রহিবে মনের গহীনে পর্ব-২১

0
1970

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_২১
#Nishi_khatun

রাতে পড়তে বসে আজ কিছুতেই অরিনের মন বসছে না পড়াতে। নিজের মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
অরিন মনে মনে ভাবছে, “আজকে লেকচারার সাহেব আমার জন্য ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইছে না।
সে কথা পরিবারের সবাই পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছে। তবে উনি কেন আমার জন্য নিজের পরিবারের সবার আনন্দঘন মুহূর্ত নষ্ট করবেন?
আমি কে হই তার? যার জন্য সে বাকিদের আনন্দময় পরিবেশ থেকে দূরে রাখছেন? জানি এসবের উত্তর তিনি কখনোই প্রকাশ করবে না।”

ইফান অনেক সময় ধরে লক্ষ করছে অরিনের মন পড়ার টেবিলে নেই। সে কোন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন আছে।

ইফান মনে মনে ভাবলো,” কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন যদি আমি মেডাম ফুলিকে প্রশ্ন করি! তাহলে সে আমাকে সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ করাবে। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব সে দিবে না। কি এক জ্বালায় পড়েছি প্রশ্ন না করলে মনে শান্তি লাগবে না। আগে মনে শান্তি তারপর বাকি অশান্তি। ”

তাই গলা দিয়ে উশখুশ আওয়াজ করতে করতে জোড়ে বলে ওঠে,

-“অরিন তুমি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত আছো?”

অরিন ইফানের দিকে শান্ত চাহনিতে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”

অরিনের মুখে ভালোবাসার কথা শুনেই ইফানের কাশি শুরু হয়ে যায়। এ মেয়ে বলে কি?

অরিন আবারো বলে,
“আমি জানি আপনি আমাকে ভালবাসেন না।
না আমাদের ঐ বিয়েটা মানেন না।
তাহলে কেন আমাকে এভাবে সারাদুনিয়ার কাছ থেকে প্রোটেকশন দিয়ে রাখেন? আপনিও জানেন আমি আর কিছুদিনের মেহমান আপনাদের বাড়িতে।
তা-ই বলছি আমাকে সারাদুনিয়ার মুখোমুখি হতে দিন। আমি আপনার ছায়াতে নির্ভর থাকতে চাই না। আমি এই দুনিয়াতে লড়াই করে বেঁচে থাকতে চাই। তবে আমাকে এভাবে আড়াল করে সে লড়াই করতে বাধা আপনি দিচ্ছেন। আমার চাইনা আপনার করুণাবা সহানুভূতি। অনেক করেছেন করুণা আর সহানুভূতি আমাকে! এবার তো মাফ করেন আমাকে?
মুক্তি দিয়ে দিন আপনার অযথা এই সম্পর্ক হীন অধিকার বোধ থেকে। আমার এসব কিছু চাই না।
আমি মুক্তির স্বাদ নিতে চাই। ”

অরিনের কথা গুলো শুনে ইফান বরফের ন্যায় জমে গেছে।
ইফান মনে মনে ভাবলো,
“সত্যি তো অরিন কোন ভুল কথা বলে নাই।
সে তো করবে না তার সাথে সংসার।
তাহলে কেন মেয়েটাকে তার প্রতি নির্ভরশীল করে গড়ে তুলছে? দুদিন পর তো অরিনকে মুখোমুখি হতে হবে এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার। তখন তো তার পাশে থাকবো না আমি।
কিন্তু কেন আমি অরিনের উপর থেকে আমার অধিকার বোধ কম করতে পারি না?
সব সময় মনে হয় অরিন আমার সম্পদ।
তার উপর শুধু আমার অধিকার।
আচ্ছা আমি যখন তাকে ভালোবাসি না বউ বলে মেনে নিবো না জীবনে। তখন তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার অধিকারটা আমার নেই।”

এসমস্ত কথা চিন্তা ভাবনা করে ইফান সোজা লাইব্রেরী রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ইফান প্রস্থান করতেই অরিন লাইব্রেরী রুমের দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কেন আমার সাথে এতো কঠোরতা? কিসের এতো দাম্ভিকতা তার?
কেন আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না?
কেন আমাকে আপন করে একটু বুকের মধ্যেখানে স্থান দেওয়া যায় না। কেন আমাকে স্ত্রীর পরিচয়ে সবার সামনে পরিচিত করা যায় না?
শুধু মাত্র আজ আমি এতিম বলে?
হায়রে দুনিয়া এই দুনিয়ার মায়া বড্ড বেহায়া।

