#রেড_রোজ (পর্ব ৬)
১.
রাহাত রয়ার পুরো কেসটা আরেকবার পড়ে। নানান দিক থেকে কেসটা ভাবার চেষ্টা করে। উল্টেপাল্টে ভাবে, নাহ, একদম নিচ্ছিদ্র একটা কেস। কেউ রয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি, সেই অর্থে এটা মার্ডার কেস না। এটা সুইসাইডও বলা যাচ্ছে না, নিছক দূর্ঘটনা। আদালতের চোখে তাই। কিন্তু একটা জায়গায় এসে রাহাতের মন আটকে যায়। রয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
কেসটা যত পড়েছে ততই বুঝেছে রয়াকে কী ভয়ংকর মানসিক চাপে বিপর্যস্ত করে একদম খাদের কিনারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। একটু একটু করে রয়ার একটা দূর্বলতা খুব বাজে ভাবে ওর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছে।
আর সেটা যে রায়ানই করেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যে লোকেশনগুলো থেকে মেসেজ এসেছে সেগুলোর প্রায় সব জায়গাতেই ওর গাড়ি দেখা গেছে। এতটা কাকতাল হবার কথা না। রায়ান আঁট ঘাট বেধেই নেমেছিল। ও ভালো করেই জানত রয়া কিছুতেই পুলিশের কাছে যাবে না। আর সেই সুযোগটাই ও নিয়েছে।
কথাটা ভাবতে ভাবতে রাহাত মাথা নিচু করে পায়চারি করছিল। হঠাৎ ও দাঁড়িয়ে পড়ে, আচ্ছা, এই রায়ানের একটা অন্যায় যেটা ওর দূর্বলতা সেটা তো রাহাত জানে।
যদি ও অদৃশ্য আততায়ী হয় তাহলে ওর মনের ভেতর একটা দূর্বলতা আছে। আর এটাকেই কাজে লাগাতে হবে। রয়াকে ও যেভাবে ভয় দেখানো মেসেজ, ফুল পাঠিয়ে ওকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিল ঠিক তেমন করে রায়ানকেও ভয় দেখানো যায়।
কথাটা মনে হতেই রাহাতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। এবার চেয়ারে বসে ভাবতে থাকে। এই রায়ানকে যদি একটু একটু করে মানসিকভাবে ভেঙ্গে ফেলা যায়? ওর অপরাধটাকে যদি ওর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়? কথাটা ভাবতেই রাহাতের মুখের পেশি টানটান হয়ে যায়। রায়ান ঠিক যেমন করে রয়াকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে রাহাতও ওকে তাই করবে, একই পদ্ধতিতে।
রাহাত সেদিন পুরোটা দিন ভাবে কী করে রায়ানকে ফাঁদে ফেলা যায়। হাফিজ ঘনঘন উঁকি দিয়ে দেখে যায়, স্যার আজ কোন কথাই বলছে না, শুধু একটু পর পর চা খাচ্ছে, আর পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে।
বিকেলের দিকে রাহাত একটা ফোন করে সাজিদকে। প্রথম রিংয়েই ফোনটা ধরে সাজিদ। একটু ভীত গলায় সালাম দিয়ে বলে,’রাহাত ভাই, সব ঠিকঠাক তো?’
রাহাত ওকে আশ্বস্ত করে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা সাজিদ, রয়া তো আপনার কাছে গান শিখত। আমি যতদূর জানি গান শেখার সময় সবাই একটা ডায়েরি রাখে। তাতে টুকটাক লিখে। রয়ার কি এমন কোনো ডায়েরি ছিল যাতে ওর হ্যান্ড রাইটিং পাওয়া যাবে।’
ওপাশ থেকে সাজিদ দ্রুত বলে, ‘হ্যাঁ, ছিল তো। ওর ডায়েরিতে ও মাঝে মাঝেই লিখে রাখত গানগুলো। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর এক দুটো কবিতাও ছিল। ওদের লিভিং রুমে যেখানে হারমোনিয়াম থাকে তার পাশেই ডায়েরিটা থাকত।’
রাহাতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে যায়, বলে, ‘অনেক ধন্যবাদ। পরে আবার ফোন দেব। আর আপনার সাথে আমার কথোপকথনের একটা শব্দও যেন কেউ না জানে।’
শেষের কথাটা কঠিন সুরেই বলে ও।
ফোনটা রেখেই রাহাত এবার জোর গলায় হাঁক ছাড়ে, ‘হাফিজ, এদিক আসো তো।’
সারাদিন পার হয়ে আজ স্যার ওকে ডাকল। তারমানে স্যার নিশ্চয়ই কোন একটা সমাধান খুঁজে বের করেছে। একটা কৌতুহল অনুভব করে হাফিজ। কাছে এসে দাঁড়াতেই রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘দশ সেকেন্ডে তালা খুলতে পারে, সেই গিট্টু চোরের কি জামিন হয়ে গেছে?’
