রহিবে মনের গহীনে পর্ব-০৫

0
2000

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_০৫
#Nishi_khatun
(গঠনমূলক মন্তব্য করবেন সবাই)
হঠাৎ করে খুব ভোরে অরিনের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। অরিন দ্রুত কল রিসিভ করতেই অপরপাশে থেকে কেউ একজন তাকে খুব খারাপ খরব দেয়।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত ছুটতে থাকে নিজের রুমের বাহিরে।

ইফান ভোরে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে নিজের রুমের দিকে আসছিল হঠাৎ করে অরিন সাথে ধাক্কা খেয়ে দুজনে দু দিকে ছিটকে পড়ে যায়।

ইফান অরিনের এমন কাজে খুব রেগে যায়। সারাদিন তো বাড়িতে অশান্তিতে রেখেছে তার উপর ভোরবেলা এমন কাহিনী।

ইফান নিজেকে সংযোত রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় অরিন কে বকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইফান থমকে যায়। মেয়েটার চোখ মুখের এ কী অবস্থা! কপালের এক কোণা দিয়ে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছে। মেয়েটার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। মেয়েটার দুচোখ জোড়া বড্ড লাল হয়ে আছে। লম্বা চুল গুলো সারা শরীরের সাথে এলোমেলো ভাবে লেপটে আছে। আজকে অরিনকে খুব এলোমেলো দেখাচ্ছে।

ইফান কে কোন কিছু না বলে দ্রূত উঠে ইজাজ রহমানের রুমের দিকে ছুটতে থাকে।

অরিনের এমন কাজে ইফান হতবাক হয়ে যায়। কোথাও তো কোন গণ্ডগোল আছে। তবে কোথাও?
তা জানার জন্য অরিনের পিছনে ইফান ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়।

অরিন ইজাজের রুমের বাহিরে এসে করাঘাত করতে থাকে।

ইজাজ এবং জিনিয়া একটু চমকে ওঠে এতো ভোরে কার কী হলো তা দেখতে দ্রুত দরজা খুলে দেয়।

অরিন ইজাজ রহমান কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

অরিনের পিছনে ইফান কে দেখে তারা দুজনে ভাবে তাদের ছেলে হয়তো অরিনের সাথে খারাপ কিছু করেছে মেয়েটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে কতোটা বিধ্বস্ত। কপালের এক কোণা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

জিনিয়া রুমের বাহিরে এসে নিজের ছেলের কান জোড়ে করে টেনে ধরে রেগে উচ্চ স্বরে বলে,”তুই কাল পর্যন্ত মেয়েটাকে বউ বলে মানতে নারায ছিলি। আর আজ হঠাৎ করে মেয়েটার সাথে জোড়াজোড়ি করতে একটু লজ্জা করলো না? এই শিক্ষা দিয়েছি আমরা?”

ইফান নিজের মায়ের হাত থেকে নিজের কানটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্তির সাথে বলে,”ঐ মরিন কে কালো বউ বলে মনে করি নাই আজও মনে করি না। আর অযথা না জেনে বুঝে আমার ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের উপর আঁচড় দিতে আসবে না।”

ইজাজ রহমান দাঁতের উপর দাঁত চেঁপে ইহান কে উদ্দেশ্য করে বলল-

“তোর মানইজ্জতের কিছু বলি! কোন সাহসে তুই অরিনের সাথে খারাপ আচরণ করিশ? বিয়ে দিয়েছি তার মানে এই নয় যে মেয়ের জীবনের লাগাম তুই টানবি।”

ইফান নিজের পক্ষে কী দলিল দিবে বুঝতে পারছে না। কোন দুঃখে যে এই অরিন মরিনের পিছনে পিছনে আসছে গেছিলাম। মানুষেরা ঠিক কথা বলে,”আগ বাড়িয়ে পায়ে কুড়ালে মারা আর কোন নারীর পিছুনেওয়া দুটো সমান কাজ। মহিলা! অরিন এখনো মহিলাদের কাতারে পড়ে না। তবে বিবাহিত তো?”