“যার আছে তো সব আছে! যার নেই তো দুনিয়ার কোন কিছুই নেই। কেউ টাকা থেকেও সুখি না তো আবার কেউ কোন কিছু না থেকেও সুখি। কারো ভালোবাসা আছে সাগর ভরা, আর যার নেই তার আছে মরুভূমি।”

পরেরদিন সকালে,,,,,,,
রমজান মাসের শেষের দিকে বলে এখন অরিন কে কলেজে যেতে হয় না সব কিছু বন্ধ। সকালে সবাই এমনিতে ঈদের কেনাকাটা নিয়ে আলোচনা করছিল।

ঠিক সে সময় ইফান সেখান এসে বলে,

”মা তোমরা রেডি থেকে আজ ইফতারি করার পর আমরা গ্রামের বাড়িতে যাব।”

সেখানে উপস্থিত সকলে তো অবাক।
এতোদিন ধরে না না করে আসছিল সে আজ এতো সহজ ভাবে হ্যা বলে দিল?
কেউ ইফান কে কোন প্রশ্ন করে না।
সে যখন যেতে রাজি হয়েছে তখন তাকে এতো ঘাটাঘাটির দরকার নেই।

অরিন বুঝতে পারছে হয়তো উনি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছে তা-ই আমার প্রতি থাকা মিথ্যা অধিকার বোধ থেকে আমাকে মুক্তি দিয়ে দিছে।
যাই হোক সমস্যা নেই। এটাই দুনিয়ার নিয়ম কোন কিছু পাবার জন্য কিছু সেক্রিফাইজ করতেই হয়।

এদিকে সারাদিন ইফান চুপচাপ ছিলো প্রয়োজন ছাড়া সে কারো সাথে কোন কথা বলে নাই।
এদিকে ইহানের নতুন চাকুরী ঈদের আগের দিন ছাড়া সে যেতে পাড়বে না। ইফানের বাবার ব্যবসার জন্য এতো জলদী যেতে পারছেনা। দুজনের রান্নাবাড়া করার জন্য জরিনা থেকে যাবে এখানে।
ঈদের আগের দিন ইহানদের সাথে যাবে।
তা-ই ইফান অরিন আর জিনিয়া তিনজন আগেই চলে যাচ্ছে। জিনিয়া চাইছে অরিনকে একটু পরিবারের সকলের সাথে মিলেমিশে ঈদের আনন্দ দিতে।
তবে উপরওয়ালা জানে কি আছে অরিনের কপালে।
আনন্দ না কী এক বুক দুঃখ।

সন্ধ্যার পর তারাবির নামাজ কমপ্লিট করে তিনজন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
এদিকে তাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাহরী খাবার সময় হয়ে যায়।

ইফানের নানার আর দাদুবাড়ি কাছাকাছি।
রাস্তার মোড়ে নানীর বাড়ি সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে তার দাদুবাড়ী। ইফানের দাদুবাড়ি কেউ থাকে না তার চাচা-চাচী বিদেশে সেটেল। দাদা-দাদী দুই বছরের মতো হলো চাচা-চাচীর কাছে বিদেশে আছে।
তা-ই ইফানদের নানী বাড়িতেই থাকতে হবে।
কী দরকার অযথা ঐ ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে একা একা ঈদ করার। তার থেকে বরঞ্চ নানু বাড়িতে সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দ করে দুদিন পরে চলে যাবে।

মাঝ রাতে নানী বাড়িতে এসে পৌঁছাই তারা।
সবার সাথে সে ভাবে কোন কথা হয় না তাদের।
তারা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে সাহরী খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পরে। অরিনের সাথে আজরিন রুম শেয়ার করছে। আজরিন অরিনকে একা থাকতে দিবে না।
যে কয়দিন থাকবে দু জন একত্রে থাকবে।
আজরিন অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“কাল সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমি তোমাকে সাথে করে আমাদের পুরো গ্রাম ঘুরে দেখাব।
আর বাড়ির বাকিদের সাথেও পরিচয় করে দিবো।”

অরিন সম্মতি জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাহিরে এসে দাঁড়াতেই একটা ছেলে এসে অরিনের সামনে দাঁড়ায়। ছেলেটার দৃষ্টি খুব একটা ভালো লাগছিল না অরিনের। ছেলেটা তার দিকে খুব খারাপ ভাবে তাকিয়ে আছে। অরিন নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে,
“কই আমার তো সব কিছু আলহামদুলিল্লাহ্‌ সুন্দর ভাবে পরিহিত তাহলে উনার দৃষ্টি আমার দিকে এমন কেন?”

