#রেড_রোজ (পর্ব ৩)
১.
রায়ান অফিসে বসে কাজ করছিল। নতুন একটা প্রোজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছে ও। কোম্পানি নতুন একটা প্রোডাক্ট লাইন লঞ্চ করবে, এর পুরো দায়িত্ব ওর। এই অফিসের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ও, তাই দায়িত্বটাও ওর। পুরো ব্যাপারটা কি করে হবে সেটা ওর টিমের সবাইকে বুঝিয়ে দিতে দিতে বিকেল হয়ে যায়। রায়ান একবার ঘড়ির দিকে তাকায়, পাঁচটা বেজে গেছে! আর বেশিক্ষণ অফিস নেই। হাতের টুকটাক কাজগুলো গুছিয়ে নিতে যেয়ে হঠাৎ করেই কি মনে হতে বাসার সিসি ক্যামেরা অপশনটা খোলে।
বছরখানেক আগে বাসা থেকে রয়ার দামী একটা কানের দুল হারিয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছিল দুলটা ছুটা কাজের বুয়াই নিয়েছে, কিন্তু কোনো প্রমাণ না থাকাতে সেবার সেটা আর উদ্ধার হয়নি। তারপর রয়াই জোর করেছিল বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগাতে। রায়ান লাগিয়ে দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই খুলে দেখত। আজও বাসার সিসি ক্যামেরা খুলে দেখে। হুম, সিসি ক্যামেরাগুলো বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই নাকি? কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলেও আইপিএস চলার কথা। রায়ান একটু ভাবে, বিকেলের এই সময়টাতে মাঝে মাঝেই সিসি ক্যামেরাগুলো বন্ধ থাকে। এটা শুরু হয়েছে সাজিদ যেদিন থেকে গান শেখাতে আসে তার মাস দুয়েক পরে। রায়ান মিলিয়ে দেখেছে যেদিনই রায়ানের গান শেখানো থাকে সেদিনই এই ঘটনাটা বেশি হয়। কাকতাল?
আজকেও ক্যামেরাগুলো বন্ধ। রায়ান মন খারাপ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর রুমের একটা দেয়াল পুরোটা কাচের বড় শার্সিতে ঘেরা। বাইরে তাকালে মন ভালো হয়ে যাওয়া সবুজ গাছের সারি। রায়ান খেয়াল করে মেহগনি গাছগুলোতে নতুন সবুজ পাতা। বসন্ত প্রায় শেষ হয়ে এল, কালকের দিন পরেই বাংলা নববর্ষ। প্রকৃতি তাই যেন নতুন করে সাজছে। রায়ান আনমনে ভাবে, ওর জীবনটাও কি এমন নতুন করে সাজবে?
২.
আজ চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন। সেই অর্থে বছরেরও শেষ দিন। কাল নববর্ষ। রয়া ঘুমের ঘোরেই টের পায় বেশ গরম লাগছে। এবার গরমটা মনে হয় ভালোই ভোগাবে। এই বেডরুমে এসি নেই। ওপাশে যে বেডরুমটায় ও এতদিন রায়ানের সাথে ঘুমাত সেটাতে এসি লাগানো। রয়া ইদানীং আলাদাই ঘুমায়। ওর ভয় লাগে রায়ানকে।
রাতে ঘুম না হওয়াতে সকাল দশটা এগারোটা পর্যন্ত ও ঘুমিয়েই থাকে। রয়া ঘুমের মধ্যেই টের পায় একটা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও কন্সট্রাকশনের কোনো কাজ চলছে। ও পাশ ফিরে শোয়, নাহ লাভ হয় না। শব্দটা বেড়েই চলছে। আধোচোখে একবার তাকায়, ধূসর রঙের জানালার পর্দায় একটা টিকটিকি দেখতে পায়। শব্দটা হচ্ছে, বেশ জোরেই। রয়া শব্দের উৎস খুঁজতে এবার পুরো চোখ মেলে তাকাতেই বুক ধক করে ওঠে। মাথার উপরে ফ্যান বিপদজনকভাবে কাৎ হয়ে ঘুরছে। শব্দটা ফ্যান থেকেই হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে একটা সেকেন্ড সময় লাগে। রয়া লাফিয়ে