#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_০৬
#Nishi_khatun
সেদিন ঐ যে মেয়েটা বাবার বাড়ি থেকে বিদ্ধস্ত অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলো! তারপর থেকে সেই চঞ্চল প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কোথাও একটা হারিয়ে গেছে।
যার বাবা- মা নেই এই দুনিয়াতে সে তো এই মস্ত বড় পৃথিবীর বুকে এতিম। মেয়েটা আর কতো আড়ালে রাখতো নিজের আপনজনদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট। কৃত্রিম হাসির আড়ালে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ দেখে না। এটাই দুনিয়ার নিময়।
জিনিয়া আর ইজাজ অরিন কে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তাদের কোন মেয়ে নেই। তবে অরিনের আগমনে মেয়ে না থাকার আপসোস কিছুটা হলেও নিবারণ হয়েছে। মেয়েটা তার চঞ্চলতা দিয়ে এই মৃতপ্রায় বাড়িটাকে প্রাণোচ্ছল করে তুলেছিল। তবে আজ প্রাণোচ্ছল মেয়েটা মলিন হয়ে গেছে। নেই তার ঠোঁটের কোণায় দুষ্টুমি ভরা হাসি,না আছে আঁখিদুটি তে একরাশ স্বপ্ন। কথার মাঝে নেই তার প্রাণের ছোঁয়া। কেমন একটা জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছে ময়না পাখিটা। এভাবে বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না। তবে আর যাই হোক জোড় করে তো কারো মন থেকে বিষাদের ছাড়া সরিয়ে ফেলা যায় না।
অরিনের নিরবতা আজকাল ইফান কেও বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে। চঞ্চল একটা মেয়ে হুট করে এভাবে চুপচাপ হয়ে যাবে এটা সে মোটেই মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু, মেনে না নেওয়া ছাড়া তার আর উপায় নেই তো।
এভাবে আরো কয়েকদিন পার হয়ে যায়।
একদিন সকালে হঠাৎ করেই অরিন সারাবাড়িতে পায়চারী করতে শুরু করে দেয়। সবাই তো অবাক হঠাৎ মেয়েটার কী হলো? এভাবে পায়চারী করছে কেনো? সকাল থেকে খাওয়াদাওয়া সে বাদ দিয়েছে।
হুট করে ইফানের সামনে এসে বলে,”এই যে লেকচারার সাহেব আপনার তো লেপটপ আছে? ওটাতে ইন্টারনেট কানেকশন আছে কী?”
ইফান দ্রূত উত্তর দেয়,
-“লেপটপ যখন আছে তখন ইন্টারনেট কানেকশন ও আছে। আমি কি লেপটপ শো অফ করতে নিজের সাথে রেখেছি? ”
অরিন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”বড়লোকদের তো আবার ভাব বেশি! তারা সব কিছু লোক-দেখানোর জন্য করে।”
ইফান আজ ঝগড়া না করে শান্ত স্বরে বলে,”আমার লেপটপ দিয়ে কী দরকার তোমার সে কথা আগে বলো।”
জিনিয়া- ইফানে পিঠ চাপড়ে বলে,”মেয়েটার সাথে ত্যাড়া ভাবে কথা না বললে চলছিল না?”
ইফান সন্দহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“তুমি আমার আপন মা তো? না কি ঐ অরিনের মা? এই মেয়েটা বাড়িতে আসার পর থেকে তোমরা দুজনে আমার সাথে পরপর ব্যবহার করো। সব কিছুতে আমার দোষত্রুটি খুঁজে বাহির করো। আর তোমাদের ঐ গুণধর মেয়ের ভুলভ্রান্তি কিছুই মনে হয় না।”
জিনিয়া- বুঝতে পারছে তা ছেলে অরিন কে নিয়ে জেলাসি ফিল করছে। ছেলেকে আর কিছু না বলে চুপচাপ অরিনের পাশে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–” আম্মাজানের কি হয়েছে বলবে না?