জিনিয়া- ইফান কে থাপ্পড় দিতে উদ্ধত হচ্ছিল তখন অরিন কান্নারত অবস্থা ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করে,”ও বাবার ভালো বন্ধু! আমি আমাদের বাড়িতে যাবো গো।”

ইজাজ অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”মা তোমার ঐ বাড়িতে যেতে হবে না। ইফান তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করছে তার জন্য মাফ করে দে মা। আজকেই ইফানের খবর করছি আর কখনো তোর পিছনে লাগতে যাবে না।”

অরিন দু হাতে চোখেরজল মুছে বলে,

-“আমার পাশের বাসার দাদুভাই টা রাতে মারা গেছে। আমি তাকে শেষ বারের মতো একটিবার দেখতে যেতে চাই! এরপর কখনো কোথাও যাবার জন্য বায়না করবো না সত্যি বলছি।”

অরিনের মুখে এমন কথা শুনে তিনজন তো একদম স্তব্ধ। তারা কী না কি ভেবেছিল আর এখানে কাহিনী তো অন্য কিছু।

ইফান কঠোর কন্ঠে বলল-

“দেখো তোমরা কোথাকার পানি কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে। আমি ঐ মরিনের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করি নাই। তারপর ও তোমরা সবটা যাচাই বাছাই না করে আমাকে দোষী ঘোষণা করে দিলে।”

জিনিয়া- অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”আম্মু টা বুঝি ঐ দাদুভাই কে খুব বেশি ভালোবাসে?”

-হ্যাঁ! আব্বু আম্মু দুজনে যখন আমাকে একলা করে চলে গেছিল তখন ঐ দাদুভাই এসে আমাকে আগলে রেখেছিল। তাছাড়া বাবা-মা তো সব সময় আমার সাথে থাকতো না। তখন আমি ঐ দাদুভাই এর সাথে অনেক গল্পগুজব করতাম। আর আমি ত কখনো নানা- নানী,দাদা- দাদীর ভালোবাসা পাইনি। তাদের কোনোদিন দেখি নাই। আমার আপনজন কারা তা-ই তো জানি না। তাই আমাদের বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের কে আপনজন ভেবেছি। তাদের সাথে মিলেমিশে আমার বড় হয়ে ওঠা। ঐ দাদুভাই টা জানো অনেক ভালো! আমাকে অনেক আদর করতো। আমার মন খারাপের সময় কতো গল্প শোনাতেন।
আমার আম্মু-আব্বুর পর সে ছিল একজন কাছের মানুষ। আজ সেও চলে গেছে। আমি বড্ড বেশি একা। আজ আমার কেউ নেই,আমার কেউ নেই, নেই!”

জিনিয়া অরিনের কষ্টটা বুঝতে পারছে। এতো ছোট বয়সে মেয়েটা কতো আপনজন দের হারিয়েছে ভাবা যায়। কয়েক মাস যেতে না যেতেই আজ আবারো আরেকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে।

ইজাজ ইফান কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমাদের দু জনের পক্ষে অরিনকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তোর কলেজ তো আজ বন্ধ। তুই অরিন কে সাথে করে নিয়ে যাবি আবার সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে আসবি।”

ইফান কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু অরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাে নিষেধ করার ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখলো।

জিনিয়া দ্রুত ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসে অরিনের কপালে মেডিসিন লাগিয়ে দেয়। তারপর অরিনের কপালে চুমা দিয়ে বলে,”যাও মা ফ্রেশ হও,তারপর না হয় রেডি হয়ে নাস্তা করে বেড়িয়ে যেও!”

অরিন কোন কথা না বলে নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে একটা কালো রঙের থ্রিপিস পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিচে নেমে আসে।

জিনিয়া অরিনকে নাস্তা করার জন্য জোড়াজোড়ি করে কিন্তু মেয়েটা কোন দানাপানি স্পর্শ করে না।

এরপর ইফানের সাথে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।

কালো থ্রিপিসে আজ দ্বিতীয় বার দেখছে সে অরিন কে। প্রথম যেদিন দেখেছিল ঐ দিনটা ছিলো অরিনের জীবনের সব থেকে ভয়ঙ্কর কালোদিন। যে দিন মেয়েটা বাবা- মা দু জন কে হারিয়ে ছিল। সেদিন মেয়েটা বারংবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল। দু তিনজন মিলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেছিল। মেয়েটার মুখের দিকে সেদিন তাকিয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক আজকেও একই অবস্থা। কালোরঙের থ্রিপিস পড়ে চুল গুলো এলোমেলো, মাথার উপরের ওড়নাটার যত্ন নেই, না আছে নিজের প্রতি নেই কোন টান। পাথরের মতো চুপচাপ বসে আছে।
একটু পর পর শুধু চোখ থেকে আপনা-আপনি জল গড়িয়ে পড়ছে।
অরিনকে এমন রুপে দেখে ইফানের কলিজায় কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠছে। বুকের বা পাশে কেন জানি ব্যাথা অনুভব করছে।

ইফানের পাশের শিটে অরিন বসে আছে তবে আজ নেই তার মুখে কোন কথা। অন্যকোন দিন হলে হয়তো ইফানের জান ত্যাজপাতা করে ছেড়ে দিত। তবেঁ অরিনের এই নিরবতা কেনো জানি ইফানের সয্য হচ্ছে না।

