#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_১৮
#Nishi_khatun
ইফান গাড়িটা নিয়ে সোজাসুজি একটা গোরস্তানে চলে আসে। গাড়িটা সেখানে এক সাইডে পার্ক করে সবাইকে বলে বাহিরে বেড়িয়ে আসতে।
সবাই বাহিরে আসার পর ইহান ভ্রূ কুঁচকে বলে,
“ভাই আমরা না অরিনের ফ্যামিলির সাথে মিট করতে আসছি? তাহলে আমাদের কেনো কবরস্থানে নিয়ে আসলে?”
ইফান বলে,”অরিনের দুনিয়া তো এখানে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তাদের সাথে দেখা করতে হলে তো এখানেই আসতে হবে।”
এরপর ইফান ইহানের হাত ধরে কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করে। আজরিন আর অরিন ও তাদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে।
ইফান পাশাপাশি দুটি কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়।
অরিন তখন ইফানের পাশে এসে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”আজরিন আপু আপনি আমার বাবা- মা’র সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। এই যে এখানে তারা দু জন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।”
ইহান ইফানের দিকে প্রশ্ন বিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইফান ইশারাতে বুঝিয়ে দেয় পরে সব কিছু ক্লিয়ার করে বলবে।
এরপর চারজন কবরস্থানে তাদের জন্য দোয়া করে কবর জিয়ারত করে বেড়িয়ে আসে।
গাড়ির সামনে আসতেই অরিন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইফান দ্রুত অরিন কে কোলে তুলে নে। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে ওর কপালে পরম মমতায় আদরের স্পর্শ দিয়ে বেড়িয়ে আসে।
ইহান আজরিন কে উদ্দেশ্য করে বলে,”অরিন বাহিরে থেকে অনেকটা নারিকেলের মত। বাহিরে শক্ত খোলস ভেতরে নরম। অনেক ছোট বয়সে মেয়েটা তার বাবা মা কে হারিয়েছে। জানিস ইহান আমি প্রথম অরিনকে যেদিন দেখেছি সেদিন মেয়েটার দুনিয়া অন্ধকার ছিলো। বাবা মা কে হারিয়ে কি যে কান্নাকাটি। মেয়েটার ঐ দুধেআলতা গায়ের রংটা সেদিন রক্তিম হয়েছিল। দু চোখেরজল ঝরতে ঝরতে ফুঁলে কি অবস্থা। ভাই- বোন সব আছে তবুও তাকে একাই সবটা দেখতে হইছে। ওর বড় ভাই বোন বিদেশে সেটেল। বাবা- মা মারা গেছে তারপর ও ছোট বোনটাকে দেখার জন্য তারা দেশে আসে নাই।
জানিস ইহান, আমি আমার এই দুই হাত দিয়ে অরিনের বাবা- মা’র কবরে মাটি দিয়েছি। প্রথমে বাবার শোকে কাতর ছিলো বাবাকে মাটি দিয়ে আসারর পর মা কে বিদায় দেওয়ার মতো কলিজা অরিনের ছিলো। মেয়েটা যেদিন নিজের সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছিল সেদিন আমিও স্বার্থপরের মত একা রেখে চলে গেছিলাম। কিন্তু পরেরদিন ঠিকি ফিরে আসি নিজের বিবেকে বাধছিল। এরপর বাবা মেয়েটাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলে যায়। কারণ বাবা- মা’র ছায়া ছাড়া একা একটা মেয়েরে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের। আর আজ দেখ তোদের সামনে কি সুন্দর হাসি মুখে নিজের বাবা- মা’র পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তবে তোরা তো জানিস না মেয়েটার কলিজার মধ্যে কতোটা ঝড় তুফান চলছিল। বুকের মাঝে চাপা যন্ত্রণা নিরবে সহ্য করতে গিয়ে মেয়েটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সমস্যা নেই অরিন নিজের অনুভূতি গুলো খুব সুন্দর করে কন্ট্রোল করতে পারে।”
