রহিবে মনের গহীনে পর্ব-০২

0
3666

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_০২
#Nishi_khatun

ইফানের বাবা-মা ছেলের সাথে কিছু কথা বলার জন্য রুমের বাহিরে এসে নক করতে থাকে। তবে অনেক সময় ধরে ইফান কে ডাকাডাকি করেও কোন রকম সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

এতে করে জিনিয়া বেগমের মনের মধ্যে খারাপ চিন্তা-ভাবনা বাসা বাঁধে। উনি জোরে জোরে বিলাপ করে বলতে শুরু করে,

–“ওগো ইফানের বাবা,আমার ছেলেটাকে জোর করে বিয়ে দেওয়াতে সে বুঝি কোন ভুল স্টেপ নিয়েছে। তুমি দ্রুত কিছু করো আমি আমার শান্ত, নম্র-ভদ্র স্বভাবের ছেলেটাকে হারাতে পাড়বো না।”

ইজাজ রহমান বিরক্তিকরভাবে বলল,
–” আহহ ইফানের মা! বাড়ির মধ্যে এসব কী শুরু করলে তোমরা? এখন যদি এসব অরিনের কানে যায়! তখন মেয়েটার মনের উপর কী প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছো? ”

“যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়” ঠিক এই প্রবাদ বাক্যের মতো ইফানের বাবা-মা যে ভয়টা পাচ্ছিল ঠিক সেই ঘটনাটা ঘটে যায়।

অরিন এসে দেখে ইফান দরজা খুলছে না। এদিকে ওর বাবা-মা খুব টেনশন করছে। বেচারি অরিন এমন পরিস্থিতিতে কোনোদিনও পড়ে নাই। তাই কি করবে বুঝতে পারে না। কিন্তু বাঙালী মেয়ে আর কিছু বুঝুক বা না বুঝুক! স্বামীর যে তার সারাজীবনের সাথী এটা ঠিক-ই বুঝে গেছে।

ইফানের বাবা-মা অরিন কে কিছু বলবে তার আগেই অরিন দ্রুত ইফানের দরজাতে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। জোরে জোরে চিৎকার করে কান্নারত অবস্থায় বলতে থাকে,

-“এই আমার নতুন বর! আপনি দরজা খুলুন!
প্লিজ আপনি সুইসাইড করবেন না। আমি বুঝি তো আপনাকে এনারা জোড় করে বিয়ে দিয়েছে আমার সাথে। ডোন্ট ওয়ারি লেকচারার আমি কাউকে বলবো না আপনি আমার বর। প্লিজ সুইসাইড করে আমাকে বিয়ের দিন বিধবা করে দিবেন না। শেষে বাবার বন্ধু তার বড় ছেলেটা হারাবে, বাবার বন্ধুর বউটা তার বড় পুত্রের শোকে জর্জরিত হয়ে স্টোক করবে। তারপর আপনার ছোট ভাই স্টাডি ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে দেশে চলে আসবে। আপনার লাশ এসে পুলিশেরা নিয়ে যাবে। তারপর তারা ডোম ঘরে নিয়ে গিয়ে লাশকাটা নেশাগ্রস্ত জল্লাদ কে দিয়ে আপনার লাশটা কেটে টুকরা টুকরা করবে। সেই লাশটা কে কাটাকুটির পর সেলাই করে বাবা-মা’র কাছে হস্তান্তর করে দিবে। আহারে সেই লাশটা দেখে সবাই কতো যে ভয় পাবে। প্লিজ নিজের এতো সুন্দর মাশাল্লাহ্ চেহারাতে মরার পরে খুঁতের সৃষ্টি করবেন না।”

ইফানের বাবা মা অরিনের কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আল্লাহ তারা এই মেয়েকে তাদের বড় ছেলের বউ করেছে ভাবা যায়?

-এমন সময় ধরাম করে ইফান দরজা খুলে অরিনের হাত ধরে রুমের ভেতরে নিয়ে যায়, বাবা-মা’র মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।

ইফানের এমন কাজে ইজাজ আর জিনিয়া হতবাক হয়ে আছে। তাদের ছেলে কখনো এমনকিছু করবে তা চিন্তার বাহির ছিল।

জিনিয়া হঠাৎ করে মুচকি হেসে বলে,

–“বুঝলে ইফানের বাবা আমাদের ছেলেটা বউয়ের কদর বুঝতে শিখেছে। বিয়ের সম্পর্ক তো পবিত্র, এখানে আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ভালোবাসা আল্লাহ নিজেই সৃষ্টি করে দেয়। চলো ওদের একা রেখে নিজেদের কাজে যায়।”

ইজাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

–“যাক আজকের পর আর ইফান কে নিয়ে আমাদের কোন টেনশন থাকবে না। অরিন ভালো ভাবে-ই ইফান কে সামলে নিবে।”

তারা দু’জনে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে যায়।

এদিকে ইফানের রুমের মধ্যে অরিনের উপর ঠিক কী ঝড় বইছে তা ইজাজ আর জিনিয়ার অজানা।
ইফান অরিনের হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বলতে শুরু করে,

–“এই বেহায়া মেয়ে! তোমার একটু লজ্জা করলো না চেনা নেই জানা নেই একটা ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে নিলে?”