অরিনের পেছনে পেছনে আজরিন বাহিরে বেড়িয়ে এসে বলে,
“বড় ভাইজান এ হচ্ছে অরিন ফুপির বাড়িতে থাকে। তোমাদের সবাই কে আমি যার কথা বলেছিলাম এই হচ্ছে সে।”

আজরিনের বড় ভাই মেহেদি বলে,
“তোর বর্ণান থেকেও তো এই পরী বেশি সুন্দরী।
আগে কেন বলিস নাই আমাকে?
তাহলে দাঁয়িত্ব নিয়ে ফুপিদের বাড়িতে যেয়ে দেখা করে আসতাম। ”

আজরিন -থাক ভাইয়া তোমাকে সে কষ্ট করতে হবে না। এই অরিন তোমাকে তো বলাই হয়নি উনি হচ্ছে আমার বড় ভাই। বাড়ির কয়েকজনের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি তার মধ্যে আমার বড় ভাই একজন। ”

অরিন মেহেদি কে সালাম দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।

মেহেদি বলে,”আজরিন এই পাখিটা কিন্তু সেই সুন্দর কচি মাল বুঝলি। আগে কেন যে বলিশ নাই চান্স নিতাম একটু।”

আজরিন – ভাই লুচ্চামি একটু কম করলে হয়।
নিজের বোনের সামনে এমন কথা বলতে লজ্জা করে না? আর হ্যা একটা কথা ইফান ভাই এসেছে।
অরিনের সাথে খারাপ ব্যবহারের চেষ্টাও করতে যেও না। এর ফল খুব ভালো হবে না। মনে রেখ ইফান ভাই সব সময় নিরব থাকে না সে প্রতিবাদ করতে জানে।”

মেহেদি বলে,”ঐ বিড়ালের কথা বাদ দে।
ইহান থাকলে না হয় একটা কথা ছিল।
ইফানের দৌড় কত দূর তা আমার জানা আছে। কয়েকবছর আগে ইফানের দৌড় কতোটা তা দেখা হয়ে গেছে। ইফানের অতীত সম্পর্কে সকলেই অবগত।
ইফান কাউকে কষ্ট দিতে জানে না তবে কষ্ট ভোগ করতে ভালোই পারে।”

আজরিন মেহেদির সাথে কোন তর্ত না করে চুপচাপ বাড়ির ভেতরে চলে যায়। ভেতরে আসতেই অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“শোন তুমি সব সময় আমার সাথে থাকবে।
হুট হাট এদিকে সেদিকে একা একা চলে যাবো না।
মনে রাখবে কথাটা।”

অরিন নিরবে সম্মতি প্রকাশ করে। পাশের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আজরিনের বলা কথা গুলো শুনে ইফানের ভ্রূ কুঁচকে আসে। অরিন একা একা ঘুরাঘুরি তে সমস্যা কোথায়?

ইফানের নানীমা এসে বলে,” এই মেয়ে শোন!
আমাদের বাড়িতে একটা নিয়ম আছে।
তুমি আমাদের বাড়ির কেউ না।
তা-ই ঈদের দিন রুমের বাহিরে আসবে না।
আর যে দুদিন আছ সে দুদিন বাহিরে ঘুরাঘুরি করবে না। তুমি আমাদের আত্মীয়দের সামনে আসলে হাজারো প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। আমরা চাই না এমন কোন কাহিনীর সৃষ্টি হোক।”

অরিন এখানেও নিরবে সম্মতি প্রকাশ করে।

ইফান আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের সাথে মনে মনে বলে,”দেখো মেয়ে মানুষের বেশি ভালো চাইতে নাই। তোমার সব সময় ভালো চেয়েছি কিন্তু সেই তুমি আমাকে ভুল বুঝলে! তুমি নিজেই যখন অপমানিত হতে চাইছো তখন আমিও দেখি কতোটা সহ্য করতে পারো তুমি। এবার না হয় আমি দর্শকের ভূমিকা পালন করবো।”

(মন্তব্য আশা করবো সবার কাছ থেকে)



চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here