#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩য়_পর্ব
#এম_এ_নিশী
দাইয়ানদের গ্রামের বাড়িটি বেশ পুরোনো। দাইয়ানের দাদার বাবা তৈরি করেছিলেন বাড়িটি। মাটির বাড়ি হওয়া সত্বেও বিশাল জায়গা নিয়েই বাড়িটি তৈরি হয়েছে।
সন্ধ্যা নেমে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে প্রায়। চার বন্ধু এসে প্রবেশ করলো বাড়িতে। বাড়ির ভেতর হতে হালকা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। রাদিফ প্রশ্ন করে,
–কি রে, ভেতরে কোনো ঝামেলা হচ্ছে নাকি?
দাইয়ান হেসে জবাব দেয়,
–আরে নাহ! জয়েন ফ্যামিলি তো, সবাই এক জায়গায় কথা বলাবলি করছে হয়তো তাই একটু শোরগোলের মতো শোনা যাচ্ছে।
ঈশান বলে উঠে,
–তোর তিন চাচাই একসাথে আছে এখনো?
–হ্যা, তাদের ছেলে মেয়ে সহ সকলেই একসাথে।
–বাহ! ইন্টারেস্টিং।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দাইয়ানের ছোটো চাচী পারুলের নজর পড়ে। হৈ হৈ করে উঠেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সকলে এসে উপস্থিত হয় সেখানে। এতোগুলো মানুষ একসাথে দেখে ভড়কে যায় বাকি ৩ বন্ধু। তবে দাইয়ান বেশ খুশি।
মেজো চাচী রেহানা এসে দাইয়ানের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
–এসে গেছিস বাবা, কত্ত বড় হয়ে গেছিস। আর এতো শুকিয়ে গেছিস কেন? খাসনা ঠিকমতো?
দাইয়ানের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো। বরং আগের চেয়ে একটু বেড়েছে বটে। দেখতে বেশ গোলগাল হয়েছে আর তাকে দেখে বলছে কি না, শুকিয়ে গেছে? তিন বন্ধু মুখ টিপে হাসছে, এই কথা শুনে। সেটা লক্ষ্য করতেই দাইয়ান চোখ পাকিয়ে তাকায়। তিন বন্ধুর কেউই সেই চোখ পাকানোকে বিশেষ পাত্তা দিলো না।
দাইয়ানের মেজো চাচীর মেজো মেয়ে রূপা আর সেজো চাচীর বড় মেয়ে ঝুমুর হা করে দেখছে এই ৪ বন্ধুকে। দাইয়ান তাদের চাচাতো ভাই হওয়া সত্বেও অনেক ছোটোবেলায় দেখেছে তাকে। ৪ জনই কত সুন্দর! যদিও একজনের মুখ ঢাকা থাকা সত্ত্বেও তার বাহ্যিক গঠন দেখেই বোঝা যায় সে কতোটা সুদর্শন। ঝুমুরকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে প্রশ্ন করে রূপা,
–বাড়িতে তো চাঁদের আলো নেমে এসেছে রে। ওই মুখ ঢাকা ছেলেটাকে দেখ। পুরাই নায়ক। ইশ! একটু যদি মুখটা দেখতে পেতাম।
গুঁতো খেয়ে বিরক্ত হলেও রূপার কথা শুনে ঝুমুরও সায় দিতে বাধ্য হয়। গুঁতো খাওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়,
–আমারও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
দাইয়ানের চাচীরা একপ্রকার হৈ চৈ করে সকলকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ওদের ঘরটা দেখিয়ে দিতেই ৪ বন্ধু একেবারে হুমড়ি খেয়ে ঢুকে পড়ে রুমে। কারণ এই মুহুর্তে বিশ্রামটা তাদের জন্য ভিষণ দরকার।
সকলে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতেই সুযোগ বুঝে রূপা আর ঝুমুর দুজনেই ৪ বন্ধুর ঘরের দরজা আড়ালে এসে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। ঠিক তখনই ঝুমুরের ছোটো বোন নূপুর এসে ক্ষীণ স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
–ওমা, একি। ভাইয়াদের ঘরের সামনে ওমন টুকটুক করে কি দেখছো তোমরা বুবু?