হাফিজ কিছু বুঝতে না পেরে বলে, ‘হ্যাঁ স্যার। এদের তো বেশিদিন জেলে রাখা যায় না। কেন কী হয়েছে স্যার? আবার চুরি করেছে?’
রাহাত হেসে বলে, ‘নাহ, চুরি করতে হবে।’
হাফিজ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘স্যার, ঠিক বুঝলাম না, চুরি করতে হবে মানে?’
এরপর রাহাত সময় নিয়ে হাফিজকে সব বুঝিয়ে বলে। হাফিজ যতই শুনছিল ততই বিস্মিত হচ্ছিল। একটা সময় বলেই বসে, ‘স্যার, এতে কি কিছু হবে? ওই বেটা কি ধরা দেবে?’
রাহাত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, ‘অবশ্যই দেবে। তুমি শুধু যা বলি তাই করো ঠিকঠাক। আর লেডি কনস্টেবল আফরিনকে একবার ডাকো। আমি ওকে বুঝিয়ে দেব। কালই তোমরা অভিযানে নেমে পড়বে। পুরো ব্যাপারটা খুব সাবধানে করতে হবে, এক চুলও ভুল করা যাবে না। তার আগে রায়ানের বাসার সিকিউরিটি গার্ডকে একবার থানায় ডেকো। ফ্ল্যাট কমিটির লোকজনের সাথেও গোপনে কথা বলে নিতে হবে।’
সেদিন রাতে রাহাত, হাফিজ আর লেডি কনস্টেবল আফরিন একটা গোপন বৈঠক করে। বার বার প্ল্যানটা ঝালিয়ে নেয়।
২.
ইদানিং রায়ানের বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। বেশিরভাগ দিন ও বাইরে থেকেই খেয়ে আসে। বাসায় এসে কে আবার রান্নাবান্না ঝামেলা করে। নাহ, এভাবে বেশিদিন চলবে না। এবার একটা বিয়ে করতেই হবে। আজকেও রায়ানের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। কোনোমতে গোসল সেরে লিভিং রুমে বসে বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখে। তারপর বারোটা বাজতেই চোখে ঘুম যেন জড়িয়ে আসে।
রায়ান টিভিটা অফ করে বেডরুমের দিকে যায়। এটা তালাবদ্ধই থাকে। ঘরটা অন্ধকার, কেউ নেই যে বাতি জ্বালাবে। রায়ানেরও ইচ্ছে করে না। ও সরাসরি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। নরম সাদা ধবধবে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। হঠাৎ একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ পায়, খুব পরিচিত ঘ্রাণ। রায়ান নাক টেনে বারবার ঘ্রাণটা নিতে থাকে। হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠে বসে, আরে এটা তো রয়ার পারফিউমের ঘ্রাণ। CK ব্র্যান্ডের এই পারফিউমটাই ও ব্যবহার করত। কিন্তু এখন এই ঘ্রাণটা কোথা থেকে আসছে!