অরিন মাথা নিচু করে বলে,”আজকে আমার পরিক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। আম্মু- আব্বু নেই তো তা-ই নিজের চিন্তা নিজেই করছি। আপনাদের বাড়িতে তো আমার না আছে লেপটপ না আছে কম্পিউটার। স্কুলে সব সময় রেজাল্ট নিতে আমার সাথে গোলাপি বানু যেত। আজকে কে যাবে? ওখানে তো যাওয়া সম্ভব নয় তা-ই অনলাইনে রেজাল্ট দেখতে হবে।”
বাড়ির সবার মাথায় তো বাঁশ! আল্লাহ তারা সবাই কি করে ভুলে গেছে আজকে মেয়েটার রেজাল্ট!
ইফান লেপটপ কোলের উপর নিয়ে বসে রেজাল্ট দেখার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। তার কাছে অরিনের বোর্ড পরিক্ষার কাগজ পত্তি ছিলো।
তখন অরিনের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলে,” আমাদের দেশে প্রচলিত একটা কথা আছে জানো তো? কেউ যদি ফেল করে তার বাবা- মা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চায় রিক্সা ওয়ালার সাথে। তা তুমি যদি ফেল করো তাহলে তোমার বিয়ে কার সাথে দিবো?”
অরিন সোজাভাবে উওর দেয়,
–“লেকচারার যদি রিক্সা চালক হয় তাতে আমার সমস্যা নেই। যেহেতু রেজাল্টের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে আমার। সেখানে দ্বিতীয় বিয়ের টেনশন নাই।”
ইফান যে নিজের খোঁড়া গর্তে নিজে পড়ছে তা সে বেশ ভালো মতো বুঝতে পারলো। এখন কোন কথা বলার আর মুখ নেই তার।
অরিনের রেজাল্ট দেখে ইফান মুখ কালো করে জোড়ে ধমকের সুরে বলে,”এই মেয়ে কেউ সব সাবজেক্টে ফেল করে?”
ফেল!! কথা শুনে অরিনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বেচারি হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
ইফান এদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরিনের কান্নাকাটির ভিডিও করতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে জিনিয়ার নজর ইফানের উপর পরতেই ভ্রূ কুঁচকে চেঁচিয়ে বলে,”এই বেয়াদব ছেলে! মেয়েটা কান্না করছে আর তুই কি না মজা নিচ্ছিস? ”
ইফান এবার জোড়ে হেসে বলে ওঠে,”আম্মাজান কেউ যদি পাস করে সেই খুশিতে মরা কান্না শুরু করে তাতে আমার কী করার আছে?”
সবাই হতভম্ব হয়ে ইফানের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইফান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
–” ইঁচড়েপাকা মেয়ের মাথায় এতোটুকু বুদ্ধি শুদ্ধি নাই? যে পরিক্ষা দিয়েছে তার কী নিজের উপর এতোটুকু ভরসা নেই? আমি বললাম উনি ফেল করেছে আর তা সাথে সাথে বিশ্বাস করে নিলো?”
অরিন কান্না কাটি বন্ধ করে বলে,”আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো ছাগল দিয়ে লাঙল চাষ করা যায় না। সেই তো মিথ্যা কথা বলে আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে। ”
–তোমার শখ হয়েছে তুমি কান্না করেছ তাতে আমার কি করার আছে?
অরিন চোখের পানি মুছে বলে,
-” জানেন রক্তের থেকে চোখের পানির মূ্ল্য বেশি! কতো কষ্ট পাওয়ার পর মানুষের চোখ থেকে পানি ঝরে?”
ইজাজ দু জন কে ধমক দিয়ে বলে,”এই তোমরা দু জন থামবে? বাচ্চা মেয়েটার সাথে বুড়া ভাল্লুক ঝগড়া করছে এটা মোটেই শোভাজনক দেখাই না।”
ইফান আহ্লাদী কন্ঠে বলে,”বাবাহহহহ তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো না। আমার আত্মসম্মান বলে কিছু আছে।!
ইজাজ বলল,
–” আত্মসম্মান বাবা মা’র সামনে দেখাতে নেই। বাহিরে লোকের সামনে দেখাবি। এখন অরিনের রেজাল্ট কি তা বল!”