উঠে পড়ে, এক গড়ান দিয়ে নিচে নামতে না নামতেই একটা কর্কশ শব্দ হয়। বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে ফ্যানটা খাটের উপর পড়ে, ঠিক যেখানটায় রয়া শুয়েছিল সেখানেই। রয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখে ফ্যানটা পাগলের মতো বিছানার চাদরে পেচিয়ে গিয়ে ছিড়েখুঁড়ে থেমে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বুকের ভেতর কেমন একটা চাপ অনুভব করে। মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।
রয়া সাবধানে মাথা তোলে, ফ্যানটা থেমে গেছে। একবার উপরে সিলিং এর দিকে তাকায়। অত উঁচু থেকে ছিড়ে পড়েছে ফ্যানটা! আজ তো ও মরেই যেত! ভাবনাটা ভাবতেই পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। এই গরমের মাঝেও কেমন শীত শীত লাগে ওর। মোবাইল হাতে নেয়, রায়ানকে ফোন করতে যেয়েও থেমে যায়। আচ্ছা, এটা রায়ানের কাজ না তো? ও কি ফ্যানের নাট বল্টু লুজ করে রেখেছিল? ভাবনাটা ভাবতেই ও শিউরে ওঠে। তাহলে রায়ানই কি ওকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই রয়ার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাসার সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখলেই তো জানা যাবে কাজটা কে করেছে। দ্রুত ও মোবাইলে সিসি ক্যামেরার ভিডিও অপশন খুলতে যেয়ে থমকে যায়। কাল বিকেলে ও নিজেই সব ক্যামেরাগুলো অফ করে রেখেছিল। এরপর আর অন করা হয়নি। ইশ! ভুল হয়ে গেছে। রয়া একই সাথে আফসোস আর অপরাধবোধের মিশ্র একটা অনুভূতি টের পায়।
নিচের কেয়ারটেকারকে ডাকতেই ও একজন মিস্ত্রি নিয়ে আসে। মিস্ত্রি অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘এইটা একদম নতুন ফ্যান। নাট বল্টু তো পুরান হয় নাই। তারমানে যে ফ্যান লাগাইছিল সে ঠিকমতো লাগায় নাই, লুজ আছিল। আপা, বাঁইচা গেছেন। মাথায় পড়লে তো শ্যাষ।’
রয়ার বুক কেঁপে ওঠে। সাজিদকে জানানো দরকার। কাল বিকেলে অনেকটা জোর করেই সাজিদ বাসায় ঢুকেছিল। কেন রয়া ওর ফোন ধরছে না, বাসায় আসতেও দিচ্ছে না সেটা জানার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। রয়া প্রথম থেকে সব খুলে বলেছিল। সাজিদ ভ্রু কুঁচকে ওর সব কথা শুনছিল। মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘এগুলো যেই করুক সে তোমাকে ভয় দেখাতেই করছে। রায়ান নিশ্চয়ই এমন করবে না। আর ও তো আমাদের ব্যাপারটা জানেই না। জানলে নিশ্চয়ই সরাসরি বলত। তুমি ভয় পেও না রয়া, আমি আছি। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
কালকের কথাগুলো ভাবতেই আরেকটা জিনিস মনে হয়। কাল সাজিদ যখন এসেছিল, একটা সময় ও ওয়াশরুমে ছিল কিছুক্ষণ। কথাটা ভাবতেই ও থমকে যায়, তাহলে কী সাজিদ! নাহ, মাথাটা খারাপই হয়ে যাচ্ছে।