ইইফানের কথার শেষে ইহান প্রতি উত্তর করে,”ঠিক তোর মতো অনুভূতি গুলোকে সবার দৃষ্টির আড়ালে রাখতে পারে। তোদের দু জনের মধ্যে খুব মিলে। কেউ তোদের বাহিরের হাসি মাখা চেহারা দেখে অন্তরের রক্তক্ষরণের পরিমাণ ধারণা করতে পারবে না।”
ইফান কোন কথার উত্তর দেয় না।
আজরিন এতো সময় ধরে অরিনের সম্পর্কে সবটা শুনে হতবাক। মেয়েটাকে দেখে ভেবেছিল গরীবের মেয়ে হয়তো তা-ই ইফানদের বাড়ির আশ্রিত। কিন্তু এখন তো দেখছে অরিন সত্যি খুব গরীব। যার এই দুনিয়াতে বাবা- মা নেই তার যতোই টাকাকড়ি থাক তবুও সে গরীব। বাবা- মা টাকাকড়ির থেকেও দামী সম্পত্তি সন্তানদের জন্য। যার বাবা- মা নেই তার কষ্ট অন্য কেউ কখনো বুঝবে না।
আজরিন গাড়ির ভেতরে বসে অরিনের মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে ওর মুখে একটু পানির ছিঁটিয়ে দিতেই অরিনের জ্ঞান ফিরে আসে।
অরিনের জ্ঞান ফিরে আসতেই সে চুপচাপ বসে থাকে কোন কথা বলে না। গাড়িটা আবারো চলতে শুরু করেছে তবে গাড়ির ভেতরের নিরবতা বাহিরের কেউ জানে না।
ইফান গাড়িটা অরিনদের বাড়ির ভেতরে এনে পার্ক করতেই গোলাপি আর রঙিলা দৌড়ে এসে অরিন কে জড়িয়ে ধরে শত আদরের স্পর্শ মেয়েটার কপালে ভরিয়ে দিতে থাকে।
অরিন আহ্লাদের সাথে তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যাদের ছাড়া সে কখনো কোন ঈদ করে নাই বাবা- মা কে হারানোর পর সে ঈদ ইফানদের বাড়িতে করেছে। তবুও নিজের বাড়িতে আসার সাহস হয়নি তার।
তবে আজকে সে একবুক সাহস নিয়ে এসেছে কিছুদিন আগে গোলাপি অরিনকে ফোন করে জানিয়েছে কিছুদিন যাবৎ রঙিলার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বারবার সে শুধু অরিনকে দেখতে চাইছে। লেখাপড়ার চাঁপে এবাড়িতে তাদের সাথে দেখা করতে আসা হয়ে ওঠে না।
রঙিলা চাচা অরিনের মাথায় হাত বু্লিয়ে দিয়ে বলে,”আম্মাজান আমাগো অনেক বড় হইয়া গেছে গো পিংকির মা। এই জন্য দেখো না আম্মাজান আমাদের সাথে দেখা করতে আসে না। ঐ যে পাশের বাড়ির দাদু মরা দেখে গেছে তারপর আর আসে না।এদিকে দেখো ছোট আম্মাজান আমাগো কত বড় আর সুন্দর হয়ে গেছে।”
গোলাপি বলে,”কি যে বলেন না পিংকির আব্বা! আম্মাজান আমাদের ভুলে যায়নি। আম্মাজান বড় ডাক্তার ইন্জিয়ার হইবো তা-ই লেখাপড়া নিয়া ব্যস্ত তবুও তো মাঝেমধ্যে ফোনদিয়ে খোঁজখবর নেই।”
অরিন চোখেরজল মুছে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,” গোলাপি খালাম্মা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর হ্যা কতো দিন তোমাদের পিচ্চি অরিন থাকবো বলতো? বড় হতে হবে ত না হলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিবো কি করে?”
ইহান অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,”তা তোমাদের বাড়িতে মেহমান আসলে বুঝি এভাবে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখ?”