চমকে উঠে ফিরে তাকায় রূপা আর ঝুমুর। নূপুর এর মাথায় জোরে একটা চাটি মেরে রূপা জবাব দেয়,
–শ য় তা ন মেয়ে। তোর কি তাতে? যা ভাগ।
মার খেয়ে ভয় পেয়ে ছুট্টে পালিয়ে যায় নূপুর। ঝুমুর বলে উঠে,
–এখন চল রূপা। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
রূপার জবাব,
–আরেএএএ দাঁড়া না। ওই মুখ ঢাকা ছেলেটার মুখটা দেখবো একটু।
–ওরা এখানেই থাকবে। কোথাও যাবে না। তুই পরেও দেখে নিতে পারবি। এখন নূপুর গিয়ে যদি কাওকে বলে দেয় সর্বনাশ হয়ে যাবে চল।
এই বলে রূপাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ঝুমুর।
_______
অরুনিকার চাচা জাহেদ দোকান থেকে বাড়িতে ফিরেছেন সবে। ফিরতেই তিনি সোজা চলে যান ভাবি আরজুর ঘরে। বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেন,
–ভাবি, একটু বসার ঘরে এসো তো।
দেবরের ডাক শুনে আরজু চিন্তিত হয়ে পড়েন। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া জাহেদ এভাবে ডেকে পাঠায় না। বসার ঘরে যেতেই দেখতে পান সেখানে শ্বশুরও বসে আছেন। একটু পর সেলিনাও এসে উপস্থিত হয়। জাহেদের দিকে তাকিয়ে আরজু প্রশ্ন করেন,
–কি ব্যাপার জাহেদ, সবকিছু ঠিকাছে তো।
–বসেন ভাবি। একটা দরকারি কথা আছে।
আরজুর শ্বশুর জসিমউদদীন বলেন,
–কি বলবি রে বাবা, জলদি বল। খুব চিন্তা হচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জাহেদ বলে উঠেন,
–আসলে আব্বাজান আমাদের গ্রামের নিয়াজী বাড়ির বড় নাতি শাহাদাতের কথা মনে আছে তোমার? যে শহরে গিয়েছিলো ডাক্তারি পড়তে।
একটু ভেবে জসিমউদদীন জবাব দেন,
–উমম! হ্যা হ্যা। ওই তো একমাত্র ছেলে এই গ্রাম থেকে প্রথম ডাক্তার হয়েছে। কতো সুনাম তার।
–হ্যা আব্বাজান। তার আব্বা নিয়াজী বাড়ির বড় ছেলে শাহীন ভাই, সে এসেছিলো আজ দোকানে। অনেকক্ষণ গল্পসল্প করলো। সে আমার কাছে একটা অনুরোধ রেখেছে আব্বা।
এই পর্যায়ে আরজু বলে উঠেন,
–কি অনুরোধ?
কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে জাহেদ জবাব দেন,
–আসলে তিনি শাহাদাতের জন্য আদ্রিকার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
আরজু বেগম অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠেন,
–কিইই! শাহাদাতের জন্য আদ্রিকা? শাহীন ভাই নিজে বলেছেন?
–হ্যা ভাবি। নিয়াজী বাড়ির সকলেই আদ্রিকাকে বেশ পছন্দ করেছেন। সকলেই রাজি। তাই শাহীন ভাই খুব করে অনুরোধ করে গেলেন আমরা যেন ভেবে দেখি।
–কিন্তু অরুর আগে আদ্রি….
–শাহীন ভাই নিজে এসে প্রস্তাব দিয়েছেন ভাবি। শাহাদাতের মতো ছেলে, নিয়াজী পরিবারের মতো পরিবার, তুমি ভাবতে পারছো?
–কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব জাহেদ? বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবো? গ্রামের মানুষ কি ভাববে? অরুর বিয়ে দেওয়াটাতো আরো কঠিন হয়ে যাবে।
–আমি বুঝতে পারছি ভাবি। কিন্তু ওরা শাহাদাতের জন্য মেয়ে দেখছে। আদ্রিকে না দিলে ওরা অন্য জায়গায় মেয়ে দেখবে। আদ্রির জন্য এমন পাত্র হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে?
এবার সেলিনা বলে উঠে,
–তাছাড়া অরুর বিয়ে হতে এখনো কত যে সময় লাগবে তাও তো বলা যাচ্ছে না। কোনো বিয়ের সম্বন্ধই টিকছে না। আদৌ বিয়ে হবে কি না…
জাহেদ ধমকে উঠেন,
–আহহ সেলিনা কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো?