তারপর ও চুপচাপ থাকতে হয় ইফান কে।
অনেকটা সময় পর অরিনের বাড়িতে পৌঁছে যায় ইফানের গাড়িটা।

অরিন গাড়ি থেকে নেমে দেখে বাড়ির সদরদরজার সামনে গোলাপি বানু আর রঙিলা চাচা দাঁড়িয়ে আছে।

অরিন কে দেখে গোলাপি শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে চোখের পানি মুছতে ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।

অরিন দৌড়ে গোলাপি কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।

অনেকটা সময় গোলাপি আর অরিন আলিঙ্গনরত অবস্থা থাকে। একটুপর রঙিলা চাচা বলে ওঠে,”কি গো বউ মাইয়া ডা কতদিন পর আইলো বাড়িতে এমনে জড়ায় ধরে কান্দলে চলবে? চলো আগে ওরে শফিক ভাইয়ের লাশটা দেখিয়ে আনি। তার তো জানাজার সময় হয়ে আসছে।”

অরিনে কে আলিঙ্গন করে হাটতে থাকে গোলাপি তাদের উদ্দেশ্য পাশের বাড়ি। ইফান গাড়ি থেকে নেমে ওদের পেছনে যেতে থাকে। বোঝায় যাচ্ছে পাশের বাড়ির অবস্থা কেমন। প্রচুর ক্রন্দনধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্রন্দনের উচ্চারিত ধ্বনিতে চারপাশের পরিবেশ গুমোট আকার ধারণ করেছে। এমটা অরিনের বাবা- মা’র মৃত্যু দিনও হয়েছিল।

পাশের বাড়িতে যাবার পর শফিক সাহেবের লাশ দেখে অরিনের সে কি ক্রন্দন। তাকে থামাতে পাড়বে এমন সাধ্যি কারো নেই। এভাবে ক্রন্দন করতে থাকলে অরিন অসুস্থ হয়ে যাবে। এসব ভেবে রঙিলা চাচা তার বউকে বলে,”তুই আম্মাজান কে নিয়ে বাড়িতে যা বউ! আমি জানাজায় শরীক হয়ে দাফনকাজ সম্পন্ন করে আসি।
রঙিলা চাচা কে উদ্দেশ্য করে ইফান বলে,”চাচা আমিও যাবো আপনার সাথে! ”

এরপর ইফান আর রঙিলা চাচা চলে যায় আর গোলাপি অরিন কে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে।

ইফান অরিনের বাড়িতে ফিরে এসে দেখে সদরদরজর সামনে গোলাপি বানুর কোলে মাথে রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে অরিন।

রঙিলা বউকে রাগ দেখিয়ে বলে,”কী রে বউ তুই আম্মাজান কে বাড়ির ভেতরে কেন নিয়ে যাসনি? ”

গোলাপি কিছু বলার আগেই অরিন উঠে এসে রঙিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”চাচা গো ঐ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার মতো কলিজায় শক্তি নেই আমার।
যে বাড়ির ভেতরে আমার মা বাবা নেই। সে ঘরের ভেতরে আমি কি ভাবে প্রবেশ করবো? ‘এই বাড়ির ভেতরে অক্সিজেনের বড্ড বেশি অভাব।’ আমি পারবোনা ভেতরে প্রবেশ করতে।”

ইফান একদৃষ্টি তে অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। চঞ্চল মেয়েটার চঞ্চলতা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে?

অরিন ইফানের কাছে এসে ওর হাত ধরে গাড়ির কাছে টেনে এনে বলে চলুন আপনাদের বাড়িতে। এবাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ইফান গোলাপি আর রঙিলার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে তার দুজনে ইফানের হাত জড়িয়ে ধরে বলে,”আমাদের কলিজার টুকরোটা আপনাদের বাড়িতে থাকে। দয়া করে একটু খেয়াল রাখবেন। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল! দিনদুনিয়ার খরব সম্পর্কে অবগত না সে। আপনারা একটু স্নেহ ভালোবাসতে আগলে রাখবেন মেয়েটাকে বাবা।”

ইফান চোখের ইশারা তে তাদের আশ্বাস দান করে গাড়িতে উঠে বসে।

এরপর ফিরে চলে আসে ঐ বিষাক্ত পরিবেশটা থেকে। যে পরিবেশে আপনজন কে হারানোর আহাজারি তে মুখোরিত।

(আজকের পর্বটা পড়ে সবার কেমন অনুভূতি?)



চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here