অরিন- উফফফফফপস দুঃখীত। আচ্ছা আগে পরিচিত হন। এই হচ্ছে আমার গোলাপি খালাম্মা আর তার স্বামী রঙিলা চাচা। এবার প্লিজ সবাই ভেতরে আসুন।
গোলাপি বলে,”হ্যা তাড়াতাড়ি ভেতরে আসেন।আম্মাজান আগে বলছিল আপনাদের আসার কথা তা-ই তো আমি সব রান্নাবাড়া করে রাখছি। জলদী ভেতরে এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিবেন সবাই।”
সবাই অরিনদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে আগে খাবার খেয়ে নেয়। এরপর সবাই একটু বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
বিশ্রাম নেওয়ার পর ওরা চারজন মিলে অরিনদের বাড়ির ভেতরের সব কিছু ঘুরে দেখছিল। অরিন ওদের তিনজন কে সাথে করে ওর বাবা- মা’র রুমে নিয়ে যায়। তাদের রুম দেখিয়ে বলে এটা আমার জান্নাতের বসবাসের রুম ছিলো। তারা দুজন সারাজীবন এই রুমে থেকেছে। এরপর নিজের রুমটা দেখিয়ে বলে এই হচ্ছে আমার রুম। বিয়েরপর জামাই নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসলে তো এই রুমে থাকতে হবে তাই আগে থেকে সব কিছু আম্মু সেভাবে সাজিয়েছিল। এরপর দুইটা রুম তালাবন্ধ। ”
আজরিন প্রশ্ন করে, “এই রুম দুটো তালাবন্ধ কেনো?”
-একটা রুম বড় ভাইয়া আর আরেকটা আপুর তারা কেউ থাকে না তাই তাদের রুম আগে থেকে তালাবন্ধ। আর আমাদের তেমন কোন আত্মীয়স্বজন তো আসে না যে রুমের কমতি হবে। তাছাড়া যে বাড়িতে কেউ থাকে না সে বাড়ির এতো রুমের দরজা খোলা রেখে লাভ কি? গোলাপি আর রঙিলার এমনিতে একা থাকে তারপর ও যতোটুকু পারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করে।”
আজরিন বলে,”আচ্ছা আমরা কি তাহলে আজকের রাতটা অরিনদের বাড়িতে থেকে যাবো?”
ইফান ভ্রু কুঁচকে বলে,”দেখছিস তো বাড়িতে কেউ থাকে না সেখান রাত থেকে কেন বেচারা দুই মুরব্বী কে কষ্ট দিতে চাইছিস? দেখছিস না এমনিতে তার দুপুরবেলা কতো কষ্ট করে রান্নাবাড়া করেছে?”
ইহান ইফানের কথায় তাল মিলিয়ে বলে,”হুম ইফান ঠিক বলেছে আমাদের সকালে গেলেও যেতে হবে। তা-ই রাতে বাড়িতে গিয়ে আরামে ঘুম দেই।”
অরিন বলে,”আপনার থাকতে চাইলে সমস্যা নেই! তাছাড়া গোলাপি আর রঙিলা আগেও আমাদের বাড়িতে সব কিছু দেখাশোনা করে আসছে। ”
অরিনকে আরও কোন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইফান অরিনের হাত ধরে বাড়ির বাহিরে নিয়ে চলে আসে।
ইফান রাগী কন্ঠে অরিন কে বলে,”তুমি এখানে বেড়াতে আসছে চাইছো আমি এনেছি তোমাকে।
তুমি এখানে থাকবে এমন কোন অনুমিত দেইনি আমি বুঝলে?”
অরিনের আর সাধ্যি কই ইফানের সাথে তর্কে জুড়ানোর?
এরপর অরিনদের পেছনে পেছনে আজরিন ও বেড়িয়ে আসে। তবে ইহান কিছুটা দেড়িতে অরিনদের বাড়ির বাহিরে বেড়িয়ে আসে।
চারজন গোলাপি আর রঙিলার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গন্তব্যে রওনা দেয়। আসার পথে ইহান চুপচাপ ছিলো কোন বাড়তি কথা বলে নাই।
এদিকে অনেকটা রাতে সবাই বাড়িতে ফিরে আসে। তারা খুব ক্লান্ত ছিলো তা-ই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন! লেখার পর রিভাইস দেই নি)
‘
‘
‘
চলবে…