–ঠিকই তো বলেছি। তুমিই ভেবে দেখো ভাবি, অরুর জন্য আদ্রির কপালটা যেন না পোড়ে।
সেলিনার কথার পৃষ্ঠে কোনো জবাব দেন না আরজু বেগম। শুধু গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন, তার আসলে কি করা উচিত?
______
সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়েছে আহরার। গ্রাম্য পরিবেশে ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে হেঁটে বেড়ানোতে এক অদ্ভুত শান্তি। বাকি ৩ জন তো ম রার মতো ঘুমোচ্ছে। ওরা এই শান্তির ঘুম নষ্ট করে এসব হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে একাই বেরিয়ে পড়েছে সে।
সবুজ, নির্মল চারিপাশ দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে আহরার। শুনেছে এই গ্রামে ছোট্ট একটি নদী আছে। উদ্দেশ্য সেই নদীর পাড়ে যাওয়া। যেতে যেতে হুট করেই সেই সাদা বাড়িটি নজরে আসে তার। গতকাল দেখা সেই মায়াবী চোখের অধীকারিনীকে দেখার বড্ড লোভ হচ্ছে তার। মুখখানি যে দেখা হয়নি কাল। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এদিক সেদিক উঁকি মেরেও কাওকে নজরে এলো না তার। আনমনে আওড়াতে থাকে সে,
–ওহে সুনয়না!
দেখা দাও একবার।
তারপর আচমকায় চমকে ওঠে সে নিজের আচরণ দেখেই। যেই আহরার খানের মুখ দেখার জন্য শত শত মেয়ে চিনাজোঁকের মতো লেপ্টে থাকে সেই আহরার খান কোনো মেয়ের মুখ দেখার জন্য অচেনা বাড়িতে এসে উঁকি মারছে। ভাবতে ভাবতেই হো হো করে হেসে ওঠে সে। হুট করে হাসি থেমে যায় এক রিনরিনে মিহি কন্ঠস্বর শুনে,
–জি, কাকে চাইছেন?
কন্ঠ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পায় এক কর্দমাক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী। হাত ভর্তি কাদামাটি লেপ্টে আছে তার। সম্ভবত মাটি নিয়ে কোনো কাজ করছিলো এতোক্ষণ। গালে, মুখে বহু জায়গায় ছোপ ছোপ মাটি লেগে আছে। ধ্বক করে ওঠে আহরারের হৃদপিণ্ড। এই তো! এই তো সেই সুনয়না। সেই মায়াবী চোখেজোড়া, যা দেখে তার দৃষ্টি থমকেছিলো। নিষ্পলক চাহনি মেলে মন ভরে দেখছে আহরার সেই সুনয়নাকে। সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে বিব্রত হয়ে যায় অরুনিকা। নিজেকে সামলে পুনরায় প্রশ্ন করে,
–কাওকে কি খুঁজছিলেন?
আনমনে জবাব দেয় আহরার,
–হ্যাঁ, আপনাকে।
মনে মনে বলে উঠে অরুনিকা,
“অদ্ভুত তো।”
তখনই আহরার একটি অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেললো। কাছের মানুষ ছাড়া, সম্পূর্ণ অচেনা এক রমনীকে স্বইচ্ছায় সে তার মুখদর্শন করালো। মুখের মাস্কটি খুলে সরাসরি অরুনিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠে,
–আপনাকেই তো খুঁজছিলাম, সুনয়না।
আহরারের মুখ টুকু দেখে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় অরুনিকা। তবে নিজেকে ধাতস্থ করতে খুব একটা সময় নেয় না সে। বিদ্রুপাত্মক হেসে জবাব দেয়,
— এতো সুদর্শন পুরুষ আমার মতো কুৎসিত মেয়েকে খুঁজতে আসতে পারেনা। কখনোই না।
এই বলে আহরারকে অবাক করে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে ছুটে ভেতরে চলে যায় অরুনিকা।
তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহরার বেশ সুন্দর করে হাসে। অতঃপর নিজমনেই জবাব দেয়,
–কে বলেছে আপনি কুৎসিত? আপনি সুন্দর, মায়াবিনী। আপনি “শ্যামবতী।”
চলবে….