আমার মামনি বলতেন, ”যে বিয়েটা হুট করে হয় অল্প-স্বল্প খরচে, সে বিয়েতে ততো বেশি নিয়ামত। তাছাড়া এখানে বেহায়াপনার কী দেখছেন আঙ্কলের বড় বেয়াদব ছেলে?”

ইফান রেগে বলে,
–“অরিইন.. কথা ঠিক করে বলবে!”

অরিন মুখ ভেংচি কেটে বলে,
–“আমি না হয় এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কম, জ্ঞানের পরিধিও কম।
কিন্তু আপনি? আপনি না ভার্সিটির লেকচারার?
তো আপনার মুখের ভাষা এমন কেনো? এভাবে বুঝি ভার্সিটির পোলাপানদের কাছে লেকচার ঝাড়েন?”

ইফান রাগেগরগর করে বলল-
” আমার প্রফেশন নিয়ে একদম কথা বলবা না।”
নয়তো তোমাকে…

অরিন ইফানের বুকে এক হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে বলতে থাকে,
–“কী করবেন আপনি? আর হ্যাঁ যাই করেন তাতে আমার কী? আপনি তো আমার বর। আহা কী মজা বাবার বন্ধুর লেকচারার পোলাডা এখন আমার জামাই। আহা কী মজা আকাশে বাতাসে। আমাকে আর কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হবে না। ইয়াহহহহ হুুু।”

ইফান অরিনের কথা শুনে রাগে জ্বলতে থাকে।
অরিন আবারো বলে,

–“আহা কী মজা! এই লম্বা বদরাগি লেকচারার টা আজ থেকে আমার বর। এটা আমার শ্বশুরের বাড়ি। ওরে আমার তো সুন্দর খচ্চর মার্কা জামাই গো।
জামাই কথায় কথায় বউ কে বকা দেয়। তাতে সমস্যা নাই তো। আমি তো জামাই পাইছি এটাই বড় কথা।”

ইফান জোড়ে ধমক দিয়ে বলে,
–“জাস্ট শাট আপ! মানি না তোমাকে আমার বউ।
এই মেয়ে বুঝলে তুমি, তোমাকে বউ বলে স্বীকার করি না।”

অরিন দু দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, “কিছু বুঝি নাই।”

ইফান বিরক্তিকর ভাবে বলে,
–” আমি কখনো তোমার মতো বাচ্চা মেয়েকে আমার বউ বলে মানতে পারব না। আর তুমিও ভুলে যাও এই বিয়ের কথা। তুমি অযথা কেন আমার মতো বয়স্ক লোকের বউ হয়ে নিজের জীবনটা ত্যাজপাতা করবে?”

অরিন বাচ্চাদের মতো করে বলে,
–“না না না বিয়ে যখন হয়ছে তখন আপনি আমার বর। আমি কেন বিয়ের কথা ভুলে যাবো? তাছাড়া আপনাকে দেখতে শুনতে খারাপ লাগে না। আপনি বুড়া হলেও আমার সমস্যা নেই। তবুও আপনি আমার একমাত্র স্বামী মহাদয়।”

ইফার রেগে চিৎকার করে বলে,
–“একদম ফালতু কথা বলবে না। জানো কেনো বিয়ে করেছি তোমাকে? শুধুমাত্র তোমার বাবা মারা যাবার আগে আমার বাবার থেকে ওয়াদা নিয়েছিল তাই। জানি না তোমার বাপের মরার আগে কেন এতো ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দরকার হলো। কেন রে ভাই তুমি কী আমাদের বাড়িতে এমনিতে থাকতে পারতে না? নাহ তার বাবার ইচ্ছা এ বাড়ির বউ হয়ে তার মেয়ে থাকবে। কিন্তু মেয়ের বাবা তো জানতো না তার মেয়েটা কতো বড় বেয়াদব। আর সব থেকে বড় কথা মেয়েকে এ বাড়ির বউ করার চক্কোরে আমি আমার ভালোবাসা হারাতে বসেছি। কেনো বুঝতে চাইছো না তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে কোন দিন ও মেনে নিতে পাবো না। শোনো মেয়ে আজকের পর যদি ভুল করেও আমাকে স্বামী মনে করেছো তাহলে তোমার ঐ মনে আমি কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিবো।”

অরিন একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
–“আচ্ছা আমি ছোট বলে আমাকে বউ ভাবতে সমস্যা আপনার? আমি যখন বড় হবো তখন না হয় দুজনে সুখে-শান্তিতে সংসার করবো। তখন করবেন তো আমার সাথে সংসার? ”

ইফান মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বলে,
–” আমাকে কী পাগলে কামড়াইছে? যে তোমার মতো বিছুটি পাতার সাথে ভবিষ্যৎ এ সংসার করার কথা চিন্তা করবো?”