রায়ান দ্রুত খাট থেকে নেমে পড়ে, বাতি জ্বালতেই পুরো রুম আলোতে ভেসে যায়। রায়ান অদ্ভুত চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশাপাশি দু’টো বালিশ রাখা। বিয়ের পর এভাবেই দু’জন পাশাপাশি ঘুমোত। রায়ান এবার নাক কুঁচকে ঘ্রাণ নিতে নিতে বিছানায় আসে। ও যেখানে শুয়েছিল তার পাশ থেকেই মিষ্টি ঘ্রাণটা আসছে। রায়ান এবার বালিশের দিকে তাকাতেই ওর বুক ধক করে ওঠে, লম্বা একটা কালো চুল, মেয়েদের! রায়ান এবার আরেকটু খুঁজতেই আরও এক দু’টো লম্বা চুল দেখতে পায়। ওর মনে হচ্ছে ও ভুল দেখছে। এখানে মেয়েদের চুল আসল কি করে? ছুটা কাজের বুয়াটা এখানে আসেনি তো? কিন্তু এই বেডরুমটা তো তালা দিয়েই রাখে। তাহলে? নাকি চুল আগে থেকেই ছিল, ও এতদিন খেয়াল করেনি? কিন্তু পারফিউমের ঘ্রাণ? রায়ান মনে করার চেষ্টা করে, কাল রাতে কি এই ঘ্রাণ পেয়েছিল? নাহ, এই ক’মাস তো এমন হয়নি। রায়ানের কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে।
বিছানা থেকে নেমে এবার সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খায়। তারপর ভাবতে থাকে, এটা কী করে সম্ভব? আচ্ছা কোনোভাবে পারফিউমের বোতলটা খুলে যায়নি তো? রয়ার ড্রেসিং টেবিলের উপরেই পারফিউমটা থাকত।
কথাটা মনে হতেই রায়ান লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর পা যেন জমে গেছে, মাথাটা কেমন ঘুরাচ্ছে। পা কেমন দূর্বল হয়ে আসে। আচ্ছা, ওর কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে! না হলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় এসব কী লেখা! রায়ান ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকে, কাচের স্বচ্ছ আয়নায় লাল লিপিস্টিক দিয়ে একটা লাইন লেখা –
‘U r killer’
হাতের লেখাটা রয়ার মতোই। রায়ানের মনে হচ্ছে ওর হার্ট অ্যাটাক হবে। বুকের বাম পাশে একটা চাপ অনুভব করে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ও নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। চোখটা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর আবার খুলে। রায়ান দেখে লেখাগুলো কেমন জ্বলজ্বল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
রায়ানের হঠাৎ করেই তীব্র একটা ভয় ঘিরে ধরে। ওর কেন জানি মনে হয় রয়া এই ঘরেই আছে। কথাটা ভাবতেই ওর পুরো শরীর শিউরে ওঠে। কোনোমতে শরীরটা টেনে বেডরুম থেকে বের হয়ে কাঁপা হাতে রুমটা লক করে দেয়। টলতে টলতে লিভিংয়ের সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। ভয় ভয় চোখে চারপাশে একবার তাকায়। নাহ, এখানে কোনো গোলমাল নেই। কিন্তু ভয়টা কিছুতেই যায় না। রায়ান একটু পর পর চমকে ওঠে। সে রাতে রায়ানের ঘুম হয় না। শেষ রাতে ও স্বপ্ন দেখে কেউ ওকে অনেক উঁচু একটা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। ও দু’হাত দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারছে না, নিচের দিকে পড়েই যাচ্ছে।
সেদিন রায়ানের ঘুম ভাঙে বেলা করে। সারা শরীরে আলিস্যি। চোখ মেলে দেয়াল ঘড়িতে দেখে সকাল দশটা। এত বেলা হয়ে গেছে! তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই পুরো ঘরে দিনের আলো ঝাপিয়ে পড়ে, অন্ধকার কেটে যায়। সেই সাথে গতরাতের ভয়টাও কাটে। রায়ান প্রথমেই বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকাতেই আরেকবার চমকে ওঠে। লেখাটা আছে –
U r killer
কিন্তু দিনের আলোতে কাল রাতের মতো অতটা ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। ও কাছে এসে লেখাটা ভালো করে দেখে। হাতের লেখাটা রয়ার! এটা কী করে সম্ভব। আবার ভয়টা ফিরে আসছে।
রায়ান বাথরুমে ঢুকে একটা টিস্যু পানিতে ভিজিয়ে পাগলের মতো আয়নার উপর লেখাটা মুছতে থাকে। আরও কয়েকটা টিস্যু ভিজিয়ে এনে পুরো আয়নাটা মুছে ফেলে। এখন আর কিছু নেই।
মনটা একটু শান্ত হয়। আজ অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। বসকে একটা মেসেজ দেয়, আজ যাবে না। মেসেজ দিয়ে এবার ও হাত মুখ ধুয়ে ফ্রিজ থেকে চার পিস ব্রেড বের করে। একটা ছোট বাটিতে দু’টো ডিম ভেঙে নেয়, সাথে একটা পেয়াঁজ কুচি, দুটো কাঁচামরিচ কুচি, একটা টমেটো। ভালো করে মাখিয়ে এবার ব্রেডের উপর লাগিয়ে নেয়। এবার চুলোটা জ্বেলে ফ্রাই প্যানে তেল ছেড়ে অপেক্ষা করে। মাথার ভেতর চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এটা অসম্ভব!