ইফান গম্ভীর কন্ঠে বলে,”সব সাবজেক্টে প্লাস।”
অরিন আলহামদুলিল্লাহ্ বলে জিনিয়া কে জড়িয়ে ধরে বলে,”এবার ভালো একটা কলেজে ভর্তি হতে হবে। তারপর এইচএসসি তে প্লাস পেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।”
ইজাজ অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”ইনশাআল্লাহ তোমাকে ভালো কলেজে ভর্তি করানো হবে।”
জিনিয়া ইফান কে বলে,”ইফান তোর ভার্সিটির সামনে যে কলেজ আছে ওখানে অরিনের এডমিশনের ব্যবস্থা করবি। তারপর রেগুলার অরিন কে সঙ্গে করে কলেজে নিয়ে যাবি এবং আসার সময় নিয়ে আসবি।”
— আমাকে কি পাগলে কামর দিছে? যে আমি অরিনকে আমার ভার্সিটির সামনের কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবো? আমার কি আর কাজ কাম নেই? সারাদিন ওরে পাহারা দিবো। আর আমার ভার্সিটি বাড়ি থেকে দুই ঘন্টার দূরত্বে। আমি জবটা বাড়ি থেকে যাওয়াআসা করে করি মানে কি অরিন কেও ঐ দূরে পড়তে যেতে হবে? আশেপাশে কোন একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দাও তাহলে হবে। লেখাপড়া করা দিয়ে তো কথা। এতো নামকরা কলেজে পড়ার কি দরকার আছে? ”
জিনিয়া কেনো জানি রেগে ইফানে গালে হঠাৎ করে থাপ্পড় দিয়ে বসে। এমন অকল্পনীয় বিষয় ঘটবে কেউ আশা করে নাই।
ইফান গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ইজাজ এসে জিনিয়ার কাধে হাত রাখে। তখন জিনিয়া বলে,”একটা এতিম মেয়ের এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকা কতোটা কষ্টের তা তুমি বুঝবে না। কারণ তোমার বাবা- মা,ভাই আত্মীয়স্বজন সব আছে। তবে ঐ এতিম মেয়ের পুরো দুনিয়াটা ফাঁকা। তার স্বপ্ন দেখাটাও বিলাসিতা। তবে আমি কোনদিন ও অরিনের কোন স্বপ্ন অপূর্ণ থাকতে দিব না। তার জন্য যদি সাজানো সংসারটা ছাড়তে হয় তাতেও রাজী। অরিনের প্রতি আমার দাঁয়িত্ব কর্তব আছে। অরিনের অধিকার আছে আমার উপর। আমি যে বড় ঋণী মেয়েটার…..
আর কিছু বলার আগেই সে তার স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
অরিন দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী ভাবছে। সে যদি এই বাড়িতে না আসতো তাহলে হয়তো এই পরিবারে এতো অশান্তির সৃষ্টি হতো না। এখন সে যে বাধা! চাইলেও সব কিছুর সমাধান করতে পারবেনা। তবে এখন থেকে পর কে আপন করার বৃথা চেষ্টা করা ছেড়ে দিবে। কি দরকার জোড় করে অন্যরে সংসারের সদস্য হওয়ার?
এরপর কয়েকদিন জিনিয়া চুপচাপ ছিলো। কারো সাথে সে ভাবে কথা বলতো না।
ইফান সেদিন বিকালে বাড়ি থেকে চলে যায়।
কেউ তার চলে যাওয়াতে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।
তারা জানে তাদের ছেলে সময় হলে ফিরে আসবে।
জিনিয়া অরিনকে বলে,” আম্মাজান তোমাকে কিন্তু নিজের সকল স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। আমি চাইনা তুমি এতিমদের মতো জীবনযাপন করো। তোমার জীবনে কোন কষ্টের ছায়া পরতে দিবো না আমি।”
অরিন তার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,”আন্টি অযথা পরের মেয়ের জন্য নিজের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করবেন না। আমি আজ আছি কাল থাকবো না। তবে আপনার পরিবার সারাজীবন সাথে থাকবে। তাদের সাথে অযথা বাহিরে একটা মেয়ের জন্য সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা আসতে দিবেন না।”
বলেই অরিন প্রস্থান করে।
জিনিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আফসোস তুমি যদি জানতে আমার সব থেকে কাছের কেউ তুমি!
তখন কি নিজেকে পর বলে সম্বোধন করতে পারতে? কিছু সত্যি থাকে যা আমরা চাইলেও প্রকাশ করতে পারি না। তুমিও আমার ঠিক তেমন একটা সত্যি। যা অপ্রকাশিত। ”
(জীবনটা কখন কোনদিকে ছুটে চলবে তা কেউ জানে না!)
”
”
”
চলবে…