শাস্তি দিচ্ছিলো। যা প্রতিভা নিজের মাঝে চেপে রেখেছে। হতে পারে প্রতিভার কনসিভ করার কথা কোন ভাবে অভিলাষ জেনে গেছে। এতে ভীষন ক্ষেপে গিয়েছে। তাই প্রতিভাকে খুন করেছে। সব কথা জানা যাবে এই অভলাষকে পাকড়াও করলে। অধরা জিহাদকে বললো,
“এই অভিলাষকে থানায় নিয়ে আসো। ডান্ডার বাড়ি পড়লে সব স্বীকার করবে। ”
“জ্বি ম্যাডাম।” বলে যেতে নিলেই অধরার ফোন বেজে উঠলো। কল রিসিভ করার পর অপাশ থেকে শোনা গেলো,
“ম্যাডাম অভিলাষ পালিয়েছে। কাল রাতের আঁধারে ব্যাক প্যাক গুছিয়ে বাসায় তালা দিয়ে পালিয়েছে।”
অধরা টেবিলে এক ঘুষি মেরে বললো,”শিট! কেসটা সমাধানের দিকে না গিয়ে জটিলতার দিকে যাচ্ছে।”
চলবে…..
হরেক জনরার গল্প লিখলেও রহস্য গল্প লেখা হয় এই গল্পের আগে। গল্পটা বছর খানেক আগের লিখেছিলাম। এই গল্পই আমার লেখা প্রথম রহস্য গল্প। তাইলে লেখার হাত বেশ অপরিপক্ক। নাম গুলোও তখনকার। এখন শুধু রি-চেইক করে দিচ্ছি। নাম নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে, কিন্তু এ পর্যায়ে এসে নাম পরিবর্তন করতে গেলে পুরো গল্পটাই হয়তো এলোমেলো হয়ে যাবে। কারণ এই নামে ও টুইস্ট আছে। ধীরে ধীরে ধরতে পারবেন। আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।
গল্পটা প্রায় ২০পর্বের মতো হবে। শুরুতেই বলে দিচ্ছি, আশা করি ধৈর্য্য ধরে পড়বেন। আর অনেকেই এক পর্ব পড়ার পর গল্প হারিয়ে ফেলেন, তারা ‘#’ চিহ্নিত গল্পের নাম কিংবা আমার নামে ক্লিক করবেন সব পর্ব চলে আসবে। ধন্যবাদ