তেল ফুটতেই ও ব্রেডগুলো ছাড়ে। ভালোমতো ভেজে ভেজে ওঠায়। একটা প্লেটে টোস্ট নিয়ে খেতে বসে। কামড় দিতেই দুটো ভুল টের পায়। এক, টোস্টে লবন দিতে ভুলে গেছে। দুই, বাসার ভেতরের সিসি ক্যামেরা রয়ার মারা যাবার পর খুলে রেখেছিল। খালি বাসায় সিসি ক্যামেরা দিয়ে কী হবে। মূল্যবান যা কিছু তা বেডরুমেই তালাবদ্ধ থাকে। তাই ওগুলো এতদিন খোলাই ছিল। নাহ, আবার সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। কেউ নিশ্চিত কাল এই বাসায় ঢুকেছিল।
কথাটা মনে হতেই রায়ান দ্রুত নাস্তা শেষ করে নিচে নামে। সিকিউরিটি গার্ড জামশেদ টুলে বসে ঝিমোচ্ছে। কাছে যেয়ে কড়া গলায় বলে, ‘জামশেদ মিয়া কি সারাদিন এমন করেই ঘুমাও নাকি ঠিকঠাক খেয়াল রাখো?’
জামশেদ মাথা ঝাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চোখ কচলে বলে, ‘কি যে কন স্যার। আমার চোখ ফাঁকি দিয়া কাকপক্ষীও এইখানে ঢুকবার পারে না।’
রায়ান বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘তাহলে, কাল আমার ফ্ল্যাটে লোক ঢুকল কী করে?’
জামশেদ অবাক গলায় বলে, ‘কখন? নাহ, কেউ তো আসে নাই কাল। এইটা কি কন? কিছু চুরি হইছে ভাইজান? আপনার ছুটা বুয়া আসছিল, আমিই ওরে চাবি দিয়া দিলাম। ভাইজান, এমন হইলে আমি চাবি রাখুম না।’
রায়ান এবার বেকায়দায় পড়ে যায়। কী করে বলে এই ভুতুড়ে ঘটনার কথা। মাথা নেড়ে বলে, ‘না কিছু চুরি হয় নাই। এখন থেকে ভালো মতো পাহারা দিবা। আর সেক্রেটারিরা বইল, সিঁড়িতে যেন সিসিটিভি লাগায়। কত করে বলি, তা শুনবে না।’
কথাগুলো বলে রায়ান বের হয়ে যায়। মোড়ের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে আসতে আসতে বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। রুমে এসেই ও আলমারি থেকে সিসি ক্যামেরাগুলো বের করে। একটা ক্যামেরা লাগাতেই বেল বাজে। নিশ্চয়ই ছুটা বুয়া কুলসুম আসছে। একে বিদায় করতে হবে। এর কোনো না কোন যোগসাজশ আছে সিকিউরিটির সাথে। দরজা খুলে দিতেই কুলসুম অবাক গলায় বলে, ‘ভাইজান আইজ বাসায়, অফিস যান নাই?’
রায়ান ওর মুখের দিকে তাকায়, কী ক্রিমিনাল একটা। একদম স্বাভাবিক মুখে কথা বলছে। ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘কেন, বাসায় না থাকলেই তোমার বুঝি সুবিধা হয়? কাল তুমি কাউরে নিয়া আসছিলা বাসায়?’
কুলসুম ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এইগুলা কি কন ভাইজান। এত বড় কথা কইলেন? আপনার বাসায় আমি কাম করমু না।’
রায়ান রাগী গলায় বলে, ‘আমিই তোমাকে বিদায় করে দেব আজ।’
কুলসুম গলার রগ ফুলিয়ে বলে, ‘আমার এই মাসের বেতন এখনই দিয়া দেন। আপনার কামের খেতা পুড়ি।’
রায়ান কঠিন কিছু বলতে যেয়েও বলে না। বেডরুমে যেয়ে আলমারি থেকে তিন হাজার টাকা বের করে নিয়ে আসে। তারপর ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘তোমারে যেন আর না দেখি এইখানে।’
কুলসুম কড়া কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। এই লোকটার বউ মরছে কয়েক মাস আগে। মাথা খারাপ লোক। আড়চোখে ও খেয়াল করে ক্যামেরার মতো কিছু জিনিস ফ্লোরে পড়ে আছে। এই জিনিস কুলসুম চিনে, সিসি ক্যামেরা কয় এইটারে। সব বাসায় লাগায়, বাসায় যাতে কিছু চুরি হইলে ধরা যায়। তা কুলসুমের সেই ডর নাই। ও ভালো বংশের মাইয়া। সেদিন যাওয়ার আগে সিকিউরিটি জামশেদ ভাইকে সেই কথাই ও ভালো করে বলে যায়।
৩.