মিস্ত্রি ফ্যানটা নিয়ে যায়, বলে যায় ব্লেডগুলো বেঁকে গেছে। ঠিক হলে হলো, না হলে নতুন কিনতে হবে। রয়া অবশ্য অন্য কথা ভাবছে, এই জীবনে আর কখনও ফ্যানের নিচে ও ঘুমাতে পারবে তো? জীবনের সবটুকু স্বস্তি কে যেন একটু একটু করে কেড়ে নিতে চাইছে ওর থেকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে টিভিটা ছেড়ে সোফায় বসে ঝিমোচ্ছিল রয়া। হঠাৎ টের পায় দিনের আলো কমে আশপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে উঠেছে। একটু পরেই শোঁ শোঁ শব্দ পেতেই রয়া চোখ খুলে জানালার ভেতর দিয়ে দেখে বাইরে ঝড় হচ্ছে। বৃষ্টি নামবে। যাক, একটু হলেও গুমোট আবহাওয়াটা কাটবে, ধুলোও মরবে। খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু থেকে থেকে বুক ধুকপুক করছে। চোখটা বন্ধ করে রয়া। ঠান্ডা হয়ে গেছে চারপাশ। রয়া ঘুমিয়ে পড়ে।
ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না, ঘুম ভাঙে কলিং বেলের শব্দে। পুরো নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটে সেটা যেন বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হয়। রয়া ধড়ফড় করে উঠে বসে। কে এল এই অসময়ে? সাজিদ তো আজ আসার কথা না। ভাবতে ভাবতে রয়া দরজার পীপ-হোলে চোখ রাখে, পরিচিত ডেলিভারি ম্যান। কিন্তু, ও তো কিছু অর্ডার করেনি। ভ্রু কুঁচকে দরজা খুলতেই লোকটা হাসি দিয়ে বলে, ‘আপা, এই গোলাপ ফুল আপনার জন্য।’
রয়ার কেমন যেন লাগছে, একটা আতংক আবার গ্রাস করছে। ও তোতলানো গলায় বলে, ‘কে, পাঠিয়েছে?’
লোকটা কেমন একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর লেখাই আছে। ধরেন এটা রাখেন।’
রয়া ফুলের বুকেটা নেয়, তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো লাল গোলাপ, একদম তাজা। কিন্তু ফুলের এই সৌন্দর্যটা কেমন যেন ভয়ংকর। লোকটাকে বিদেয় করে রয়া নাম, ঠিকানা দেখে। তানভির নামে কেউ একজন। মোবাইল নম্বর খেয়াল করতেই ওর ভ্রু কুঁচকে উঠে। চেনা চেনা লাগছে নম্বরটা। সন্দেহ হতে ও দ্রুত মোবাইল খুলে, সেই অচেনা নম্বরের সাথে মিলে যেতেই স্তম্ভিত হয়ে ও বসে পড়ে। এই লোকটা আবার! উফ, ও কি মরে যাবে???
ভীষণ অস্থির লাগছে। এই পুরো বাসাটা যেন ওকে গিলে খাচ্ছে এখন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রয়া ঘরের দরজা লক করে আলুথালু বেশে ছাদে উঠে পড়ে। ছাদের কিনারে বাগানবিলাস গাছের নিচে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। ঝড়ে বাগান বিলাসের লাল লাল ফুলগুলো নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রয়া চুপ করে তাকিয়ে থাকে পড়ে থাকা ফুলগুলোর দিকে। ওর জীবনে ঠিক এমন একটা ঝড় এসেছে যেটা ওকে বৃন্তচ্যুত করবে। আজ পর পর দু’টো ঘটনা ঘটল। হয়ত এতক্ষণে ও মারাই যেত।
মন খারাপ করে কথাটা ভাবতে ভাবতে রয়া উঠে ছাদের স্টিলের রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকাতেই মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে। দ্রুত চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়, সাজিদকে দেখা যাচ্ছে না। এখন অবশ্য থাকারও কথা না। সন্ধ্যেয় ঠিক একবার দাঁড়াবে, বাইনোকুলার হাতে। রয়া তাও চোখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে, সাজিদ আছে কিনা।
ঠিক এই সময় মেসেজটা আসে। রয়া আনমনে তাকাতেই চমকে ওঠে, সেই অচেনা নাম্বার। একটা ঢোঁক গিলে রয়া। কাঁপা হাতে দ্রুত মেসেজ খুলে,
‘Tis the last rose of summer,
Left blooming alone.
All her lovely companions
Are faded and gone’
আঁন্দ্রে রিউ এর বিখ্যাত একটা গানের অর্কেস্ট্রার লিরিক। রয়ার হঠাৎ করেই কিছুক্ষণ আগের লাল গোলাপ ফুলগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। কেমন দিশেহারা লাগে, রয়া আজ সাহস করে নিজেই ফোন দেয় নাম্বারটায় যদিও ফোনটা বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু ফোনটা বাজে। রয়ার বুক ধক করে ওঠে, হার্ট বিট বেড়ে যায়। ওর হাত পা কাঁপছে, মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে। ওপাশে ফোন বেজেই চলছে। রয়ার হাতের মুঠোতে চাপ বাড়ে, কানের সাথে ফোনটা এত জোরে চেপে ধরেছে যে হাতের আঙুলগুলো রক্তশুন্য হয়ে ওঠেছে।
রয়া যখন ভাবছিল ফোনটা কেউ ধরবে না, ঠিক তখন ফোনটা কেউ ধরে। রয়ার বুকের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হয়, উত্তেজনায় মনে হচ্ছে মাথা ফেটেই যাবে। ও গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে চেচিয়ে বলতে যায়, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না গলা দিয়ে। তার বদলে ওপাশ থেকে একটা ভারী কন্ঠস্বর কেটে কেটে বলে,
‘The secret is no more a secret but an open secret to everyone now. Your murderer is waiting for your last breath.’
কলটা কেটে যায়। লোকটা কী বলল? ওর গোপন করে রাখা সত্যটা জানে! গলাটা কেমন চেনা চেনা মনে হলো। রয়ার মনে হচ্ছে ও জ্ঞান হারাবে, হাত পা কেমন দূর্বল হয়ে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখছে কেমন। বিপদজনকভাবে ও ছাদের রেলিঙের উপর দুলতে থাকে। শরীরের অনেকটাই এখন রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়েছে। রয়া বার বার মনে করার চেষ্টা করে, গলাটা কার। হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর মনে পড়ে, এই গলাটা ও চেনে। মাথাটা এবার সত্যিই ঘুরে উঠে রয়ার, রেলিঙের উপর শরীরের ভারসাম্যটা আর থাকে না। একটা মোচড় খেয়ে নিচে পড়তে থাকে। রয়া শুন্যে ভাসতে ভাসতে আঁন্দ্রে রিউ এর মিষ্টি অর্কেস্ট্রার সুর শুনতে পায় –
Tis the last rose of summer,
Left blooming alone.
All her lovely companions
Are faded and gone’
৩.
সাজিদ দূর থেকে বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রয়াকে দেখছিল। এই অসময়ে ও ছাদে কী করছে? ফোনে কারও সাথে কথা বলছে এখন। কার সাথে? সাজিদ জুম করে দেখতেই বুকটা খামচে ধরে কেউ, চিৎকার করে বলে ‘রয়া, পড়ে যাচ্ছে….’
রায়ান অফিস থেকে ফেরার পথে একটা ফুলের দোকানে দাঁড়ায়। অনেকগুলো লাল গোলাপ কেনে। একটু মন খারাপ করে ভাবে বিয়ের পর প্রতিদিন ও লাল গোলাপ নিয়ে যেত। একদিন ভুল হলেই রয়া খুব মন খারাপ করত। অথচ এখন লাল গোলাপ দেখলেই ভয় পায়!
রায়ান ফুলগুলো নিয়ে গাড়িতে উঠতেই ফোন আসে, ভ্রু কুঁচকে দেখে সাজিদের ফোন। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে সাজিদ উদভ্রান্তের মতো বলে, ‘রায়ান, এখুনি হাসপাতালে চলে আয়। রয়া ছাদ থেকে পড়ে গেছে।’
সাজিদ হড়বড় করে হাসপাতালের ঠিকানা বলে যায়। রায়ান কেমন স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। পাশের সিটে রাখ লাল গোলাপগুলোর দিকে তাকায়, কেমন রক্তের মতো লাল টকটকে ফুল।
৪.
তিন মাস, রয়া নেই। এই ক’টা দিন থানা, পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই রায়ানের সময় চলে গেছে। পুলিশ প্রথমেই ওকে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু সাজিদের চাক্ষুষ সাক্ষ্মি খুব কাজে লেগেছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে রয়া তখন সেই অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসা মানুষটার সাথে কথা বলছিল। অনেক খোঁজ করেও সেই লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফোনটা এরপর থেকেই বন্ধ। পুলিশ বলেছে ওরা খোঁজ রাখবে, ফোনটা খোলামাত্রই খুনিকে ধরে ফেলবে। এদিকে সাজিদকেও পুলিশ বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সব না জানলেও এতটুকু জানা গেছে, রয়ার সাথে ওর প্রায়ই কথা হতো।
রায়ান অবশ্য এসব নিয়ে আর ভাবে না। ও শুধু রয়ার সাথে ওর বিয়ের প্রথম ক’টা বছরের স্মৃতিই বেশি করে ভাবে। রয়া লাল গোলাপ পছন্দ করত। একটা দিন লাল গোলাপ না নিয়ে এলে ও ভীষণ মন খারাপ করত। লাল গোলাপ দিলেই ও একটা চিঠি দিত। আচ্ছা, রয়া কি এখনও মন খারাপ করে থাকে? কতদিন ওকে ফুল দেওয়া হয় না, রয়াও ওকে চিঠি দেয় না। কথাটা ভাবতেই রায়ান বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। মোড়ের দোকান থেকে বেছে বেছে কতগুলো লাল গোলাপ কেনে, সাথে একটা গোলাপ ফুলের গাছ। তারপর বাসায় ফিরে ফুলগুলো একটা গ্লাসের পানিতে রাখে। আপাতত থাকুক, রাতে বেরোবে। মানুষের অনুসন্ধিৎসু চোখ আর ভালো লাগে না।
রায়ান একটা রকিং চেয়ারে বসে দেয়ালে ঝোলানো কাঠের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁতেই উঠে দাঁড়ায়। কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নেয়। তারপর ফুলগুলো আর গাছটা সাথে নিয়ে নিচে নামে। গ্যারেজ থেকে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। বাইরে থেমে থেমেই বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়িটা চলতে চলতে একটা কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ হয়ে যায়। গাড়িতে রাখা রেইনকোট পরে রায়ান নামে। গাড়ির পেছনের বুট থেকে এক জোড়া গাম বুট আর ছোট একটা শাবল বের করে। কালো গামবুটটা পরে চারদিকে একবার সাবধানে তাকায়। নাহ, আশেপাশে কেউ নেই। কবরস্থানের পাহারাদারও ঘুম। এমন ঝুম বৃষ্টির দিনে কেউ বাইরে থাকার কথা না। ওর রয়াকে ও একাই পেতে চায়, ওর আশেপাশে আর কেউ না থাকুক।
রায়ান পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। একটা কবরের সামনে এসে থামে। পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বের করে একবার নামফলকের দিকে তাকিয়ে থাকে ‘রয়া মুনতাসির’। বিড়বিড় করে বলে, ‘কেমন আছ, রয়া?’
রায়ান উবু হয়ে বসে পড়ে। টর্চ লাইটটা নিভিয়ে এবার শাবল দিয়ে খুড়তে শুরু করে। বর্ষার নরম মাটি, খুব সহজেই অনেকখানি খুড়ে ফেলে। একটা সময় থামে রায়ান। একদম ঘেমে গেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে কপালের ঘাম মুছে একটু জিরোয়। তারপর পকেট থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে, রয়ার সাথে ওর স্মৃতিচিহ্ন। একবার কি যেন ভাবে, তারপর যত্নের সাথে প্যাকেটটা একদম নিচে রাখে। এবার মাটি দিয়ে কিছুটা ভরাট করে গোলাপ গাছটা লাগায়। তারপর মাটি দিয়ে আবার পুরোটা ভরে দেয়। মাটি ভরাট শেষ হলে এবার সাথে আনা গোলাপ ফুলগুলো কবরের উপর রাখে, ফিসফিস করে বলে, ‘তোমার কাছে গোলাপ ফুল ছাড়া আসতেই ইচ্ছে করে না। রইল ফুলগুলো। একটা গোলাপ গাছও লাগিয়ে দিয়ে গেলাম, আমি নিয়মিত না আসতে পারলেও এই গাছ তোমাকে ফুল দেবে। আর হ্যাঁ, ভয় পেও না, আর কেউ বিরক্ত করবে না তোমাকে।’
বৃষ্টির জোর বেড়েছে, সাথে ঝড়ো বাতাস। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতিগুলো আজ জ্বলছে না কোনো কারণে। চারপাশ কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। এর মাঝে একজন মানুষকে দেখা যায়, রেইনকোট পরা, কাদা মাখা বুট, হাতে শাবল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কান পাতলে গুনগুন করে একটা গানের কলিও শোনা যায়।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০২/০৩/২৩