অরিন ভাব নিয়ে বলে,
“কেনো আমি দেখতে কী খুব খারাপ? আপনি জানেন সংসারের ‘স’ টা আমি বুঝি না, সেখানে আপনার এতো আপত্তি! তাহলে কেনো করতে গেলেন বিয়ে?
না করে দিতে পারতেন। হুদায় কামে আমারে বিবাহিত বানিয়ে ছেড়ে দিলেন। এখন কে করবে আমাকে বিয়ে?”

–কেউ কোনোদিন জানবে না আমাদের মিথ্যা বিয়ের কথা। তাই তুমি বড় হলে নিজের পছন্দ মতো কাউকে বিয়ে করে সংসার করিও।

অরিন অতি আগ্রহের সাথে বলে,
” বড় হয়ে যদি আপনার সাথে সংসার করতে চাই, তখন কী করবেন আমার সাথে সংসার?”

ইফান রেগে বলে,”ঘুরেফিরে সেই একি কথা। আরে বাবা বুঝতে চেষ্টা করছো না কেন আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসি। আমার মনে তো দূরের কথা জীবনের কোন অংশের সাথেও তোমাকে জড়াতে চাই- না।”

অরিন জোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–“সেই তখন থেকে একি কথা বার বার রিপিট করে বলে যাচ্ছেন আপনি। সমস্যা কী?”

ইফান এবার নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–“তোমাকে বোঝাতে পারে এমন কেউ এই দুনিয়া তে পয়দা হয় নি। আমারও আর সাদ্ধি কই?”

-“তাহলে কষ্ট করে বোঝানোর দরকার নেই।”

ইফান শান্ত ভাবে বলে,
– “আমাদের বিয়ের কথা আজকেই তুমি ভুল যাবে। জীবনে কখনো ভুল করেও সমাজের সামনে আমাকে তোমার স্বামী বলতে পারবে না। আমাদের বিয়ের কথা কোনোদিন কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবে না। আমাকে কোনোদিন ও জোর করতে আসবে না এই সম্পর্কের জন্য। যদি কখনো এসবের কোন কিছু করো তাহলে আমিও তোমার বাবা-মা’র মতো ঐ আকাশের সদস্য হয়ে যাব। আমি সুইসাইড করবো।
যেহেতু তোমার দাঁয়িত্ব আমার পরিবার বহন করছে সেই হিসাবে তুমি এই পরিবারের কাছে ঋনি।
আশা করছি এই বিয়েটা কে আমাদের ঋণ শোধ করার মাধ্যম হিসাব করে ভুলে যাবে। এরপর ও যদি আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করো তাহলে আমি সত্যি সত্যিই সুইসাইড করতে বাধ্য হবো।”

অরিন চুপচাপ মাথা নিচু করে কিছু সময় সেখান দাঁড়িয়ে থাকে তারপর ইফানে রুম থেকে বেড়িয়ে আসার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বলে,

–“সময় আসতে দিন আপনাদের সব হিসাব-নিকাশ আমি মিটিয়ে দিবো। আর হ্যাঁ আপনি যখন চাইছেন না আপনাকে স্বামী হিসাবে মনে করি, তখন করবো না। ভুলে যাবো সবটা! তবে মনে রাখবেন আমি যা ভুলে যাবো তা চাইলেও আর মনে করাতে পারবেন না। দেখবেন সেদিন আপনাকে আফসোস না করতে হয় এই অরিনের জন্য। মনে রাখবেন জীবনটা আমার আপনার নয়।”

অরিন ইফানের রুম থেকে নিরবে প্রস্থান করে চলে যায়। তখন…

ইফান বলে,
–“যে না লিলিপুট সে আসছে লেকচারার কে লেকচার দিতে হুহ।”

এরপরে কী হবে? কী আর হবে অরিন ইফানের জীবনের কোন নতুন অধ্যায় শুরু হবে?না কি নতুন কোন ঝড়ের আগমন হবে?
প্রশ্ন রইলো আপনাদের কাছে।



চলবে….!?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here