হ্যান্ড রাইটিং স্পেশালিস্ট সবুর খান আগ্রহ নিয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহাত ভাইয়ের কথামতো গতকাল ওই রায়ান নামের লোকটার বাসার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছোট্ট একটা লাইন লিখে এসেছিল। লেখাটা ভিকটিম রয়ার হাতের একদম নকল। এই কাজে ওর সুনাম আছে।
সবুর খান কৌতুহলের সাথে বলে, ‘রাহাত ভাই এরপরে কোন লেখাটা লিখতে হবে?’
রাহাত হেসে বলে, ‘খুব বেশি কিছু না, আরেকটা লাইন লিখে দিবা, ‘Miss u in Grave’
সবুর খান চোখ বড় বড় করে বলে, ‘আপনি তো লোকটাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলবেন।’
রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘ও যেমন করে ওর স্ত্রীকে ভয় দেখিয়েছে ওকে এমন করেই ভয় দেখাতে হবে। ওকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে না ফেললে হবেই না।’
পাশে বসা লেডি কনস্টেবল আফরিনের দিকে তাকিয়ে রাহাত বলে, ‘আফরিন, তুমি বুদ্ধি করে একটা ভালো কাজ করেছ। তোমাকে শুধু কয়েকটা চুল রেখে আসতে বলেছিলাম। পারফিউমটা বিছানার চাদরে মাখিয়ে দিয়ে ভালোই করেছ।’
আফরিন হেসে বলে, ‘আমার তো স্যার শুয়ে শুয়ে ঘুম চলে আসছিল।’
রাহাত হেসে ফেলে, একটা কিছু বলতে যেতেই হাফিজ মুখ অন্ধকার করে রুমে ঢোকে, মন খারাপ গলায় বলে, ‘স্যার একটা খারাপ খবর আছে।’
রাহাত ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই হাফিজ বলে, ‘সিকিউরিটি গার্ড জামশেদ ফোন করেছিল, বলল, ওই রায়ান বেটা ঘরের ভিতরে নাকি সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে আজ।’
রাহাত একটু থমকে যায়, সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে! তাহলে তো প্ল্যানমতো কাজ এগোবে না। রাহাত চিন্তিত গলায় বলে, ‘তারমানে ও অতটা ভয় পায়নি। উলটো সন্দেহ করেছে কেউ ওর বাসার ভেতরে ঢুকেছে। লোকটা বুদ্ধিমান, কিন্তু আমাদের আরেকটু বেশি বুদ্ধিমান হতে হবে।’
হাফিজ বুঝতে না পেরে বলে, ‘সেটা কি রকম স্যার?’
রাহাত একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা হাফিজ, মনে করো সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে, তারপরেও যদি বাসার ভিতরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় হাতের লেখা পাওয়া যায়, অথবা রুমে খাটের উপরে লম্বা লম্বা চুল পাওয়া যায়?’
হাফিজ অবাক গলায় বলে, ‘কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব! সিসি ক্যামেরা থাকলে তো সব ভিডিও থাকবে। আর আমাদের লোকজন তখন ঢুকলে তার ফুটেজও থাকবে।’
রাহাত একটু চিন্তা করে বলে, ‘এখানেই তো চ্যালেঞ্জ। সিসি ক্যামেরা থাকবে আবার আমাদের লোকজনদেরও দেখা যাবে না। এটা যদি করা যায় তাহলে ওই রায়ান সত্যিকারের ভয়টা পাবে যেটা আমরা দেখাতে চাচ্ছি। হাফিজ, ভাবো, অনেক বেশি করে ভাবো। আর হেড অফিসের আইটি ডিপার্টমেন্টর বিখ্যাত আনোয়ার ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখো একটা বুদ্ধি বের করা যায় কি না। একবার যদি সিসি ক্যামেরা থাকার পরও কোনো প্রমাণ ছাড়া কাজগুলো করা যায় তাহলে রায়ানের মনে রয়ার অশরীরী আত্মার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।’
হাফিজ মাথা চুলকায়, এটা কী করে সম্ভব! এদিকে রাহাতও ভাবতে থাকে, রায়ান একটা চ্যালেঞ্জ ওকে ছুড়ে দিয়েছে, আর ওকে এটা ঠিকঠাক উতরে যেতে হবে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর